সময়টা সম্ভবত ১৯৯৭ সালের মাঝামাঝি। আমি নাজিমুদ্দিন মোস্তান ভাইয়ের ড্রইংরুমে বসে আছি। এমন সময়ে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক ভদ্রলোক ড্রইংরুমে ঢুকলেন। মোস্তান ভাই তখন ড্রইংরুমে ছিলেন না- অন্য কাজে অন্দরমহলে ব্যস্ত ছিলেন। যদ্দুর মনে পড়ে, এরই মধ্যে আমরা পরিচয়পর্ব সেরে নিয়েছিলাম। জানলাম তিনিই আবদুল কাদের, যিনি কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা।
এদিকে আমি মোস্তান ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় তার প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘রাষ্ট্র’-এ তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক লেখা শুরু করেছি। এরই মধ্যে কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আমার নাম শুনে মনে হলো তিনি এ নামটি শুনেছেন বা আমার কোনো লেখা পড়েছেন। তিনি আমাকে অনুরোধ জানালেন তার পত্রিকায় লিখতে। তার অনুরোধ শুনে মনে হলো- তিনি সম্ভবত আমার লেখা পছন্দ করেন বা করেছেন। ব্যাপারটি আমাকে বেশ দোলা দেয়। প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে আবদুল কাদের ভাইয়ের সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হয়। এবারও তিনি তার পত্রিকায় লেখা দেবার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু আমি এ ব্যাপারে কিছুটা রক্ষণশীল ভূমিকা পালন করি। এর কারণ ছিল বহুবিধ। প্রথমত সময়ের অভাব। বেশ কিছু দিন পর আবদুল কাদের ভাইয়ের অনুরোধের কথা মনে পড়ে গেল। আমি একটি লেখা নিয়ে কমপিউটার জগৎ-এর আজিমপুর অফিসে চলে গেলাম। অফিসে তখন কাদের ভাইয়ের স্ত্রী নাজমা কাদের ছিলেন। তার সাথে পরিচয় হলো। একে একে অনু, স্বপন ভাইসহ অনেকের সাথেই পরিচয় হলো। ভাবি আমাকে লেখা দেবার পাশাপাশি আরো কিছু দায়িত্ব নেবার জন্য অনুরোধ করলেন। কারণ, ইতোমধ্যে জগৎ-এর দুই কান্ডারি তুষার এবং ইকো আজহার পরীক্ষা এবং গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়াতে জগৎ-এর জন্য সময় দিতে পারছিলেন না। আমার মনে আছে, সেদিন ভাবি আমাকে জগৎ-এর ১২ সংখ্যা একসাথে বাঁধাই করা একটি অ্যালবাম উপহার দিয়েছিলেন।
বাঁ থেকে অধ্যাপক আবদুল কাদের, আফতাবুল ইসলাম, নাজিমউদ্দিন মোস্তান ও মজিবুর রহমান স্বপন
যাহোক, এরপর কমপিউটার জগৎ-এর সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কাদের ভাইয়ের সাথে প্রায়শই দেখা ও কথা হতো। তিনি কমপিউটার জগৎ নিয়ে বিশাল স্বপ্ন দেখতেন। কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিটি সংখ্যায় প্রতিটি বিষয় তিনি খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতেন এবং কিভাবে এর উন্নয়ন করা যায়, তা ভাবতেন। আমাদেরকে নিয়মিত লেখার ব্যাপারে পরামর্শ দিতেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বিদেশী জার্নাল, ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতেন এবং আমাদেরকে তা পাঠ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। ধীরে ধীরে তিনি আমাকে লেখা ছাড়াও আইটি সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত করে দিলেন। ফলে বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে আমি জড়িত হয়ে গেলাম এবং আমি তা সানন্দে করতে থাকলাম। তথ্যপ্রযুক্তির হার্ডওয়্যার বিশেষ করে প্রসেসরসংক্রান্ত লেখা/প্রতিবেদনের ওপর তিনি সবসময় আমাকে প্রাধান্য দিতেন।
আজ মনে পড়ে, মোস্তান ভাইয়ের একটি বিশেষ উক্তির কথা। তিনি বারবার আমাকে এ উক্তিটি শুনিয়েছেন। উক্তিটি একজন মনীষীর যিনি ‘প্রতিভা’র সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতার সামাজিকীকরণই হচ্ছে প্রতিভা’। আর এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমাদের আবদুল কাদের ভাই। তিনি তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতার সামাজিকীকরণ করেছেন শুধু কমপিউটার জগৎ পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে নয়, বরং একে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করেছেন। তিনি শুধু প্রিন্ট মিডিয়া নয় বরং অন্যান্য গণমাধ্যমকেও (রেডিও/টিভি) ব্যবহার করেছেন। জাতিকে ‘কলসেন্টার’, ‘ডাটাঅ্যান্ট্রি’, ‘সফটওয়্যার উন্নয়ন’সহ বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। সেমিনার, সিম্পোজিয়াম করেছেন। প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছেন। আজ যে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা শোনা যাচ্ছে এর অগ্রণী ব্যক্তিত্ব হচ্ছেন আবদুল কাদের ভাই। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে কমপিউটার জগৎ-এর প্রথম সংখ্যা (১৯৯১ মে) প্রকাশিত হয়েছিল একটি স্লোগানকে কেন্দ্র করে- ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’। তিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করতেন দেশের দারিদ্র্য বিমোচন তথা অর্থনীতির উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তি প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। জনগণ তথ্যপ্রযুক্তিতে যত বেশি সংশ্লিষ্ট হবে, ততই দেশের অর্থনৈতিক মঙ্গল হবে। এতে কালক্ষেপণ সমীচীন হবে না। কমপিউটার কিভাবে গরিব জনগণ বা গ্রামের মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়া যায়, এর জন্য দুয়েকটি পাইলট প্রকল্পও হাতে নিয়েছিলেন, তবে সরকারি সহায়তার অনুপস্থিতির কারণে এটি তেমন প্রসার লাভ করতে পারেনি। তিনি মনে করতেন, তথ্যপ্রযুক্তি তার আপন গতিতে একদিন জনগণের মাঝে ঠাঁই করে নেবে, কিন্তু যে ব্যাপারে তার উদ্বেগের কারণ নীতিনির্ধারকদের অবহেলা ও উপেক্ষার ফলে এটি যথার্থ সময়ে যথার্থ স্থানে ঠাঁই করে নিতে পারবে কি না। এর একটি ভালো উদাহরণ হচ্ছে- সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনার ব্যাপারে নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বহীনতা। যে স্থাপনা একযুগ আগে হতে পারতো, তা হয়েছে একযুগ পরে। এজন্য তিনি বেশ মনঃস্তাপ বোধ করেছেন এবং সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছেন।
কাদের ভাই ছিলেন নিভৃতচারী মানুষ। তার স্বভাব ছিল অন্তর্মুখী। এ অন্তর্মুখী মানুষ কী করে সামাজিক আন্দোলনের ভিত তৈরি করেছেন, তা বিস্ময়ের ব্যাপার। শুধু তাই নয়, তিনি যে আন্দোলনের সূচনা করেছেন তার ঢেউ এখনও প্রবাহিত হচ্ছে এবং কাঙ্ক্ষিত ফল দিচ্ছে বলেই আমাদের ধারণা। ব্যক্তিজীবনে জন্ডিসপরবর্তী লিভারের যে ব্যাধি তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল, তা আমরা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। আমাদেরকে বুঝতে দেননি কিভাবে তিলে তিলে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। ২০০২ সালে অস্ট্রেলিয়া আসার আগে তার সাথে শেষ দেখা হয়েছিল পিজি হাসপাতালে। আমার ধারণা ছিল তিনি সেরে উঠবেন, কিন্তু তা আর হয়নি। তখন লক্ষ করেছিলাম চিকিৎসকের বরাবর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি কমপিউটার জগৎ-এর বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিতেন। মৃত্যুকে তিনি সহজভাবে নিয়েছিলেন। তার দূরদৃষ্টি কতদূর ব্যাপক ছিল তা বুঝা যায় মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তিনি কয়েক পৃষ্ঠাব্যাপী কতিপয় অসিয়ত বা নির্দেশনা দিয়ে যান তার স্ত্রী এবং উত্তরসূরিদের। তিনি জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে কত সজাগ ছিলেন তা এই অসিয়তনামা দেখলে উপলব্ধি করা যায়। আন্তরিক ও মৃদুভাষী এ মানুষটি কমপিউটার জগৎ পরিবারের সবাইকে আপন করে রেখে গেছেন। মৃত্যু অমোঘ এবং নির্ধারিত। তথাপি কিছু মানুষ হৃদয়ে শূন্যতা সৃষ্টি করে চলে যায়। মনে হয় যেন আরো কিছুদিন থাকলে কতনা ভালো হতো। আমাদের জন্য বিরাট সান্ত্বনা যে, অন্তর্যামী যা করেন তা মানুষের মঙ্গলের জন্যই করেন-যদিও আমরা অবুঝ।
পরিশেষে দাবি করব বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রনায়ক আবদুল কাদের ভাইকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেয়া হোক এবং তার অন্তর্নিহিত ক্ষমতার সামাজিকীরণ তথা প্রতিভার মূল্যায়ন করা হোক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সূচনালগ্নে- যে স্বপ্ন আজীবন দেখে এসেছেন আমাদের আবদুল কাদের ভাই। স্রষ্টা তার আত্মার মাগফিরাত দিন- আজকের দিনের এটাই আমাদের কামনা মহান আল্লাহর কাছে।
কজ ওয়েব