চলতি অর্থবছরের শুরুতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের কষ্টার্জিত আয়ের ওপর ১০ শতাংশ হারে কর সংযোজন করে। ফলে জুলাইয়ের শুরুতে ব্যাংকওয়্যার ট্রান্সফারের মাধ্যমে যারা বিদেশ থেকে টাকা পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে শতকরা ১০ ভাগ অর্থ সাথে সাথেই কেটে নেয়া হয়, যা দেশের ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে চরম হতাশার সৃষ্টি করে। বিভিন্ন ব্লগ এবং ফেসবুকে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ জুলাই অর্থমন্ত্রী ও তথ্যমন্ত্রীর সাথে একটি উচ্চপর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। পরিশেষে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তা প্রত্যাহার করতে গেজেট প্রকাশ হবে বলে আশ্বাস পাওয়া যায়। বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সারের সাথে যোগাযোগ করে জানা যায়, ২০ জুলাইয়ের পর বিদেশ থেকে যারা টাকা পেয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে কোনো ট্যাক্স নেয়া হয়নি। এর আগে যাদের কাছ থেকে ট্যাক্স নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে দু’জন ফ্রিল্যান্সার ব্যাংক থেকে তাদের টাকা ফেরত দেয়া হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন। অন্যদের টাকাও খুব শিগগির ফেরত দেয়া হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
জুলাইয়ের শুরুতে যেসব ফ্রিল্যান্সারের কাছ থেকে কর নেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন হচ্ছেন আল-মামুন সোহাগ। তিনি একজন স্বনামধন্য আইফোন গেম ডেভেলপার। তিনি কানাডার একটি প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘরে বসে কাজ করেন। সর্বশেষ পেমেন্টে শতকরা ১০ ভাগ কম পাওয়ার পর ব্যাংক থেকে এই তথ্যটি জানতে পারেন। পরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে এর সত্যতা পান। যেখানে আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪-এ একটি সংযোজন পাওয়া যায়। যাতে লেখা রয়েছে-
52Q. Deduction of tax from resident for any income in connection with any service provided to any foreign person. Any person, responsible for paying or crediting to the account of a resident any sum remitted from abroad by way of service charges or consulting fees or commissions or remunerations or any other fees called by whatever name for any service rendered or any work done by a resident person in favour of a foreign person, shall deduct tax at the rate of ten percent of the amount so paid at the time of making such payment or credit of such payment to the account of the payee.
এই করের ব্যাপারে আল-মামুন সোহাগ বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। আয়কর দিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আয়ের ওপর কর তখনই প্রযোজ্য হবে, যখন সরকার আমাদেরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে অবকাঠামোগত সব ধরনের সুবিধা দেবে। কিন্তু আমাদের দেশে যারা ফ্রিল্যান্সিং করছেন, তারা এই কাজটি সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে করছেন। কানাডাতে একজন গ্র্যাজুয়েট যখন পাস করে বের হন, তখন তার পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের সব ধরনের সুবিধা সরকার দেয়। কিন্তু আমাদের দেশে একজন গ্র্যাজুয়েট পাস করে সে ধরনের কোনো সুবিধাই পান না। এ নিয়ে অন্যান্য ফ্রিল্যান্সারের সাথে কথা বলেও একই ধরনের মতামত পাওয়া যায়। মূলত আয়কর এক বিষয় আর আউটসোর্সিংয়ের আয়ের ওপর কর ধার্য আরেক বিষয়। আয়করের ক্ষেত্রে আয় যখন একটি নির্দিষ্ট সীমার ওপর হয়, তখন সেই অতিরিক্ত আয়ের ওপর কর দেয়া হয়, যা পরিশোধ করা দেশের প্রত্যেক নাগরিকেরই দায়িত্ব। কিন্তু আউটসোর্সিংয়ের আয়ের ক্ষেত্রে সেটা যে পরিমাণ আয়ই হোক না কেন, সাথে সাথে ব্যাংক থেকে শতকরা ১০ ভাগ কেটে নেয়া হয়েছিল। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যারা ঘরে বসে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন তারা দেশে অনেক মাধ্যম ঘুরে, অনেক কমিশন দিয়ে তারপর টাকা হাতে পান। আউটসোর্সিং মার্কেটপ্লেসে ১০০ ডলারের একটি কাজে পুরোটা পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে তাদেরকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ ফি দিতে হয়। তারপর বিভিন্ন পরিশোধ পদ্ধতি ব্যবহার করে সেই টাকা দেশে আনতে আরো কিছু খরচ হয়। সব মিলিয়ে প্রতি ১০০ ডলারে ৮০-৮৫ ডলারের মতো টাকা হাতে পাওয়া যায়। সেই টাকার ওপর যদি এখন আপনাকে শতকরা ১০ ভাগ হারে কর দিতে হয়, তাহলে তা একজন ফ্রিল্যান্সারের জন্য বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে একজন বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারকে অন্য দেশের ফ্রিল্যান্সারদের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য করে।
পরিশেষে কর প্রত্যাহার করায় দেশের ফ্রিল্যান্সারেরা সরকারকে মোবারকবাদ জানিয়েছেন। তারা বলেন, এই মুহূর্তে সরকারের সবচেয়ে জরুরি করণীয় হচ্ছে নতুন ফ্রিল্যান্সারদের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ইন্টারনেটের খরচ কমানো এবং সর্বোপরি ইন্টারনেটে অর্থ লেনদেনের প্রধান মাধ্যম পেপাল (Paypal) সার্ভিসকে আমাদের দেশে নিয়ে আসতে যথাযথ অবকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটানো। আউটসোর্সিংয়ের কাজ করে ফ্রিল্যান্সাররা যে প্রতিনিয়ত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আনছেন তা একদিকে যেমন দেশের অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখছে, তেমনি দেশের বেকার সমস্যা নিরসনে কার্যকরী ভূমিকা পালন করছে। ফ্রিল্যান্সারদের ওপর অযথা করারোপ দেশের আউটসোর্সিং খাতকেই চরমভাবে নিরুৎসাহিত করবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : zakaria.cse@gmail.com