গত ৩১ মার্চ ২০১০ বাংলাদেশের আইসিটি খাত তথা জাতীয় ইতিহাসে এক নতুন মাইলফলক রচিত হলো। এইদিন ‘বিসিএস ডিজিটাল এক্সপো ২০১০’ ও ‘অ্যাসোসিও ট্রেড ভিজিট ২০১০’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘অ্যাসোসিও আইটি অ্যাওয়ার্ড’ আনুষ্ঠানিকভাবে দেয়া হয়। তার হাতে এ পুরস্কার তুলে দেন অ্যাসোসিও প্রেসিডেন্ট লুই কিয়েন লিয়ং। এ পুরস্কার মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আইসিটি (তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি) খাতের প্রতি আগ্রহ, ঐকান্তিক উদ্যোগ ও বিশেষ অবদানের জন্য এবং একই সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০২১ রূপকল্পের জন্য দেয়া হয়। উল্লেখ্য, অ্যাসোসিও আইটি অ্যাওয়ার্ড এশিয়া মহাদেশের সম্ভবত তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উল্লেখযোগ্য একটি পুরস্কার।
সেদিন রাতে সব টিভি চ্যানেলের এবং পরদিনের সব পত্রিকার মাধ্যমে এ পুরস্কারের কথা দেশবাসী জানতে পারে। তাই অনেকের মনে কৌতূহল জাগে, অ্যাসোসিও কী এবং এর পেছনে কারা রয়েছেন। মূলত কৌতূহলী পাঠকদের সেই কৌতূহল মেটানোর লক্ষ্য নিয়েই তৈরি করা হয়েছে এই বিশেষ প্রতিবেদন।
Asian Oceanian Computing Industry Organization তথা Asocio হচ্ছে এই অঞ্চলে আইটি ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সংগঠন। ১৯৮৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের আইটি (তথ্যপ্রযুক্তি) শিল্পকে সহায়তা করা এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ খাতে সহযোগিতা বাড়িয়ে তোলা ও বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়ানো। বর্তমানে অ্যাসোসিও’র ২১টি সদস্যদেশ রয়েছে। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, কোরিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, নিউজিল্যান্ড, পাকিস্তান, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম হচ্ছে এর সদস্য। এছাড়া সাতটি অতিথি সদস্যদেশ রয়েছে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, স্পেন, রাশিয়া, ফ্রান্স ও কেনিয়া।
বর্তমানে অ্যাসোসিও’র সদস্যদেশগুলোর অধীনে এ অঞ্চলের প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি আইসিটিবিষয়ক কোম্পানি রয়েছে এবং তাদের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি ডলারের মতো। তাই দেখা যাচ্ছে, অ্যাসোসিও এ অঞ্চলের আইসিটি খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সংগঠন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে অ্যাসোসিও আইটি অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়, তা অতি মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার এবং এ পুরস্কার প্রথম দেয়া হয় ১৯৯৫ সালে। সে বছর দক্ষিণ কোরিয়ার মন্ত্রী মিয়ঙ্গ ওহ সর্বপ্রথম এ পুরস্কার পান। ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছরই আইসিটি খাতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বকে এ পুরস্কার দেয়া হয়ে আসছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও প্রবাদপুরুষ ড. মাহাথির মোহাম্মদ। তিনি এ পুরস্কার পান ১৯৯৮ সালে। ২০০১ সালে এই পুরস্কার পান ভারতের তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিযোগাযোগ ও সংসদীয় কার্যক্রমবিষয়কমন্ত্রী প্রমোদ মহাজন। উল্লেখ্য, ভারতের আইসিটি খাতের উন্নয়নে এবং আউটসোর্সিং সুপার-পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশের পেছনে ভারত সরকার যে সহায়ক ভূমিকা পালন করে, তার নেতৃত্ব দেন প্রমোদ মহাজন। ২০০২ সালে থাইল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা এবং ২০০৩ সালে ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী ফান ভ্যান খাই এই পুরস্কার পান।
উল্লেখ্য, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো সরকারপ্রধান হিসেবে সর্বপ্রথম এ পুরস্কারে ভূষিত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে দক্ষিণ এশিয়া থেকে ভারতের প্রমোদ মহাজন ও শ্রীলঙ্কার অধ্যাপক ভি. কে. সামারনায়েকে এ পুরস্কার পেলেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধান এখন পর্যন্ত এ পুরস্কার পাননি। তাই এই পুরস্কারটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য বরং আমাদের জাতির জন্য একটি অতিগৌরবের বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানে তার বক্তব্যে বলেন, এ ধরনের আয়োজন দেশে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়নে ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি বলেন, ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম স্বাধীনতার সুবর্ণজয়মত্মীর বছর ২০২১ সালের মধ্যে আমরা একটি ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলব, যে বাংলাদেশ হবে আলোকিত, সমৃদ্ধ এবং আধুনিক বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছে দেয়া।
তিনি আরো বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উপযুক্ত মানবসম্পদ তৈরির জন্য মাধ্যমিক ও তদুর্ধ্ব পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয় সিলেবাসভুক্ত করা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইন্টারনেট সংযোগসহ কমপিউটার ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে আরো এক হাজার এবং পর্যায়ক্রমে সব ইউনিয়ন পরিষদকে ফাইবার অপটিক ক্যাবল সংযোগের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে আইসিটিসংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিবিদ, গবেষক, সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি সবাইকে এগিয়ে আসার জন্য উদাত্ত আহবান জানান।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সভাপতি মোস্তাফা জববার। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য ডিজিটাল সরকার এবং শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। এ দু’টি কার্যক্রম এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যাওয়া সহজ হবে।
অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, ডিজিটালপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য মাধ্যমে মোবাইল ফোনকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে। আত্মবিশ্বাস আর উদ্যোগী কার্যক্রমের মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।
বাণিজ্যমন্ত্রী ফারুক খান বলেন, প্রযুক্তি খাতে উন্নতি হচ্ছে। যার ফলে বর্তমানে নানা ধরনের কার্যক্রম সহজ হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া সহজ।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, প্রযুক্তি দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বড় একটি মাধ্যম। সরকারকে ডিজিটালাইজড করা এবং ই-কমার্সের কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। আমরা আশা করছি, ২০২১ সালের মধ্যে আমাদের দেশে অন্যতম জনশক্তি হবে প্রযুক্তিতে। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন অ্যাসোসিও প্রেসিডেন্ট লুই কিয়েন লিয়ং, অ্যাসোসিও’র ডেপুটি প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ এইচ কাফী, এক্সিয়েটা (বাংলাদেশ) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাইকেল ক্যুনর, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলমগীর কবির এফসিএসহ অনেকে।
অ্যাসোসিও’র ডেপুটি প্রেসিডেন্ট ও বিসিএসের সাবেক সভাপতি আব্দুল্লাহ্ এইচ কাফী তার বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এ পুরস্কার লাভ করার জন্য অভিনন্দন জানান ও বলেন, অ্যাসোসিও তথা সমগ্র এশিয়া অঞ্চলে শেখ হাসিনা সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০২১’ ভিশনটি বেশ সাড়া জাগিয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের কাছ থেকে এ ধরনের কর্মসূচি আসায় তারা মুগ্ধ। তাই অ্যাসোসিও নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন অ্যাসোসিও আইটি অ্যাওয়ার্ড পাবার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব হলেন শেখ হাসিনা। দেশবাসীকে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০২১’ উপহার দেবার জন্য আব্দুল্লাহ এইচ কাফী প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান ও তাকে অবহিত করেন, অ্যাসোসিও কিছুদিন আগে ভিশন ২০২০ নামে একটি ডকুমেন্ট প্রস্তুত করে। এতে বাংলাদেশের ওপর যে চ্যাপ্টার রয়েছে তাতে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০২১’-এর কথা বেশ গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করা হয়েছে।
ক্ষমতার প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বছরে ১০ হাজার প্রোগ্রামার তৈরির পরিকল্পনার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আব্দুল্লাহ এইচ কাফী বলেন, এই কর্মসূচি আবার ফিরিয়ে আনতে হবে ও বাস্তবায়ন করতে কবে। বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং অনেকটা হয়ে গেছে, এবার সময় এসেছে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির। এখন প্রয়োজন এ জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেবার। এছাড়া অবকাঠামো উন্নয়নও বেশ জরুরি বলে মন্তব্য করেন আব্দুল্লাহ এইচ কাফী।
অ্যাসোসিও ভিশন ২০২০ ডকুমেন্টের প্রচ্ছদ
১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনার সরকার কমপিউটার সামগ্রীর ওপর সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহার করে। এছাড়া ওই সরকার ২০০০ সালে ভি-স্যাট প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত করে দেয়। এ এইচ কাফী বলেন, এই দুটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের ফলে গত ১২ বছরে বাংলাদেশের আইসিটি খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তবে ১৯৯৮ সালের তুলনায় আইসিটি পণ্যের সংজ্ঞা অনেক বদলে গেছে এবং এখন আরো কিছু পণ্যকে শুল্কমুক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, আইসিটি হলো আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল খাত। এ খাতে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করা হলে বাংলাদেশ হয়তো আগামী ৫ বছরের মধ্যে মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত হবে এবং তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন আব্দুল্লাহ্ এইচ কাফী।
‘অ্যাসোসিও আইটি অ্যাওয়ার্ড ২০১০’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের আইসিটি খাতে একটি বড় ধরনের উপকার সাধিত হলো। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করা যেকোনো সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। গত কয়েক বছর ধরে আমরা দেখেছি, অনেকেই বলছেন বাংলাদেশের ইমেজ ও ব্র্যান্ডিং আরোও জোরদার করতে হবে। মূলত এই পুরস্কারের মাধ্যমে তা কিছুটা হলেও সাধিত হয়েছে। অ্যাসোসিও’র আরোও ২০টি দেশের অন্তত আইসিটি খাতের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ জানতে পারলেন, বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে আইসিটি খাতকে রাষ্ট্রের একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে গুরুত্ব দেয়া হয়। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নিজে এ খাতকে খুবই গুরুত্ব সহকারে দেখেন। শুধু তাই নয়, বরং অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রধান নিয়ামক হিসেবে আইসিটি খাতকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট রয়েছেন। এছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ ২০২১ ভিশনের ব্যাপারেও এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলের অনেকেই অবগত হলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর অ্যাসোসিও প্রতিনিধিরা ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ তথা ডিসিসিআই সদস্যদের সাথে দেখা করেন। এ সময়ে বিসিএস সভাপতি মোস্তাফা জববার, অ্যাসোসিও’র ডেপুটি প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ এইচ কাফি, ডিসিসিআইর সাবেক পরিচালক মোহাম্মদ সবুর খান, ডাটা সফটের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাহবুব জামান এবং টেলিকম আইসিটি এবং ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য খন্দকার আতিক-ই-রাববানী উপস্থিত ছিলেন।
অ্যাসোসিও’র প্রেসিডেন্ট লুই কিয়েন লিয়ং তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশ আইসিটি খাতে প্রভূত উন্নতি করতে পারে। আব্দুল্লাহ এইচ কাফি তার বক্তৃতায় বলেন, এশিয়ার দেশগুলো আইসিটি খাতে পরস্পরকে সাহায্য ও সহযোগিতার মাধ্যমে একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে। তিনি আরো বলেন, অ্যাসোসিও’র মতো একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত হয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের কাছে নিজের ব্র্যান্ড ইমেজকে সফলভাবে তুলে ধরতে পারে। মুস্তাফা জববার বলেন, বিসিএস বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচিকে সফল করে তোলার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজ করেছে।
অ্যাসোসিও ওয়েব সাইটের হোমপেইজ, http://www.asocio.org
১ এপ্রিল অ্যাসোসিও প্রতিনিধিদলটি বিসিএস কমপিউটার সিটি মার্কেট পরিদর্শন করে। অ্যাসোসিও প্রেসিডেন্ট লুই কিয়েন লিয়ং মার্কেট ঘুরে দেখেন এবং এর প্রশংসা করেন। এ সময়ে বিসিএস কমপিউটার সিটি মার্কেট কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং বিসিএস সেক্রেটারি জেনারেল মজিবুর রহমান স্বপন অ্যাসোসিও প্রতিনিধিদের স্বাগত জানান। আব্দুল্লাহ এইচ কাফি ডেলিগেটদের মার্কেটের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অবহিত করেন।
একই দিনে অ্যাসোসিও’র ডেলিগেটরা বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের কাছে তাদের দেশের আইসিটি খাতের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য দিক তুলে ধরেন। এ সময়ে বিসিএস সভাপতি মোস্তাফা জববার উপস্থিত ছিলেন।
সিকি শতাব্দীর অ্যাসোসিও
অ্যাসোসিও একটি ২৫ বছরের পুরনো সংগঠন। এর জন্ম ১৯৮৪ সালে। ১৯৮৪ সালের জুনে জাপানে একটি সভা হয়। সেখানে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, কোরিয়া, তাইওয়ান, নিউজিল্যান্ডের প্রতিনিধিরা অংশ নেন এবং সেখানে পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন চীন, হংকং, ফিলিপিন্স ও সিঙ্গাপুরের প্রতিনিধিরা। সে বৈঠকেই অ্যাসোসিও গঠিত হয় এবং জাপানের ইচিরো তানিজাওয়া সভাপতি, অস্ট্রেলিয়ার কেভিন মরিসে সহ-সভাপতি, কোরিয়ার ওয়াই টিলি সেক্রেটারি এবং জাপানের ফুজিমোটো কাজিরো ডিরেক্টর নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে সিঙ্গাপুর ফেডারেশন অব দ্য কমপিউটার ইন্ডাস্ট্রি এর সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৮৮ সালে কমপিউটার ইন্ডাস্ট্রি-অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য কমপিউটার ইন্ডাস্ট্রি মালয়েশিয়া (পিআইকেওএম) পূর্ণ সদস্যের মর্যাদা লাভ করে। ১৯৯২ সালে ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকা (আইটিএ ) এবং ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যাসোসিয়েশন অব কানাডা আইটিএস অতিথি সদস্যের মর্যাদা লাভ করে। ১৯৯৪ সালে সংগঠিনটি দশ বছর অতিক্রম করে। ১৯৯৬ সালে অ্যাসোসিওতে বাংলাদেশ যোগদান করে। ২০০১ সালে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি তথা বিসিএস একটি নতুন মাইলফলক তৈরি করে অ্যাসোসিওতে। প্রথমবারের মতো অ্যাসোসিও’র মাল্টিল্যাটারাল ট্রেড ভিজিট অনুষ্ঠিত হয় এবং বিসিএস এর অয়োজন করে। উল্লেখ্য, তখন বিসিএস সভাপতি ছিলেন আব্দুল্লাহ এইচ কাফি, যিনি বর্তমানে অ্যাসোসিও’র ডেপুটি প্রসিডেন্ট।
২০০৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে অ্যাসোসিও অফিসার্স মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, ওই বছর অ্যাসোসিও সংগঠনটি তার বিশতম বর্ষপূর্তি পালন করে। ২০১০ সালে বাংলাদেশ আবার অ্যাসোসিও মাল্টিল্যাটারাল ট্রেড ভিজিটের আয়োজন করলো।
বোর্ড অব অফিসার্স
অ্যাসোসিও পরিচালনা করছে একটি বোর্ড অব অফিসার্স। বর্তমানে সভাপতি হচ্ছেন মালয়েশিয়ার লুই কিয়েন লিয়ং। ডেপুটি প্রেসিডেন্ট হলেন বাংলাদেশের আব্দুল্লাহ এইচ কাফি ও সেক্রেটারি জাপানের হিরোমি সুজিয়ামা। অ্যাসোসিও’র বর্তমানে কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন বুনরাত সাগানদার। অ্যাসোসিও’র অতীতে যারা সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ভারতের অশোক আসানক দেশাই, অস্ট্রেলিয়ার জন গ্রান্ট, ভিয়েতনামের টিয়ং গিয়াবিং, তাইওয়ানের রিচার্ড ইন প্রমুখ। অ্যাসোসিও’র বোর্ড অব অফিসার্সদের সবসময় সংগঠনটি চালানোর পাশাপাশি এর এশিয়া-ওশেনিয়া অঞ্চলে আইসিটি খাতকে আরো বিকশিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। অ্যাসোসিও’র কাজগুলো যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য জাপানের টোকিওতে রয়েছে অ্যাসোসিও সেক্রেটারি বা সচিবালয়। এই সচিবালয়ের সেক্রেটারি জেনারেল হলেন লুকাস লিম। এছাড়া বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির মতো বিভিন্ন দেশের আইসিটি সংগঠনগুলো অ্যাসোসিওকে সহযোগিতা করে থাকে। সম্প্রতি অ্যাসোসিও’র কাজকে আরোও গতিশীল করে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয়েছে ভাচুর্য়াল সেক্রেটারিয়েট।
বাংলাদেশের আইটি খাতে অ্যাসোসিও’র ভূমিকা ও কিছু কথা
দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় ধরে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলগুলোর আইসিটি খাতের উন্নয়নের জন্য অ্যাসোসিও নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে চলছে। বাংলাদেশের সাথে অ্যাসোসিও’র সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি প্রথম অ্যাসোসিও মাল্টিল্যাটারাল ট্রেড ভিজিটের আয়োজন করে। এর তিন বছর পরে, ২০০৪ সালের জুলাই মাসে বিসিএস অ্যাসোসিও’র অফিসার্স মিটিং স্ট্র্যাটেজিক প্ল্যানিং সেশন এক্সিকিউটিভ মিটিং এবং অ্যাসোসিও’র ২০তম বর্ষপূর্তি উদ্যাপন কমিটির বৈঠক আয়োজন করে। আশা করা যাচ্ছে, খুব শিগগিরই বাংলাদেশ অ্যাসোসিও’র জেনারেল অ্যাসেম্বলি মিটিং আয়োজন করবে। এটা খুবই আনন্দের কথা যে অ্যাসোসিও’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি আব্দুল্লাহ এইচ কাফি সুদীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। তার এই পরিশ্রমের ফলে বাংলাদেশের আইসিটি উদ্যোক্তারা অ্যাসোসিও’র বিভিন্ন সুযোগসুবিধা পাচ্ছেন।
অ্যাসোসিও বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ইমেজকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশ অগাধ সম্ভাবনার দেশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক বাংলাদেশকে জানে একটি গরিব দেশ হিসেবে যেখানে সবসময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বছরজুড়ে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। অ্যাসোসিও তার সদস্য দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের ভালো দিকগুলো তুলে ধরতে পারবে। যেমন- বাংলাদেশে প্রায় নিয়মিতভাবে প্রতিবছর ৫-৬% হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে, যা খুবই আশার বিষয়। বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনে প্রায় ৪০-৫০ জন মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও বাংলাদেশের কমপিউটার খাত খুব দ্রুত হারে বাড়ছে। বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি এদেশে আইটি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সদস্যসংখ্যা ৭০০ অতিক্রম করে গেছে।
বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে তোলার ক্ষেত্রে অ্যাসোসিও একটি চমৎকার কাজ করেছে। অ্যাসোসিও’র নিজস্ব নিউজলেটার ‘অ্যাসোসিও কানেক্ট’-এর পঞ্চম সংস্করণে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের আইসিটি খাতের ওপর একটি বিশদ বিবরণী প্রকাশ করে। এসব কিছুর পাশাপাশি অ্যাসোসিও তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের ওপর একটি মাইক্রোসাইট তৈরি করতে পারে। যেখানে বাংলাদেশের আইসিটি সেক্টর সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সব তথ্য পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতি অ্যাসোসিওকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারে। এভাবে অ্যাসোসিও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে বিদেশের কাছে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরতে পারে।
এছাড়াও বছরের বিভিন্ন সময়ে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন উন্নত দেশগুলোতে যেমন- অস্ট্রেলিয়া, জাপান, তাইওয়ান, কোরিয়া, এসব দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন- আইটি এক্সপো, কনফারেন্স, সেমিনারসহ বিবিধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। অ্যাসোসিও তার সদস্য দেশগুলোকে এসব অনুষ্ঠানে আসার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের আইটি উদ্যোক্তারা যাতে এসব অনুষ্ঠানে যেতে পারেন, অ্যাসোসিও সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো বাংলাদেশের আইসিটি খাতের ওপর নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের সংবাদ ও ফিচার লিখে থাকে। কিন্তু দেশের বাইরের গণমাধ্যমে বাংলাদেশের আইসিটি খাত নিয়ে তেমন আলোচনা হয় না। বিদেশী গণমাধ্যমে কিভাবে বাংলাদেশের আইসিটি খাত সম্পর্কে সংবাদ ও তথ্যসমৃদ্ধ লেখালেখি প্রকাশ করা যায়, সে ব্যপারে অ্যাসোসিও বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতিকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা করতে পারে।
আরেকটি ক্ষেত্র যেখানে অ্যাসোসিও বাংলাদেশের আইসিটি খাতকে সাহায্য করতে পারে তা হলো গবেষণা। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের আইসিটি খাত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইসিটি বাজারের সার্বিক অবস্থা নিয়ে কোনো পূর্ণাঙ্গ জরিপ প্রকাশিত হয়নি। এক্ষেত্রে অ্যাসোসিও তাদের সদস্য দেশগুলোকে তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দিয়ে বাংলাদেশের আইটি উদ্যোক্তাদের সাহায্য করার জন্য অনুরোধ করতে পারে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : ahmed_razib@yahoo.com