• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলাভাষার বিকাশ
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১০ - ফেব্রুয়ারী
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল সিস্টেম
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ২
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলাভাষার বিকাশ
বাঙালির সৃজনশীলতার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশ ঘটে একুশের বইমেলায়। ২০১০ সালের সেই মেলাটির উদ্বোধন হয়েছে। মেলা এরই মাঝে বেশ জমে উঠেছে। বিপুলসংখ্যক প্রকাশক ও সৃজনশীল সংস্থা এই উপলক্ষে তাদের শ্রেষ্ঠতম আয়োজনটি পুরো জাতির সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছে।

এ বইমেলার উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা বাড়ানোর কথা বলেছেন। তিনি দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসমূহের ভাষা রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট হবার কথাও বলেছেন। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে ক্ষুদ্র ভাষাসমূহ তো বটেই, আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলাই এখন চরমভাবে বিপন্ন। বিশেষ করে আমরা যখন ডিজিটাল যুগের কথা বলছি, তখন রাষ্ট্রভাষাকে ডিজিটাল যন্ত্রে প্রয়োগ করার ব্যাপারে চারপাশে যেমন অগোছালো ভাব দেখছি এবং যেভাবে মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনসহ চরম অবজ্ঞা দেখছি তাতে শঙ্কাটি আরও বাড়ছে। যদিও সরকার বাংলাভাষা প্রমিতকরণ নামে একটি কমিটি গঠন করে পূর্বতম অবস্থার পরিবর্তন করেছে, তথাপি এই ক্ষেত্রে আরও কিছু সঠিক পদচারণা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে।

একথা স্বীকার করতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলাভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি বিশ্বজুড়ে বাংলাভাষার মর্যাদা বাড়ানোর কাজের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমরা দেখেছি সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিলেন এবং বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবি জানালেন। বিশ্বের প্রায় তিরিশ কোটি মানুষের ভাষা বাংলার জন্য শেখ হাসিনার এই দাবির প্রতি সমর্থন দিয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যসভা ও রাজ্য সরকার। এই দাবিটি এখন থেকে আরও বিশ বছর আগে করা যেতো।

যাহোক, ’৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে একটি বড় সম্মান আমাদের জন্য এনে দিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা শুরু হয়। জাতিসংঘ এই দিনটিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বিশ্বজুড়ে বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের সম্মান বাড়িয়েছে। এবার যদি শেখ হাসিনার প্রস্তাবনা অনুসারে জাতিসংঘ বাংলাকে জাতিসংঘের দাফতরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি তবে আমরা আরেকটি মাইলফলক অর্জন করতে পারবো।

শেখ হাসিনার সরকার এবার ক্ষমতায় আসার আগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা অনেক রুটিন সমস্যায় আক্রান্ত ছিল। শেখ হাসিনার আমলে এনকোডিংসহ যেসব কাজের অগ্রগতি হয়েছিল তাকেও আপডেট করা হয়নি। ফলে ২০০০ সালের বাংলা এনকোডিং অচল হয়ে পড়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত বাংলাভাষার কোনো সমস্যার প্রতি দৃষ্টি দেবারও সময় ছিল না দুটি সরকারের। এই সাত বছরে সরকারের চরম অবজ্ঞার মাঝে স্থবির ও সঙ্কটাপন্ন ছিল বাংলাভাষা।

যাহোক, শেখ হাসিনা ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলাভাষার খুবই জরুরি কিছু সঙ্কট নিয়েই যাত্রা শুরু করেন। এগুলো হলো :

০১. ২০০৯ সালেও বাংলাদেশের বাংলাভাষা ডিজিটাল যন্ত্রের এনকোডিং সমস্যায় জর্জরিত ছিল। সরকারের বিএসটিআই বিডিএস ১৫২০:২০০০ নামের একটি কোডসেট অনুমোদন করেছিল, যেটির সাথে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম এবং আইএসও’র কোডের বেশ কিছুটা গরমিল ছিল।

০২. সরকারের কমপিউটার কাউন্সিল জাতীয় কীবোর্ড নামের একটি কীবোর্ড প্রণয়ন করেছিল। সেটির বিরুদ্ধে অভিযোগ হচ্ছে, সেটি বিজয় কীবোর্ডের প্রায় পুরো নকল।

০৩. এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মোবাইলের কীবোর্ডের কোনো মান নেই। সরকারের পক্ষ থেকে মোবাইলে বাংলা প্রচলনের কোনো উদ্যোগও ছিল না।

০৪. বাংলাভাষার সর্টিং মান নিয়ে জটিলতা রয়েছে। আমরা অভিধানে বাংলা বর্ণের একরকম অনুক্রম পাই-আবার পাঠ্য বইতে ভিন্ন রকম অনুক্রম পাই।

০৫. বাংলা ব্যাকরণ ও বানান শুদ্ধ করার জন্য উপযুক্ত ও কার্যকর কোনো সফটওয়্যার নেই।

০৬. বাংলাভাষার জন্য অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিডার জাতীয় কোনো সফটওয়্যার নেই।

০৭. বাংলা স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার নেই।

০৮. বাংলা টেক্সট টু স্পিচ ও স্পিচ টু টেক্সট সফটওয়্যার নেই।

০৯. বাংলাভাষার প্রয়োজনীয় ডিজিটাল কনটেন্ট নেই।

১০. বিভিন্ন ভাষা থেকে বাংলায় ও বাংলা থেকে বিভিন্ন ভাষার জন্য স্বয়ংক্রিয় অনুবাদক সফটওয়্যার নেই।

বছরের পর বছর এবং বারবার প্রায় প্রতিটি সরকারের কাছে এসব বিষয়ে আমরা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গেছি, কিন্তু কোন ফল বা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি।

অবশেষে অনেক দেনদরবারের পর বাংলাভাষার উন্নয়ন- বিশেষত ডিজিটাল যন্ত্রে এর প্রয়োগ ও বিকাশের জন্য বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের সভায় আলোচনা করা হয় এবং ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯-এর কাউন্সিল সভার সিদ্ধান্ত [সিদ্ধান্ত ৩(৩১)/২০০৯(ঢ)] মোতাবেক একটি প্রমিতকরণ কমিটি গঠন করা হয়। আমি নিজে কমপিউটার কাউন্সিল এবং নবগঠিত কমিটির একজন সদস্য। কাউন্সিল সভায় প্রসঙ্গটি আমাকেই উত্থাপন করতে হয়েছে।

৩ ফেব্রুয়ারি ২০১০ পর্যন্ত এ কমিটির তিনটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কমিটি কয়েকটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলাভাষার প্রয়োগকে অনেকটাই সহজ করে দেবে। প্রথমত, কমিটি ইউনিকোড এবং বাংলাদেশ সরকারের কোডসেটে যে গরমিল ছিল সেটি দূর করেছে এবং ইউনিকোড ৫.২কেই বাংলাদেশের বাংলাভাষার মান হিসেবে। এর ফলে পৃথিবীতে বাংলা ডাটা ইন্টারচেঞ্জের সঙ্কট দূরীভূত হবে। দ্বিতীয়ত, কমিটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান অবস্থায় একটি প্রমিত কীবোর্ড তৈরি করার প্রয়োজনীয়তা নেই-বাজারের নিয়মে কীবোর্ড বিষয়টির নিষ্পত্তি হবে। এর ফলে সরকার কীবোর্ড নিয়ে যেসব সমস্যা তৈরি করে রেখেছে তার অবসান হতে পারে। বিশেষ করে এই কমিটি কপিরাইট রেজিস্ট্রারকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় কীবোর্ড যে বিজয় কীবোর্ডের নকল কি না সেটি তদন্ত করার যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে আমরা কীবোর্ড নিয়ে একটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছাতে পারব। তৃতীয়ত, কমিটি মোবাইল ফোনের নিউম্যারিক কীপ্যাডে কিভাবে বাংলা বর্ণ ইনপুট দেয়া হবে তার ব্যাপারে একটি মান তৈরি করবে। কমিটির দুটি সভায় এই মান নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে, ফেব্রুয়ারি মাসেই এই মানটি নির্ধারিত হয়ে যাবে। কমিটি এরই মাঝে বাংলা সর্টিং নিয়ে আলোচনা করেছে। সর্টিংয়ের ক্ষেত্রেও একটি মান আমরা অচিরেই তৈরি করতে পারব।

অন্যদিকে আমাকে এবং মুনির হাসানকে নিয়ে একটি উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে বাংলাভাষার উন্নয়ন করার জন্য যেসব প্রকল্প নেয়া উচিত তার তালিকা প্রণয়ন করতে। মুনির হাসান ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে গণিত অলিম্পিয়াড নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আমরা কাজটি জানুয়ারির মাঝে সম্পন্ন করতে পারিনি। তবে, ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝেই আমরা এই কাজটি সম্পন্ন করতে পারব। আমাদের প্রস্তাবিত তালিকা অনুসারে যদি সরকার উপযুক্ত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয় তবে আমরা ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলাভাষার বিদ্যমান সঙ্কট কাটিয়ে একটি বিশ্বমানের মাতৃভাষার অধিকারী হতে পারব। এসব খাতে প্রকল্প গ্রহণ করার পরও প্রকৃতপক্ষে কাজ করার মতো জনবল পাওয়া যাবে কি না সেটি আমরা জানি না। এই খাতে কাজ করার জন্য উপযুক্ত প্রোগ্রামার পাওয়া যায় না। বাংলাভাষা এবং প্রোগ্রামিং দুটিই বুঝেন তেমন তরুণের সংখ্যা খুবই কম। আমাদের সে তরুণ লোকবল তৈরি করতেই হবে।

যেভাবেই হোক আমাদেরকে এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতেই হবে।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : mostafajabbar@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস