আমজাদ আলী। একজন বাংলাদেশী। মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিলেন চাকরির সন্ধানে। সেখানে কাজ শুরু করেন একজন শ্রমিক হিসেবে। কয়েক বছর ধরে চলে তার কঠোর কায়িক পরিশ্রমের কাজ। এরপর ২০০১ সালে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক একটি কোম্পানিতে শুরু করেন আইপি টেলিফোনি সার্ভিস। এ কোম্পানিতে সাত বছর কাজ করার পর তিনি জানতে পারেন নতুন চালু হওয়া মোবাইল ভিওআইপির কথা। কোম্পানির চাকরি ছেড়ে চালু করেন মোবাইল ভিওআইপির ব্যবসায়। এ ব্যবসায়ে তিনি অভূতপূর্ব সাফল্য পান। ট্রাফিক ও রাজস্ব আয়ে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির দেখা পান তিনি। এখন তার রয়েছে অনেক রিসেলার। এরা কাজ করছেন তার অধীনে। প্রতিদিনের ভিওআইপি ট্রাফিকও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখে। এমনকি তিনি তা আরো বাড়িয়ে তোলার পরিকল্পনা করেছেন। কিন্তু তার ব্যবসায়ের মাত্রার কথা ভেবে তিনি দেখেছেন- গ্রাহক সহায়তা যোগানো, পণ্য উন্নয়ন, কাস্টমাইজেশন, বিলসংশ্লিষ্ট সহায়তা ও ভেন্ডর ব্যবস্থাপনার মতো বিশেষায়িত সেবার জন্য পর্যাপ্ত জনবল তার নেই। আমজাদ আলী এখন খুঁজছেন আউটসোর্সিং অ্যাজেন্সি, যা দূর থেকে এসব সেবা জোগাবে তার শাখা অফিসের জন্য।
আরেকজনের কথা জানা গেছে। তিনি জার্মানির নাগরিক হার্ভে। পেশায় ভিওআইপি সার্ভিস প্রোভাইডার। ব্যবসায় শুরু করেন ২০০০ সালে। তখন এক্ষেত্রে এতটা প্রতিযোগিতা ছিল না। এই দশ বছরে তিনি তার ব্যবসায় সম্প্রসারণ করেছেন দেশের বাইরেও এবং তা সাফল্যের সাথে পরিচালনাও করছেন। এ পর্যায়ে তার ব্যবসায়ের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট কিছু বিশেষায়িত সেবা। যেমন- ডকুমেন্টেশন, কাস্টমার সাপোর্ট, আইটি হেল্পডেস্ক সিস্টেম। তার দরকার এমন জনবল, যারা লাভজনক রেটে ভিওআইপির জন্য রুট কেনাবেচার কাজ চালাতে পারেন। এ ধরনের বিশেষায়িত কাজের জন্য জার্মানিতে প্রচুর অর্থ খরচ করতে হয়। কেউ একজন তাকে পরামর্শ দিয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার মতো উন্নয়নশীল দেশ থেকে এসব সেবা আউটসোর্স করার জন্য। এতে তার খরচ বাঁচবে।
সম্ভাবনা এখন আমাদের সামনে হাতছানি দিচ্ছে। এই তো কয়দিন আগে সুপরিচিত গবেষণা সংস্থা গার্টনার আউটসোর্সিং বিষয়ে যে জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করে, তাতে ৩০টি সেরা আউটসোর্সিং ডেস্টিনেশন বা গন্তব্য চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। ৩০টি সেরা আউটসোর্সিং দেশের তালিকায় এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নাম স্থান পেল। এ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে সাতটি উন্নত দেশের নাম। এসব দেশ এর আগে এ তালিকার প্রথম দিকে ছিল। বাদ পড়া এসব দেশ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, ইসরাইল, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও স্পেন। এই বাদ পড়া দেশগুলোর জায়গা দখল করেছে নতুন আটটি দেশ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের নাম। এ রিপোর্ট থেকে বোঝা যায়, আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে এক বড় ধরনের সম্ভাবনা।
ভিওআইপি আউটসোর্সিং সম্ভাবনার নতুন দুয়ার
গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস তথা বেসিস আয়োজিত ‘সফটএক্সপো-২০১১’। এটি দেশের সবচেয়ে বড় বার্ষিক সফটওয়্যার মেলা। তবে কয় বছর ধরে নিয়মিত আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই মেলা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এক মেগা ইভেন্টে রূপ নিতে শুরু করেছে। পাঁচদিন ধরে চলা এবারের সফটএক্সপোতে দেশের ও দেশের বাইরের দেড়শ’ সফটওয়্যার ও আইটি এনাবলড সার্ভিস কোম্পানি অংশ নেয়। এ মেলার মাধ্যমে কার্যত সফটওয়্যার ও আইটি এনাবলড সার্ভিসের সম্ভাবনাকেই তুলে ধরা হয়। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বর্তমান সফটওয়্যার শিল্পের বাজারের পরিমাণ ১০০০ কোটি টাকা। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে এ বাজার ৫০০০ কোটি টাকায় পৌঁছবে বলে আশা করা হচ্ছে। আইটি ও টেলিযোগাযোগ শিল্প অপরিহার্যভাবে পরস্পর সমন্বিত। কারণ, মোবাইল হ্যান্ডসেটগুলোকে এর মূল্য সংযোজন সেবার জন্য ব্যবহার করতে হয় বহু ধরনের সফটওয়্যার ও অন্যান্য অ্যাপ্লিকেশন। বাংলাদেশে এখন সেলফোনের মূল্য সংযোজন সার্ভিসের বাজারের পরিমাণ ৫০ কোটি টাকা। এ বাজারের প্রায় সবই স্থানীয় সফটওয়্যার কোম্পানিসংশ্লিষ্ট। আগামী ৫ বছরে এ বাজার ৩০০ কোটি টাকায় উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এই সফটএক্সপোর গোল্ড স্পনসর ছিল বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ভিওআইপি পণ্য ও সেবা প্রতিষ্ঠান ‘রিভ সিস্টেমস’। এ প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের টেলিযোগাযোগ শিল্পের বাজারের সাথে সংশ্লিষ্ট। বিশ্বজুড়ে টেলিকম সফটওয়্যার, টেকনোলজি সলিউশন ও টেলিকম সার্ভিস প্রোভাইডারদের সেবা যোগানোর জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি ‘আইএসও ৯০০১:২০০০’ সনদপ্রাপ্ত। ভিওআইপি শিল্পের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি পর্যায়ে বিশ্বের বহু শীর্ষস্থানীয় ও সৃজনশীল প্রোভাইডারদের সাথে সরাসরি কাজ করছে রিভ সিস্টেমস।
সফটএক্সপো-২০১১ চলার সময় রিভ সিস্টেমস ‘আউটসোর্সিং অপরচুনিটিজ ইন ভিওআইপি ইন্ডাস্ট্রি’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ সেমিনারের আয়োজন করে। এ সেমিনার আয়োজনের মাধ্যমে রিভ সিস্টেমস ভিওআইপি বাজারে বিদ্যমান সুযোগ ও সম্ভাবনা সম্পর্কে সংশ্লিষ্টদের জানার সুযোগ করে দেয়। সেমিনারে বক্তারা জানান, ভিওআইপি শিল্পে আউটসোর্সিং ব্যবসায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যে একশ’ কোটি মার্কিন ডলার আয় করতে পারে। বাংলাদেশ সহজেই আইটি শিল্পের এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ এর আইটি শিল্পের সমৃদ্ধি আনতে পারে। এ সেমিনারে বক্তারা সংশ্লিষ্টদের কাছে কার্যত যে বার্তাটি পৌঁছাতে চেয়েছেন তা হলো- ভিওআইপি আউটসোর্সিং এই সময়ে বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় এক নতুন দুয়ার উন্মোচিত করতে পারে। অতএব আটঘাট বেঁধে এখনই কাজে নেমে পড়তে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্ভাবনার সবটুকু যথার্থভাবে কাজে লাগাতে হবে।
সেমিনারে মূল আলোচক ছিলেন রিভ সিস্টেমসের বিপণন পরিচালক সঞ্জিৎ চ্যাটার্জি। ছিলেন কয়েকজন প্যানেল আলোচক। এরা হচ্ছেন- সুকান্ত দে, ইব্রাহিম আহমেদ, আবদুস সালাম এবং হাবিবুল্লাহ এন করিম। আর সেমিনারের মডারেটর ছিলেন রিভ সিস্টেমসের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী কর্মকর্তা এম রেজাউল হাসান।
সেমিনারে মূল আলোচক রিভ সিস্টেমসের বিপণন পরিচালক সঞ্জিৎ চ্যাটার্জি ভিওআইপি শিল্পের বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার আলোকে ভিওআইপি শিল্পের সেই সব আউটসোর্সিং সম্ভাবনা ও সুযোগের কথা উল্লেখ করেন, যা বাংলাদেশী উদ্যোক্তারা কাজে লাগাতে পারেন। তিনি বলেন, ভিওআইপি ক্রমেই মূলধারায় চলে আসছে। স্কাইপির রয়েছে ৫৫ কোটি ব্যবহারকারী। আর বিশ্বে ১২ শতাংশ ভয়েস ট্রাফিক বা সকণ্ঠ কথাবার্তা চলে স্কাইপির মাধ্যমে। ভিওআইপি মিনিট বছরে বাড়ছে ২৫ শতাংশ হারে। বিশ্বে আবাসিক ভিওআইপি গ্রাহকের সংখ্যা ২৬ কোটি ৭০ লাখ। আর মোবাইল ভিওআইপি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে।
ইনস্ট্যাটের সূত্র উল্লেখ করে তিনি জানান, ২০০৬ সালে যেখানে গ্লোবাল পেইড ভিওআইপি ইউজারের সংখ্যা ছিল মোটামুটি ২৫ লাখের মতো, সেখানে ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ কোটি ৭৫ লাখে। আশা করা হচ্ছে, ২০১৩ সালে তা বেড়ে হবে ৪০ কোটিরও বেশি। মোবাইল ব্যবহারের প্রবৃদ্ধিও ঘটছে, সংখ্যাও বাড়ছে একইভাবে। তিনি তার আলোচনায় মোবাইল ভিওআইপি রাজস্বের প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ২০১০ সালে এ খাতের বাজারের পরিমাণ যেখানে দেড়শ’ কোটি ডলার, সেখানে ২০১৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে চারশ’ কোটি ডলার। তিনি ভিওআইপি আউটসোর্সিংয়ের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোর কথা উল্লেখ করে বলেন, এসব ক্ষেত্র হচ্ছে কাস্টমার সাপোর্ট, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, এনওসি সাপোর্ট, ভিএএস, বিলিং, সুইস ও সার্ভার হোস্টিং, ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট এবং ইউটিলিটি সার্ভিস।
কাস্টমার সাপোর্টের ক্ষেত্রে যেসব সার্ভিস আউটসোর্স করা যায় তার মধ্যে আছে- বিটুসি অপারেশনের জন্য ভয়েস/চ্যাট/ওয়েব/ই-মেইল সাপোর্ট; ট্রানজেকশন প্রসেসিং; ইনস্টলেশন ও ট্রাবলশুটিং সাপোর্ট। এর জন্য আমাদের রিসোর্স প্রয়োজন- আইটি/নেটওয়ার্কিং জানা গ্র্যাজুয়েট, ভয়েস সাপোর্টের জন্য ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলার সক্ষমতা, প্রাইভেট লেভেল অপশনসহ সিআরএম সফটওয়্যার এবং দ্রুতগতির নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট। এ জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন ১৫-২০ হাজার মার্কিন ডলার।
এনওসি সাপোর্ট আউটসোর্সিং সার্ভিসের ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- সার্ভার অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, সুইস অপারেশন, নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট, ডাটাবেজ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, অ্যাপ্লিকেশন মনিটরিং, ইনস্টলেশন ও ট্রাবলশুটিং সাপোর্ট। এসব আউটসোর্সিংয়ের জন্য আমাদের রিসোর্স প্রয়োজন- আইটি নেটওয়ার্কিংয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট; সুইস হ্যান্ডলিং, অ্যাপ্লিকেশন ইউজেস/নেটওয়ার্কিং সিকিউরিটির জ্ঞান; সুইস/অন্যান্য সফটওয়্যার সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ এবং দ্রুতগতির নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট। এতে বিনিয়োগ প্রয়োজন ২০-২৫ হাজার মার্কিন ডলার।
সার্ভিস/হেস্টিং হিসেবে সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে যেসব সার্ভিস আমরা আউটসোর্স করতে পারি তার মধ্যে আছে- কো-লোকেশন, ডাটা সেন্টার সার্ভিস, অ্যাপ্লিকেশন ও সার্ভার হোস্টিং, ব্যান্ডউইডথ, হার্ডওয়্যার ইনস্টলেশন ও মেইনটেন্যান্স। এ জন্য রিসোর্স প্রয়োজন- ইন্টারনেট ডাটা সেন্টারের কো-লোকেশন/স্পেস, সার্ভার ম্যানেজমেন্টে বা রিমোট এনওসি অপারেশনে অভিজ্ঞ আইটি গ্র্যাজুয়েট। নেটওয়ার্ক/মনিটরিং/ব্যান্ডউইডথ ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার; হার্ডওয়্যার, সফট সুইচ ও অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার। বিনিয়োগ প্রয়োজন ৫০-৬০ হাজার মার্কিন ডলার।
ভেন্ডর ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে যেসব সার্ভিস আউটসোর্স করা যায় তার মধ্যে আছে- রেট নিগোসিয়েশন, ইন্টারকানেক্ট অ্যাগ্রিমেন্ট, টেস্টিং, ক্যারিয়ার রিলেশনশিপ, কোয়ালিটি মনিটরিং, রাউটিং পরিবর্তন, বিলিং রিকনসিলেশন এবং পেমেন্ট ফ্যাসিলিটেশন। এ জন্য প্রয়োজনীয় রিসোর্স হচ্ছে- আইটি/বাণিজ্যিক দক্ষতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট; এলসিআর, ক্যারিয়ার নিগোসিয়েশন ও অ্যাগ্রিমেন্টের অভিজ্ঞতা; ট্র্যাকিং এলসিএ’র জন্য সফটওয়্যার, সেভিংস জেনারেটেড টেস্ট সফটওয়্যার। দ্রুতগতির নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ২০-২৫ হাজার মার্কিন ডলার।
সুইচ ফার্ম/ম্যানেজড সার্ভিসের আউটসোর্সের সেবা ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- সফট সুইচ হোস্টিং ও ম্যানেজমেন্ট, হার্ডওয়্যার/সফটওয়্যার সাপোর্টসহ ম্যানেজড সার্ভিস, কাস্টমার সাপোর্ট ও বিলিং সাপোর্ট। এর জন্য রিসোর্স লাগবে- আইটি/নেটওয়ার্কিং জানা গ্র্যাজুয়েট, রোবাস্ট সফট সুইচ সফটওয়্যার, নেটওয়ার্ক ম্যানেজমেন্ট/ব্যান্ডউইডথ ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার এবং দ্রুতগতির নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট। প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ৫০-৭০ হাজার মার্কিন ডলার।
তিনি রিভ সিস্টেমসের ২০১৫ সালের প্রজেকশন বা প্রক্ষেপণ চিত্র তুলে ধরে বলেন, এ শিল্পের প্রবৃদ্ধি মোকাবেলার জন্য আরো ১৪০০ ক্যারিয়ার সৃষ্টি করতে হবে। অনুমিত হিসাবমতে, ২০১৫ সালের দিকে ক্যারিয়ারপ্রতি ভিওআইপি কলের পরিমাণ দাঁড়াবে বছরে ৩০ কোটি মিনিট। এর ফলে এ শিল্পে অতিরিক্ত ৫০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। এর জন্য ৭০০০ অ্যাপ্লিকেশন সার্ভার হোস্টিংয়ের প্রয়োজন হবে।
তিনি বলেন, ভিওআইপি শিল্পে এখন বাংলাদেশের সামনে ব্যাপক ব্যবসায়ের সুযোগ অপেক্ষা করছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ২০১৫ সালের মধ্যে ১৪৫ কোটি ডলার আয় করতে পারে। কোন খাতে এ আয় কী পরিমাণ হতে পারে তিনি এর একটি বণ্টন হিসাবও দেন- ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট ৮ শতাংশ, সফটওয়্যার ডেপেলপমেন্ট ১৭ শতাংশ, হোস্টিং ১৭ শতাংশ, এনওসি সাপোর্ট ২৫ শতাংশ এবং কাস্টমার সাপোর্ট ৩৩ শতাংশ।
কেনো ভিওআইপি আউটসোর্সিং? তিনি এর একটা উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেন। এর জবাব খাড়া করেন শতাংশের হিসেবে। তার মতে, ভিওআইপি আউটসোর্সিংয়ের ৩৬ শতাংশ কারণ ব্যয় কমানো, ৩৬ শতাংশ ফোকাস অন কোর, ১৩ শতাংশ মানোন্নয়ন, ১০ শতাংশ বাজারে গতি আনা, ৪ শতাংশ উদ্ভাবনের প্রসার ঘটানো এবং ১ শতাংশ মূলধন সংরক্ষণ।
ভিওআইপি ও টেলিকম শিল্পে আউটসোর্সিং এবং ভারত
ভারতে বর্তমানে ভিওআইপি ও টেলিকম শিল্পে আউটসের্সিং পরিস্থিতি কেমন, তা আমরা জানতে পারি প্যানেল আলোচক সুকান্ত দে’র কাছ থেকে। তিনি ভারতের টাটা টেলিসার্ভিসের সাবেক প্রেসিডেন্ট। টেলিকম ও এফএমসিজি শিল্পে বিক্রয়, ব্র্যান্ড উন্নয়ন, বিপণন ও প্রফিট সেন্টার ব্যবস্থাপনায় তার রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা। বিপণন ও অর্থায়ন বিষয়ে এমবিএ করেছেন কলকাতার ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে। প্রকৌশল ডিগ্রি নিয়েছেন খড়গপুর ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে। এক সময় ছিলেন আইডিয়া সেলুলারের প্রধান বিপণন কর্মকর্তা। ছিলেন পেপসিকো ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক। টাটা ডকোমোর মাধ্যমে ভারতে থ্রিজি চালু করার ক্ষেত্রে তিনি বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেন।
একজন প্যানেল আলোচক হিসেবে তিনি সেমিনারে কথা বলেন ভারতীয় মোবাইল অপারেটর ও এ ক্ষেত্রে ভারতের আউটসোর্সিং মডেলের সাফল্য সম্পর্কে। কথা বলেন ভারতীয় টেলিকম শিল্পের প্রবৃদ্ধিতে আউটসোর্সিং কৌশল নিয়ে। তিনি তার বক্তব্য শুরু করেন টেলিকম শিল্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে এবং বলেন, বিপ্লবটা শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। ইন্টারন্যাশনাল টেলি কমিউনিকেশন ইউনিয়ন তথা আইটিইউর দেয়া তথ্যমতে, ১৯৮৫ সালে এসেও বিশ্বের ৫৫ শতাংশ মানুষ জীবনে একটি টেলিফোন কল করার সুযোগও পায়নি। ৫০ শতাংশ মানুষ ৪ ঘণ্টা হেঁটে কাছাকাছি স্থানে গিয়ে একটি ফিক্সড লাইন টেলিফোন কল করার সুযোগ পেত। ১৯৮০-র দশকে এসে পিসির সূচনা ঘটে। প্রথম প্রজন্মের সেলুলার ফোন তখন সবেমাত্র উদ্ভাবিত হয়েছে। ইন্টারনেট তখনো যুক্তরাষ্ট্রের DARPA প্রযুক্তিকেই ধারণ করে আছে। তখন চলত ১০০ কেপিবিএস গতির শুধু টেক্সট ই-মেইল। ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব তখনো উদ্ভাবনের অপেক্ষায়। আর আজ সময়টা হচ্ছে টেলিফোন ব্যবসায়ের দ্রুত প্রবৃদ্ধির সময়। এখন বিশ্বে সেলফোন ব্যবহারকারী ৫০০ কোটি। প্রতি ১০০ জনের ৭৫ জনেরই ফোন আছে। ইউরোপে প্রতি ১০০ জনে ফোন ১৩০টি। আর আফ্রিকায় ৫০টি। বিশ্বের ৩০ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ২১০ কোটি।
ভারতের মোবাইল টেলিযোগাযোগ সম্পর্কে তিনি জানান, চীনের পর ভারতের সেলুলার গ্রাহকভিত্তি বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধির সেলুলার বাজার। বছরে এর বাজার বাড়ছে ৫০ শতাংশ। প্রতি মাসে ভারতে গ্রাহক বাড়ছে দেড় কোটি থেকে দুই কোটি। এখন গ্রাহকসংখ্যা ৭৫ কোটির মতো। সেলফোন ঘনত্ব প্রতি ১০০ জনে ৫৪। ভারতে সেলুলার টেলিফোনির হার হচ্ছে- জিএসএম ৯০ শতাংশ, সিডিএমএ ১০ শতাংশ। ব্যবহারকারীপ্রতি মাসে গড় রাজস্ব আয় ১৫০ ভারতীয় রুপি। শুধু ভয়েস কল থেকে আসে ৮৫ শতাংশ আয়। বাকি ১৫ শতাংশ আসে ভিএএস, এসএমএস, এমএমএস, ডাটা ও ইন্টারনেট থেকে।
ভারতের ইন্টারনেট বাড়ছে শম্বুকগতিতে। ২০১০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সে দেশের মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। মোট গ্রাহকসংখ্যা সাড়ে ৭ কোটি। নিয়মিত ব্যবহারকারী ৫ কোটি ২০ লাখ। ব্রডব্যান্ড গ্রাহক ১ কোটি। অবশ্য এক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ কোটি। গতির ক্ষেত্রে ভারতের সংজ্ঞায়ন ২৫৬ কেবিপিএস (এখন ৫১২ কেবিপিএস)। বিশ্বের সংজ্ঞায়ন ২ এমবিপিএস (২০৪৮ কেবিপিএস)।
থ্রিজি ভারতে আসে ২০০৮ সালে। সে বছর সেখানে ইনফোটেক সংশোধিত আইন পাস হয়। এমটিএনএল থ্রিজি চালু করে দিল্লিতে আর বিএসএনএল চেন্নাইয়ে। বেসরকারি উদ্যোক্তারা ২০১০ সালের মে মাসে থ্রিজির জন্য এবং জুনে ব্রডব্যান্ড অ্যাক্সেসের জন্য দরপত্র দাখিল করে। ২০১১ সালে এসে বেসরকারি খাতে থ্রিজি চালু হয়। মোবাইল ও ইন্টারনেট প্রবেশের একটা অব্যাহত প্রভাব পড়ে সে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। দেখা গেছে কম টেলিঘনত্বের রাজ্যগুলোর চেয়ে বেশি টেলিঘনত্বের রাজ্যগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি-হার ১.২ শতাংশ বেশি। থ্রিজির অভিজ্ঞতা সে দেশে বাড়ছে।
তিনি সবিশেষ উল্লেখ করেন, ভারতীয় টেলিকম খাতের নতুন স্ট্র্যাটেজি বা কৌশল হচ্ছে ‘আউটসোর্সিং’। ভারতীয় টেলি-উদ্যোক্তারা ২০০৮ সালে চারটি আন্তর্জাতিক বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং কোম্পানির সাথে ১০০০ কোটি ভারতীয় রুপির চুক্তি স্বাক্ষর করে। লক্ষ্য- এর কলসেন্টার কেন্দ্রগুলো থেকে আগামী ৪-৫ বছরের মধ্যে এ পরিমাণ অর্থের কাজ আউটসোর্স করা। ভারতের প্রথম আউটসোর্স চুক্তি থেকে দেখা যায়, এর সম্ভাব্য আউটসোর্সিং ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- ইনফরমেশন টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট, সিআরএম, ডাটা সেন্টার ও ডিজাস্টার রিকভারি। এমনকি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য হেলপ ডেস্ক পর্যন্ত আউটসোর্স করা যাবে। ভারতে টেলিকম আউটসোর্সিং গতিশীল হয়ে উঠছে। সেখানে মোবাইল টেলিফোনিতে নতুন আসা কোম্পানি এয়ারসেল ৯ বছরে আইটি সলিউশন প্রোভাইডার আইটিউইপ্রো ইনফোটেকের কাছে ৩৫০ কোটি ডলারের আউটসোর্স করবে। ২০০৯ সালে ভারতী এয়ারটেল অ্যালকাটেল-লুসেন্টের সাথে ৫০ কোটি ডলারের চুক্তি করে শেষোক্ত কোম্পানির ব্রডব্যান্ড ও ফিক্সড লাইন নেটওয়ার্কে ৫ বছরে ম্যানেজমেন্ট ও সার্ভিসিং আউটসোর্স করার জন্য। ভারতী এয়ারটেল আফ্রিকা মহাদেশের বেশিরভাগ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক কিনে নিয়েছে। এখন এটি পরিকল্পনা করছে কলসেন্টার জব আফ্রিকায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। এয়ারটেল প্রাথমিকভাবে ৫ বছরের জন্য আইবিএম, টেক মহিন্দ্র ও স্পেনকোর মতো পার্টনারদের সাথে মিলে এর কলসেন্টার সৃষ্টি করবে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিএসএনএলের ওয়্যারলেস কাস্টমার সার্ভিস বিপিও আউটসোর্স করে বেসরকারি কলসেন্টারগুলোর কাছে এসব কেন্দ্র গড়ে তোলা ও এগুলোর বিপিও অপারেশন ব্যবস্থাপনার জন্য। ভারত সরকারের মালিকানাধীন ‘ভারত সঞ্চার নিগম’ পরিকল্পনা করছে এর থ্রিজি মোবাইল সার্ভিস আউটসোর্স করার জন্য। এখন কাজ চলছে ফ্র্যাঞ্চাইজ চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে। ভারতীয় সব টেলিকম কোম্পানিই তাদের আউটসোর্স সম্প্রসারণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস ও অ্যালকাটেল-লুসেন্ট চুক্তি স্বাক্ষর করে ২০০৮ সালের জুলাইয়ে চালু করে একটি জেবি, যাতে করে গ্লোবাল সার্ভিস বিজনেসের একটি কার্যকর ব্যয়ের ডেলিভারি হাব গড়ে তোলা যায়। পাঁচ বছর মেয়াদী এ চুক্তি বিশ্বের বৃহত্তম কয়টি মাল্টিভেন্ডর ম্যানেজড সার্ভিস চুক্তির অন্যতম। আর ভারতে এটি প্রথম মাল্টি-টেকনোলজি ম্যানেজড সার্ভিস (সিডিএমএ ও জিএসএম)। ইতিসালাত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারতের টেলিকম বাজারে একটি লো-কস্ট এন্ট্রির। এটি রিলায়েন্স কমিউনিকেশনস ও এর সহযোগী সংস্থা ইনফ্রাটেলের কাছে আউটসোর্স করবে এর প্যাসিভ টেলিকম ইনফ্রাস্ট্রাকচার। ভারতে ইতিসালাতের যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে দশ বছরে দুটি রিলায়েন্সকে পরিশোধ করবে ১০ হাজার কোটি ভারতীয় রুপি। ডলারের হিসেবে ২০০ কোটি ডলার। খরচ কমানো ও ভারতে ব্যবসায় উন্নয়নের লক্ষ্যে বিখ্যাত মোবাইল ফোন কোম্পানি ভোডাফোন এসারের পুরো অপারেশন আউটসোর্স করে আইবিএম ইন্ডিয়ার কাছে। নেটওয়ার্ক সার্ভিস প্লাটফরম এবং হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ছাড়া ভোডাফোন এসারের সব আইটি অপারেশনের দায়িত্ব পালন করবে আইবিএম ইন্ডিয়া। ২০০৯ সালের এপ্রিলে অ্যালকাটেল-লুসেন্ট ম্যানেজড সার্ভিস চুক্তি করে শিয়াম সিস্টেমার সাথে বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও কলকাতা নামের তিনটি সার্কেলে। ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শিয়াম সিস্টেমার জন্য এটি ছিল এর এ ধরনের প্রথম চুক্তি, যা সম্পাদিত হয়েছে একটি ইকুইপমেন্ট সাপ্লায়ার ও টেলিকম অপারেটরের সাথে। আর টেলিকম খাতের ক্রমবর্ধমান ম্যানেজড সার্ভিসের বাজার ধরার লক্ষ্য নিয়েই করা হয়েছে এ চুক্তি।
আন্তর্জাতিক টেলিকম কোম্পানিগুলো আউটসোর্স করছে ভারতে। নিউজিল্যান্ডের টেলিকম কর্প এখন বিবেচনা করে দেখছে ভারতের টেকনিক্যাল সার্ভিসের জন্য একটি আউটসোর্সিং চুক্তি করার ব্যাপারে। ভারতের টেক মহিন্দ্র লিমিটেড, উইপ্রো লিমিটেড ও অন্যান্য কোম্পানি ১০০ কোটি ডলারের আউটসোর্সিং চুক্তি করার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রিটিশ টেলিকমের বার্ষিক ১২০ কোটি ডলারের চুক্তির মধ্যে ৭০ শতাংশই ভারতীয় ভেন্ডরদের দখলে। এ ভেন্ডরদের মধ্যে আছে- টাটা কনসালট্যান্সি সার্ভিস, ইনফোসিস, টেক মহিন্দ্র, এইচসিএল, ফার্স্টসোর্স। এগুলো ব্রিটিশ টেলিকম প্রজেক্টে নিয়োগ দেয় ২০ হাজার লোক।
জুনিপার রিসার্চের সূত্র উল্লেখ করে সুকান্ত দে ভিওআইপি আউটসোর্স সম্পর্কে জানান- থ্রিজি ও ওয়াইফাই উভয় মোবাইল ভিওআইপি সার্ভিসের প্রতি ইউজারদের আকর্ষণ বেড়ে চলা অব্যাহত থাকবে। ২০১২ সালের দিকে এ ধরনের ইউজারের সংখ্যা ১০ কোটিতে পৌঁছবে। থ্রিজির তুলনায় ওয়াইফাই মোবাইল ভিওআইপি প্রসার বেশি ঘটবে। এর ফলে ২০১৫ সালের মধ্যে মোবাইল অপারেটররা রাজস্ব হারাবে ৫০০ কোটি ডলার।
থ্রিজি প্রসঙ্গে তিনি বলেন- থ্রিজি সামাজিক নেটওয়ার্ক প্রপঞ্চ বা ফেনোমেননকে জোরদার করে তুলছে। বিশ্বের প্রতিটি ব্যক্তি এখন সাংবাদিক ও প্রযোজক, যার বিশ্বব্যাপী রয়েছে শ্রোতা-দর্শক। প্রতিটি মানুষ এখন মতামত ও সংবাদের সৃষ্টিকারী, সংগ্রহকারী এবং সেই সাথে সরবরাহকারী। ব্লগিং বিশ্বের প্রতিটি ব্যক্তিকে সুযোগ করে দিয়েছে নামমাত্র খরচে একটি সংবাদপত্র বা সাময়িকী প্রকাশের, যার রয়েছে বিশ্বব্যাপী পাঠক। যেমন- blogspot.com, wordpress ইত্যাদি। সবাই এখন ফটোগ্রাফার। যেমন- Flickr, PhotoBucket।
এ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, থ্রিজি সমাজ গড়াকে ত্বরান্বিত করছে। ইউটিউব বিশ্বের সবাইকে সুযোগ দিচ্ছে স্বল্প খরচে তার নিজস্ব টিভি চ্যানেল ও রেডিও স্টেশন চালু করার। আর এর থাকবে বিশ্বব্যাপী দর্শক-শ্রোতা। কারো একটি ওয়েব এনাবলড ক্যামেরা ফোন থাকলে, এ ধরনের একটি টিভি চ্যানেলের মালিক হতে পারেন। ওয়েব ২.০ (ফেসবুক ইত্যাদি) আপনাকে সুযোগ দেবে রিয়েল টাইমে মিথষ্ক্রিয়ার। সুযোগ থাকবে মন্তব্যের ওপর ফলোআপ মন্তব্যের। কার্যত থ্রিজি বিপ্লব শুরু হয়েছে এবং অব্যাহতভাবে তা চলছে। আশা করা হচ্ছে তা অব্যাহত থাকবে।
প্যানেল আলোচকরা বললেন
আবদুস সালাম এ সেমিনারের আরেক প্যানেল আলোচক। তিনি বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান অগ্নি সিস্টেমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। অগ্নি সিস্টেমস এ দেশের অন্যতম এক আইএসপি ও আইটিএসপি। তিনি বিজ্ঞানে ও ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের নর্থইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সংশ্লিষ্ট শিল্পে তার রয়েছে নানাধর্মী অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, ভিওআইপি শিল্পে বিদ্যমান আউটসোর্সিং সুবিধা কাজে লাগাতে হলে সরকারের উচিত সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানে পরিবর্তন আনা।
প্যানেল আলোচকদের মধ্যে ছিলেন সুপরিচিত আইটি ব্যক্তিত্ব হাবিবুল্লাহ এন করিম। তিনি টেকনোহ্যাভেন কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী। তিনি বেসিসের প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব এবং সাবেক সভাপতি। একজন কলাম লেখকও। তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়েছেন বিএসইই ডিগ্রি। তিনি বলেন, বিশ্বের সেরা ৩০টি আউটসোর্সিং গন্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশ এরই মধ্যে স্থান নিশ্চিত করেছে। আইটি/টেলিকম খাতে বাংলাদেশের দক্ষ জনশক্তি রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর মতো একটি চমৎকার অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।
মোবাইল ভিওআইপি বাজার
মোবাইল ভিওআইপি এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আশা করা হচ্ছে, ২০১৪ সালের মধ্যে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটি ৯০ লাখে গিয়ে পৌঁছবে। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সার্ভিস এ প্রবণতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে তা জানা গেছে। উল্লেখ্য, মাত্র পাঁচ বছর আগে মোবাইল ভিওআইপির ব্যবহার শুরু হয়।
বাজার বিশ্লেষক অ্যামি ক্র্যাভেন জানিয়েছেন, মোবাইল ভিওআইপি সত্যিকারের বাজার উপস্থিতি অর্জন করতে শুরু করেছে। ব্যবহারের হার দ্রম্নত বাড়ছে। এটি যতই অন্যান্য মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনের সাথে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে, বিশেষত যত বেশি সংশ্লিষ্ট হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের সাথে, ততই এর সম্ভাবনার পরিধি সম্প্রসারিত হচ্ছে। অনেক মোবাইল ভিওআইপি কোম্পানি তাদের বাজার অবদান বাড়ানোর প্রত্যাশা করছে। অনেক মোবাইল অপারেটর সম্ভাবনাময় উন্নততর সার্ভিস জোগাতে চাইছেন। তাদের মধ্যে এ প্রবণতা সত্যিকারের এক প্রণোদনা সৃষ্টি করবে।
সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের একটি একীভূত সমন্বিত উপাদান হিসেবে বিশ্বব্যাপী কম দামে কলের জন্য মোবাইল ভিওআইপি একমাত্র বিকল্প হয়ে উঠার পথে- এ ভবিষ্যদ্বাণী ‘ইনস্ট্যাট’-এর। ইনস্ট্যাটের সাম্প্রতিক জরিপে দেখানো হয়েছে- টি-মোবাইল ইউজারেরাই সবচেয়ে মোবাইল ভিওআইপি ব্যবহার করে। নতুন জরিপমতে, এদের সংখ্যা অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ। ২০১৪ সালের দিকে গিয়ে মোবাইল ভিওআইপি বণ্টিত হবে এভাবে- ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা : ৩৯ শতাংশ, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল : ৩২ শতাংশ, উত্তর আমেরিকা : ২১ শতাংশ এবং বাকি দুনিয়া : ৮ শতাংশ। বহনযোগ্য মোবাইল ভিওআইপি ইউজারেরা বিদেশ ভ্রমণের সময়েও তা ব্যবহার করতে পারবে। এ জন্য মোবাইল ফোন অপারেটরেরা রোমিং চার্জও দাবি করতে পারবে না। এখন মোবাইল ভিওআইপিতে যেসব বাধা আছে, তা থাকবে না।
টিএমসি ডট নেট জানিয়েছে, আজকের দিনে ব্যয়সাশ্রয়ী টেলিযোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ভিওআইপি মোবাইলের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে মোবাইল ডিভাইস আজ রূপ নিচ্ছে এসআইপি ক্লায়েন্টে। মোবাইল ডিভাইসগুলো কল পাঠানো ও গ্রহণের জন্য ব্যবহার করছে একটি ডাটা নেটওয়ার্ক। বিষয়টি গ্রাহকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।
টিএমসি আরো জানিয়েছে- আশা করা যাচ্ছে, ২০১৩ সালের মধ্যে মোবাইলের বাজার ৩২২০ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। আর সাম্প্রতিক শিল্প রিপোর্ট মতে, ২০১৯ সালের দিকে অর্ধেক মোবাইল কলই সম্পন্ন হবে আইপি নেটওয়ার্কের মধ্যেমে।
টিএমসি জানায়, মোবাইল ভিওআইপি প্রোভাইডার রিভ সিস্টেমস আইটেল মোবাইল ডায়ালার এক্সপ্রেসের মাধ্যমে মোবাইল ভিওআইপিতে উত্তরণের জন্য অপারেটরদের সহযোগিতা দেয়। আইটেল এমন একটি মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন, যা যেকোনো মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভিওআইপি ব্যবহারের সুযোগ দেয় এবং তা অপারেটরদের মাধ্যমে ব্র্যান্ড করা যাবে। আইটেল মোবাইল ডায়ালার এক্সপ্রেস ইন্টারনেট কানেকটিভিটির জন্য জিপিআরএস, ওয়াইফাই এবং ব্লু-টুথ সাপোর্ট করে। এটি চলে যেকোনো সিম্বিয়ান ফোনে কিংবা উইন্ডোজ ৫ বা ৬ প্লাটফরমে। অধিকন্তু এই মোবাইল ভিওআইপি বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে ১১৫০টি আইপি সুইস সাপোর্ট দিচ্ছে। রিভ সিস্টেমসের অন্যান্য পণ্যের মধ্যে আছে- আইটেল কলব্যাক ও কল থ্রো ডায়ালার, আইটেল বাইট সেভার, আইটেল পিন প্রটেকটর, আইটেল এমভিএনও স্মার্ট, আইটেল সুইচ ও আইটেল বিলিং।
ভিওআইপি সার্ভিস বনাম ভিওআইপি সিস্টেম
ভিওআইপি বা ভয়েস ওভার ইন্টারনেট টেলিফোনি হচ্ছে টেলিফোনির ভবিষ্যৎ। কমপিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ডাটা হিসেবে ফোনকল পাঠাতে ভিওআইপি সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। এর মাধ্যমে খরচ বাঁচানো যায়। ভিওআইপি ব্যবস্থা সুদৃঢ় ও সহজে সম্প্রসারণযোগ্য। ফলে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানের কাছে এ ব্যবস্থা পছন্দের। ভিওআইপি বিভিন্ন কোম্পানির জন্য বিভিন্ন মাপের উপকার বয়ে আনে। এ উপকারের মাত্রা সবার জন্য সমান নয়। এক্ষেত্রে তিনটি বিকল্প রয়েছে। আপনাকে বেছে নিতে হবে কোন বিকল্পটি আপনার জন্য সবচেয়ে বেশি উপকার বয়ে আনতে পারে।
আপনার ব্যবসায়ে বা কাজে ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা দুটি ভিওআইপি উপায় রয়েছে। ভিওআইপি সিস্টেমটি আপনার বিদ্যমান ফোন সিস্টেমের মতো। এ ব্যবস্থায় পিএবিএক্স অথবা অন্যান্য টেলিফোন হার্ডওয়্যার দিয়ে ইনকামিং ও আউটগোয়িং কল, ভয়েস মেইল ও এক্সটেনশন কল সম্পাদন করা যায়। আরেকটি টেকনোলজির কথা আমরা জানতে পেরেছি, তা হচ্ছে ভিওআইপি সার্ভিস। প্রচলিত ফোন সার্ভিসের মতো একটি ভিওআইপি সার্ভিস দেশ-বিদেশের অন্যদের সাথে আপনার কোম্পানির যোগাযোগ গড়ে দেয়। এতে প্রয়োজন খুবই কম হার্ডওয়্যার কিংবা একেবারেই কোনো হার্ডওয়্যার লাগে না। ভিওআইপি সার্ভিস আপনার কোম্পানি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাওয়া ফোন ট্রাফিক পরিচালনা করতে পারে। ভিওআইপি সার্ভিস ক্রমেই পরিপক্বতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর সুপরিচিত প্রোভাইডাররা এখন কাজ করছে ভোক্তাদের কথা মাথায় রেখে।
এম রেজাউল হাসান জানালেন
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে বেসিস আয়োজিত সফটএক্সপোতে ‘ভিওআইপি শিল্পে আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে ভিওআইপি বাজারে বিদ্যমান সুযোগগুলো সম্পর্কে আমাদের জানার সুযোগ করে দিয়েছে রিভ সিস্টেমস। সেমিনারের প্যানেল আলোচনার সঞ্চালক ছিলেন রিভ সিস্টেমসের প্রধান নির্বাহী এম রেজাউল হাসান। তিনি আইপি যোগাযোগের ক্ষেত্রে একজন স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। টেলিকম ও ভিওআইপি সম্পর্কিত অনেক আন্তর্জাতিক সেমিনার ও ওয়ার্কশপে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি তার মূল্যবান অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন। প্রকৌশল বিষয়ে তিনি একজন স্নাতক। এমবিএ ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে।
ভিওআইপি ও টেলিকম শিল্পে আউটসোর্সিং বিষয়ে এ প্রতিবেদকের কথা হয় এম রেজাউল হাসানের সাথে। এ সময় তিনি জানান, ভিওআইপি সার্ভিস শিল্পে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি এ ব্যাপারে জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন। তিনি অভিমত প্রকাশ করে বলেন, সব দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশভিত্তিক আইটি শিল্পের জন্য বিশ্বের আইপি শিল্প থেকে আউটসোর্সিং সেবা নেয়া যেতে পারে। তিনি আরো জানান, ভিওআইপি শিল্পে আউটসোর্সিং ব্যবসায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ২০১৫ সালের মধ্যে ১০০ কোটি মার্কিন ডলার আয়ের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এটি বাংলাদেশের আইটি শিল্পের জন্য নতুন ভবিষ্যতের দুয়ার খুলে দিতে পারে। এ সময়ে বিশ্বের ভিওআইপি বাজার ১০০০০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে। ভিওআইপির ক্ষেত্রে আমাদের সামনে আউটসোর্সিংয়ের অফুরান সুযোগ। যেমন- আমরা আউটসোর্স করতে পারি কাস্টমার সাপোর্ট, হেলপ ডেস্ক, টেকনিক্যাল সাপোর্ট, সুইচ ম্যানেজমেন্ট, ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট ও বায়িং, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট ও কাস্টমাইজেশন, ডিভাইস ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি। আগামী বছরগুলোতে এর মাধ্যমে বাংলাদেশে যেমনি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় সম্প্রসারণের সুযোগও রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি গার্টনার বাংলাদেশকে সেরা ৩০ আউটসোর্সিং দেশের তালিকাভুক্ত করেছে যথার্থ কারণেই। আইটি ও টেলিকমিউনিকেশন ডোমেইনে বাংলাদেশের রয়েছে দক্ষ জনশক্তি। বাংলাদেশ আবির্ভূত হচ্ছে একটি আউটসোর্সিং হাব হিসেবে। এর ফলে এটি হতে পারে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জনের এক নিয়ামক। মোবাইল ভিওআইপি সম্পর্কে তিনি বলেন, মোবাইল ভিওআইপি যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, তা আর কোনো মোবাইল কমিউনিকেশন এনে দিতে পারেনি। এর মজাটা নিহিত মোবাইল ভিওআইপির অর্থনীতিতে। এটা শুধু সস্তাই নয়, এতে রয়েছে যথার্থ বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়।
সাক্ষাৎকার
............................................................................................................
সরকারকে আউটসোর্সিং সহায়ক নীতি তৈরি করতে হবে
ড. মশিউর রহমান, বিজ্ঞানী, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ন্যাচারাল সায়েন্সেস, জাপান
সম্প্রতি গার্টনার বাংলাদেশকে সেরা ত্রিশ আউটসোর্সিং গন্তব্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
গার্টনার এর মন্তব্য অবশ্যই আমাদের আরো বেশি আউটসোর্সিংয়ের কাজ পেতে সাহায্য করবে। তবে যাত্রা সবে শুরু, সত্যিকারভাবে আমাদের এই শিল্পটিকে গার্মেন্টসের মতো সফল করতে হলে আরো অনেকদূর পথ চলতে হবে। যারা বিদেশীদের সাথে কাজ করি তারা জানি, একটি কাজ পাওয়া আসলেই কত কঠিন। তবে আমি সেদিনের স্বপ্ন দেখি, পাড়াগাঁয়ে বসে আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা সারা বিশ্বের কাজ করে দেবে। বড় কোম্পানিগুলো বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার নেবার জন্য পাল্লা দেবে। প্রজেক্ট পাবার ক্ষেত্রে লিখিত-অলিখিত সিদ্ধান্ত থাকবে, বাংলাদেশীদের বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
ভিওআইপি ও টেলিকম শিল্পে বাংলাদেশের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে বলুন?
আমরা যারা টেলিকম খাতের সাথে যুক্ত, তারা বারবারই বলেছি অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের জন্য। বিশ্বের টেলিকম খাতগুলোর প্রজেক্টগুলো আগে বড় বড় কোম্পানির কাছেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আমরা গত ১০ বছরে দেখতে পাচ্ছি এ খাতের অনেক কাজই এখন আউটসোর্সিং হচ্ছে। বাংলাদেশ এই সুযোগ নিতে পারে। ভিওআইপি শিল্পের সাথে যারা যুক্ত তারা এই আউটসোর্সিংয়ের কাজ করতে পারে।
একটি উদাহরণ দেয়া যাক। একটি প্রজেক্ট হলো, একটি নতুন সার্ভারের কনফিগারেশন ভিওআইপির জন্য করতে হবে। আগে দেখা যেত শুধু টেলিকম কোম্পানিগুলো এই কাজ করত। দুবাইভিত্তিক কোনো ইঞ্জিনিয়ারকে দিয়ে কাজ করালে একটি বড় অঙ্কের ডলার প্রয়োজন হতো। এরপর কোম্পানিটিও একটি মুনাফা নিত। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের কাজ ভিওআইপি’র সাথে সংযুক্ত বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য করা সম্ভব। তারা ঘরে বসে সার্ভারে রিমোট লগইন করেই কাজটি করতে পারে। এই ধরনের আউটসোর্সের কাজ এখন প্রচুর আসছে। এছাড়া ভিওআইপি’র জন্য সফটওয়্যার তৈরির কাজও প্রচুর আসছে।
এক্ষেত্রে আউটসোর্সিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আইটি জনবল আমাদের আছে কী? আমাদের সামগ্রিক প্রস্ত্ততিই বা কেমন?
জনবল আমাদের প্রথম চ্যালেঞ্জ। আমাদের ভালো ইঞ্জিনিয়াররা আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদেশে চলে যাচ্ছে। দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হলো, তারা বাংলাদেশে কাজ করার চেয়ে কানাডা বা অন্য কোনো দেশে চলে যাওয়াটি অনেক ভালো সুযোগ মনে করছে। আমার প্রস্তাবনা হলো, প্রযুক্তিবিদ বা প্রফেশনালদের প্লাটফর্ম বা নেটওয়ার্ক তৈরি হলে এ সমস্যা কিছুটা সমাধান হতে পারে। এই নেটওয়ার্ক অনলাইনেও হতে পারে, কিংবা কোনো কফি শপে হতে পারে। Bdosn, উইকিপিডিয়া অনেকটা এই মডেলে কাজ করছে। আমরা তাদের মডেলগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারি। আমাদের প্রযুক্তিবিদেরা এই প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করে কাজ শিখতে পারে, সমস্যায় পড়লে সিনিয়রদের পরামর্শ নিতে পারে। বর্তমানে কাজগুলো ইনস্টিটিউশনাল না হয়ে খুবই ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। আমাদের এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
ভিওআইপি আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো আইন ও বিধানগত কিংবা নীতিগত বাধা আছে কী?
আমাদের দেশের নীতি ও সংশ্লিষ্ট লোকের অভিজ্ঞতার প্রচন্ড অভাব রয়েছে। ব্যাংকের ফ্রন্ট ডেস্কে কোনো ইঞ্জিনিয়ার গিয়ে যদি বলে, আমি আউটসোর্সের কাজ করেছি, আমার টাকা বিদেশ থেকে আমার অ্যাকাউন্টে আসবে, তবে ব্যাংকের লোকজন নিয়ম-কানুন ও আইন-আদালত দেখাবে। পরিচিত ব্যাংকের হাতে- পায়ে ধরে টাকাটা আনতে হয়। অন্তত ২০০৮ সালে আমার নিজেরই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। জানি না, বর্তমানে অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি না। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ (proactive) ভূমিকা রাখার জন্য অনুরোধ করছি।
বাংলাদেশের আউটসোর্সের সাথে যুক্ত ইঞ্জিনিয়ারদের প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো পেপাল, মানিবুকার, ক্রেডিট কার্ড নিয়ে সমস্যায় পড়া। অনেক কষ্টে এই অদ্ভুত নীতিগুলোর কারাবরণ করেই আমাদের ছেলেমেয়েরা কাজ করছে। এদের সাফল্যকে ছোট করে দেখার উপায় নেই। একটু সাপোর্ট পেলে বাংলাদেশকে সোনার দেশে রূপান্তর করার মতো ক্ষমতা আছে এদের। এখন কথা হলো, এই ক্ষমতা কতটুকু আমরা ব্যবহার করব?
ভিওআইপি ও টেলিকম শিল্পে আউটসোর্সিং জোরদার করে তুলতে আপনার কোনো পরামর্শ আছে কী?
তবে এই শিল্পটিকে সম্ভাবনাময় করার জন্য সবার একত্রে কাজ করতে হবে। যুব সমাজ যেন আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আরো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে সেজন্য আমি নিচের প্রস্তাবনাগুলো দেবো-
০১.
সরকারকে এই শিল্পটির সহায়ক পলিসি তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে এখনো আউটসোর্সিংয়ের কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ বাংলাদেশে প্রবেশ করতে ব্যাংকগুলোর সহায়তা পাওয়া যাচ্ছে না। এজন্য ব্যাংকিং নীতির উন্নয়ন জরুরি।
০২.
বহির্বিশ্বের মিডিয়া ও তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সংযুক্ত বাংলাদেশী কমিউনিটিগুলো বাংলাদেশের এ সাফল্য ও সম্ভাবনার সাথে বিশ্ববাসীর পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ প্রজেক্টগুলো পাবার ক্ষেত্রে ভাবমর্যাদা উন্নত করতে হবে।
০৩.
এ শিল্পের সাথে সংযুক্ত প্রযুক্তিবিদদের আরো বেশি professional হতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক প্রজেক্টটি সম্পন্ন করার মাধ্যমে দেশের সুনাম তৈরি করতে হবে। একজনের ব্যর্থতার কারণে পরবর্তীতে বাংলাদেশে কাজ না আসার সম্ভাবনাই বেশি।
............................................................................................................
আউটসোর্সিংয়ে উদ্যোক্তাদের এগিয়ে আসার সময় এটি
কাজী জামিল আহমেদ, প্রধান নির্বাহী, কিউএসআর সিস্টেমস লি.
কিউএসআর সিস্টেমস ২০০৪ সালের কাজ শুরু করে দেশে-বিদেশে কমিউনিকেশন সফটওয়্যার সার্ভিসের মাধ্যমে। এখন কিউএসআর ১৫টি দেশে এর গ্রাহকদেরকে তাদের ভিওআইপি কোম্পানির জন্য নানা ধরনের সার্ভিস যোগাচ্ছে। কেমন চলছে আপনাদের এ আউটসোর্সিং ব্যবসায়- পাঠকদের জানাবেন কী?
আমাদের ব্যবসায় ভালোই চলছে। প্রতিবছরই ব্যবসায় বাড়ছে জোরালোভাবে। বর্তমানে আমরা আমাদের গ্রাহকদের জন্য ভাড়ায় ১৪০টি ডেডিকেটেড সার্ভার পরিচালনা করছি। এবারে ২০১১ সালে বেসিস সফটএক্সপোতে আমরা উদ্বোধন করেছি বিশ্বের সবচেয়ে কম খরচের ভিওআইপি সার্ভার রেন্টাল সার্ভিস। এক্ষেত্রে আমরা জোগান দিচ্ছি সফট সুইসসহ সার্ভার। সাথে থাকছে মাত্র ১০০ মার্কিন ডলারে মাসিক সাপোর্ট সার্ভিস, যা বিশ্বে সবচেয়ে কম খরচ বলে বিবেচিত। এর টার্গেট হচ্ছে এসএমই ভিওআইপি প্রোভাইডারেরা, যারা ভাড়ায় ব্যয়বহুল সার্ভার নিয়ে ব্যবসায় শুরু করার সমতা রাখে না। আমাদের ১০০ ডলারের প্যাকেজের মাধ্যমে তারা ব্যবসায় শুরু করতে পারে এবং ধীরে ধীরে বাজারে বড় প্রোভাইডার হওয়ার সুযোগ নিতে পারে। আমরা আরো ফিচারসমৃদ্ধ ও কম খরচের অফারের সন্ধানে আছি। এর জন্য গ্রাহকদেরকে আমাদের ‘জুন ২০১১ অফারের’ জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আমি এখন তা উল্লেখ করতে চাই না।
আপনাদের কোম্পানির জনবল সম্পর্কে কিছু বলুন?
তিনটি দেশে কিউএসআরের রয়েছে খুব শক্তিশালী টিম। বাংলাদেশে আমাদের আছেন ২৩ সহযোগী। সিঙ্গাপুরে ৫ সহযোগী। মালয়েশিয়ায় সবেমাত্র আমাদের অফিস পুনর্গঠনের কাজ শেষ হয়েছে এবং সেখানে আছেন ১২ সহযোগী। সে কাজের জন্যই আমি এখন এ অঞ্চলে অবস্থা করছি। তবে বাংলাদেশে নিয়োগদানের কাজ চলছে সহযোগীর সংখ্যা ৫০-এ বাড়িয়ে তুলতে।
ভিওআইপি আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও সমস্যা সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
ভিওআইপি আউটসোর্সিংয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রচুর সুযোগ রয়েছে। আমার বিবেচনায়, বিভিন্ন খাতে কাজ করার এটি একটি বড় ক্ষেত্র। প্রযুক্তির উদ্ভাবনও অব্যাহতভাবে চলছে। অতএব যেকেউ এ শিল্পে ব্যবসায়ের প্রসার ঘটাতে পারেন। বর্তমানে আমি শুধু বলতে পারি, এটি একটি সুযোগের খাত। প্রচুরসংখ্যক বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তার এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিৎ। হাজার ট্রিলিয়ন ডলারের খাতের এ ব্যবসায়ে বাংলাদেশ সরকারকেও মনোযোগী হওয়া দরকার। ভিওআইপি আউটসোর্সিং বাজারে বাংলাদেশ এরই মধ্যে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছে। এবং কোনো গ্রাহক যদি কাউকে জিজ্ঞেস করে ভিওআইপি আউটসোর্সিংয়ের জন্য কোথায় যেতে হবে, তখন আমাদের দেশের নাম আসবে সবার আগে। অতএব আমি বলব, বাংলাদেশে নতুনদের জন্য এটাই বড় সুযোগ, যারা নতুন ভিওআইপি ব্যবসায় শুরু করতে চান।
আপনাদের পণ্য ও সেবা সম্পর্কে বলুন?
ভিওআইপি প্রোভাইডার কিংবা অপারেটরদের আমরা জোগান দিই সব ধরনের সলিউশন ও সার্ভিস। এর মধ্যে আছে- সফট সুইচের মতো সফটওয়্যার ডায়ালার, কলশপ, সিডিআর, ‘কুয়েস্ট’ ব্র্যান্ডনেমের ওয়েব ম্যানেজমেন্ট টুল। আছে মেইনটেন্যান্স ও মনিটরিং সার্ভিসসহ ডেডিকেটেড সার্ভার।
স্বাভাবিকভাবে ভিওআইপি প্রোভাইডারেরা কোনো একক ব্যক্তি নয়, এরা কর্পোরেট সংস্থা। অতএব তাদের ব্যবসায়ের অ্যাকাউন্ট, চাকুরে, বিক্রি, ক্রয় এবং সংগঠনের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই দেখাশোনা করতে হয়। এজন্য আমরা তাদের জোগান দিই বিজনেস টাকার ইপিআর, যাতে করে এরা এদের ব্যবসায়কে স্বয়ংক্রিয় করে তুলতে পারে। আমরা সাহায্য করি সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় এবং সুযোগ দিই তাদের ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
আইপি টেলিফোনি ও সাদিয়াটেক
আইপি টেলিফোনিসহ ইলেক্ট্রনিক যোগাযোগপ্রযুক্তি নিয়ে উৎকর্ষ মানের কাজ করছে Sadiatec নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এটি এর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন লাখ লাখ মিনিট ভয়েস কল সঞ্চালন করছে। এটি আরো যেসব সার্ভিস যোগায় তার মধ্যে আছে : ফিক্সড মোবাইল কনভার্জেন্স (এফএমসি), ইউনিফাইড কমিউনিকেশন (ইউসি), আইপি টেলিফোনি সার্ভিস, ডাটা সেন্টার কালেকশন সার্ভিস, ডাটা সিকিউরিটি ও মনিটরিং সার্ভিস এবং অ্যাডভান্স ও নেটওয়ার্কিং কনসালট্যান্সি। বাংলাদেশে Faber @ home অবকাঠামো গড়ে তুলে Sadiatec পরিকল্পনা করছে ঢাকায় এর অপারেশন সম্প্রসারিত করবে, যাতে করে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর দেশব্যাপী ইউনিফাইড কমিউনিকেশন্স সার্ভিস দেয়া যায়। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানের জনবল ৬০ জন।
কাজে লাগাতে হবে এ সুযোগ
সুযোগ বারবার আসে না। যখন সুযোগ আসে তখনই তা কাজে লাগাতে হয় যথা সচেতনতা নিয়ে। অতীতে এক্ষেত্রে আমাদের ব্যর্থতা সীমাহীন। ফলে প্রযুক্তি খাতের অনেক সম্ভাবনা আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক উন্নয়নও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি এ কারণেই। এ ভুল থেকে এবার অন্তত যেনো আমরা বেরিয়ে আসতে পারি। এতক্ষণের আলোচনায় নিশ্চয় এটুকু স্পষ্ট হয়ে গেছে, এ সময়টায় আমাদের সামনে ভিওআইপি আউটসোর্সিংয়ের একটা অপূর্ব সুযোগ অপেক্ষা করছে। অতএব সরকারি-বেসরকারি মহলসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলের প্রতি অপরিহার্য তাগিদ এসেছে এ সুযোগকে পুরোদমে কাজে লাগানোর। আমরা সবাই এ জন্য প্রস্ত্তত তো? না সেই অতীতের মতো আবারো গা ভাসানোই সার হবে? এ প্রশ্নের ইতিবাচক জবাবটাই সবার কাম্য। তবে একটা বিষয় অবশ্যই মনে রাখতে হবে, সুযোগের সুফল পুরোপুরি ঘরে তুলতে হলে এগিয়ে যেতে হবে উপযুক্ত ও সফল প্রতিযোগিতা কৌশল নিয়ে। নীতিদর্শন আর নীতিকৌশল নিয়ে। আর সে কৌশল রচনা করতে হবে আমাদের উদ্যোক্তা ও সরকারকে একসাথে বসে। তবেই মিলবে কাঙ্ক্ষিত সফলতা। আমরা পাবো কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
কজ ওয়েব