লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
সাড়ে তিনশ’ বছরে গণিতের এক সমস্যার সমাধান
পিথাগোরাসের উপপাদ্য থেকে আমরা জানি, একটি সমকোণী ত্রিভূজের লম্ব ও ভূমির বর্গের সমষ্টি এর অতিভূজের বর্গের সমান। অন্য কথায় লম্ব২ + ভূমি২ = অতিভূজ২। যদি একটি সমকোণী ত্রিভূজের লম্ব, ভূমি ও অতিভূজ যথাক্রমে x, y ও z হয়, তবে x2 + y2 = z2। যেমন- একটি সমকোণী ত্রিভূজের লম্বের দৈর্ঘ্য যদি ২ একক ও ভূমির দৈর্ঘ্য ৩ একক হয়, তবে এর অতিভূজের দৈর্ঘ্য অবশ্যই হবে ৫ একক। কারণ ২২ + ৩২ = ৫২। আবার আরেকটি সমকোণী ত্রিভূজের লম্ব ও ভূমির দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৫ একক ও ১২ একক হলে এর অতিভূজের দৈর্ঘ্য অবশই হবে ১৩ একক। কারণ ৫২ + ১২২ = ১৩২। এখানে প্রথম উদাহরণের ক্ষেত্রে (২, ৩, ৫) হচ্ছে একটি পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেট বা পিথাগোরীয় সংখ্যাত্রয়ী । আর দ্বিতীয়টির বেলায় (৫, ১২, ১৩) হচ্ছে আরেকটি পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেট। এভাবে আমরা পূর্ণসংখ্যার অসংখ্য পিথাগোরিয়ান ট্রিপলেট বা সংখ্যাত্রয়ী তৈরি করতে পারি।
যদি এই x , y ও z-এর পাওয়ার ২ না হয়ে n বা যেকোনো পূর্ণসংখ্যা হতো, তবে x2 + y2 = z2 সমীকরণটির সাধারণ রূপ দাঁড়াতো xn + yn = zn। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে কি আমরা এমন অসংখ্য পূর্ণসংখ্যার ট্রিপলেট বা ত্রয়ীসংখ্যা পেতাম, যা xn + yn = zn সমীকরণটিকে সিদ্ধ করে। বিখ্যাত সংখ্যাতাত্ত্বিক পিয়েরে ডি ফারমেট (Pierre de Fermat) ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে একটি বইয়ের মার্জিনে লেখেন, xn + yn = zn সমীকরণটিতে যদি n-এর মান ২-এর চেয়ে বড় কোনো পূর্ণসংখ্যা হয়, তবে এর কোনো সমাধান নেই। অর্থাৎ n-এর মান ২-এর চেয়ে বড় কোনো পূর্ণসংখ্যা ধরলে এই সমীকরণটি সিদ্ধ হবে না। এরই নাম দেয়া হয় ফারমেট’স লাস্ট থিওরেম। তবে মজার ব্যাপার হলো, তিনি এই তত্ত্বের কথা আমাদের জানালেও এর প্রমাণ তিনি দিয়ে যাননি। তিনি এই বইয়ের মার্জিনে শুধু এটুকু লিখেন- ‘I have discovered a truly remarkable proof, which this margin is too small to contain।’ এর মাধ্যমে তিনি শুধু জানালেন- এই উল্লেখযোগ্য গাণিতিক তত্ত্বটির সত্যিকারের প্রমাণ তার কাছে আছে। কিন্তু ওই বইয়ের মার্জিনে তা উপস্থাপন করতে গেলে স্থান সঙ্কুলান হবে না। তবে অন্য কোথাও তার উদ্ভাবিত এর তত্ত্বের প্রমাণ তিনি উপস্থাপন করেছেন, এমনটিও জানা যায়নি। ফলে ধরে নেয়া হয়, ফারমেট এই তত্ত্বটি দিয়েছেন, কিন্তু এর প্রমাণ দিয়ে যাননি। এই তত্ত্বটি গণিতের ইতিহাসে ‘ফারমেট’স লাস্ট থিওরেম’ নামে খ্যাত। উল্লেখ্য, সপ্তদশ শতাব্দীর এই বিখ্যাত সংখ্যাতত্ত্ববিষয়ক গণিতবিদ তেমন কোনো বই লিখে যাননি। তার স্বভাব ছিল, বই পড়ার সময়ে মার্জিনে গণিতবিষয়ক নানা মন্তব্য লেখা। ফারমেট তার লাস্ট থিওরেমের বেলায়ও ঠিক এই কাজটি করে যান।
এই থিওরেমটি যে সঠিক, তা কিন্তু গণিতবিদেরা ভালো করেই জানতেন। শুধু জানা ছিল না এর প্রমাণটি। ফলে তা প্রমাণ করার ভার আপনা-আপনি পড়ল বাকি সব গণিতবিদের ওপর। গণিতবিদেরা উঠেপড়ে লাগলেন থিওরেমটি প্রমাণের কাজে। তা প্রমাণ করতে গিয়ে এরা গণিতের সংখ্যাতত্ত্বে আরও অনেক উন্নতি সাধন করলেন, কিন্তু সহজে ফারমেটের শেষ থিওরেমটি প্রমাণ করতে পারছিলেন না। তা প্রমাণ করতে তাবৎ বিশ্বের গণিতবিদেরা কাজ করলেও এর প্রমাণ পেতে সময় লাগে সাড়ে তিনশ’ বছর। ১৬৩৭ সালে ফারমেটের উদ্ভাবিত এই থিওরেম ১৯৯৪ সালে পুরোপুরি প্রমাণ করেন অ্যান্ড্রু উইলস। ফলে ফারমেটের লাস্ট থিওরেমকে বলা হয়, সমাধানে বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় নেয়া গণিত সমস্যা- ‘দ্য লংগেস্ট-স্ট্যান্ডিং ম্যাথ প্রবলেম’।
শুরুতে মনে হয়েছিল, এই তত্ত্ব প্রমাণ খুব কঠিন কিছু হবে না। কিন্তু প্রমাণ করতে গিয়ে গণিতবিদেরা রীতিমতো নাস্তানাবুদ। তারা দেখলেন, তত্ত্বটি সহজ মনে হলেও এর প্রমাণ করাটা কিন্তু খুবই জটিল। এই সরলতা আর জটিলতার মাঝে সাড়ে তিনশ’ বছর কাটাতে হয় বিশ্বের তাবৎ গণিতবিদদের। রাতের ঘুম হারাম করে কাজ করেও এর সমাধান যেন পাওয়া যাচ্ছিল না।
অ্যান্ড্রু উইলস
এরপর এলেন অ্যান্ড্রু উইলস। তিনি একনাগাড়ে সাত বছর কাজ করে সক্ষম হয়েছিলেন এর প্রমাণ খুঁজে পেতে। শৈশব থেকেই উইলস মজা পেতেন গণিতের নানা সমস্যার সমাধান বের করতে। বয়স যখন ১০, তখন তিনি জানতে পারেন সাড়ে তিনশ’ বছর ধরে চেষ্টা করেও গণিতবিদেরা ফারমেটের লাস্ট থিওরেম প্রমাণ করতে পারছেন না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তাকে এর প্রমাণ বের করতেই হবে। তার গোটা স্কুল ও কলেজ জীবনে তিনি চেষ্টা করেছেন এই থিওরেমটির প্রমাণ হাজির করতে। এ সময় তিনি ব্যবহার করেন তার নিজস্ব পদ্ধতি এবং এর আগে এ ক্ষেত্রে কাজ করা অন্যান্য গণিতবিদের অবলম্বিত পদ্ধতিও। কিন্তু কিছুতেই তা প্রমাণ করতে পারছিলেন না। এরই মধ্যে তিনি হন একজন গবেষক ছাত্র। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, ফারমেটের লাস্ট থিওরেম নিয়ে আর কাজ করবেন না। উইলসের উপলব্ধি ছিল, চলতি কৌশল প্রয়োগ করে কেউ বছরের পর বছর কাজ করেও এই সমস্যার সমাধানে কোনো অগ্রগতি খুঁজে পাবেন না। তা ছাড়া ফারমেটের লাস্ট থিওরেমের প্রমাণ বের করাটা গণিতের জন্য পুরোপুরি অপ্রয়োজনীয়। এর প্রমাণ বের করা গণিতের কিংবা গণিতবিদদের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনবে না। তাই এ নিয়ে আর গবেষণা না চালিয়ে গণিতের ইলিপটিক্যাল কার্ভ বিষয়ে পড়াশোনা করতে ক্যামব্রিজে চলে যান। মনে করলেন, ইলিপটিক্যাল কার্ভ নিয়ে পড়াশোনাই বরং তার জন্য উপকারী হবে। কারণ, ১৯৮৬ সালে এর একটি নতুন সম্ভাবনা উইলসের কাছে তুলে ধরা হয়েছিল। Ken Ribet ফারমেটের লাস্ট থিওরেমের সাথে আরেকটি সমাধান না করা সমস্যার সাথে সংশিস্নষ্ট করেন।
পিয়েরে ডি ফারমেট অ্যান্ড্রু উইলস
সেটি হচ্ছে Taniyama-Shimura Conjecture, যা ছিল ইলিপটিক্যাল কার্ভ সম্পর্কিত একটি কনজেকচার বা প্রমাণহীন অনুমান। যদি এই কনজেকচার সঠিক হয়, তবে ফারমেটের লাস্ট থিওরেমও সঠিক হবে। অতএব উইলস যদি ‘তানিয়ামা-শিমুরা কনজেকচার’ প্রমাণ করতে পারেন, তবে তিনি ফারমেটের লাস্ট থিওরেমের প্রমাণ করতে পারবেন। সেই মুহূর্ত থেকে তিনি আবার স্থির সিদ্ধান্ত নিলেন ফারমেটের লাস্ট থিওরেমের প্রমাণ খুঁজে বের করবেন। তখন তিনি যেসব প্রকল্পে কাজ করছিলেন সব ছেড়েছুড়ে মনোনিবেশ করলেন তানিয়ামা-শিমুরা কনজেকচারের ওপর। অনেকটা গোপনে এবং সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করে যেতে থাকেন। তিনি বলেন- ‘আমি উপলব্ধি করলাম, ফারমেটের লাস্ট থিওরেম নিয়ে যাই করতে হবে, তা করতে হবে গভীর আগ্রহের সাথে। বিভাজিত মনোযোগ দিয়ে বহু বছর কাজ করেও এ ক্ষেত্রে কোনো ফলোদয় হবে না। তাই তার এই গোপনীয়তা ও বিচ্ছিন্নতা।’ তিনি যে এ গবেষণার কাজটি করছেন, এমনকি তার স্ত্রীও জানতেন না, তাদের হানিমুনের সময়ে তাকে বলার আগে পর্যন্ত।
উইলস সাত বছর একটানা এ নিয়ে গবেষণা চালান। পরিবারকে কিছুটা সময় দেয়া ছাড়া এই পুরো সময়টা কাটিয়েছেন ফারমেটের লাস্ট থিওরেম প্রমাণের মানসে। তিনি এ কাজে অগ্রগতি অর্জন করলেও পুরো প্রমাণ হাজির করেন ১৯৯৩ সালে। এর প্রমাণ হাতে পেয়ে বিকেল বেলা স্ত্রীর কাছে গিয়ে বললেন, ‘তিনি কাঙিক্ষত প্রমাণটা পেয়ে গেছেন।’
উইলস বেশ কয়েকটি লেকচাওে এই প্রমাণের বিষয়টি তুলে ধরেন, যেখানে কোনো উল্লেখ ছিল না ফারমেটের লাস্ট থিওরেমের, বরং সেখানে উল্লেখ ছিল ইলিপটিক্যাল কার্ভের। তা সত্ত্বেও তৃতীয় লেকচার শেষে শ্রোতারা বুঝতে পেরেছিলেন উইলস শেষ পর্যন্ত তাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। যখন উইলস তানিয়ামা-শিমুরা কনজেকচার প্রমাণ করা শেষ করলেন, তখন তিনি বোর্ডে লিখলেন ফারমেটের লাস্ট থিওরেম এবং শেষ করলেন এই বলে- ‘I think I’ll stop there।’
সাড়ে তিনশ’ বছর ধরে ঝুলে থাকা এই সমস্যার সমাধান দিয়ে উইলস গণিতবিদ হিসেবে রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে ওঠেন। তা সত্ত্বেও Nick Katz আবিষ্কার করলেন, উইলসের মূল প্রমাণের মুখ্য অংশে একটা ভুল ছিল। এই সমস্যা থেকে উতরানো উইলসের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তার কোনো পদ্ধতিই এই ভুল শোধরাতে পারেনি। তিনি আশা প্রায় ছেড়ে দিতে যাচ্ছিলেন। তখন আবার পরীক্ষা করেন মূল পদ্ধতি (যদিও এ পদ্ধতি তিনি বাতিল করে দিয়ে ছিলেন) এবং দেখলেন এই ভুল শোধরানোর একটি উপায় আছে। উইলস সমস্যাটি সমাধানের মুহূর্তে বললেন, ‘ইট ওয়াজ সো ইনডেসক্রাইবেবলি বিউটিফুল। ইট ওয়াজ সো সিম্পল অ্যান্ড সো সো এলিগেন্ট, অ্যান্ড আই জাস্ট স্টেয়ার্ড ইন ডিসবিলিফ ফর টুয়েন্টি মিনিট।’ অর্থাৎ ‘এটি ছিল বর্ণনাতীতভাবে সুন্দর। এটি ছিল এতটাই সরল ও এতটাই দক্ষতাপূর্ণ যে, আমি অবিশ্বাস্যভাবে অবাক হয়ে ২০ মিনিট তাকিয়ে ছিলাম’।
এভাবেই ১৯৯৪ সালে উইলসের কাছ থেকে পেলাম ফারমেটের লাস্ট থিওরেমের ২০০ পৃষ্ঠায় লেখা পরিপূর্ণ প্রমাণ। তবে এই প্রমাণ শুধু উচ্চতর জ্ঞানসম্পন্ন গণিতবিদেরাই বুঝতে সক্ষম। সাধারণ মানুষের পক্ষে এই জটিল গাণিতিক প্রমাণ বোঝার কোনো সুযোগ নেই।
এ নিয়ে পুরো ধাঁধার সমাধান এখনও হয়নি। কারণ, আমরা এখনও জানি না, আসলেই ফারমেটের কাছে এই থিওরেমের অন্য কোনো আরও আকর্ষণীয় ও সহজ প্রমাণ ছিল কি না। হয়তো উইলস যে প্রমাণ হাজির করেছেন, তা থেকে আলাদা কোনো প্রমাণ ছিল ফারমেটের কাছে। কিংবা এর আরও কোনো সরল সমাধান রয়ে গেছে।
-গণিতদাদু