প্রশান্ত মহাসাগরের সবচেয়ে গভীর এলাকা চষে বেড়াবার জন্য এখন প্রায় প্রস্ত্তত রোবট সাবমেরিন নারিয়াস। মহাসাগরের তলদেশে কারা রাজত্ব করছে তা নিশ্চিত হতেই এমন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এটাই হতে যাচ্ছে প্রথম কোনো স্বায়ত্তশাসিত যান, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের ১১ হাজার মিটার (৩৬ হাজার ৮৯ ফুট) গভীরের নানা তথ্য তুলে আনবে। মহাসাগরের ‘চ্যালেঞ্জার ডিপ’ নামে পরিচিত এলাকায় ওই গভীরতা রয়েছে। এর আগে মাত্র দুটি যান ওই গভীরতায় পৌঁছতে পেরেছে। এর একটি ছিল মানুষচালিত এবং অপরটি দূর নিয়ন্ত্রিত। রোবট সাবমেরিন নারিয়াস তৈরিতে ব্যয় হয়েছে ৫০ লাখ ডলার।
নারিয়াসের একজন ডিজাইনার এবং উডস হোল ওসেনোগ্রাফিক ইনস্টিটিউশনের অ্যান্ডি বোওয়েন বলেছেন, আমরা দেখেছি ১ হাজার মিটার, ৪ হাজার মিটার এবং ৮ হাজার মিটার গভীরতায় রোবটটি কেমন কাজ করে। ফলাফলে সন্তুষ্ট হওয়ার কারণেই এবার ১১ হাজার মিটার গভীরতায় তাকে পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
সাউদাম্পটনে ন্যাশনাল ওসেনোগ্রাফি সেন্টারে ডিপ প্লাটফর্মস গ্রুপের প্রধান আয়ান রোস এই প্রকল্পকে বড় ধরনের কারিগরি বা প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, সাড়ে ৬ হাজার মিটারের (২১ হাজার ৩২৫ ফুট) মধ্যে গভীরতা হলে নারিয়াস তার ডিজাইনের কারণেই খুব ভালো কর্মদক্ষতা দেখাতে পারবে না। কিন্তু সাড়ে ৬ হাজার মিটার থেকে ১১ হাজার মিটার পর্যন্ত তার কর্মতৎপরতা চাঞ্চল্য ফেলে দেবার মতো। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বিশেষ করে ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং জাপানের গবেষকরা প্রকল্পটির প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছেন। রোবট যান দিয়ে সাগরতল চষে বেড়ানোর প্রযুক্তি তারাও পেতে আগ্রহী।
মহাসাগরের সবচেয়ে গভীর এলাকা হিসেবে পরিচিত চ্যালেঞ্জার ডিপের অবস্থান পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের গুয়াম দ্বীপের মারিয়ানাস ট্রেঞ্জের কাছে। গভীরতা ১১ হাজার মিটার অর্থাৎ দুই কিলোমিটারের বেশি। এভারেস্ট পর্বতশৃঙ্ঘের দৈর্ঘ্যের চেয়ে গভীর এটি। সমুদ্রপৃষ্ঠে কোনো বস্ত্তর ওপর যতটা চাপ তৈরি হয় ১১ হাজার মিটার গভীরে, সে চাপ হয় ১ হাজার ১শ’ গুণ বেশি। আর এ কারণেই আজ পর্যন্ত মাত্র দুটি যান ওই গভীরতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। তৃতীয়টি হতে যাচ্ছে রোবট নারিয়াস।
অ্যান্ডি বোওয়েন মনে করেন, প্রকৌশলের দিক থেকে চিন্তা করলে এমন কঠিন চাপে টিকে থাকার মতো যান তৈরি করা নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার। স্বায়ত্তশাসিত যানের ক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জের মাত্রা আরো বেশি।
১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে সুইস নির্মিত ট্রায়েস্ট নামের ডুবোযানে করে প্রথম মহাসাগরের ওই তলদেশ স্পর্শ করেছিলেন জ্যাক পিকার্ড এবং ডন ওয়ালস। স্টিলের তৈরি ওই যানের ব্যাস ছিল ২ মিটার (৬ ফুট)। সাথে যুক্ত ছিল ১৫ মিটার দীর্ঘ (৫০ ফুট) পেট্রোলের ট্যাঙ্ক। ৯ ঘণ্টার ওই মিশনে দুই ব্যক্তি গভীর তলদেশে মাত্র ২০ মিনিট অবস্থান করতে সক্ষম হন। এ সময় গভীরতা মাপা হয় ১০ হাজার ৯১৬ মিটার (৩৬ হাজার ৮১৩ ফুট)।
এ ঘটনার ৩৫ বছর পর জাপানের কাইকো নামের একটি দূর নিয়ন্ত্রিত যান সেখানে গিয়েছিল। তখন সে গভীরতা ছিল ১০ হাজার ৯১১ মিটার (৩৫ হাজার ৭৯৭ ফুট)। কাইকোকে জ্বালানি দেয়া এবং নিয়ন্ত্রণের কাজটি করা হয় সমুদ্রপৃষ্ঠে অবস্থান করা একটি জাহাজ থেকে। এই যানটি ক্যাবল সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ২০০৩ সালে মহাসমুদ্রে হারিয়ে যায়।
এখন যেসব ডুবোযান রয়েছে সেগুলো সাড়ে ৬ হাজার মিটার পর্যন্ত গভীরতায় যেতে পারে। এদের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা সাগরতলের ৯৫ শতাংশ এলাকায় চোখ রাখতে সক্ষম হন। নারিয়াসকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে বিজ্ঞানীরা সাগরতলের পুরোটাই দেখতে পারেন। জাপানের কাইকোর মতো তারের সংযোগ এতে থাকছে না। এটি সম্পূর্ণ পৃথক এবং স্বায়ত্তশাসিত একটি যান। কাইকো জরিপ চালাতে পারতো একটি নির্দিষ্ট এলাকায়, নারিয়াসের ক্ষেত্রে সে ধরনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। অনেক বেশি এলাকায় সে বিচরণ করতে পারবে।
মিশনের চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে দুটি পৃথক কনফিগারেশনে পরিচালিত হবে নারিয়াস। সে একাও ছুটতে পারবে, আবার ক্যাবল সংযোগের মাধ্যমেও একে চালানো যাবে। বোওয়েন বলেছেন, মাদারশিপে থাকা অপারেটরের সহযোগিতা ছাড়াই নারিয়াস তার মিশন চালাতে পারবে। এর সে স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে মিশন সম্পর্কে তার হার্ডডিস্কে আগে থেকেই প্রোগ্রাম দেয়া থাকবে। বিশেষ ধরনের কমপিউটার হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার ব্যবহার হয়েছে রোবট নারিয়াস তৈরিতে। এতে রয়েছে পর্যাপ্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ব্যাটারি। আরো ব্যবহার করা হয়েছে কেমিক্যাল সেন্সর, সোনার এবং ডিজিটাল ফটোগ্রাফি। মিশন শেষ করে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মাদারশিপের কাছে ফিরে আসবে এবং তখন একে কনভার্ট করা যাবে একটি রিমোট অপারেটেড ভেহিক্যালে।
নারিয়াসে সংযুক্ত করা হচ্ছে একটি যান্ত্রিক হাত, যাতে করে সে সাগরতল থেকে নমুনা সংগ্রহ, কোনো যন্ত্রপাতি বা ক্যাবল স্থাপনে সক্ষম হয়। মাদারশিপ থেকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তার সঙ্গেই ক্যাবল সংযোগ রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে।
এমন একটি অত্যাধুনিক যান তৈরি করতে প্রকৌশলীরা ব্যবহার করেছেন নতুন প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি। অধ্যাপক ক্রিস গারম্যান বলেছেন, দশকের পর দশক ধরে আমরা যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছি নারিয়াসের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করা হয়নি। মাদারশিপের সঙ্গে যুক্ত রাখার জন্য এর সঙ্গে কোনো ক্যাবল জুড়ে দেয়া হয়নি। প্রচলিত ডুবোযানে একটি স্টিল কেসিং, পানির নিচের দিকে যাওয়ার জন্য তামার এবং উপাত্ত সংগ্রহের জন্য অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল থাকে। কিন্তু ১১ হাজার মিটার গভীরে টিকে থাকার মতো কোনো ক্যাবল এখনো তৈরি হয়নি। তাই নারিয়াসের ক্ষেত্রে এসব অচল। জাপানের কাইকোর সীমাবদ্ধতা ছিল সেখানেই। বিদ্যুৎ বা জ্বালানির জন্য নারিয়াসে ব্যবহার করা হয়েছে রিচার্জ উপযুক্ত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি, যা কিনা ব্যবহার করা হচ্ছে ল্যাপটপ কমপিউটারে। নিয়ন্ত্রণ এবং তথ্য-উপাত্ত রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে পাঠানোর জন্য ব্যবহার করা রয়েছে চুল পরিমাণ প্রশসেত্মর ফাইবার অপটিক ক্যাবল। আর এ সবকিছুর জন্যই তার পক্ষে ২০ ঘণ্টা ডুবে থাকা সম্ভব হবে।
অধ্যাপক গারম্যান বলেছেন, একই ধরনের ডুবোযান তৈরিতে টাইটানিয়াম এবং গ্লাসসহ যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয় নারিয়াসের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে নতুন হালকা ওজনের উপাদান। এর মধ্যে রয়েছে সিরামিক সরঞ্জাম। সবকিছু মিলিয়েই এই যান সাগরতলে অনেক বেশি চাপ সহ্য করে টিকে থাকতে সক্ষম হবে।
নারিয়াসের এই মিশন হতে যাচ্ছে আসলে নতুন প্রযুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষার একটি বিষয়। বিজ্ঞানীরা এটি ব্যবহার করে উন্মোচন করতে চাইছেন সাগরতলের রহস্য। ডব্লিউএইচওআইর জীববিজ্ঞানী টিম শ্যাংক বলেছেন, আমরা আশা করছি সাগরে বিরাজমান নতুন জীবন সম্পর্কে সবকিছুই আমাদের সামনে উন্মোচিত হবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com