লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি ধারা
আইসিটি নিয়ে শঙ্কা বাড়ছেই
অনেক কিছু হয়েছে, অনেক কিছু হচ্ছে এবং আরও বহু কিছুর সম্ভাবনা থাকলেও কোথাও একটা আশঙ্কার বীজ যেনো আছে। আইসিটি এখন যা কিছুকে জড়িয়ে, তার সবকিছু যে বিশ্বের সব জায়গায় ঠিকমতো চলছে তা কিন্তু নয়। একদিকে এখন পর্যন্ত নানা বাধায় ডিজিটাল ডিভাইডের শঙ্কা দূর হচ্ছে না, অন্যদিকে আইসিটির ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটানো সামাজিক সাইটগুলো বিতর্কের বাইরে থাকতে পারছে না।
এই তো গত ২৪ ডিসেম্বর ভারত সরকার ফেসবুক, ইউটিউব, এমএসএন, টুইটারসহ সবরকম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী ১৯টি সংস্থাকে হুশিয়ারি দিয়েছে এই বলে, ধর্মীয় বিতর্কিত কোনো বিষয় সাইটগুলোতে থাকতে পারবে না, অবিলম্বে ওই ধরনের কনটেন্টগুলো সরিয়ে না নিলে ভারতে বন্ধ করে দেওয়া হবে সাইটগুলো। একে কী বলা যাবে- রক্ষণশীলতা! ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি রক্ষণশীল দেশগুলোর কর্মকান্ড। একদিকে ছিল কমিউনিস্ট দেশগুলো, অন্যদিকে ধর্মীয় রক্ষণশীল দেশগুলো। এতদিন তাদের হুমকি-ধমকিই আমরা দেখেছি, কিন্তু এবার বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের এহেন হুশিয়ারি বিস্মিত হওয়ার মতোই। তবে সম্ভবত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ঠিক রাখতেই দেশটির সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারে। কারণ, রাজনৈতিক ইন্ধনে ধর্ম-বর্ণ নিয়ে উস্কানিমূলক কর্মকান্ড গণতান্ত্রিক দেশটিতে কম হয় না। সেই প্রেক্ষাপটে এখন সামাজিক ওয়েবসাইটগুলোকে উস্কানিদাতারা ব্যবহার করার চেষ্টা করতেই পারে।
গত সিকি শতাব্দীতে আমরা দেখতে পেয়েছি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মানুষকে যতটা উদার হওয়ার সম্ভাবনা দেখিয়েছে, মানুষ কিন্তু ততটা উদার ও সামাজিক বৈষম্যহীন হয়ে উঠতে পারেনি। সভ্যতার পথের প্রধান বাধা বর্ণবৈষম্য ও সাম্প্রদায়িকতা এখনও মানুষকে প্ররোচিত করছে হীন পথে চলতে।
আসলে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গেলে যে নতুন মূল্যবোধ ও আদর্শের চর্চা করতে হয়- সে বিষয়টিকেই অনেকে এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। প্রাচীন সংস্কার বা কুসংস্কার আর কূপমন্ডূকতা নিয়ে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার কী পরিমাণ ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে তার উদাহরণ কিন্তু আগেই আমরা দেখেছি টেলিভিশনের অপব্যবহারের মাধ্যমে। ওই গণমাধ্যমটির মাধ্যমে অপসংস্কৃতি যে পরিমাণে ছড়িয়েছে বা ছড়াচ্ছে সে তুলনায় সামাজিক সুস্থতা বা নতুন আদর্শের প্রচার তেমনভাবে হয়নি বা হচ্ছে না। আইসিটির কল্যাণে টেলিভিশন যত দ্রুত উন্নত হয়েছে, তত দ্রুত বা কার্যকর সভ্যতার উপকরণ হয়ে উঠতে পারেনি। অথচ অমিত সম্ভাবনা ছিল এই গণমাধ্যমটির। মূলত যন্ত্র বা প্রযুক্তির পেছনে যারা কাজ করেন, তাদের ধ্যান-ধারণা আদর্শ-উদ্দেশ্যই প্রধান ভূমিকা পালন করে। কুসংস্কার এবং আদিম মূল্যবোধ থেকে মুক্ত নতুন মানবিক ও জ্ঞানপিপাসু মানসিকতা না থাকার কারণেই গণমাধ্যমগুলো কলুষিত হয়েছে।
প্রাচীন মূল্যবোধ দিয়ে নতুন প্রযুক্তিকে বেঁধে ফেলার একটা অপপ্রয়াস বিশ্বব্যাপীই লক্ষ করা যাচ্ছে। কোনো কোনো সময় তা ভয়াবহ হয়ে উঠতেও দেখা যাচ্ছে, যেমন ভারতে হয়েছে। এই প্রাচীন মূল্যবোধ আসলে কতটা প্রাচীন সেটাও একটা প্রশ্ন। আমরা দেখতে পাচ্ছি অতি প্রাচীন-প্রায় আদিম অথবা সুনির্দিষ্টভাবেই বলা যায় বিংশ শতাব্দীর আগের সামন্তযুগের মূল্যবোধ দিয়ে আধুনিকতম এই প্রযুক্তিকে ঠেকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিংশ শতাব্দীতে মানবসভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যেমন হয়েছে, তেমনি নানা আদর্শিক উন্নয়নও ঘটেছে। এর ফলে প্রথমত সামন্তবাদী এবং শেষে উপনিবেশবাদী প্রবণতার বিকাশ সাধন করা হয়েছিল। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ মানবিকভাবে এবং উদারনীতির ভিত্তিতে সভ্যতার বিকাশ ঘটানোর অঙ্গীকার করে। দিনক্ষণ ঠিক করে যদিও এ কাজটি করা হয়নি, কিন্তু বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বাধীনতা অর্জন ও গণতন্ত্রচর্চার মাধ্যমে বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়। এর সাথে সাথে আইসিটির উন্মেষ, কৃষিবিপ্লব, চিকিৎসা ক্ষেত্রে উন্নয়ন, পদার্থবিদ্যায় ব্যাপক সাফল্য মানুষের সভ্যতাকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের শেষভাগে আইসিটি আগের সব ধরনের যোগাযোগ প্রযুক্তিকে ছাড়িয়ে গেলে মানুষ সভ্যতার এক নতুন আলোর উদ্ভাস দেখতে পায়।
বহুদিন ধরে মানুষ যে মনোজাগতিক মুক্তি চেয়েছিল, সেই মুক্তি যেনো ধরা দিতে চেয়েছে আইসিটির মাধ্যমে। চিন্তার গতিতে মানুষে মানুষে যোগাযোগ বিষয়টা এখনই আর অসম্ভব ব্যাপার নয়। কিন্তু এর সত্যিকার রূপটা বুঝতে অনেকেরই সমস্যা হচ্ছে। কিংবা অনেকে বুঝতে পেরেও যেনো বুঝতে চাচ্ছেন না। আমরা দেখতে পাচ্ছি এক ধরনের মানুষ আছেন, যারা মনে করেন নতুন অত্যাধুনিক জিনিস মানেই অবোধ্য বিষয়, আর এক ধরনের মানুষ মনে করছেন এর মাধ্যমে যে সহজ ব্যাপারগুলো ঘটছে তা সমাজের জন্য ভালো নয়। আমাদের দেশসহ আরও বহু দেশেই দেখা গেছে এই ধরনের মূল্যবোধ নিয়ে আইসিটির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করতে।
আমাদের আশপাশের অনেক দেশেই এখন পর্যন্ত দ্রুতগতির যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আবার দেখা যাচ্ছে কিছুটা এগিয়েও কেউ কেউ থমকে যাচ্ছে। দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তির সুফল জনসাধারণকে ভোগ করতে দেয়া হচ্ছে না। আমাদের দেশেই আমরা দেখতে পাচ্ছি ভিওআইপি নিয়ে সমস্যা এখন পর্যন্ত মেটেনি। আর এর ফলে যা হয়েছে তা হলো দুর্নীতির প্রসার। কারণ ভিওআইপিকে বৈধতা দেওয়া হয়নি ঠিকই, কিন্তু এর গোপন ব্যবহার থেমে নেই। অনেকে অভিযোগ করছেন খোদ সরকারের মালিকানাধীন অপারেটর সংস্থাটির কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িয়ে পড়েছেন এই গোপন অবৈধ কর্মকান্ডে। অভিযোগ উঠেছে- অন্য বেসরকারি অপারেটরের নম্বর অপব্যবহারেরও।
একটি কথা সংশ্লিষ্ট সবার মনে রাখা প্রয়োজন- জ্ঞানের ভিত্তি থেকে আইসিটির উদ্ভব এবং জ্ঞানের পথেই একে চালিয়ে নিতে হবে। আর জ্ঞানের পথে বলা যায় না আদর্শ ও মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নিয়ে যে কান্ড ঘটছে বা ঘটতে চলেছে তা অনেক প্রশ্নেরই জন্ম দেবে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় করা হয়েছিল। সেটা যে শুধু একজন মন্ত্রীর জন্য নাম পরিবর্তনই ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখন বিজ্ঞান থেকে তথ্য প্রযুক্তিকে আলাদা করে আবার তার সাথে টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়কে জুড়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে সেটাকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে হচ্ছে না। যদিও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নিয়ে দূরদর্শিতা থাকলে একে আগেই টেলিযোগাযোগের সাথে যুক্ত করা হতো। আজকে যারা এসব বিষয়ে সুপারিশ করছেন আগেও তারা দায়িত্বশীল পদেই ছিলেন, কিন্তু তখন তারা এসব বিষয়কে মূল্য দেননি। এখন দিচ্ছেন, কারণ এসব বিষয়ে এখন ‘দুর্নীতি’ এবং অন্যান্য ‘লাভজনক’ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। আগে যারা তথ্যপ্রযুক্তির বাইরের লোক ছিলেন, এখন তারাও প্রযুক্তি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করুন ব্যবসায় কাম দুর্নীতি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে চাচ্ছেন। মূলত দেখা যাচ্ছে প্রযুক্তি বা এর প্রসারের চেয়ে বিশেষ ব্যক্তি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই বিষয়টিই ভবিষ্যতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এ ছাড়া আশঙ্কা আরও যেটা করতে হচ্ছে তা হলো- এ দেশে আইসিটি নিয়ে জ্ঞানভিত্তিক কাজকর্ম কিছু হবে কি না সেটা এখনও নিশ্চিত নয়। আর তা যদি না হয় তাহলে প্রাচীন মূল্যবোধ দিয়ে আইসিটিকে মূল্যায়ন করলে জটিলতা আরও বাড়বে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com