লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
দেড় দশকেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন প্রশ্নে শুধু মুখভরা প্রচার-সর্বস্ব ভুলি থাকলেও এর উন্নয়নে মনে হয় আমরা আন্তরিক পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসছি না কিংবা আসতে পারছি না। ফলে প্রশ্ন উঠছে- কবে উড়বে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট? কেনো পেছানো হচ্ছে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের সাল-তারিখ? কেনো হাইটেক পার্ক প্রকল্প এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি? কেনো তথ্যপ্রযুক্তির নানা খাতে আমাদের অবস্থান সীমাহীনভাবে নাজুক? কেনো ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স কর্মকা-- কোনো গতি নেই? কেনো ২০১১ সালের আগস্টের পর টাস্কফোর্সের আর একটি বৈঠকও বসল না? সর্বোপরি কেনো এ খাতে দুর্নীতি রোধে নেই আন্তরিক পদক্ষেপ? কেনো প্রায় দেড় দশকেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়? কেনো সংবাদপত্রে আমাদের খবর পড়তে হয়- চোরাকারবারীদের পকেটে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ের ১২ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে প্রতিদিন? এমনি আরও নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে এ দেশের সাধারণ বিবেকী মানুষের মাথায়।
গত ২২ সেপ্টেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের শীর্ষ খবরে জানানো হয়েছে- প্রতিদিন অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়ের ১২ কোটি টাকা চলে যাচ্ছে চোরাকারবারীদের পকেটে। ১৪ বছরেও নিয়ন্ত্রণে আসেনি অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়। খবরে বিটিআরসি’র বার্ষিক প্রতিদিনের বরাত দিয়ে আরও জানানো হয়, বছর তিনেক আগে ২০১১ সালের জুলাই মাসে বিদেশ থেকে দেশে বৈধ পথে আসা অন্তর্গামী টেলিফোন কলের পরিমাণ ছিল ১৫৫ কোটি ৩৯ লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৩ মিনিট। আর বহির্গামী কলের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২১ লাখ ২২ হাজার ৬৮৭ মিনিট। ওই সময় দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ ৭৫ হাজার ৬৬৬।
আমরা এও জানি, প্রতিবছর প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ৯০ লাখ। দেশের মোবাইল ফোনের গ্রাহকসংখ্যা বেড়ে সাড়ে ১১ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই মোবাইল ফোন গ্রাহকসংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে বৈধ পথে ভিওআইপি কলের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে তেমনটি ঘটতে দেখা যাচ্ছে না। বিগত দুই বছরে অন্তর্গামী ও বহির্গামী এ দুই ধরনের কলের পরিমাণ বরং কমে গেছে। এর অর্থ ভিওআইপি কলগুলো চোরাকারবারীরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত ১৪ বছর ধরে ভিওআইপি’র অবৈধ কারবারীরা বিভিন্নভাবে বৈদেশিক কল চুরি করে তাদের পকেট ভারি করছে। মাঝে-মধ্যে এদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়েও এতে কোনো সফলতা পাওয়া যায়নি। কারণ, এসব চোরাকারবারী হয় অটেল রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী, নয়তো ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট। এদের কারসাজিতে অন্তর্গামী ও বহির্গামী ভিওআইপি কলের অর্ধেকই থেকে যাচ্ছে সরকারি খাতার হিসাবের বাইরে।
এ খাতে অরাজকতা দূর করতে সরকার ২০১০ সালে বৈদেশিক কলের ক্ষেত্রে ২০০৭ সালের নীতিমালা সংশোধন করে নতুন ‘আইএলডিটিএল পলিসি’ গ্রহণ করে ঢালাওভাবে আইজিডাব্লিউ, আইসিএক্স, আইআইজি ও ভিএসপি লাইসেন্স দেয়। এতে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার কারণে বর্তমানে ৯টি আইজিডবিস্নউ অপারেটরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মামলাও হয়েছে কয়েকটির নামে। যেগুলো চালু ছিল, সেগুলো নিয়মিত রাজস্ব দিচ্ছে না। নিয়মিত লাইসেন্স ফিও পাচ্ছে না সরকার। এই ফি’র পরিমাণ কমিয়ে দিয়েও কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ভিওআইপি’র অবৈধ কল টার্মিনেশন কমাতে রেট কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে খবরে প্রকাশ, সরকারের শত কোটি টাকার পাওনা মিটিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছে একটি আইজিডবিস্নউ অপারেটর প্রতিষ্ঠান। ‘কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেড’ নামের এ প্রতিষ্ঠানটি যেখানে ছিল, সেখানে এখন আর এর অস্তিত্ব নেই। ‘কে টেলিকমিউনিকেশন্স লিমিটেড’ সংসদ সদস্য শামীম ওসমান পরিবারের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। কিন্তু শামীম ওসমানের দাবি, তার পরিবারের সদস্যরা এখন আর এর মালিক নন। যাদের নতুন মালিক বলা হচ্ছে তাদের নাম-ঠিকানা ভুয়া।
প্রতিদিন কী পরিমাণ কল চোরাকারবারীদের মাধ্যমে দেশে আসছে, এ থেকে সরকার কী হারাচ্ছে, তা নিয়ে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। বিটিআরসি চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোসের ধারণা, প্রতিদিন অবৈধভাবে কল টার্মিনেশনের কারণে সাড়ে ৩ কোটি মিনিটের মতো আন্তর্জাতিক কল হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। বৈধ পথে আসার কথা প্রতিদিন ৮ কোটি মিনিট, আর আসছে সাড়ে ৪ কোটি মিনিট। তবে আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারগুলোর দাবি, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১৪ কোটি মিনিট আন্তর্জাতিক কল আসে। অর্থাৎ প্রতিদিন ১০ কোটি মিনিট কল চুরি হয়। এর ফলে চোরাকারবারীরা প্রতিদিন পকেটে পুরছে ১২ কোটি টাকার ওপরে।
গত দেড় দশকে এভাবেই চলছে অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসায়। আর এর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাত। এর দায় সরকার কিছুতেই এড়াতে পারে না। আমাদের তাগিদ- অবিলম্বে এই চুরি বন্ধে কার্যকর কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হোক। সেই সাথে এ পর্যন্ত এ ধরনের চুরির সাথে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হোক। বন্ধ করা হোক সরকারি অর্থের এই চুরি।