• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > ডিজিটাল বাংলা ভাষা ও সরকারের নতুন কমিটি
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০০৯ - নভেম্বর
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি ও সমাজ
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
ডিজিটাল বাংলা ভাষা ও সরকারের নতুন কমিটি

অবশেষে বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের কার্যক্রম শুরু ১৯৮৭ সালে। বাইশ বছর পর এতে একটি নতুন মাত্রা যোগ হতে যাচ্ছে। আমরা লক্ষ করেছি, ডিজিটালপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহারকে প্রমিত করার জন্য শেখ হাসিনার সরকার নড়েচড়ে বসেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে শেখ হাসিনা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলায় ভাষণ দেন। এটি মাতৃভাষার প্রতি তার দরদই প্রকাশ করে। তেমনি বাংলা ভাষা ডিজিটাল যন্ত্রে প্রমিতকরণের জন্য কমিটি গঠন এই সরকারের মাতৃভাষার প্রতি দায়িত্বশীলতার প্রমাণ বহন করে।

১৯৮৭ সালে কমপিউটারে বাংলা ভাষা সাফল্যের সাথে প্রয়োগ করার পর বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার এখন যে পদক্ষেপটি নেয়া হলো, ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে (সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩) ডিজিটাল যুগে শক্তিশালী করার জন্য অতীতে যেসব উল্টো কাজ করা হয়েছে এবার সেসব ভুল সংশোধন করার পাশাপাশি অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পন্ন করার ব্যাপারে কার্যকর, সময়োপযোগী ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেবার সুযোগ তৈরি হলো।

বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি এই কাজটি করার জন্য সরকারের কাছে বারবার অনুরোধ করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই উদ্যোগ নেবার জন্য তাগিদ দিয়েছি বহুবার। ভুক্তভোগী হিসেবেও আমি এর প্রতিকার চেয়েছি। চারদলীয় জোট সরকার এক্ষেত্রে শুধু যে অনীহা প্রকাশ করেছিল তাই নয়-বরং এ খাতে চরম সঙ্কট তৈরি করে রেখেছে। আমি নিজে ব্যক্তিগতভাবে বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের চরম আক্রোশের শিকার হয়েছিলাম। একই সাথে তৎকালে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি ও বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল আমার মেধাসম্পদকে সরকারের সম্পদে পরিণত করার চেষ্টা করেছিল। এর প্রতিকার আমি জোট সরকারের বিদায়ের পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছেও পাইনি।

আমি যখন ১৯৮৭ সালে কমপিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশ করার উদ্যোগ নিই, তখন ভাষা উন্নয়নের ক্ষেত্রে সরকার নীরব ছিল, যা এখনো আছে। অন্যদিকে কমপিউটারে বাংলা কোড নির্ধারণ ও কোড প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কোনো সরকারি মান ছিল না। ফলে ১৯৮৭ সালে আমি একটি এনকোডিং (আনন্দ ফন্টের) ও কীবোর্ড (জববার কীবোর্ড) তৈরি করি। এরপর আমি আমার মতো করে ১৯৮৮ সালে একটি বাংলা এনকোডিং এবং বিজয় কীবোর্ড তৈরি করি। এই উদ্ভাবনাটি ১৯৮৯ সালে ও তার পরে কপিরাইট করা হয় এবং পরে সেটি প্যাটেন্টও হয়। এর ডিজাইন নিবন্ধিত আছে। বিজয় একটি নিবন্ধিত ট্রেডমার্কও। মেধাসম্পদবিষয়ক যে কয়টি নিবন্ধন বা আইনগত স্বীকৃতি প্রয়োজন তার সবই এর করা হয়েছে। এমনকি এখন প্যাটেন্ট অধিকার সংরক্ষণের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশনাও বাস্তবায়িত হয়েছে।

সরকারের কোনো মান না থাকায় একইভাবে বাজারে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য অনেক এনকোডিং ও কীবোর্ড জন্ম নেয়। কিন্তু বিজয় আশাতীত জনপ্রিয়তা পায়। নানাজন এর পুরোপুরি বা আংশিক নকল করতে থাকে।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করলেও কমিটি কাজের কাজ কিছুই করেনি। চার বছর পর ১৯৯১ সালে এই কমিটি একটি কোডসেটের খসড়া অনুমোদন করে। ১৯৯২ সালে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বাংলা কীবোর্ড প্রমিত করার সুপারিশ করা হয়। বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কমিটির পাশাপাশি অন্যরাও নানা ধরনের অপতৎপরতা চালায়। অনেক সরকারি অফিস প্রশিকা, লেখনী ইত্যাদি সফটওয়্যার ব্যবহার করা শুরু করে। সরকার এ ব্যাপারে নিজে কোনো দিকনির্দেশনা দিতে পারেনি। ১৯৯২ সালে বাংলা একাডেমী সাইটেক-এর প্রস্তাবনা অনুসারে বিজয়-এর নকল ‘একাডেমী কীবোর্ড’ অনুমোদন করে। কিন্তু সেই কীবোর্ড একেবারেই প্রচলিত হয়নি। অন্যান্য কীবোর্ড এবং সফটওয়্যারও মুখ থুবড়ে পড়ে। এমনকি বাংলা একাডেমী নিজেও তাদের অনুমোদিত কীবোর্ডটি ব্যবহার করেনি। ১৯৯৩ সালে বিএনপি নেতা ফেরদৌশ কোরেশীর সপ্তসিন্ধু কীবোর্ডটিকে বাংলা একাডেমী অনুমোদন দেয়। বাংলা একাডেমী এরই মাঝে ২৫ লাখ টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে তিন স্তরের একটি কীবোর্ডও অনুমোদন করে। বাস্তবতা হলো একাডেমী এসবের একটি কীবোর্ডকেও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করতে পারেনি।

অন্যদিকে ১৯৯৩ সালে সরকার জাতীয় কীবোর্ড নামে একটি কীবোর্ড অনুমোদন করে। তবে সেটি বিএসটিআইয়ের অনুমোদন পায়নি। ২০০০ সালে সরকার তাদের পূর্বতন মানকে সংশোধন করে বাংলা এনকোডিং মান হিসেবে বিডিএস ১৫২০:২০০০ নির্ধারণ করে। এখন পর্যন্ত এটিই আমাদের বাংলা ভাষার বর্ণসমষ্টির মান। তবে ১৯৯৩ সালে বিসিসি অনুমোদিত জাতীয় কীবোর্ডটি বিডিএস মান না পাওয়ায় সেটিকে বিডিএস ১৫২০:২০০০-এর সাথে সমতুল্য করে প্রণয়ন করার জন্য ২৯-০৫-২০০০ তারিখে একটি ৯ সদস্যবিশিষ্ট উপ-কমিটি গঠন করা হয়। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর ২০০৩ সালের ৩০ জানুয়ারি এই উপ-কমিটি বিজয় কীবোর্ডকে প্রমিত কীবোর্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেবার জন্য বিএসটিআইয়ের ইটি-১৫ কমিটির কাছে সুপারিশ করে। এর আগে বাংলা ভাষার প্রমিত করার ব্যাপারে সরকারের কালক্ষেপণ ও ব্যর্থতা থাকলেও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয় সেদিন থেকেই।

বিএসটিআইয়ের ইটি-১৫ কমিটির ৩০ জানুয়ারির সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক এ এম চৌধুরী। তিনি বিজয় কীবোর্ড প্রমিত করার সুপারিশ আসায় সভার কাজ একতরফাভাবে মুলতবি করেন ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ পর্যন্ত। সেই মুলতবি সভা আর অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং মঈন খান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আইসিটি টাস্কফোর্সের নির্বাহী পরিষদের সভার প্রধান তৎকালীন সরকারের মুখ্যসচিব কামাল সিদ্দিকীকে প্রভাবিত করে বিএসটিআইয়ের কমিটি ভেঙ্গে দেন এবং তার নিজের মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১২ এপ্রিল ২০০৩ একটি কমিটি গঠন করে কীবোর্ড প্রমিত করার দায়িত্ব দেন। কমিটি কীবোর্ড প্রমিত করার জন্য একটি উপ-কমিটি করে। সেই কমিটির প্রধান ছিলেন ড. জাফর ইকবাল। তিনি তার প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বিজয় কীবোর্ডকেই সবচেয়ে বিজ্ঞানসম্মত ও জনপ্রিয় কীবোর্ড হিসেবে স্বীকার করেন।

সেই কমিটির সুপারিশ অনুসারে বিডিএস ১৭৩৮:২০০৪ অনুমোদিত হয়। কার্যত এটিই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন পাওয়া প্রথম বাংলা কীবোর্ড। সেই কীবোর্ড লেআউটটি বিজয় কীবোর্ডের শতকরা ৯৮ ভাগ নকল। একটি বোতাম অদলবদল ও দু’টি বোতাম পরিবর্তন করে বিজয়-এর নকল করার পর এর কপিরাইটও গ্রহণ করা হয়। কমপিউটার কাউন্সিল সেই কীবোর্ড বাস্তবায়নের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিনামূল্যে বিতরণ করারও উদ্যোগ নেয়। আমি বাধ্য হয়ে কপিরাইট অধিদফতরে কমপিউটার কাউন্সিলের কপিরাইট নিবন্ধন বাতিল করার জন্য আবেদন করি। সেই অভিযোগটিরও এখন পর্যন্ত কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ হওয়ায় কপিরাইট নিবন্ধক এই বিষয়ে দু’টি শুনানি করার পর এর শুনানিও বন্ধ করে দেন। এরপর নির্বাচন কমিশন বিসিসির কীবোর্ডের আওতায় বিজয়ের নকল সফটওয়্যার ব্যবহার করতে থাকে। সেখানেও প্রতিবাদ করে কোনো সুফল পাইনি আমি। তবে মজার বিষয়, বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলও তাদের নিজেদের সফটওয়্যার ব্যবহার করে না, বিজয় ব্যবহার করে। এখন পর্যন্ত এই কীবোর্ড বা প্রযুক্তির কোনো ব্যবহারকারী পাওয়া যায়নি। তবে ফি বছর জনগণের অর্থ ব্যয় করে এর আপডেট করা হয়।

২০০৯ সালে আসা বর্তমান সরকারের কাছেও আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ডিজিটাল যুগের বাংলা ভাষার প্রমিতকরণকে নকলমুক্ত ও আপডেটেড করার আবেদন জানাই। আইসিটি পলিসি ২০০৯-এও একই প্রস্তাবনা গৃহীত হয়। সর্বশেষ বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের ২৯ সেপ্টেম্বরের সভায় বিষয়টি আলোচিত হয় এবং ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সংক্রান্ত প্রস্তাবিত কমিটির সুপারিশের আলোকে এতদসংক্রান্ত গবেষণা ও উন্নয়নবিষয়ক প্রকল্প/কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে (সিদ্ধান্ত ৩(৩১)/২০০৯(ঢ)’ মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সম্ভবত বিসিসির কাউন্সিলের সেই সভায়ই সরকারকে কমপিউটার কাউন্সিলের প্রস্তাবিত কমিটি অনুমোদন দানের কাজটিকে ত্বরান্বিত করে থাকবে। কারণ, মন্ত্রণালয় সেদিনই ২৭ দিন (২ সেপ্টেম্বর ২০০৯ কমপিউটার কাউন্সিল প্রস্তাব পেশ করে) ফেলে রাখার পর বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের প্রস্তাবটি অনুমোদন করে।

৮ অক্টোবর ২০০৯ বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির পক্ষ থেকে একটি মেইলে আমাকে জানানো হয়, সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রমিতকরণ সংক্রান্ত একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমপিউটার কাউন্সিলের পত্র মোতাবেক এই কমিটির আহবায়ক হলেন বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের কার্যনির্বাহী পরিচালক।

বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল যখন বিজ্ঞান ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ে ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ভাষার প্রমিত করার বিষয়ে কমিটি গঠন করার প্রস্তাব পাঠায়, তখন তারা সাকুল্যে চারটি পত্রের সূত্র উল্লেখ করেছিল। প্রথমত প্রতিষ্ঠানটি ২০০৩ সালের বিজ্ঞান ও আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সেই পত্রের উল্লেখ করে যার মাধ্যমে বিজয় কীবোর্ড প্রমিত করার জন্য বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড ও টেস্টিং ইনস্টিটিউটের গৃহীত সর্বশেষ উদ্যোগটি বাতিল করার জন্য এ এম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটি গঠন করা হয়। এই পত্রটিই যে কমপিউটার কাউন্সিলকে প্রমিত করার অধিকার দিয়েছে এবং বিএসটিআইয়ের ইটি-১৫-এর যৌক্তিক অধিকারকে হরণ করেছে, সেটি অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন। মন্ত্রণালয়ের এই পত্রের ক্ষমতার উৎস হলো প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন আইসিটি টাস্কফোর্সের নির্বাহী কমিটির সভা। সেই সভায় ইটি-১৫ বাতিল ও মঈন খানের মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্মরণ করা প্রয়োজন, বিজয় কীবোর্ডটিকে যাতে জাতীয় কীবোর্ডের স্বীকৃতি না দেয়া যায় সেজন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।

প্রস্তাবনায় উল্লিখিত পত্রের সূত্রের সাথে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল বিএসটিআইয়ের (বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট) একটি পত্রের কথা তাদের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করেছিল। আমি খুব খুশি হতাম যদি বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল বিএসটিআইয়ের পত্রের সাথে যুক্ত আরও একটি পত্রের কথা উল্লেখ করত। অথবা এটি তারা স্বীকার করত যে, বিএসটিআই বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির একটি পত্রের বরাত দিয়ে তাদের সেই পত্রটি লিখেছিল। এই পত্রটি বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল এক বছর আগে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে পায়। কিন্তু সেই পত্রের বরাতে তারা সেই সময়ে তো বটেই, নতুন সরকার আসার পরও প্রায় ছয় মাস কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং কপিরাইট বোর্ডের মামলায় আমার প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেক বেশি দক্ষতা দেখায়। তারা উকিলের জন্য টাকা খরচ করে এবং এমনকি তাদের অপছন্দনীয় প্রত্যাখ্যাত সফটওয়্যারটির উন্নয়নের জন্যও নতুন করে টাকা ব্যয় করে। হতে পারে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে কমপিউটার কাউন্সিল রাজনৈতিক চাপ থেকে বের হতে পারেনি। তবে এই বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও তাদের অমার্জনীয় নীরবতা মোটেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাদের কাছে আমার লিখিত পত্র এবং মৌখিক আলাপে এই বিষয়টি আমি স্পষ্ট করেছিলাম যে, কোনো রাষ্ট্র একজন ব্যক্তির মেধাসম্পদকে কোনো কালেই গিলে খেতে পারে না।

বিসিসি জানে, বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি বিএসটিআইয়ের কাছে পাঠানো পত্রে বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার প্রমিতকরণ সংক্রান্ত বিষয়গুলো হালনাগাদ করার পাশাপাশি নকলের অভিযোগ থেকে মুক্ত করার জন্য অনুরোধ করেছিল। বিএসটিআইয়ের পরিচালক (মান) আকতারুজ্জামান তার পত্রে জানিয়েছিলেন, এ বিষয়ে তাদের কোনো এখতিয়ার নেই। সেজন্যই তারা বিসিএসের পত্রটি সংযুক্ত করে তাদের পত্রটি বিসিসিকে পাঠিয়েছিলেন।

সরকারের নতুন কমিটির কার্যপরিধি হলো দু’টি :

ক. কমিটি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার সাথে সঙ্গতি রেখে বাস্তবতার নিরিখে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার প্রমিত করার বিষয়ে সরকারের বিবেচনার জন্য বিসিসির কাছে সুপারিশ পেশ করবে।

খ. আন্তর্জাতিক মান ইউনিকোডের সাথে জাতীয় মানের ভিন্নতা নিরসনের জন্য বিএসটিআই গৃহীত কমপিউটারে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার সংক্রান্ত জাতীয় মানসমূহ যাচাই ও হালনাগাদ করা।

কমিটির কার্যপরিধিতে মোবাইল ফোনের কীবোর্ডের কথা বলা হলেও এর এনকোডিং বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। প্রকৃতপক্ষে আমরা সব ডিজিটাল যন্ত্রের জন্যই এনকোডিং করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। এখন যদি মোবাইল ফোনের এনকোডিং নির্ণয় করা না যায়, তবে কোনোভাবেই আমরা একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে রেহাই পাব না।

এই কমিটির কার্যপরিধিতে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও গবেষণাসংক্রান্ত প্রকল্প বা কার্যক্রম গ্রহণ বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। এটি এজন্য হয়নি যে, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯ অনুষ্ঠিত বিসিসির কাউন্সিল সভার আগে এই বিষয়ে কমপিউটার কাউন্সিল কিছুই ভাবেনি। বরাবর এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলা ভাষার প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বিষয়ে নীরবতাই পালন করেছে। এই অমার্জনীয় অপরাধের জন্য এই সংস্থাটিকে কখনো কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয়নি।

কমিটি গঠনের প্রস্তাবনায় আরো তিনটি অনুচ্ছেদ রয়েছে। সেগুলো হলো : গ. সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির পর থেকে পরবর্তী দুই বছরের জন্য কমিটির কার্যকারিতা বহাল থাকবে। ঘ. কমিটি বিএসটিআইয়ের মাধ্যমে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামসহ সংশ্লিষ্ট সব আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগের বিষয়ে সমন্বয় সাধন করবে। ঙ. কমিটি প্রয়োজনে এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট ইন্ডাস্ট্রি থেকে সদস্য কোঅপ্ট এবং কারিগরি সাব-কমিটি গঠন করতে পারবে।

কমিটির গঠন কাঠামোতে এটি স্পষ্ট, এতে সংশ্লিষ্ট সব খাতের মানুষকেই সম্পৃক্ত করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত সমিতি ও সংগঠনগুলোর পাশাপাশি এর উন্নয়নের সাথে জড়িত প্রায় সব প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার পক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে বলে এটি দুই বছরের জন্য স্থায়ী করায় কোনো অসুবিধা হবে না।

এরই মাঝে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলে এই কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১১ অক্টোবর ২০০৯ বিকেল সাড়ে তিনটায়। সেখানে কমিটির করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।

আমি মনে করি, কমিটির সামনে করণীয় বিষয়গুলো

তিন ভাগে বিভক্ত হতে পারে :

ক. বাংলা কীবোর্ড সংক্রান্ত বিদ্যমান নকলের অভিযোগের জটিলতা নিরসন এবং একটি মানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য কীবোর্ড প্রমিত করা। এই মান প্রমিত করার কাজটি কমপিউটার, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ডিজটাল যন্ত্রের জন্য প্রযোজ্য হবে। এর ফলে বিজয় কীবোর্ড নকল করার জন্য বিসিসির কীবোর্ডের দায়কেও মুক্ত করা হবে। এমনকি প্রয়োজনে কোনো প্রমিত কীবোর্ড ঘোষণা নাও করা হতে পারে। বাজার অর্থনীতির ওপর কীবোর্ডের ভবিষ্যত ছেড়ে দেয়া যেতে পারে।

খ. বাংলা এনকোডিং সম্পর্কে ইউনিকোড মানকে অনুসরণ ও ইউনিকোড মান সম্পর্কে বাংলাদেশের বক্তব্য যথাস্থানে পেশ করা এবং এ বিষয়ে কনসোর্টিয়ামের অনুকূল সিদ্ধান্ত পাওয়া। এর ফলে বিদ্যমান মানকে আপডেট করা হবে।

গ. বাংলা ভাষার উন্নয়নে গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড গ্রহণ, বাস্তবায়ন ও মনিটর করা। কমিটির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হবে এটি।

ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ভাষা প্রমিত করার জন্য গঠিত সরকারের স্থায়ী কমিটির কাজগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করলেও এর জন্য মাত্র একটি ক্ষেত্রেই দীর্ঘস্থায়ী কাজ করতে হবে। অন্য অর্থে বলা যায়, একটি খাতেই রয়েছে এই কমিটির চ্যালেঞ্জ। কমপিউটারের কীবোর্ড বা মোবাইল ফোনের কীবোর্ড নিয়ে খুব বেশি গবেষণা করার সুযোগ নেই। কমিটিকে বাজার এবং বাস্তবতা এই দু’টির প্রতি লক্ষ রেখে কীবোর্ড বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোড বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়াটা প্রথম সভাতেই সম্পন্ন হয়েছে। কারণ, ইউনিকোড এনকোডিংকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোনো সুযোগ এখন আর নেই। ফলে বর্তমানে বিদ্যমান ইউনিকোড ৫.১/৫.২ এনকোডিং গ্রহণ করাটাই সুবিবেচনার কাজ হয়েছে। তবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হবে ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও উন্নয়ন বিষয়ে প্রকল্প গ্রহণ এবং সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা। নিচে কমিটির কাজগুলো সম্পন্ন করার বিষয়গুলো আলোচিত হলো।

কমপিউটার ও মোবাইল ফোনের কীবোর্ড :

কমপিউটারে বাংলা কীবোর্ডবিষয়ক জটিলতা হলো বর্তমান মানটি একদিকে বিজয় কীবোর্ডের নকল এবং অন্যদিকে এটি ত্রুটিপূর্ণ ও চার স্তরের। নকল সম্পর্কে বলা যায়, একটি মেধাস্বত্বের পণ্যের সামান্য অদলবদল করা হলেই সেটি নতুন পণ্য হয় না। এর কপিরাইট নিবন্ধন হতে পারে না এবং এটি নিজস্ব পণ্য হিসেবে বাজারে প্রচলিত হতে পারে না। বিজয় কীবোর্ডের এফ ও এইচ বোতাম অদলবদল এবং জেড ও এক্স বোতামে নতুন অক্ষর বসিয়ে দিয়ে বিসিসির কীবোর্ড যেভাবে তৈরি হয়েছে তাকে বাতিল করতে হবে এবং কপিরাইট অফিসকে এই নিবন্ধন বাতিল বা প্রত্যাহার করতে বলতে হবে। এটি চার স্তরের বলে এতে অল্ট জিআর ছাড়া যুক্তাক্ষর ও সব বর্ণ লেখা যায় না। বিজয় কীবোর্ডে এই জটিলতার সমাধান আছে। ইংরেজি জি বা বাংলা হসন্ত বোতাম দিয়ে সব বর্ণ ও যুক্তাক্ষর তৈরির আবিষ্কৃত, ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত ও জনপ্রিয় এই পদ্ধতি পরিবর্তন করার প্রয়োজন ছিল না। একই সাথে বিসিসির বিদ্যমান কীবোর্ডে ৎ বর্ণটি নেই। সার্বিকভাবে এর স্পষ্ট সমাধান হলো : বিদ্যমান বিসিসি কীবোর্ডের কপিরাইট নিবন্ধন প্রত্যাহার করা এবং বিজয় কীবোর্ডকে এর যথাযথ মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় মান হিসেবে মেনে নেয়া।

মেধাস্বত্বের স্বত্বাধিকারী হিসেবে আমি বলতে পারি, অবাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমি কোনো ধরনের আর্থিক উপার্জন চাই না। তবে বাণিজ্যিক ব্যবহার সেটি হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার যাই হোক না কেনো, তাতে আমার মেধাস্বত্বের সব অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। যেমন সরকার উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমে যদি কোনো কীবোর্ড ব্যবহার করে তবে আমার কীবোর্ডের জন্য প্রাপ্য সম্মানি আমাকে দিতে হবে। মাইক্রোসফট বা অ্যাপল যদি এটি তাদের অপারেটিং সিস্টেমে ব্যবহার করে তবে মাইক্রোসফটকে আমাকে সম্মানী দিতে হবে। কারণ, উইন্ডোজ বা ম্যাক ওএস বিনামূল্যের পণ্য নয়। আবার যদি লিনআক্স বিজয় কীবোর্ড ব্যবহার করে তবে এর জন্য শুধু আমার লিখিত অনুমতি নিতে হবে। যদি কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক কারণে আমার কীবোর্ড ব্যবহার করে তবে তাকে অবশ্যই এর বাণিজ্যিক বিষয়টি আমার সাথে ফয়সালা করতে হবে। একইভাবে যারা বিজয় কীবোর্ড মুদ্রিত হার্ডওয়্যার আমদানি করবে ও বাজারে মূল্যের বিনিময়ে বিক্রি করবে তারা আমার মেধাস্বত্বের সম্মানী হিসেবে প্রাপ্য দেবে। যদি কেউ তার বাণিজ্যিক সফটওয়্যারে বিজয় কীবোর্ড ব্যবহার করে, তবে তার জন্য তাকে আমাকে অর্থ দিতে হবে। কিন্তু অবাণিজ্যিক বা মুক্ত সফটওয়্যারে কোনো রয়্যালটি দিতে হবে না, কিন্তু অবশ্যই লিখিত অনুমতি নিতে হবে। এই হার নির্ধারণে আমি এই কমিটির যুক্তিসঙ্গত মধ্যস্থতা মানতেও রাজি আছি। এমনকি কোনো তৃতীয় পক্ষ, যেমন বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলকে এসব বিষয় সমন্বয় করার দায়িত্বও দিতে পারি।

প্রসঙ্গত আমি এটিও উল্লেখ করতে চাই, সরকার বা এই কমিটি প্রয়োজনে বিজয় ছাড়া অন্য কোনো কীবোর্ডকেও প্রমিত করতে পারে। কারণ, এই স্বাধীনতা সবারই আছে যে তারা নতুন কোনো প্রযুক্তিকে গ্রহণ করবে। অবশ্য তখন সরকারকে স্মরণ রাখতে হবে, বাংলা ভাষার প্রায় এক কোটি ব্যবহারকারী এখন বিজয় কীবোর্ড প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ব্যবহার করে এবং প্রতিমাসে শুধু বাংলাদেশেই ৮০ হাজারের বেশি বিজয় কীবোর্ড লেআউট মুদ্রিত কীবোর্ড বাজারে বিক্রি হয়। সফটওয়্যারের প্রকৃত হিসেব পরিমাপ করা সম্ভব না হলেও শতকরা ৯৯টি কমপিউটার যে বিজয় কীবোর্ডসহ ব্যবহারকারীর হাতে যায় এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। খুব সঙ্গতকারণেই এই কমিটিকে এই বিশেষ বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে যে, বাইশ বছর আগে যেভাবে কীবোর্ড প্রমিত করার সুযোগ ছিল এখন আর তা নেই।

বিদ্যমান বিসিসি কীবোর্ডের কপিরাইট নিবন্ধন প্রত্যাহার করা এবং বিজয় কীবোর্ডকে এর যথাযথ মেধাস্বত্বের স্বীকৃতি দিয়ে জাতীয় মান হিসেবে মেনে নেয়া।

মেধাস্বত্বের স্বত্বাধিকারী হিসেবে আমি বলতে পারি, অবাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমি কোনো ধরনের আর্থিক উপার্জন চাই না। তবে বাণিজ্যিক ব্যবহার সেটি হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার যাই হোক না কেনো, তাতে আমার মেধাস্বত্বের সব অধিকার অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে।


কমপিউটার বা স্মার্ট ফোনের জন্য একই কীবোর্ড ব্যবহার হবে। সেখানে ভার্চুয়াল বা ফিজিক্যাল সব কীবোর্ডেই একই লেআউট থাকবে। তবে যেসব ডিজিটাল যন্ত্রে শুধু নিউমারিক কীপ্যাড ইনপুটের জন্য ব্যবহার হয় যেমন জাভাভিত্তিক বা অন্যান্য মোবাইল ফোন, তাতে বাংলা বর্ণ ব্যবহার হবে এরকমভাবে : ১ বোতামে-অ,া, ,,ী,ু,ূ; এখানে নরমাল পজিশনো, ,,ৃ এবং শিফট পজিশনে অ,ী,ূ থাকতে পারে। ২ বোতামে-ৃ, ,, ,, ও, Š; এর মাঝেৃ, ,, স্বৈাভাবিক পজিশনে এবং অন্য বর্ণগুলো শিফট পজিশনে ব্যবহৃত হতে পারে। ৩ বোতামে- ক, খ, গ, ঘ, ঙ থাকতে পারে। এর মাঝে ক, গ, ঙ স্বাভাবিক ও খ, ঘ শিফটে থাকতে পারে। ৪ বোতামে-চ, ছ, জ, ঝ, ঞ থাকতে পারে। এর মাঝে চ, জ, ঞ স্বাভাবিক ও বাকি বর্ণগুলো শিফটে থাকতে পারে। ৫ বোতামে-ট, ঠ, ড, ঢ, ণ থাকতে পারে। এর মাঝে ট, ড ও ণ স্বাভাবিক ও বাকিগুলো শিফটে থাকতে পারে। ৬ বোতামে-ত, থ, দ, ধ, ন থাকতে পারে। এর মাঝে ত, দ ও ন স্বাভাবিক এবং বাকিগুলো শিফটে থাকতে পারে। ৭ বোতামে- প, ফ, ব, ভ, ম থাকতে পারে। এর মাঝে প, ব, ম স্বাভাবিক ও বাকি দু’টি শিফটে থাকতে পারে। ৮ বোতামে-য, র, ল, শ, ষ, স থাকতে পারে। যার মাঝে য, র, ল, স স্বাভাবিক ও বাকিগুলো শিফটে থাকতে পারে; ৯ বোতামে- হ, ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং,ঃ,ঁ থাকতে পারে যার মধ্যে হ, ড়, য় স্বাভাবিক ও বাকিগুলো শিফটে থাকতে পারে এবং ০ বোতামে- স্পেস, ।, \ ইত্যাদি বোতাম থাকতে পারে, যার মাঝে । ও \ শিফটে থাকতে পারে। অন্যদিকে * বোতামে্ (হসন্ত), টাকা চিহ্ন ও অন্যান্য চিহ্ন থাকবে। হসন্ত বা * বোতামটি স্বরবর্ণ ও যুক্তাক্ষর তৈরির জন্য ব্যবহৃত হবে। # বোতামটি শিফট, র ফলা, য ফলা ও রেফ-এর জন্য ব্যবহৃত হবে। যদিও এই কী লেআউট আমার নিজের চিন্তার বিষয়-তবু এর কোনো মেধাস্বত্ব আমি দাবি করছি না এবং এটি ব্যবহার করার জন্য আমি কোনো রয়্যালটিও দাবি করছি না। তবে ‘জনাব মোস্তাফা জববারের ধারণা অনুসারে এই লেআউটটি প্রমিত করা হয়েছে’-এটি স্বীকার করা হলে আমি আনন্দিত হবো।

কীবোর্ড প্রমিত করার পর সরকার এই দু’টি কীবোর্ড ব্যবহার বাধ্যতামূলক করবে এবং সব সফটওয়্যারে ও ডিজিটাল যন্ত্রে এই কীবোর্ড অবশ্যই থাকার জন্য একটি আইন প্রণয়ন করবে। কমপিউটার ও মোবাইলসহ সব ডিজিটাল যন্ত্রে এই কীবোর্ড মুদ্রণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।

তবে যদি কমপিউটারের জন্য কোনো কীবোর্ড প্রমিত করা না হয় তবে আমাদের সবাইকে বাজারের ওপর সব কিছু ছেড়ে দিতে হবে এবং আমরা তখন কেবল ডাটা এনকোডিংকেই আমাদের মূল বিষয় হিসেবে গণ্য করব। সেক্ষেত্রে আমরা কাউকেই একথা বলতে পারব না যে, তুমি অমুক কীবোর্ড ব্যবহার করো বা অমুক কীবোর্ড ব্যবহার করো না। মানুষ ইউনিকোড যা বিডিএস ১৫২০:২০০৯ নামে অভিহিত হবে তার অনুসারে ডাটা স্টোর করবে এবং তার পছন্দমতো কীবোর্ড ব্যবহার করবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিশেষভাবে ডাটা কম্প্যাটিবিলিটির কথা জোর দিয়ে ভাববে। সরকার ইচ্ছে করলে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইউনিকোড এনকোডিং ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে পারে।

বাংলা এনকোডিং ও ইউনিকোড :

ইউনিকোড নিয়ে আমাদের সমস্যা হলো : ক. এই কোডসেটে বাংলা বর্ণানুক্রমকে দেবনাগরীর মতো করতে গিয়ে কিছু কিছু বর্ণকে মূল বর্ণের সারিতে না রেখে বাড়তি অংশে রাখা হয়েছে। আমরা বর্ণ পরিচয় বা বাল্যশিক্ষায় ড়, ঢ়, য়, ৎ, ং,ঃ বর্ণগুলোকে যেভাবে পাঠ করি বাংলা অভিধানে বা ইউনিকোডে সেভাবে রাখা হয়নি। খ. দেবনাগরীর কোডসেট থেকে দাড়ি এবং দুই দাড়ি ব্যবহার করতে হয়।

ইউনিকোড নিয়ে বেশ কিছু সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আমি মনে করি, আমরা ইউনিকোডের বর্তমান মানটি গ্রহণ করতে পারি। তবে বিএসটিআইয়ের মাধ্যমে আইএসও-কে আমরা আমাদের দাবির কথা জানাতে পারি। উল্লেখ প্রয়োজন, বছরে ১২ হাজার ডলার দিয়ে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য না হবার ফলে এই প্রতিষ্ঠানটির কারিগরি দলে আমরা প্রবেশ করতে পারিনি। এখন বোধহয় তার প্রয়োজনও নেই। তবে যেহেতু বাংলাদেশ আইএসও’র সদস্য সেহেতু আমরা আমাদের কথাগুলো আইএসও-কে জানাতে পারি। বর্তমানে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য না হয়েও আইএসও’র মাধ্যমে আমরা আমাদের কথাগুলো বলতে পারি। কার্যত দু’টি প্রতিষ্ঠান এখন একসাথে কাজ করে। ফলে আমাদের আইএসও’র সদস্যপদই এ বিষয়ে আমাদেরকে সহায়তা করতে পারে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা আইএসওতেও আমাদের ভূমিকা পালন করি না। আমি দেখেছি ইউনিকোড সঙ্কেতায়নে বাংলা হারে চিহ্ন নেই। অভাগ্রহ নামে হ দিয়ে তৈরি একটি অক্ষর আছে। দেবনাগরীতেও এটি আছে। আমি জানি না এই অভাগ্রহ কোন কাজে লাগে। তবে কাজে লাগুক আর না লাগুক সেই অক্ষরটি থাকলে আমার কোনো সমস্যা নেই। হতে পারে অসমিয়াতে এর ব্যবহার আছে। তবে আমি অবশ্যই মনে করি আমাদের একটি হারে চিহ্ন প্রয়োজন। বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের সুপারিশ অনুসারে বিএসটিআই-কে এখনই আইএসও-কে এই তথ্যটি জানাতে হবে। আমি ধারণা করি বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে বিষয়টি তুলে ধরতে পারে তবে দাড়ি ও হারে চিহ্ন নিয়ে আমাদের এখন যে সঙ্কট আছে তা থাকবে না।

যেভাবেই হোক হারে চিহ্ন, দাড়ি ও দুই দাড়ির জন্য তিনটি আলাদা কোড আমাদেরকে অবশ্যই পেতে হবে। কাজটি অনেক দ্রুত করা দরকার। নইলে বিদ্যমান তথ্যকে ভবিষ্যতে রূপান্তর করার জন্য কঠিন লড়াই করতে হবে।

বিদ্যমান বিডিএস ১৫২০:২০০০-এর বদলে ইউনিকোডের ৫.১/৫.২ মানকে আমরা আমাদের জাতীয় মান হিসেবে নিলেও বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে কমপিউটারের বিভিন্ন অপারেটিং সিস্টেম ও অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামে এর সমর্থন না থাকা নিয়ে। কেবল মাইক্রোসফটের উইন্ডোজের সব অ্যাপ্লিকেশন ইউনিকোড সমর্থন করে। এর কারণ এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো ইনপুটের জন্য উইন্ডোজের ডিএলএল অনুসারে কাজ করে। কিন্তু অন্য কোম্পানি যেমন অ্যাডোবি, কোয়ার্কের অ্যাপ্লিকেশনগুলো সেই ডিএলএল অনুসারে ক্যারেক্টার ডিসপ্লে করে না। ফলে এসব অ্যাপ্লিকেশনে ইউনিকোড সমর্থন থাকলেও সেটি দিয়ে বাংলায় কাজ করা যায় না। তবে প্রায় সবার তৈরি করা ইন্টারনেট ব্রাউজারগুলো ইউনিকোড সমর্থন করে।

অ্যাপলের অপারেটিং সিস্টেম ম্যাক ওএস ইউনিকোড সমর্থন করলেও বাংলা সমর্থন করে না। সম্ভবত তাদের জন্য বাংলা ভাষা এখন আর তত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। অ্যাপল, অ্যাডোবি, কোয়ার্ক এসব প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বাংলা ইউনিকোড সমর্থন না করার প্রধান কারণ দু’টি। প্রথমত- পাইরেসির জন্য এসব প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য আলাদাভাবে সফটওয়্যার উন্নয়ন করার কাজ করে না। দ্বিতীয়ত- বাংলার বাজার খুব সীমিত।

অ্যাডোবি বা কোয়ার্ক যদি তাদের অ্যাপ্লিকেশনে উইন্ডোজের ডিএলএল সমর্থন করে তবেই এই সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। অ্যাপল যদি তাদের অপারেটিং সিস্টেমে বাংলার ডিসপ্লে সমর্থন করে এবং অ্যাপ্লিকেশনগুলো যদি সেই ডিএলএল অনুসারে কাজ করে তবেই এর সমাধান হতে পারে। এজন্য কমপিউটার কাউন্সিল বা সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।

বাংলা সর্টিং :

ইউনিকোড এনকোডিং নিয়ে আলোচনা করার পাশাপাশি আরও একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রমিতকরণ জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা যদি এখনই এই বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা না নিই, তবে আমাদের জন্য একটি বিশাল সমস্যা আরো অনেক দিন বেঁচে থাকবে। লক্ষ করবেন, বাংলা ভাষা কমপিউটারে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে একটি অন্যতম সমস্যা হলো সর্টিং বা বর্ণানুক্রম। বাংলা সর্টিংয়ের কমপিউটার ছাড়াও সমস্যা আছে। আমাদের অভিধানে যেভাবে আমরা বাংলা বর্ণ পাই, আমাদের লেখাপড়ার সময় সেভাবে আমরা পাঠ করি না। আমাদের অভিধানে প্রথমেই থাকে ং,ঃ,ঁ ইত্যাদি। এই নিয়মটি সংস্কৃত বা দেবনাগরী থেকে পাওয়া। আবার আমাদের ড়, ঢ়, য়, অভিধানে কখনো শেষে থাকে-আবার কখনো ড, ঢ ও য-এর সাথে থাকে। এসব নিয়মও দেবনাগরীকে অনুসরণ করা। আমি মনে করি, যদি এই নিয়মটি মানতে হয় তবে আমাদের পাঠ্যবইয়ের সংস্কার করতে হবে। আমরা আমাদের শিশুকে যেভাবে বাংলা পড়াই বর্ণানুক্রম সেভাবেই হওয়া উচিত। তখন আমাদের অভিধানের প্রথম বর্ণ হবে অ। স্বরবর্ণের পর আমাদের ব্যঞ্জনবর্ণ ক দিয়ে শুরু হবে। ইংরেজির মতো আমাদের সংখ্যাও বর্ণানুক্রমে আগে থাকতে পারে। আমরা বহুদিন যাবত এই বিষয়ে কথা বলেছি। কিন্তু কোনোভাবেই দেবনাগরীকে অনুসরণ করার বর্ণানুক্রম থেকে বের হতে পারিনি। যারা অন্য কারণে ভারত বিরোধিতা করেন তারাও কেন জানি প্রচলিত এই বর্ণানুক্রমকে পরিবর্তন করতে চান না।

আমি ব্যাকরণের পন্ডিত নই-শুধু বাংলা ভাষার ছাত্র। সে হিসেবেই আমি মনে করি আমাদের জীবনের স্বাভাবিক গতির সাথে ভাষাকে সমন্বিত করতে হবে। এর মধ্য থেকে সম্ভাব্য সব জটিলতা দূর করার চেষ্টা করতে হবে।

নবগঠিত কমিটির জন্য এটি একটি সুসংবাদ যে, এই কমিটিতে বাংলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রফেসর মনসুর মুসা রয়েছেন। বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক বা তার প্রতিনিধিও এই কমিটিতে রয়েছেন। সর্টিং অর্ডার ঠিক করার জন্য দেশে বাংলা ভাষার অন্য যেসব পন্ডিত রয়েছেন তারাও এই কমিটির কারিগরি অংশে যোগ দিতে পারেন। অন্তত বাংলা একাডেমী এই বিষয়ে সেমিনার বা কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। কমিটির পক্ষ থেকেও এমন কর্মশালার আয়োজন করা যায়। সেই কর্মশালায় বাংলা ভাষার পন্ডিতদের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে। তারা নিজেরা আলোচনা-বিতর্ক করতে পারেন। যদি আমাদের পন্ডিতদের সুমতি হয় তবে তারা দেবনাগরীর অনুকরণে বাংলা সর্টিং প্রথাটি বর্জন করে যেভাবে বিদ্যাসাগর বাংলা বর্ণের অনুক্রম ঠিক করেছেন এবং আমরা এখনো আমাদের শিশুকে যেভাবে বাংলায় পড়াই সেভাবেই বাংলা সর্টিংয়ের মান ঠিক করতে পারেন।

নর্মালাইজেশন :

বাংলা সর্টিং অর্ডার ঠিক করার পাশাপাশি ইউনিকোড নর্মালাইজেশন বিষয়টি নিয়েও ভাবা দরকার। আমরা জানি ইউনিকোড নিজে একটি বর্ণানুক্রম অনুসরণ করে। এতে আমরা যেভাবে বাংলা দেখি সেভাবে বাংলা বর্ণ সংরক্ষণ করা হয় না। যেমন আমরা ‘পথিক’ দেখি যেভাবে ইউনিকোড সেভাবে এই বর্ণগুলো সংরক্ষণ করে না। পথিক ইউনিকোডে ‘পথকি’ হয়ে যায়। এর মানে আমরা যে ‘’’ কারটি থ-এর আগে দেখি, সেটি পড়ে বসে। এমনি করে কোর কার তার অবস্থান পরিবর্তন করে। বাংলা কার চিহ্নের এই স্থান পরিবর্তন পুরোপুরি হিন্দি বা দেবনাগরীকে অনুসরণ করেই করা হয়েছে। এই কারণে দেবনাগরীতে নেই এমন বর্ণ যেমন ড়, ঢ়, য় নিয়ে মহাবিপদ হচ্ছে।

২০০৯ সালে এসে আমরা এটি উপলব্ধি করতে পারি, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ এবং তার রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও ভাষার প্রমিতকরণ নিয়ে তেমনভাবে কাজ করতে না পারার জন্য আজকের সঙ্কটগুলো রয়ে গেছে। যদি আমরা শুরুতেই সতর্ক হতাম, অন্তত নববই সালের পর থেকে যদি আমরা ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য হতাম এবং এর কার্যক্রমে অংশ নিতাম তবে বাংলা ভাষার যেমন প্রমিতকরণ হয়েছে তার চাইতে আরো ভালো কিছু একটা আমরা পেতে পারতাম। এখন দেরিতে হলেও অতীতের ভুল সংশোধন করতে হবে। এবার যে কমিটি হয়েছে সেই কমিটি অতীতের ব্যর্থতা থেকে বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল বাংলাদেশের সাফল্যে আনতে সক্ষম হবে বলেই আমি মনে করি।

নবগঠিত কমিটির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জের বিষয়টি হবে সরকারি-বেসরকারি খাতে বা যৌথভাবে বাংলা ভাষার গবেষণা ও উন্নয়ন কাজ চিহ্নিত করা, সেসব কাজের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।

বাংলা ভাষার ডিজিটাল যাত্রার উন্নয়ন ও গবেষণা : পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড নামের একটি সংস্থা ছিল। শহীদ মুনীর চৌধুরী এই বোর্ডের সহায়তায় ও সরাসরি অর্থায়নে মুনীর কীবোর্ড উন্নয়ন করেন। এই বোর্ড বাংলা সাহিত্যের বিকাশের জন্য নজরুল রচনাবলী প্রকাশ করেছিল। স্বাধীনতা লাভের পর এই বোর্ডটিকে বাংলা একাডেমীর সাথে একীভূত করা হয়। বাংলা একাডেমী কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ডের সম্পত্তি মুনীর কীবোর্ড প্রয়োগ করে অপটিমা মুনীর টাইপরাইটার বাজারজাত করে। সেই অর্থে বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হলো বাংলা একাডেমী। এই প্রতিষ্ঠানটি এরই মাঝে ইলেকট্রনিক টাইপরাইটারের উন্নয়নের জন্য অন্তত একটি প্রকল্প বাস্তবায়নও করেছে। আমার জানা মতে সেই প্রকল্পটিতে ২৫ লাখ টাকার একটি বরাদ্দ ছিল, যার অন্তত অর্ধেক ব্যয় করা হয়েছিল। জামিল চৌধুরী এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিন স্তরের কীবোর্ডটি তার ধারণাপ্রসূত বলে জানা যায়। তবুও এই প্রতিষ্ঠানটিকে জাতির মনন হিসেবে দাবি করে কার্যত বাংলা ভাষার উন্নয়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখে আসছি।

বাংলা একাডেমীর বাইরে সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয় গঠিত বাংলা ভাষা বাস্তবায়ন কোষ কমপিউটারে বাংলা ভাষার উন্নয়নে কাজ করেছে। এই সূত্র ধরেই জাতীয় কমপিউটার কমিটি এবং পরে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল গঠিত হয়। ফলে বাংলা ভাষার ডিজিটাল উন্নয়নে কমপিউটার কাউন্সিলের একটি স্পষ্ট ভূমিকা রয়েছে। কমপিউটার কাউন্সিল গঠনের আইনটি আমরা হাতের কাছে পাইনি। ফলে তাদের এই বিষয়ে কী ভূমিকা আছে এবং সেটি আইনগতভাবে কতটা তাও জানা যায়নি। কিন্তু আইসিটি টাস্কফোর্স ২০০৩ সালে যে সিদ্ধান্ত নেয় এবং কমপিউটারের বাংলা কোডিং ও এনকোডিং করার ক্ষেত্রে এই প্রতিষ্ঠানটিকে যে দায়িত্ব দেয়া হয় তার সূত্র ধরে আমরা এই প্রতিষ্ঠানটির হাতে বাংলা ভাষার উন্নয়নের দায়িত্ব থাকবে বলেই মনে করি। স্মরণ রাখতে হবে, বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল- বিসিসি’র বিতর্কিত কীবোর্ড এবং ইউনিকোড ৫.১ ভিত্তিক একটি বাংলা সফটওয়্যার উন্নয়ন করেছে এবং সেটি বিনামূল্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা করেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রতিষ্ঠানটির এমন কাজ জাতির জন্য কোনো সুফল দেয়নি। তারা কাজটি যে যথাযথভাবে করেনি তার সবচেয়ে প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হলো, বিডিএস ১৫২০:২০০০ অনুসারে এনকোডিং ব্যবহার না করে তারা ইউনিকোড এনকোডিং ব্যবহার করেছে। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান সরকারের নিজের মানকে (বিডিএস ১৫২০:২০০০) অস্বীকার করে অন্য কোনো মান ডেভেলপ করতে পারে না। কাউন্সিল সেই কাজটিই অবলীলায় করেছে। বাস্তবতা হলো, এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন এবং সরকারের নবগঠিত কমিটিকে এই কাজটির ব্যাপারে সুপারিশ পেশ করা, প্রকল্প গ্রহণ করা, প্রকল্প বাস্তবায়ন করা ও সার্বিক দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেয়া দরকার।

বাংলা ভাষার উন্নয়ন-বিশেষত ডিজিটাল যন্ত্রে এর প্রয়োগ ও বিকাশের জন্য নতুন কমিটিকে প্রথমে তাদের কার্যপরিধিতে এই বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৯-এর কাউন্সিল সভার সিদ্ধান্ত (সিদ্ধান্ত ৩(৩১)/২০০৯(ঢ) মোতাবেক কাজ করার জন্য কার্যপরিধি সংশোধন করা কোনো কঠিন কাজ হতে পারে না। গত ১১ অক্টোবর ২০০৯ অনুষ্ঠিত সভায় এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে এবং কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এই কমিটির কার্যপরিধির মাঝে একে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে।

কমিটির কাজের শুরুতে প্রথমে শনাক্ত করতে হবে- বাংলা ভাষার কোন কোন কাজ সম্পন্ন করার জন্য কমিটিকে উদ্যোগ নিতে হবে। আমি মনে করি, সরকার এ বিষয়ে সচেতন না হলেও এই কাজগুলো প্রায় চিহ্নিত হয়েই আছে। আমার মতে, এই কাজগুলোকে দু’টি ভাগে ভাগ করা যায় : ক. প্রথম ভাগ হলো- ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগকে সহজতর করার কাজ করা। খ. দ্বিতীয় ভাগ হলো- বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা।

ক. এই মুহূর্তে ডিজিটাল যন্ত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগকে সহজতর করার জন্য ছয়টি কাজ করা যেতে পারে। যেমন- ০১. বাংলা ভাষার জন্য বানান ও ব্যাকরণ শুদ্ধিকরণ সফটওয়্যার তৈরি করা। ০২. বাংলা ভাষার জন্য অপটিক্যাল ক্যারেক্টার রিডার সফটওয়্যার তৈরি করা। ০৩. বাংলা ভাষার জন্য স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার তৈরি করা। ০৪. বাংলা ভাষার জন্য টেক্সট টু স্পিচ সফটওয়্যার তৈরি করা। ০৫. বাংলা ভাষার জন্য স্পিচ টু টেক্সট সফটওয়্যার তৈরি করা। ০৬. বাংলা ভাষার বহুভাষিক অনুবাদক সফটওয়্যার তৈরি করা। অন্তত বাংলা থেকে ইংরেজি ও ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদের সফটওয়্যার উন্নয়নের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। বাংলা-আরবী, বাংলা-মালয়, বাংলা-জাপানী, বাংলা-কোরীয় ইত্যাদি অনুবাদক সফটওয়্যারও অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকতে পারে।

খ. বাংলা ভাষার সাহিত্য সংস্কৃতির জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করার তিনটি ধারা হতে পারে : ০১. প্রথম ধারাটি হতে পারে পাঠ্যবিষয়ভিত্তিক। শিশু শ্রেণী, প্রাথমিক শ্রেণী, হাইস্কুল, কলেজ ও উচ্চশিক্ষার পাঠ্যপুস্তককে ডিজিটাল ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্টে পরিণত করা। ০২. দ্বিতীয় ধারাটি হতে পারে বাংলা সাহিত্যের কপিরাইট মেয়াদোত্তীর্ণ বা কপিরাইট ছেড়ে দিতে ইচ্ছুক লেখকদের কনটেন্টকে ডিজিটাল ফরমেটে রূপান্তর করা। ০৩. তৃতীয় ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি হতে পারে সংস্কৃতিবিষয়ক। বাংলা গান, নাটক, চলচ্চিত্র ইত্যাদির ডিজিটাল রূপান্তর, ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্টে রূপান্তর ও মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট হিসেবে উন্নয়ন একটি চমৎকার ধারা হতে পারে।

এই কাজগুলো করার জন্য আমরা তিন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করতে পারি : ০১. বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল, ০২ বাংলা একাডেমী ও ০৩. বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এই কাজগুলো সরকারিভাবে করা যেতে পারে। সরকারি কাজগুলোতে বিনিয়োগ করবে সরকার এবং জনগণ এর সুফল ভোগ করবে। এগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বিতরণ করা হতে পারে। সরকার এই কাজগুলো নামমাত্র মূল্যে বা বাণিজ্যিকভাবেও বাজারজাত করতে পারে। এই কাজগুলো পিপিপি মডেলেও করা যেতে পারে। আবার সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে বাণিজ্যিকভাবে এই কাজগুলো করা যায়। সরকার কোনো এনজিওকে দিয়েও এই কাজ করাতে পারে। সরকার যদি নিজে এই কাজগুলো করে তবে তার দায়িত্ব ভাগ করা হতে পারে। বাংলা একাডেমী কাজ করতে পারে প্রকাশনাবিষয়ক ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করার ক্ষেত্রে। বিশেষত ডিজিটাল প্রকাশনায় বাংলা একাডেমী তার দায়িত্ব পালন করতে পারে। শিশু একাডেমী ও শিল্পকলা একাডেমী সংস্কৃতিবিষয়ক কাজগুলো করতে পারে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, জাতীয় পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড পাঠ্যপুস্তক প্রকাশনার কাজ করতে পারে। সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় বা পিপিপি মডেলেও এই কাজ করতে পারে।

অন্যদিকে বাংলার জন্য সফটওয়্যার ও প্রযুক্তি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল তার ভূমিকা পালন করতে পারে। কাউন্সিল নিজেদের প্রোগ্রামার দিয়ে এসব সফটওয়্যার তৈরি করতে পারবে এমন সম্ভাবনা নেই। আবার শুধু টেন্ডার করে এই কাজ সম্পন্ন করা কঠিন হতে পারে। এজন্য বিসিএস-বেসিস-আইএসপিএবি’র সহায়তাসহ একটি গবেষণা দল কাজ করতে পারে এবং সেই দলে অন্তত ছয়টি টিম ছয়টি কাজের জন্য নিযুক্ত থাকতে পারে। দেশ-বিদেশের সেরা প্রযুক্তিবিদদের এজন্য নিয়োজিত করা যেতে পারে। দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এজন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। অন্যদিকে কেবল পাইরেসি বন্ধ করে ও অনুদান প্রদান করে এই কাজগুলো বাণিজ্যিকভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা সফল হতে পারে।


কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস
অনুরূপ লেখা