লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
উইন্ডোজ ১০ পাল্টে দেবে ডিজিটাল যন্ত্রকে
২০১৫ সালের ২৯ জুলাই বিশ্বখ্যাত সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট তাদের ব্যবসায়ের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা নিয়ে অপারেটিং সিস্টেমের দুনিয়াতে আবির্ভূত হয়েছে। ওই দিন এরা বিশ্বের ১৯০টি দেশে উইন্ডোজ ১০ প্রকাশ করেছে। যদিও এখনও পণ্যটি বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না, তথাপি বিদ্যমান ওএস-কে আপডেট করা ও কমপিউটার যন্ত্রে প্রিলোড করা অবস্থায় এই অপারেটিং সিস্টেমটি পাওয়া যায়। আমিও আমার ওএসকে আপডেট করে নতুন অপারেটিং সিস্টেমটি ব্যবহার করছি। পাওয়া তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে এটি সামনের অক্টোবরে পাওয়া যেতে পারে। এই অপারেটিং সিস্টেমটির ডেস্কটপ সংস্করণ প্রকাশিত হলেও ফোন সংস্করণ প্রকাশিত হবে অক্টোবরে।
১৯৮১ সালে মাইক্রোসফট যখন ডস তৈরি করে, তখন ওএসের জগতে দুনিয়া একটি নতুন পথের সন্ধান পায়। এরপর এরা উইন্ডোজ প্রকাশ করে। কিন্তু সেটি অ্যাপলের ম্যাক ওএসের পাশে দাঁড়াতে পারেনি। তবে ১৯৯৩ সালে মাইক্রোসফট যখন উইন্ডোজ ৩ প্রকাশ করে, তখন সারা দুনিয়াতেই একটি প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। আমার নিজের মতে, উইন্ডোজ ১০-এর প্রকাশ সেই ’৯৩ সালের পর একটি বড় ধরনের মাইলফলক ঘটনা। আমি অবাক হয়েছি এজন্য যে, বাংলাদেশের উইন্ডোজ ব্যবহারকারীরা এখনও বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। মিডিয়ায় এর তেমন গুরুত্ব ছিল না। সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কেও তেমন কোনো আলোচনা ছিল না। প্রায় দেড় দশক ধরে উইন্ডোজ ব্যবহার করে, দুনিয়ার বিদ্যমান অন্য সব অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহারের প্রক্রিয়া ও বিকাশ থেকে আমার ধারণা জন্মেছে, মাইক্রোসফট ’৯৩ সালের পর এই প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অপারেটিং সিস্টেম সম্পর্কে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আমরা লক্ষ করেছি, ইতোপূর্বে কমপিউটারের অপারেটিং সিস্টেম মেইনফ্রেম ও মিনিফ্রেম কমপিউটারের হাত ঘুরে প্রথমে ডস (প্রো ডস-এমএস-ডস) ও পরে ম্যাক (লিজা-ম্যাক) ওএস এবং উইন্ডোজ নামে ব্যবহার হতে থাকে। পিসি বা পার্সোনাল কমপিউটারের এসব অপারেটিং সিস্টেমের পর ট্যাবলেটে আই-ওএস ও অ্যান্ড্রয়িড রাজত্ব করতে শুরু করে। কালক্রমে স্মার্টফোনেও এই দুটি প্রধান অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে বিরাজ করতে থাকে। বর্তমানে ডেস্কটপ পিসিতে শুধু উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার হয় শতকরা ৯০.৯০ ভাগ (সেপ্টেম্বর ২০১৪-এর হিসাব)। অন্যদিকে ম্যাক ওএস (ওএস ১০) ব্যবহার হয় শতকরা ৬.৩৮ ভাগ। লিনআক্সের ব্যবহার শতকরা ১.৬৪ ভাগ মাত্র। কিন্তু নেট অ্যাপ্লিকেশনের চিত্রটাই আলাদা। সেখানে উইন্ডোজের ব্যবহার শতকরা ৫৭.১২, লিনআক্সের ব্যবহার ২০.১২ এবং অ্যাপলের ওএসের ব্যবহার ১৮.০৪ ভাগ।
ট্যাবলেট পিসিতে অ্যাপলের আধিপত্য একতরফা। তাদের দখলে ৭২.৯০ এবং অ্যান্ড্রয়িডের দখলে ২৪.০২ ভাগ। উইন্ডোজ এখানে কার্যত নেই। সার্ভারের ক্ষেত্রে ইউনিক্স জাতীয় অপারেটিং সিস্টেমের ব্যবহার ৬৭.৪ এবং উইন্ডোজের ব্যবহার ৩২.৬ শতাংশ। ২০১৫ সালে এই অবস্থাটি বদলেছে। এর মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মোবাইল ফোনে অ্যান্ড্রয়িডের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। সারা দুনিয়ার ডিজিটাল যন্ত্রের শিপমেন্টের তালিকায় দেখা যায় ২০১৩ সালে যেখানে অ্যান্ড্রয়িডের মার্কেট শেয়ার ছিল মাত্র ৩৮.৫১ শতাংশ, সেখানে ২০১৪ সালে সেটি ৪৮.৬১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। উইন্ডোজ ২০১৩ সালে যেখানে ১৩.৯৮ শতাংশ ছিল সেটি ২০১৪ সালে ১৪ শতাংশ উঠেছে। অন্যদিকে ২০১২ সালে উইন্ডোজের বাজার দখল শতকরা ১৫ ভাগে ছিল। অন্যদিকে ডেস্কটপ পিসির চিত্রটা আলাদা। এতে সবচেয়ে জনপ্রিয় উইন্ডোজ ৭। এর বাজার দখল শতকরা ৫৮.৩৯ ভাগ। উইন্ডোজ এক্সপির বাজার দখল শতকরা ১৫.৯৩ ভাগ। উইন্ডোজ ৮.১-এর বাজার দখল শতকরা ১১.১৬ ভাগ। এর বাইরেও পিসিতে উইন্ডোজ ৮ শতকরা ৩.৫ ও উইন্ডোজ ভিস্তা ১.৯৫ ভাগ রয়েছে। সব মিলিয়ে উইন্ডোজের বাজার দখলের হার ৯০.৯৩ শতাংশ। লিনআক্সের হার শতকরা ১.৫২ এবং ম্যাক ওএসের হার ৭.৩৬ ভাগ। এটি এপ্রিল ২০১৫-এর হিসাব। প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক, মাইক্রোসফট কি ডেস্কটপের এই প্রাধান্যের বিপরীতে অন্যান্য প্লাটফরমে তার আধিপত্য পুরোই হারিয়ে ফেলবে। কোনো ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান সম্ভবত এটি ভাবতেও পারে না। সম্ভবত এই ভাবনাতেই উইন্ডোজ ১০-এর জন্ম।
এমন একটি বিচিত্র অবস্থায় আমাদের দেশের জন্য একটি বড় বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, আমাদের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার কি প্রচলিত ধারার বাইরে চলে যাচ্ছে? আরও বিবেচনার বিষয়, উইন্ডোজ ১০ আসলে দুনিয়ার জন্য নতুন কোন বাণীটি নিয়ে এসেছে?
আমি মনে করি, উইন্ডোজ ১০ দুনিয়ার ডিজিটাল ডিভাইসের জগৎটাকে আবারও সমন্বিত করবে। এখন যেভাবে ডেস্কটপ-ল্যাপটপ এক ধরনের অপারেটিং সিস্টেম (প্রধানত উইন্ডোজ ও ম্যাক ওএস) এবং ট্যাবলেট ও স্মার্টফোন অন্য ধরনের অপারেটিং সিস্টেম (যেমন আইওএস ও অ্যান্ড্রয়িড) ব্যবহার করছে- সেটির বদলে উইন্ডোজ ১০ স্মার্টফোন থেকে ডেস্কটপ পিসি পর্যন্ত সব কিছুতেই ব্যবহার হতে পারবে। এটি কি ছোটখাটো ঘটনা? অনেকের কাছেই মনে হবে- এটা আর কী? অ্যান্ড্রয়িড ও আইওএস যথারীতি ট্যাবলেট-পিসির জগতে এবং উইন্ডোজ পিসির জগতে রাজত্ব করবে। এরা হয়তো মনে করে, কেউ কারও সীমানা অতিক্রম করতে পারবে না।
কিন্তু বিষয়টি সম্ভবত এমন নয়। ঘটনাটি এমন হতে পারে, আগামী এক দশকে দুনিয়ার সব মানুষ ইন্টারনেটে যুক্ত হবে। এর মানে দাঁড়াবে কমপক্ষে ৮০০ কোটি বা তার কাছাকাছি ডিজিটাল ডিভাইস দুনিয়াতে সক্রিয় থাকবে। এসব ডিভাইসের সিংহভাগ থাকবে হাতের তালুতে। আমরা বর্তমানের সংজ্ঞায় এগুলোকে স্মার্টফোন বা ট্যাবলেট বলি। এসব যন্ত্র যদি ডেস্কটপ বা ল্যাপটপের সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে পারে, তবে তথ্যপ্রযুক্তির জগৎটা কতটা বদলে যাবে? দুনিয়ার এখনকার প্রবণতা হচ্ছে ডেস্কটপ পিসির বিক্রি কমে যাওয়া। দিনে দিনে ল্যাপটপ পিসির বিক্রি ডেস্কটপকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আবার ট্যাবলেট পিসি ল্যাপটপের বাজারে ভাগ বসিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় টুকরাটা এখন স্মার্টফোন নিয়েছে। ঘটনাচক্রে এই দুনিয়াতে মাইক্রোসফট একেবারেই অসহায়। উইন্ডোজ ১০ এনে মাইক্রোসফট ফোনের জগতে একটি দৃঢ় অবস্থান তৈরি করার সেই সম্ভাবনাটিকেই উস্কে দিয়েছে।
আমি যদি তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ইতিহাসটার দিকে তাকাই, তবে এটি আমাকে বিবেচনায় নিতে হবে যে বিষয়টি এমন থাকবে না। মাইক্রোসফটও ভেবেছিল তারা ট্যাবলেট ও স্মার্টফোনের জন্য আরও দুটি আলাদা অপারেটিং সিস্টেম প্রচলিত করবে। দুটি অপারেটিং সিস্টেম তারা বাজারেও ছেড়েছিল। প্রধানত অপারেটিং সিস্টেমগুলোর দুর্বলতা এবং অ্যান্ড্রয়িড ও আইওএসের দাপটে এরা উইন্ডোজ ফোন অপারেটিং সিস্টেম দিয়ে বস্ত্তত কোনো মার্কেট শেয়ারই দখলে নিতে পারেনি। বলা যেতে পারে, এক ধরনের বাধ্য হয়েই এরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। এই কৌশলটির সুফল তারা পেতে পারে। এর মূল ভিতটা হলো ব্যবহারকারীরা উইন্ডোজ ব্যবহারের সাথে সমিলতা রেখে যদি ট্যাবলেট ও ফোন ব্যবহার করতে পারে, তবে মাইক্রোসফট তার নিবেদিতপ্রাণ গ্রাহকদের কাছ থেকে আনুগত্য পেতে পারে। এই কৌশলটির আরও একটি প্রভাব তথ্যপ্রযুক্তির জগতে পড়তে পারে। অ্যাপলকে তাদের দুটি অপারেটিং সিস্টেমকে সমন্বিত করতে হতে পারে। এমনকি অ্যান্ড্রয়িডকেও ডেস্কটপ পিসির উপযোগী করতে হতে পারে। ফলে ডিজিটাল ডিভাইসের আকার ভিন্ন হলেও অপারেটিং সিস্টেম তার অবয়ব এক রাখতে পারে। এছাড়া সব ধরনের ডিভাইসেই একই গোত্রীয় অ্যাপ চলতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির জগৎটা ডেস্কটপ-ল্যাপটপের ভুবন ছেড়ে হাতের মুঠোতেও স্থায়ীভাবে চলে যেতে পারে। যতদূর জানা গেছে, মাইক্রোসফট তার অ্যাপগুলোকে সব ডিভাইসে চলার উপযোগী করার কথাও ভাবছে। এটিও একটি যুগান্তকারী ঘটনা হতে পারে।
এবারে একটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে যে উইন্ডোজ ১০ কেমন হয়েছে। আমরা উইন্ডোজ ১০-কে ট্যাবলেট পিসি, ডেস্কটপ এবং ল্যাপটপে ইনস্টল করেছি। কিছু ড্রাইভারের বিষয় ছাড়া তেমন কোনো বড় সমস্যা এতে আমরা দেখিনি। মোটামুটি ভালোভাবেই এটি কাজ করছে। অনেকেই মন্তব্য করেছেন, এটি বস্ত্তত উইন্ডোজ সেভেন ও এইটের সমন্বিত রূপ। খুব সঙ্গতকারণেই এটি প্রথমত মাইক্রোসফটের বিদ্যমান গ্রাহকদের প্রাথমিক চাহিদা পূরণ করবে। দ্বিতীয়ত এটি ট্যাবলেট বা স্মার্টফোনের গ্রাহকদের টাইলস-টাচস্ক্রিন প্রবণতাকেও কাজে লাগাবে। উইন্ডোজ ১০ বিষয়ে মাইক্রোসফটের বড় প্রতিশ্রম্নতি হলো, এতে নিরাপত্তার বিষয়টিকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করে, আপনি উইন্ডোজ ১০-এর আবির্ভাবকে ইতিবাচক ঘটনা হিসেবে কেন দেখছেন, তাহলে ইতোপূর্বে বর্ণিত কথাগুলো তো আমি বলবই, সাথে আরও একটি বিষয়ের কথা বলব। আমরা লক্ষ করেছি, মাইক্রোসফট তার অপারেটিং সিস্টেম বিকাশের ক্ষেত্রে যে পথে হেঁটেছে তাতে তাদের কোনো একটি অপারেটিং সিস্টেম জনপ্রিয় হলেও পরেরটা ব্যবহারকারীরা পছন্দ করে না। সম্প্রতি মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ৮ প্রকাশ করেছে। এটি ব্যবহারকারীরা নানা কারণে পছন্দ করেনি। এরপর ৯ প্রকাশিত না হয়ে সেটি ১০ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে করি, এটি ব্যবহারকারীরা পছন্দ করছে। ফলে উইন্ডোজ ৮-এর ব্যর্থতা মাইক্রোসফট কাটিয়ে উঠতে পারবে।
আমি অপেক্ষাকরছি কবে আমি আরও দুটো যন্ত্র নিজে ব্যবহার করব। আমার বন্ধু-বান্ধবেরা সবাই আইপ্যাড-আইফোন বা অ্যান্ড্রয়িড ফোন নিয়ে মাতামাতি করছে। কিন্তু আমি এর কোনোটাই ব্যবহার করতে পারি না। এক ধরনের প্রযুক্তি প্রতিদ্বন্দ্বিতা আমার মাঝে কাজ করে। আমি এক সময়ে যখন ম্যাক ব্যবহার করতাম তখন শুধু ম্যাক ব্যবহার করেছি। এরপর যখন উইন্ডোজ ব্যবহার করতে শুরু করেছি তখন সেটাই করে আসছি। নতুন করে আইওএস বা অ্যান্ড্রয়িড শেখার ইচ্ছে হচ্ছে না। আমার নিজের ধারণা টাচস্ক্রিনের জন্য আমার আঙুলগুলো অনেক বড়। আবার আমি দেখেছি আমাদের বিজয় পরিবারের সর্বকনিষ্ঠা সৃজনশীল মানুষ ১৪ বছর বয়সী পরমা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে উইন্ডোজ, আইওএস এবং অ্যান্ড্রয়িড ব্যবহার করছে। দুনিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই দুই প্রজন্মকে এক সূত্রে বাধা। আমার মতো যারা নানা যন্ত্রে নানা ধরনের ইন্টারফেস ব্যবহার করতে চান না তারা নিশ্চয়ই উইন্ডোজ ১০ দেখে খুশি হবেন। তবে আমি এখনও অপেক্ষাকরছি, এই অপারেটিং সিস্টেম ও মাইক্রোসফটের অ্যাপগুলোর ডেস্কটপ-ল্যাপটপ-ট্যাবলেট ও স্মার্টফোনে ব্যবহার করতে পারি। কথা হলো আমি যেন সবখানেই বিজয় বাংলা ব্যবহার করতে পারি।
এখন পর্যন্ত উইন্ডোজ ১০ হচ্ছে দুই প্রজন্মকে এক সাথে সব ডিজিটাল যন্ত্রে সমন্বিত করার উদ্যোগ। কামনা করি মাইক্রোসফটের এই উদ্যোগ সফল হোক। একই সাথে অ্যাপল ও গুগলকে মাইক্রোসফটের পথে হাঁটতে শুরু করার জন্য অনুরোধ করছি
ফিডব্যাক: mustafajabbar@gmail.com