লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
ড. মো: সোহেল রহমান
মোট লেখা:১
লেখা সম্পর্কিত
ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং হাতি দেখা
অধ্যাপক, সিএসই বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয়
ভাবছিলাম আজ থেকে প্রায় বেশ ক’বছর আগের কথা। আমাদের চারপাশে তখন সবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগানটি আলোচিত হচ্ছিল। সে সময় অনেকেই এই ডিজিটাল শব্দটি নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। এরপর আমরা অতিক্রম করেছি অনেকটা পথ। পাড়ি দিয়েছি অনেক চড়াই-উতরাই। রূপকল্প বাস্তবায়নে অনেক কিছুতেই বেশ খানিকটা এগিয়েছি। কিন্তু যতটা এগোনোর দরকার ছিল, ততটুকু কি পেরেছি? চারদিকে যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের শনৈঃ শনৈঃ রব, তখন এমন প্রশ্ন মনে জাগাটাই স্বাভাবিক। এগোতে হলে তো এমন পর্যালোচনা করতেই হবে।
স্বভাবতই বাস্তবতার নিরিখে একটু নিবিড় পর্যালোচনায় বসলাম। ফলাফল মোটেই হতাশাজনক নয়; তবে একটা জায়গায় এসে আমরা যেন থমকে গেছি! আটকে যাচ্ছি নিজেদের তৈরি বলয়ে। একসময় ওয়েবসাইট তৈরি করাকে যেমনটা ডিজিটাল হয়ে যাওয়া মনে করে আমরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছি, ঠিক একইভাবে হালে আমাদের ডিজিটাল চিমত্মাভাবনাগুলো কেমন যেন অ্যাপনির্ভর হয়ে পড়েছে- আমরা একটার পর একটা অ্যাপ তৈরি করে যাচ্ছি। অ্যাপগুলো অবশ্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখছে। কিন্তু সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে গেলে এই অ্যাপ সংস্কৃতিই কিন্তু সব নয়। এ জন্য আমাদেরকে একটা সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে সহসাই। পরিস্থিতি-দৃষ্টে মনে হচ্ছে আপাতত আমরা আসলে একটি বড় হাতির সামান্য অংশ যেন দেখতে পাচ্ছি। আর এর ভিত্তিতেই পরিকল্পনা করছি। তাই আমাদের পরিকল্পনার পাখাটা আরও মেলতে হবে। এখন পুরো হাতিটা আমাদের দেখতে হবে।
আমাদের সোনার বাংলাদেশকে সত্যিকারের ডিজিটাল করতে গেলে আমাদের সব ক্ষেত্রেই মনোযোগ দিতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কি আমাদের সেই মনোযোগ আছে? একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বর্তমান সরকারের দৃশ্যমান অনেকগুলো অবকাঠামোগত প্রকল্প/পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের প্রিয় ঢাকা শহরে গত কয়েক বছরের মধ্যেই বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার তৈরি হলো এবং কিছু অংশ এখনও নির্মাণাধীন। এই তো হাতিরঝিলেও আমরা একটা সুন্দর প্রকল্প চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে যেতে দেখলাম। অনেকগুলো ব্রিজ তৈরির পরিকল্পনার কথাও আমরা জানি; আর আমাদের পদ্মা সেতু তো রয়েছেই। এখন প্রশ্ন হলো, এই যে বিশাল বিশাল অবকাঠামোগত প্রকল্প, এর মধ্যে তথ্য ও প্রযুক্তিগত কোনো উপাংশ (ICT Component) কি আছে? পদ্মা সেতুর মতো বিশাল একটা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ (maintenance) প্রক্রিয়া কি আমরা ম্যানুয়ালি করার পরিকল্পনা করছি? একই প্রশ্ন করা যায় অন্যান্য বড় বড় সেতুর ক্ষেত্রেও।
২০০৭ সালের ১ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপলিসের একটি সেতু কোনোরকম সতর্কবার্তা ছাড়াই ধসে পড়ে। এতে একশ’র বেশি গাড়ি মিসিসিপি নদীতে পড়ে যায়; ১৩ জন নিহত ও ১৪৫ জন আহত হয়। পরবর্তী পাঁচ/সাত বছরে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ এবং Real-Time পর্যবেক্ষণ/নিরীক্ষণের (monitoring) ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। সেতু মনিটরিংয়ের জন্য এখন ব্যবহার হচ্ছে খুব ছোট ছোট সেন্সর। সেন্সরগুলো তারবিহীন (wireless sensor) সংযোগে নিজেদের মধ্যে এবং অনতিদূরের বেজ স্টেশনের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। এই সেন্সরগুলো সেতুর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে স্থাপন করে সেতুর হাল-হকিকত (স্বাস্থ্য) এবং রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত মৌলিক বিষয়গুলো যেমন- স্ট্রেইন (strain), কম্পন (vibration), বিকৃতি (deformation), চাপ (pressure), স্থানচ্যুতি (displacement), ফাটল (crack), আর্দ্রতা (humidity), তাপমাত্রা (temperature) ইত্যাদির তথ্য ও উপাত্ত পরিমাপ করতে পারে। প্রয়োজনীয় উপাত্ত পরিমাপের পর পুরো তথ্যাদি কাছাকাছি স্টেশনে এরা পাঠিয়ে দিতে পারে। সেই তথ্য বিশেস্নষণপূর্বক সহজেই সেতুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে একদম real-time-এ ধারণা পাওয়া সম্ভব। আর সেই বিশেস্নষণের ওপর ভিত্তি করে সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়েও ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। চিমত্মা করে দেখুন, এরকম একটা তারবিহীন সেন্সরসমৃদ্ধ ব্যবস্থা যদি আমাদের বড় বড় সেতুগুলোতে আমরা নির্মাণের সময় থেকেই রাখতে পারি, তবে আমাদের কত সুবিধা হবে! উপরে যে দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তদমেত্মর পর ধারণা করা হয়েছিল যে একটি ত্রম্নটিপূর্ণ ধাতব প্লেটই এই দুর্ঘটনার সম্ভাব্য কারণ। এখন যদি সেন্সরগুলো আগেই সেখানে থাকত, তবে অনেক আগেই এই ধাতব প্লেটের ত্রম্নটি ধরা পড়ে যেত এবং এই বড় দুর্ঘটনাটি হয়তো এড়ানো যেত!
সেতুর কথা যখন উঠলই, সেতুর টোল ব্যবস্থা নিয়েও একটু কথা বলি। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় টোল ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা অনেকেই জানি। আমাদের টোল সেতুগুলোতে অবশ্যই স্বয়ংক্রিয় টোল ব্যবস্থা থাকা উচিত। এরকম আরেকটি আধুনিকতম ব্যবস্থা নিয়ে একটু কথা বলা যাক। আমাদের গুণী প্রকৌশলীরা যখন একটি সেতু, ব্রিজ বা ফ্লাইওভারের নকশা করেন তখন তাদের একটা হিসাব থাকে- এর ওপর সর্বোচ্চ কয়টা গাড়ি একবারে চলতে পারবে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের যেহেতু এই বিষয়টির ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, সেহেতু আমাদের প্রকৌশলীদের হয়তো অনেক অতিরিক্ত লোড ধরে নিয়ে নকশাটা করতে হয়। এতে খরচও হয়তো অনেক বেড়ে যায়। এখন একটা ব্যবস্থা চিমত্মা করুন, যেখানে একটা গাড়ি সেতুর ওপর উঠতে পারবে কি না তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্ধারিত হবে। ধরা যাক, সেতুটিতে একবারে একশ’ গাড়ি উঠতে পারে। সুতরাং সেতুটির স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যারে ১০০ ইলেকট্রনিক টোকেন থাকবে। যখনই একটা গাড়ি সেতুর ওপর থাকবে সে একটা টোকেন পাবে। যেই মুহূর্তে এই গাড়িটি সেতু থেকে বেরিয়ে যাবে, তার টোকেনটা আবার সেতুটির স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যারের অধিকারে মুক্ত টোকেন হিসেবে চলে আসবে এবং অন্য একটি গাড়ি তখন তা নিতে পারবে। সেতুতে প্রবেশের মুখে একটি গাড়িকে থামিয়ে দেয়া হবে যদি কোনো ফাঁকা টোকেন না থাকে। এটি নিশ্চয়ই এতক্ষণে পরিষ্কার, মুক্ত টোকেন না থাকা মানে হলো ইতোমধ্যে ১০০ গাড়ি সেতুর ওপরে চলছে। সুতরাং এদের মধ্যে কোনো গাড়ি সেতু থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নতুন গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে না।
আসলে এই আলোচনার কোনো শেষ নেই। তথ্যপ্রযুক্তি আমাদের সামনে সম্ভাবনার অসংখ্য দ্বার খুলে দিয়েছে। আমাদের সেই সম্ভাবনার প্রতিটি দরজা পেরিয়ে অনুসন্ধান এবং অন্বেষণ করতে হবে। কি করা যায় তা বুঝে বের করতে হবে। অর্থাৎ এভাবে চিমত্মা ও গবেষণার পরম্পরায় ডিজিটালাইজেশন করাটাই এখন সময়ের দাবি।
এই যে উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করলাম, তাও আসলে হাতির ছোট্ট একটি অংশ। তবে এটি আমরা যেই অংশটুকু এখন খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি তার বাইরের একটি অংশ। আমাদের অন্য অংশগুলোও দেখতে হবে এবং পুরো হাতিটা আমাদের দৃষ্টিসীমার মাঝে নিয়ে আসতে হবে। তাহলেই আমরা সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব
ফিডব্যাক : sohel.kcl@gmail.com