লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যপ্রযুক্তির বাজেট সংলাপ
গত ২৪ মে রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট একটি বাজেট সংলাপ। এ সংলাপের আয়োজনে ছিল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের তিনটি শীর্ষস্থানীয় সংগঠন বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি (বিসিএস), বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) ও ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)। তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক এ বাজেট সংলাপে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপি। এ সংলাপে সভাপতিত্ব করেন বেসিস সভাপতি শামীম আহসান।
স্বভাবতই এ সংলাপে আয়োজক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে আসন্ন বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কিছু বাজেট প্রস্তাবনা ছিল। জানা গেছে, সরকারের গৃহীত ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার ঘোষিত ৩০ জুন ২০১৫ সাল পর্যন্ত তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আয়ের ওপর আয়কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা চাইছেন সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবার ওপর এই আয়কর অব্যাহতির সময়সীমা আরও ১০ বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর রাখা হোক। সংলাপে এরা এমনটিই প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া এরা একই সাথে সব ধরনের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ের আয়ের কর অব্যাহতির বাইরে অনেক ক্রেতাই অগ্রিম আয়কর বিধি ‘এআইটি রুল-১৬’ অনুযায়ী আয়কর মওফুক সনদ চান। যেহেতু সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবাদাতা সব প্রতিষ্ঠানই আয়কর অব্যাহতির আওতামুক্ত, সেহেতু প্রতিবারেই সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে ক্রেতাকে আয়কর অব্যাহতির সনদ দেখানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে সংলাপে অংশ নেয়া অনেকেই মন্তব্য করেন। বর্তমানে আইটি পরামর্শ সেবাকে সাধারণ সেবা হিসেবে গণ্য করে অনেক ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ আয়কর কাটা হয়। কিন্তু অনেক আইটি কোম্পানি দেশে ও বিদেশে আইটি পরামর্শ সেবা দিয়ে থাকে। আইটি পরামর্শ সেবাকে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা গণ্য করে এর ওপর থেকে ১০ শতাংশ কর যাতে আর কাটা না হয়, সে বিষয়েও সংলাপে প্রস্তাব করা হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ই-কমার্সকে উৎসাহিত করতে এ খাতের পণ্য ও সেবার লেনদেন ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। তাই প্রস্তাব করা হয়েছে অনলাইনে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে কেনাকাটা, ডিজিটাল সার্টিফিকেট চালু ইত্যাদি উৎসাহিত করতে প্রাথমিকভাবে তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য ই-কমার্সের সব লেনদেনের ওপর থেকে খুচরা বিক্রয় পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের। আইটি খাতের ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বাড়ি ভাড়ার ওপর থেকে ৯ শতাংশ ভ্যাট মওকুফসহ উল্লেখযোগ্য প্রণোদনা থাকা প্রয়োজন বলে আলোচকেরা উল্লেখ করেন।
আমদানি পর্যায়ে আইসিটিসংশ্লিষ্ট প্রায় সব পণ্য বা আনুষঙ্গিক পণ্যের ওপর উৎসে কর ৪ শতাংশ হারে অতিরিক্ত আদায় করা হয়। এই সংগ্রহের ভিত্তি হচ্ছে আনুমানিক ২৬.৬৭ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর। সব শিল্প খাতের সব পণ্যের বেলায় এই অনুমোদন বাস্তবসম্মত নয়। ফলে ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত করের বোঝা বহন করতে হয়। তাই ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের যথাযথ সংশোধন এনে এ সমস্যা দূর করার প্রস্তাবও এসেছে এ সংলাপ অনুষ্ঠানে। সরকার তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবাকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আয়কর অব্যাহতি দিলেও ভ্যাটের ক্ষেত্রে সে সুবিধা দেয়া হয়নি। আলোচকেরা বলেছেন, আয়কর ও ভ্যাটের মধ্যে সমতা আনা দরকার। সংলাপে এই মর্মে আরও প্রস্তাব এসেছে যে, আইসিটি শিল্পের উন্নয়নের জন্য জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালার আলোকে ৭০০ কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করতে হবে, যার কমপক্ষে ১০ শতাংশ বা ৭০ কোটি টাকা আসন্ন বাজেটে বরাদ্দ করতে হবে।
আউটসোর্সিং ও ফিল্যান্সিং উৎসাহিত করতে বিশেষ ব্যবস্থায় এ কাজে নিয়োজিত তরুণদের অর্জিত বিদেশী অর্থ দেশে আনার অনুমোদন দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে বিশেষ নির্দেশ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ প্রস্তাব অত্যন্ত যৌক্তিক। কারণ, ফ্রিল্যান্সারেরা তাদের উপার্জনের অর্থ দেশে আনতে নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হয়। অপরদিকে ইন্টারনেট সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর জন্য নেটওয়ার্কিং যন্ত্রপাতির প্রয়োজন। আইসিটি উন্নয়নের স্বার্থে এসব নেটওয়ার্কিং পণ্য সহজলভ্য করা খুবই দরকার। তাই সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা, সরকার আসন্ন বাজেটে এসব পণ্যের ওপর থেকে বিবিধ শুল্ক প্রত্যাহার করে নেবে। এছাড়া বর্তমানে ফাইবার অপটিক ক্যাবলের জন্য যে ৩৭.৮৩ শতাংশ ভ্যাট ও শুল্ক দিতে হয়, তা কমানোর প্রস্তাবও এসেছে এই বাজেট সংলাপে।
এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে আরও বেশ কিছু প্রস্তাব এসেছে। আমরা মনে করি, আসন্ন বাজেট প্রণয়নের বেলায় এসব প্রস্তাব সুবিবেচনায় নেয়া উচিত। এছাড়া মাসখানেক আগে আইসিটি খাতের শীর্ষ সংগঠন তথা বিসিএস, বেসিস, আইএসপিএবি ও অ্যামটব তাদের নিজ নিজ সংলাপের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বাজেট প্রস্তাবনা রেখেছে। এগুলোও সুবিবেচনার দাবি রাখে। আমরা আশা করব, অর্থমন্ত্রী আসন্ন বাজেটকে একটি আইসিটিবান্ধব বাজেট করে তোলার ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবেন। ভুললে চলবে না, আইসিটির প্রভাব আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতে প্রয়োগ না হলে জাতীয়ভাবে অগ্রগতি অর্জনের কোনো সুযোগ আমরা পাব না।