লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
গ্রাহাম’স নাম্বার: ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন লার্জেস্ট নাম্বার
গ্রাহাম’স নাম্বার
ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন লার্জেস্ট নাম্বার
শুরুতেই জানিয়ে রাখি, আমরা এ লেখায় আলোচনা করব গ্রাহাম’স নাম্বার নিয়ে, যা আসলে একটি অতি বড় সংখ্যা এবং এর নাম দেয়া হয়েছে রোনাল্ড গ্রাহামের নামানুসারে। এটি বিনিয়োগ সম্পর্কিত ‘গ্রাহাম নাম্বার’ পদবাচ্য থেকে পুরোপুরি আলাদা, যার নাম দেয়া হয়েছে বেঞ্জামিন গ্রাহাম নামের অন্য এক ব্যক্তির নামানুসারে। অতএব গ্রাহাম’স নাম্বার আর গ্রাহাম নাম্বার এ দু’টিকে কখনই একসাথে গুলিয়ে ফেলা যাবে না।
শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, আমাদের আলোচ্য গ্রাহাম’স নাম্বার অভাবনীয়ভাবে একটি অতি বড় সংখ্যা। অতি বড় সংখ্যা বলতে আমরা বুঝব সেই সংখ্যাগুলোকে, যেগুলো আমাদের প্রতিদিনের কাজে ব্যবহারের সংখ্যা থেকে অনেক অনেক বড়। আমরা বলছি এমন এক বড় সংখ্যার কথা, যা লিখতে গেলে লিখেও শেষ করা যায় না। এগুলো আমরা সচরাচর ব্যবহার করি না। এগুলোর ব্যবহার আছে গণিতে, জ্যোতির্বিদ্যায়, ক্রিপটোগ্রাফি ও মেকানিকসে। এজন্য মানুষ কথাবার্তায় ‘অ্যাসট্রোনমিক্যালি লার্জ’ কথাটি ব্যবহার করে থাকেন। এরপরও এসব বড় সংখ্যা গাণিতিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব। এই সংখ্যাটিকে কেউ কেউ আবার ‘ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন লার্জেস্ট নাম্বার’ বলেও আখ্যায়িত করেন। ১৯৭৭ সালে পপুলার সায়েন্স রাইটার মার্টিন গার্ডনার এই নাম্বারটি নিয়ে সুপরিচিত বিজ্ঞান পত্রিকা ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এ একটি লেখা লিখে তা প্রথমবারের মতো সাধারণ মানুষের কাছে প্রকাশ করেন। এটি ‘গিনিস বুক অব রেকর্ড’-এর ১৯৮০ সালের সংস্করণে গাণিতিক সমাধানে ব্যবহৃত সবচেয়ে বড় সংখ্যা হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। রামসে থিওরির সুনির্দিষ্ট একটি সমস্যা সমাধানে এই গ্রাহাম’স নাম্বারকে ‘আপার বাউন্ড’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
গ্রাহামের নাম্বারটি এতটাই বড় যে, প্রচলিত পাওয়ার বা ঘাত, কিংবা পাওয়ারের পাওয়ার চিহ্ন দিয়ে তা প্রকাশ করা যাবে না। এই সংখ্যাটি অভাবনীয়ভাবে কত বড় যে, তা বুঝাতে বলা হয়ে থাকে, দুনিয়ার সব বস্ত্তকে যদি কালি ও কলম বানানো হয় তবুও এই নাম্বারটি লিখে শেষ করা যাবে না। ফলে এই নাম্বারটি লিখতে দরকার হয় বিশেষ চিহ্নের ব্যবহার। আর এই বিশেষ চিহ্ন উদ্ভাবন করেছেন Donald Knuth। এর নাম Donald Knuth’s up-arrow notation। আর এটি প্রকাশ করা হয় দুইভাবে : ^ এবং | আমরা এর যেকোনো একটি নোটেশন এখানে ব্যবহার করব।
যদিও গ্রাহাম’স নাম্বার TREE(3)-এর চেয়ে ছোট, তবুও এটি অন্যান্য অনেক বড় সংখ্যার চেয়ে বড়। যেমন- এটি Skewes' number এবং Moser's number-এর চেয়ে বড়। আর এ দু’টি নাম্বার কিন্তু কম বড় নয়। এই দু’টি সংখ্যা googolplex নামের সংখ্যার চেয়ে অনেক অনেক বড়। আমরা জানি googol হচ্ছে ১০১০০, অর্থাৎ ১-এর ডানে ১০০টি শূন্য বসালে যে সংখ্যা পাওয়া যায় সেটিই গুগল সংখ্যা। অপরদিকে googolplex হচ্ছে 10googol, এর অর্থ গুগলপ্লেক্স নম্বরটি লিখতে ১-এর পর এত বেশি শূন্য বসাতে হবে যে, তা বসাতে বসাতে যেকেউ হয়রান হয়ে যাবেন। আমরা যদি গ্রাহাম নাম্বারের ডিজিট বা অঙ্কগুলো একের পর এক লিখতে যাই, তবে গোটা বিশ্বেই এই ডিজিটগুলোর জায়গা হবে না, যদি ধরে নিই প্রতিটি ডিজিট ১ প্ল্যাঙ্ক আয়তন জায়গা তথা ৪.২২১৭ গুণ ১০-১০৫ ঘনমিটার জায়গা দখল করে। উল্লেখ্য, একটি ডিজিটের জন্য এটাই সম্ভাব্য সবচেয়ে ছোট জায়গা।
জানিয়ে রাখি, ইন্টারনেটে আমরা যে গুগল (google) সার্চ দিই এবং গুগল কোম্পানির হেড কোয়ার্টার হিসেবে যে গুগলপ্লেক্সকে (goooleplex) আমরা জানি, তার সাথে সংখ্যা গুগল (googol) ও গুগলপ্লেক্সের (googolplex) বানান পার্থক্য রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।
এমনকি পাওয়ারের ওপর পাওয়ার বসিয়ে পাওয়ার-টাওয়ার তৈরি করে গ্রাহামের সংখ্যাটি লেখার জন্য পর্যাপ্ত স্থান মিলবে না। তাই আমরা এখানে এই সংখ্যাটি প্রকাশের বেলায় Knuth's up-arrow notation ব্যবহার করব। যদিও গ্রাহাম’স নাম্বারের সবগুলো ডিজিট কমপিউট করা খুবই কঠিন, তবে এর শেষদিকের ডিজিটগুলো সরল অ্যালগরিদমের মাধ্যমে জানা সম্ভব। এর শেষ ১২টি ডিজিট বা অঙ্ক হচ্ছে : ২৬২৪৬৪১৯৫৩৮৭।
আমরা ৩-এর স্কয়ার বা বর্গকে লিখি ৩২ বা ৩ গুণ ৩, যার মান ৯। আবার ৩-এর কিউব বা ঘনফল লিখি ৩৩, বা ৩ গুণ ৩ গুণ ৩, যার মান ২৭। একইভাবে ৪-এর পাওয়ার ৩ হলে লিখি ৪৩, বা ৪ গুণ ৪ গুণ ৪। আর এর মান ৬৪। এভাবে কোনো সংখ্যার ঘাত বা পাওয়ারের মান কীভাবে লিখতে হয় ও মান বের করতে হয়, তা আমরা স্কুলের গণিতে পড়ে এসেছি। কিন্তু কোনো সংখ্যার পাওয়ারের ওপর পাওয়ার, তার ওপর আরও পাওয়ার, এভাবে পাওয়ারের পর পাওয়ার বসানোর কাজটি সহজে লিখতে পারি না। এই কাজটি করার জন্য আমরা Knuth’s up-arrow notation বা ঊর্ধ্বমুখী তীরচিহ্ন ব্যবহার করি। যেমন- ৩-এর বর্গকে ৩২ না লিখে ঊর্ধ্বমুখী তীরচিহ্ন ব্যবহার করে লিখি 3^2, যার মান ৯। আবার ৩৩-এর কিউবের কিউবকে ঊর্ধ্বমুখী তীরচিহ্ন ব্যবহার করে লিখি 3^^3। এর অর্থ ৩২৭, বা 3^27, যার মান ৩-কে ২৭ বার পাশাপাশি লিখে এক সাথে গুণ করালে যা হয় তা। আর এই সংখাটি হচ্ছে ৭,৬২৫,৫৯৭,৪৮৪,৮৯৭।
তাহলে আমরা পেলাম :
3^3 = ৩ গুণ ৩ গুণ ৩ = ২৭।
3^^3 = 3^(3^3) = 3^27 = 7,625,597, 484,987।
একইভাবে,
3^^^3 = 3^^(3^^3) = 3^^7,625,597,484,987 = 3^(7,625,596,484,987^7,625,597,484,987।
এই সংখ্যাটিতে রয়েছে ঘাতের পর ঘাত বা পাওয়ারের পর পাওয়ার। এত পাওয়ারের যে টাওয়ার হবে তা এর মানকে অকল্পনীয়ভাবে বড় করে তুলবে। একইভাবে 3^^^^3 = 3^^^(3^^^3) সংখাটির পাওয়ার টাওয়ার নিশ্চয় আরও বড় হবে, তেমনি মানও হবে আরও অনেক অনেক বড়। গ্রাহাম’স নাম্বার যে কত বড় হতে পারে তার সামান্য একটু অাঁচ করা যাবে এই সংখ্যা থেকে।
এবার ভাবা যাক এমন একটি সংখ্যার কথা, যার ডানে আছে 3^^^^3টি তীরচিহ্ন। নিশ্চয় এটি আগের সংখ্যাগুলো থেকে আরও অনেক অনেক বড়।
এখন আমরা উপরে উলিস্নখিত সংখ্যা 3^^^^3-কে G1 নাম দিই এবং ধারাবাহিকভাবে G2, G2, G3, … ইত্যাদি নাম দিয়ে নিচের মতো করে সংখ্যাগুলো গঠন করি, তবে গ্রাহামের সংখ্যাকাঠামোটা নিমণরূপ দাঁড়ায় :
G1 = 3^^^^3
G2 = 3^^...^^3, যেখানে রয়েছে G1 সংখ্যক ঊর্ধ্বমুখী তীরচিহ্ন।
G3 = 3^^...^^3, যেখানে রয়েছে G2 সংখ্যক ঊর্ধ্বমুখী তীরচিহ্ন।
...
গ্রাহাম’স নাম্বার G = 3^^...^^3, যেখানে রয়েছে G63 সংখ্যাক ঊর্ধ্বমুখী তীরচিহ্ন।
এভাবে ৬৪-তম ধাপে এসে যে সংখাটি আমরা পাব, সেটিই হচ্ছে গ্রাহাম’স নাম্বার। কেউ জানার চেষ্টা করে G1, G2 ইত্যাদি সংখ্যার মান খাতায় লিখে বের করতে চেষ্টা করেন, তবে তিনি আন্দাজ করতে পারবেন গ্রাহামের সংখ্যা আসলে কত বড় মাপের সংখ্যা।
- গণিতদাদু