• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > বিশ্বকাপ ফুটবলে নজরকাড়া নতুন প্রযুক্তি
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: তাজুল ইসলাম
মোট লেখা:২২
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৪ - জুন
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
প্রযুক্তি
তথ্যসূত্র:
রির্পোট
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
বিশ্বকাপ ফুটবলে নজরকাড়া নতুন প্রযুক্তি
১৯৭০ সালে মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত হয় ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা। সেই থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা আর নতুন প্রযুক্তি যেনো হাত ধরাধরি করে চলেছে। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় সর্বপ্রথম ম্যাচগুলোর রঙিন সম্প্রচার শুরু হয়। বলা যায়, মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে টেলিভিশনে নতুন প্রযুক্তি ও বিশ্বকাপের মধ্যে সম্পর্কের সূচনা ঘটে। এরপর ২০০৬ সালে জার্মানিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলে প্রথমবারের মতো খেলাগুলো সস্প্রচারিত হয় হাই ডেফিনিশন টিভিতে। আর ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলাগুলো প্রথমবারের মতো সরাসরি দেখা যায় ইন্টারনেট স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে। তখন কিছু কিছু খেলা দেখা গেছে থ্রিডি টেলিভিশনেও।

এই জুনে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা ২০১৪। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের এবারের এই বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা ব্যতিক্রম কিছু নয়। এই বিশ্বকাপের প্রতিটি ক্ষেত্রে থাকছে প্রযুক্তির প্রভাব। প্রযুক্তির কল্যাণে এই খেলা বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি ফুটবল আমুদে মানুষ উপভোগ করতে পারবেন তাদের ট্যাবলেট, ফোন, ওয়েব ও টেলিভিশনের মাধ্যমে। ফলে সম্ভবত এবারই বিশ্বে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক দর্শক বিশ্বকাপ ফুটবল উপভোগ করার সুযোগ পাবেন। এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবল আসরে যেমনি ব্যবহার হবে অন-ফিল্ড টেকনোলজি, তেমনি ব্যবহার হবে অফ-ফিল্ড টেকনোলজি। অন-ফিল্ড টেকনোলজির মধ্যে আছে : গোললাইন টেকনোলজি ও জিপিএস ট্র্যাকিং। আর অফ-ফিল্ড টেকনোলজিতে আছে : ট্র্যাক চেক, ভিডিও রিপ্লে ও বিগ স্ক্রিন, সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্রডকাস্টিং।
শুরুতেই রোবটের ছোঁয়া

১২ জুন, ২০১৪। ব্রাজিলের স্থানীয় সময় বিকেল ৫টা বাজার আগ মুহূর্ত। স্থান ব্রাজিলের রাজধানী সাও পাওলোর ‘অ্যারিনা কোরিন্থিয়ানস’ স্টেডিয়াম। একজন ব্রাজিলীয় প্যারাপ্লেজিক (শরীরের নিচের অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি, যিনি পা নড়াচড়া করার ক্ষমতা রাখেন না) তরুণ তার হুইল চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াবে, হেড যাবে মাঝমাঠ বরাবর এবং একটি বলে লাখি মেরে উদ্বোধন করবে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার। এ ক্ষেত্রে যে টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো একটি মাইন্ড কন্ট্রোল রোবটিক এক্সোস্কেলেটন অর্থাৎ মন-নিয়ন্ত্রিত রোবট দেহকাঠামো। এই তরুণের জটিল ও নজরকাড়া স্যুটটি তৈরি করা হয়েছে হালকা সঙ্কর পদার্থ থেকে এবং এটি চলে হাইড্রোলিক পাওয়ার বা পানি-বিদ্যুতে। এর কাজ খুবই সরল। যখন একজন প্যারাপ্লেজিক ব্যক্তি এই স্যুটের ভেতরে ঢুকে পড়ে, তখন মেশিনেই সেই কাজটি করে, যা ওই ব্যক্তির পায়ের পেশী করতে পারে না। একটি আন্তর্জাতিক প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানী দল বছরের পর বছর ধরে গবেষণা করে এই এক্সোস্কেলেটন বা দেহের বহিঃকাঠামোটি তৈরি করেছেন। ‘ওয়াক অ্যাগেইন’ প্রকল্পের মাধ্যমে এরা এ কাজটি সম্পন্ন করেন। এর রোবটকর্মটি সম্পন্ন করেছেন মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ডন চেং। আর এক্সোস্কেলেটনটি বানিয়েছেন ফরাসি গবেষকেরা। এই টিম এখানে ব্যবহার করেছে মানুষের ব্রেন ওয়েভ বা মস্তিষ্ক তরঙ্গ। মস্তিস্ক তরঙ্গের সিগন্যাল ব্যবহার করা হয়েছে রোবটের অঙ্গ-প্রতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের কাজে।

এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে রোবটের ব্যবহার এখানেই শেষ নয়। এই বিশ্বকাপ ফুটবল ফ্যানদের নিরাপত্তা দেয়ার কাজে ব্যবহার হচ্ছে ড্রোন ও রোবট। বিশ্বকাপ ফুটবল খেলায় খেলোয়াড়দের পাশাপাশি দর্শকদের নিরাপত্তা নিয়ে রয়েছে উদ্বেগ। সে উদ্বেগ দূর করতে সহায়তা নেয়া হচ্ছে প্রযুক্তির। মানবশূন্য ইসরায়েলি ড্রোন বিমানগুলো ম্যাচগুলোর সমবেত দর্শকদের মনিটরিং করবে তাদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য। এ ছাড়া সিকিউরিটি সার্ভিসের সদস্যদের হাতে থাকবে ‘PackBot 510’ নামের রোবট। এই রোবটের প্রস্ত্ততকারক কোম্পানি iRobot এসব রোবট ফিফাকে সরবরাহ করবে। সত্যি কথা বলতে, এই রোবট আসলে তৈরি করা হয়েছে সৈনিকদের মাল্টিপল মিশনে ও পাবলিক সেফটি প্রফেশনালদের ব্যবহারের জন্য। এর ফলে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে পরিস্থিতিগত সতর্কতা জোরদার হবে, ঝুঁকি কমবে, বাড়বে মিশনের সাফল্য। আরেকটি নতুন উদ্ভাবিত প্রযুক্তি প্রথমবারের মতো ব্যবহার হবে এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলের আসরে। রেফারিরা এবার ব্যবহার করবেন ভ্যানিশিং স্প্রে পেইন্ট। এর মাধ্যমে রেফারি সেই জায়গাটি সহজেই নির্ধারণ করে দিতে পারবেন, যেখন ফ্রিকিক নিতে হবে। এছাড়া রেফারি ১০ গজ লম্বা একটি লাইন টেনে দিতে পারবেন, যাতে ফ্রিকিক নেয়ার সময় এই দাগের ভেতরে এসে বলের কাছাকাছি আসতে না পারেন ডিফেন্ডিং টিমের খেলোয়াড়েরা। এই স্প্রে পেইন্ট দিয়ে টানা রেখা এক মিনিটের মধ্যেই আবার অদৃশ্য হয়ে যাবে। এ ছাড়া রেফারি ব্যবহার করবেন কিছু ওয়্যারেবল টেকনোলজি।
সনি’র ফোর কে কভারেজ

সনি কর্পোরেশন ও ফিফা যৌথভাবে ঘোষণা দিয়েছে, ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্যাপকভাবে ব্যবহার হবে সনি ফোর কে (4K) টেকনোলজি কো-অপারেশন প্রোগ্রাম। ফিফা অফিসিয়াল পার্টনার হিসেবে সনির রয়েছে ফোর কে প্রোডাক্ট লাইন, রেডিও ও টেলিভিশন প্রফেশনাল ইক্যুইপমেন্ট থেকে শুরু করে বেশ কয়েক ধরনের প্রফেশনাল সলিউশন। সেই সাথে ফোর কে টিভি, হোম প্রজেক্টর, ক্যামেরা ও কনজ্যুমার প্রোডাক্ট। সনি প্রোভাইড করে ফোর কে সলিউশন শুটিং, মেকিং ও ওয়ার্কের সুবিধা। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় রেকর্ড করা নতুন ফোর কে আল্ট্রা হাই ডেফিনিশন ফুটেজগুলো সনি খেলার পর এর প্রমোশনাল টুল হিসেবে প্রদর্শন করবে। সেই সাথে ফুটেজগুলোর রেজ্যুলেশনেও মনিটর করবে সনি। সনি ও ফিফা যৌথভাবে প্রযোজনা করবে ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের অফিসিয়াল মুভি সংস্করণ। এই মুভি ফিফার মাধ্যমে অনলাইনে ছাড়া হবে। শর্টার প্রেজেন্টেশনগুলো বিশ্বব্যাপী ইলেকট্রনিক স্টোরগুলোতে পাঠানো হবে ফোর কে টেলিভিশন ও মনিটরে ডিসপ্লে’র জন্য। বিশ্বকাপ খেলা চলার সময় সেখানে সনির বুথে আগ্রহীরা অন্যান্য কোর কে প্রেজেন্টেশন উপভোগ করতে পারবেন। ২০১৪ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবলে সনির উপস্থিতি হবে একটি প্রমোশনাল জব। সেই সাথে ফোর কে আল্ট্রা হাই ডেফিনিশনে স্পোর্টস ফিল্মিংয়ের ক্ষেত্রে কঠিন পরীক্ষা। এই ওয়ার্ল্ড কাপ হবে সনির প্রোডাক্টের জন্য একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র। এই ইভেন্ট ফিল্মিংয়ে সনির কোন কোন প্রোডাক্ট টেস্ট করা হবে, এর একটি তালিকা প্রকাশ করেছে সনি। এসব প্রোডাক্টে অন্তর্ভুক্ত আছে : সাইন আল্ট্রা ফোর কে ডিজিটাল ক্যামেরা, ৩০ ইঞ্চি ফোর কে ট্র্যান্সমিটার, এলসিডি প্রফেশনাল মনিটর, মাল্টিপোর্ট এভি স্টোরেজ ইউনিট ও মাল্টি ফরম্যাট প্রোডাকশন সুইচার প্রসেসর। সনির সর্বশেষ প্রযুক্তি টেলিভিশনে খেলা উপভোগকে সত্যিকারের জীবন্ত করে তুলবে। দর্শকেরা যখন ঘরে খেলা দেখবেন, তখন মনে হবে যেনো স্টেডিয়ামে বসেই মাঠের খেলা দেখছেন।

জিপিএস ট্র্যাকিং
অন-ফিল্ড স্পোর্টস পারফরম্যান্সের জন্য প্রযুক্তির উন্নতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মোশন অ্যানালাইসিস টেকনোলজি আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে ইনডিভিজুয়াল মনিটরিংয়ের। এটি কোচ ও ফিটনেস স্টাফদের দেয় প্রয়োজনীয় ফিডব্যাক। জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) টেকনোলজির মাধ্যমে অবস্থান ও চলার গতি দিয়ে পারফরম্যান্স অ্যানালাইসিস করা যায়। স্পোর্টসের ক্ষেত্রে জিপিএস ট্র্যাকিং বিষয়ে আমাদের আলোচনা ‘ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১৪’ সম্পর্কিত। জিপিএস ট্র্যাকিং একটি শক্তিশালী ও উদ্ভাবনামূলক টুল, যা বিশ্বের নানা দেশের ফুটবল কমিউনিটি ইতোমধ্যেই ব্যবহার করেছে। ফুটবলে জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে খেলোয়াড়দের মনিটরিং করা যায়। মনিটর করা যায় বলও। এর মাধ্যমে অত্যন্ত সঠিকভাবে অফসাইড ধরা যায়। ফুটবল খেলায় অফসাইড হওয়া-না হওয়া নিয়ে প্রচুর বিতর্ক চলে এসেছে। জিপিএস ট্র্যাকিং এই বিতর্কের অবসান ঘটাবে। দু’টি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি এই প্রযুক্তি সরবরাহ করছে। এগুলো হলো : জিপিএস পোর্টস ও ক্যাটাপুল্ট স্পোর্টস।

ভিডিও রিপ্লে
ফুটবল খেলায় ব্যবহার করার মতো আরেকটি টুল হচ্ছে ‘ভিডিও রিপ্লে’। এর মাধ্যমে দর্শকেরা অ্যাকশন রিভিউ করতে পারবেন। এটি রেফারিদের সহায়তা করবে যথার্থ সিদ্ধান্ত নিতে। এটি একটি অন-ফিল্ড টেকনোলজি। এটি ব্যবহার হয় স্টেডিয়ামের বড় স্ক্রিন ও মাঠের বাইরের ভিডিওতে। এটি একটি টেকসই হাইটেক হলেও ফিফা এটি ব্যবহারে এখনও বাধা সৃষ্টি করছে। এরই মধ্যে এ নিয়ে ‘ভিডিও রিপ্লে কন্ট্রোভার্সি’ নামে একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

বিগ স্ক্রিনের ব্যবহার
গত এক দশকে বিশ্বের প্রায় সব প্রফেশনাল ফুটবল টিমের স্টেডিয়ামগুলোতে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। এগুলোতে যুক্ত করা হয়েছে হালনাগাদ প্রযুক্তি। এর মধ্যে আছে বড় জাম্বরটন স্ক্রিন। এর মাধ্যমে খেলার আকর্ষণীয় অ্যাকশনগুলো দেখানো হয়। এবারের বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্যবহার হচ্ছে অতি উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ বিগ স্ক্রিন।

ব্রাজুকা : বিশ্বকাপের ফুটবল
ব্রাজুকা (Brazuca) হচ্ছে এবারের ব্রাজিল বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার জন্য নির্ধারিত বল। নতুন এই ফুটবল ডিজাইন করেছে অ্যাডিডাস। ১৯৭০ সালের পর যতগুলো বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর বসেছে, প্রতিটিরই বল ডিজাইন করে আসছে অ্যাডিডাস। ব্রাজুকা বলটি উন্মোচন করা হয় গত বছরের ডিসেম্বরে। তখন ঘোষণা দেয়া হয় ২০১৪ সালের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলে এই বলটি ব্যবহার হবে। Brazuca নামটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে। ব্রাজিলের ১০ লাখ ফুটবল আমুদে মানুষের ভোটের মাধ্যম এই নামটি গৃহীত হয়। এই নামটি সেখানকার স্থানীয় একটি পদবাচ্য, যায় মাধ্যমে বর্ণিত ব্রাজিলীয় জাতীয় গর্ব। এর রং ও ডিজাইন ব্রাজিলের ফুটবলের সাথে সংশ্লিষ্ট গৌরবের প্রতীক। সেখানকার ফুটবলের প্রতীকতা ও বলের নন্দনতত্ত্ব ছাপিয়ে বলে সংযোজিত হয়েছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। ব্রাজুকা প্রচলিত আর সব ফুটবল থেকে আলাদা। এটি তৈরি করা হয়েছে ছয়টি ইন্টারলকিং পলিইউরেথেইন প্যানেল দিয়ে। আর এই বলটির গায়ে রয়েছে হাজার হাজার ছোট ছিদ্র। এই ডিজাইন করা হয়েছে বলের গঠন সুদৃঢ় ও গতি বাড়ানোর জন্য। আগের বিশ্বকাপের ফুটবলগুলো বেশি পাতলা কি না, বল উড়ে যাওয়ার সময় এর গতি অস্থির ছিল কি না, এ ক্ষেত্রে বলের গড়নে কোনো ভুল ছিল কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। ব্রাজুকা তৈরির ক্ষেত্রে নানা ধরনের পরীক্ষা চলে গত আড়াই বছর ধরে। এবারের ব্রাজুকা বলের ব্যাপারে অনুমোদন পাওয়া গেছে বিশ্বের ৬০০ সেরা খেলোয়াড়ের। এদের মধ্যে রয়েছেন : লিওনেল মেসি, ইকার ক্যাসিয়াস, বাস্টিয়ান সোয়েনস্টিগার ও ফ্রান্সের সাবেক ফুটবলার জিনেদিন জিদান। অ্যাডিডাস এ ব্যাপারে আস্থাশীল যে, ব্রাজুকার প্রযুক্তি এবারের ফিফা বিশ্বকাপের চাহিদা যেমন মেটাবে, তেমনি সব ফিফা মেট্রিক্সকে ছাড়িয়ে যাবে। সব অবস্থায় এই বল টপ পারফরম্যান্স নিশ্চিত করবে। অ্যাডিডাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে- এই বলটি ৬টি অনন্য সমমাত্রিক প্যানেলসহ এর কাঠামোগত উদ্ভাবন এবং সেই সাথে এর উপরিভাগের আলাদা কাঠামো উন্নত গ্রিপ, টাচ, স্ট্যাবিলিটি ও অ্যাক্রোডিনামিকস নিশ্চিত করবে। ব্রাজুকা বলটি ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েই তৈরি করা হয়েছে, যাতে সব অবস্থায় টপ পারফরম্যান্স নিশ্চিত হয়।

বলা দরকার, অ্যাডিডাসের সরবরাহ করা এই ব্রাজুকা বল, সেটা তৈরি হয়েছে পাকিস্তানের খাজা আকতারের কারখানা থেকে। ২০০৬ সালে বিশ্বকাপ যখন হচ্ছিল, তখনই খাজা আকতার স্বপ্ন দেখেছিলেন তার কারখানার তৈরি ফুটবল দিয়ে খেলা হবে বিশ্বকাপ ফুটবল। তার সে স্বপ্ন আজ বাস্তব সত্যিতে পরিণত হতে যাচ্ছে ব্রাজিল বিশ্বকাপে। তার কারখানার তৈরি ব্রাজুকা বল এখন বিশ্বকাপ টুর্নামেন্টে ব্যবহার হওয়ার অপেক্ষায়! ব্রাজুকা বল বানানোর জন্য অ্যাডিডাস চুক্তি করেছিল চীনের সাথে। চীন তা পালনে ব্যর্থ হলে পরে দেয়া হয় খাজা আকতারের ফরোয়ার্ড স্পোর্টসকে।

গোললাইন টেকনোলজি
ফুটবলটি একদম গোললাইনের কাছাকাছি অথবা গোললাইনের ওপর কিংবা গোললাইনের কিছুটা পেরিয়ে গেছে। গোলকিপার লাফ দিযে বলটাকে জড়িয়ে ধরেছেন। দর্শক গ্যালারিতে দর্শকদের একাংশ গোল বলে চিৎকার করে উঠেছে। হয়তো অপর অংশের কপালে চিন্তার চাপ, গোলটা কি আসলেই হয়েছে? এমনই অবস্থায় রেফারি দুই ধরনের সিদ্ধান্ত দিতে পারেন : বাঁশি বাজিয়ে জানিয়ে দিতে পারেন গোল হয়েছে। কিংবা ঘোষণা করতে পারেন গোল হয়নি। এই সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে দর্শকদের কোন অংশ আনন্দে আত্মহারা হবে আর কোন অংশ হবে বিমর্ষ। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত যে অংশের বিরুদ্ধে যায়, সে অংশের দর্শকেরা বিতর্কেরও জন্ম দিতে পারেন। বলতে পারেন, গোল হয়েছে বা গোল হয়নি। বলতে পারেন, রেফারি পক্ষপাতদুষ্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কেউ কেউ এমনও বলতে পারেন- রেফারি একটা পাগল, নইলে কেনো এমন ভুল সিদ্ধান্ত দেবেন।
গ্রামে এ ধরনের বিতর্ক প্রায়ই চলতে দেখা যায়। কেউ হয়তো বলবেন, বল গোললাইন পার হয়েছে, অতএব গোল হয়েছে। আবার কেউ বলবেন, গোললাইন পার হয়নি, অতএব গোল হয়নি। আবার এমনও বলা হতে পারে- বল গোললাইনের ওপর উঠলেও বেশিরভাগ বল ভেতরে কিংবা বাইরে ছিল। এ নিয়ে গ্রামে গ্রামে প্রবল ঝগড়া-ঝাটি ও খুনোখুনি হতেও আমরা অনেক সময় দেখেছি।

এই বিতর্ক আর ঝামেলা এড়াতে টেকনোলজি এগিয়ে এসেছে আমাদের সহায়তা করতে। গোললাইন টেকনোলজি (জিএলটি) হচ্ছে এ ক্ষেত্রে অতি উঁচু ধরনের সঠিক ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে একদম সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায়, বল গোলমুখ বা গোললাইন পার হয়েছে কি হয়েছে না, গোল হয়েছে কি হয়েছে না। প্রযুক্তি আমাদের সামনে সে সুযোগ এনে হাজির করেছে। প্রথমবারের মতে ব্রাজিলে এই জুনে শুরু হতে যাওয়া ফিফা বিশ্বকাপে ব্যবহার হবে এই গোললাইন টেকনোলজি। জার্মানি-ভিত্তিক এই সিস্টেমের নাম Goal Control 4D। এর বিপরীতে এমনই ধরনের Hawk-Eye নামের আরেকটি ব্রিটিশ সিস্টেম রয়েছে। ব্রিটিশেরা জার্মানদের সাথে প্রতিযোগিতা করেছে, যাতে ফিফা কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ সিস্টেম আসন্ন বিশ্বকাপে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ অনুমোদন পায় জার্মানদের ‘গোল কন্ট্রোল ৪ডি’ সিস্টেমটিই। ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য এবারের বিশকাপ ফুটবলের জন্য তৈরি প্রতিটি স্টেডিয়ামে ‘গোল কন্ট্রোল ৪ডি’ সিস্টেম স্থাপন করতে খরচ হবে ২ লাখ ইউরো। তা প্রতিটি ম্যাচে ব্যবহারের জন্য চালু রাখতে খরচ হবে ৩ হাজার ইউরো। এই সিস্টেম ব্যবহার করে ১৪টি হাইস্পিড ক্যামেরা। এগুলো বসানো হয় স্টেডিয়ামের পিচের চারপাশের ছাদে ও ক্যাটওয়ার্কে। প্রতিটি গোলের দিকে তাক করানো আছে সাতটি করে ক্যামেরা। এসব ক্যামেরা প্রতি সেকেন্ডে ৫০০ ফ্রেম রেকর্ড করতে সক্ষম। সর্বোচ্চ ৫ মিলিমিটার পর্যন্ত সঠিকভাবে এটি গোলের সিদ্ধান্ত জানাতে সক্ষম। ক্যামেরাগুলো সংযুক্ত রয়েছে শক্তিশালী ইমেজ প্রসেসিং সফটওয়্যারের সাথে। এর মাধ্যমে খেলার মাঠের সব চলমান বস্ত্ত চিহ্নিত ও ফিল্টার করা যাবে, যাতে করে সবশেষে শুধু বলের মুভমেন্টই ছবিতে অবশিষ্ট থাকে। এই সিস্টেম বলের একদম সঠিক ভার্টিক্যাল (আনুলম্বিক) ও হরাইজন্টাল (আনুভৌমিক) অবস্থান নির্ণয় করতে পারে। মাত্র কয়েক মিলিমিটার মাপ পর্যন্ত এই অবস্থান যথার্থভাবে নির্ণয় এর মাধ্যমে সম্ভব। ‘গোল কন্ট্রোল ৪ডি’ সিস্টেম খেলার সময়ে বল চলাচলের গতিপথ ধরে রাখে। বলটি গোললাইন পার হওয়ার সময় প্রতি মিলিসেকেন্ড সময়ে এর অবস্থান কোথায় ছিল, তা জানিয়ে দিতে সক্ষম এই সিস্টেম। আর সে নোটিসটি পাওয়া যাবে সরাসরি একটি বিশেষ হাতঘড়িতে।

অতএব আপনি যদি ঘরে বসে আপনার হাই ডেফিনিশন টেলিভিশনে সুপার স্পোর্টসে টিউনিং করে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখেন, তবে রেফারি যা দেখতে পাবেন না, তাও আপনি ঘরে বসেই দেখতে পাবেন। স্পষ্ট দেখতে পাবেন অফসাইড হলো কি হলো না, বল গোললাইন পার হলো কি হলো না, গোলরক্ষক বল ধরার সময় ঠিক কোন অবস্থানে বলটি ছিল, কোন খেলোয়াড় কী মাত্রায় ফাউলটি করলেন- ইত্যাদি সবই স্পষ্ট জেনে যাবেন আপনি। আর এজন্য ধন্যবাদ পাওয়ার দাবি রাখে হালনাগাদ প্রযুক্তি।

ফিফার গোললাইন টেকনোলজি প্রোভাইডার হওয়ার জন্য অনেক কোম্পানিই প্রতিযোগিতায় ছিল। আর সে প্রতিযোগিতার দৌড়ে জিতে ‘Goal Control GmbH’ নামের কোম্পানি হতে পেরেছে ফিফার গোললাইন টেকনোলজির অফিসিয়াল প্রোভাইডার ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতার জন্য। এজন্য গোল কন্ট্রোল জিএমবিএইচ-কে ‘ফিফা কোয়ালিটি প্রোগ্রাম’ মোকাবেলা করে অর্জন করতে হয়েছে ‘ফিফা কোয়ালিটি পিআরও সার্টিফিকেট’। এই সার্টিফিকেট হচ্ছে ফুটবল আমুদের এটুকু নিশ্চিত করার উপায় যে, এরা যে সিস্টেম বাস্তবায়ন করছে তা ব্যাপকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরই গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গোল কন্ট্রোল জিএসবিএইচ-কে টেস্ট করা হয়েছে ২০১৩ সালের ‘ফিফা কনফেডারেশন কাপ ব্রাজিল’-এ। সেখানে দেখা গেছে তা একটি উপযুক্ত টেকনোলজি।

পোর্টেবল আপলিঙ্ক সলিউশন
বরাবরের মতো বিশ্বকাপ ফুটবলের এবারের খেলাটি যতসংখ্যক দর্শক উপভোগ করবেন মাঠে উপস্থিত থেকে, তার চেয়েও অনেক অনেক গুণ বেশি দর্শক তা উপভোগ করবেন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোটি কোটি ফুটবল আমুদে দর্শককে টেলিভিশনে সরাসরি খেলা দেখাকে কেউ কেউ ‘সেকেন্ডহ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স’ বলেও অভিহিত করেন। কিন্তু এ পর্যন্ত আমরা বিশ্বকাপ ক্রিকেট কিংবা বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলাগুলো টেলিভিশনে সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছে শুধু ঘরে বসেই। কোনো জরুরি কাজে হঠাৎ করে বাইরে যেতে হলে, তখন সরাসরি সে খেলা দেখার সুযোগটা হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা ব্রাজিলের বারোটি শহরের মানুষ পোর্টেবল আপলিঙ্ক সলিউশন ‘LeveU’-এর মাধ্যমে ঘরের বাইরে থাকা অবস্থায়ও সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারবেন। এ কোম্পানি ব্রাজিলের ১২টি হোস্ট সিটিতে ২০০টির বেশি পোর্টেবল লাইভইউ ইউনিট বসিয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা ভিডিও স্ট্রিমিং সাপোর্ট দেয়া হবে খেলা চলার সময়ে। ভিডিও সম্প্রচার ছাড়াও লাইভইউ ডাটাব্রিজের মাধ্যমে হটস্পট কানেক্টিভিটিও পাওয়া যাবে ডাটাব্রিজের সাহায্যে। একটি লাইভইউ ইউনিটকে প্রয়োজনে একটি হটস্পটে রূপ দেয়া যাবে যেকোনো ধরনের ডিভাইসে যেকোনো ধরনের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য।
‘লাইভইউ’ হচ্ছে তেলআবিব-ভিত্তিক একটি ইসরায়েলি কোম্পানি। এটি টেলিভিশন ব্রডকাস্টারদের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উৎপাদন করে, যাতে করে ওয়্যারলেস সেলুলার নেটওয়ার্কের মাধ্যমে লাইভ ভিডিও লিঙ্কের সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। এ কোম্পানির উত্তর আমেরিকার সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সির হ্যাকেনসেকে। পোর্টেবল লাইভ ভিডিও অ্যাকুইজিশন, কন্ট্রিবিউশন ও ম্যানেজমেন্ট সল্যুশনের ক্ষেত্রে এটি একটি শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি। এর পুরস্কার বিজয়ী প্রযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে সরাসরি ভিডিও ট্রান্সমিশন সম্ভব। ব্যাকপ্যাক থেকে শুরু করে স্মার্টফোনের জন্য লাইভইউ সব ধরনের ডিভাইসের জোগান দেয় লাইভ ভিডিও কভারেজের জন্য।

লাইভইউ পার্টনার করেছে ব্রাজিল-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইউসিএএন ডিজিটাল ট্র্যান্সমিশনকে, যা লাইভইউ টেকনোলজি অথবা অন্যান্য উপগ্রহ ব্যবহার করে অডিও ও ভিডিও সরবরাহে সহায়তা দেবে। লাইভইউ ইউসিএএন-কে এর আপলিঙ্ক সলিউশনের পোর্টফোলিও ব্যবহার করতে দেবে। এটি স্থানীয় ও বিদেশী সাংবাদিকদের রিপোর্টিংয়ে সহায়তা করবে। বিশ্বের স্পোর্টস নিউজ নেটওয়ার্ক, নিউজ এজেন্সি, স্থানীয় স্টেশন ও ব্রডকাস্টারগুলো ওয়ার্ল্ড কাপ কভারেজে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করবে লাইভইউ টেকনোলজি। লাতিন আমেরিকার ইন্টারনেট-ভিত্তিক কোম্পানি TERR-A এই মর্মে নিশ্চিত করেছে যে, এরা লাইভইউ টেকনোলজি ব্যবহার করবে।
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৪ - জুন সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস