• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > প্রযুক্তি জগতের অনন্য এক প্রেরণাপুরুষ
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: গোলাপ মুনীর
মোট লেখা:২৩৩
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১১ - জুলাই
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
অধ্যাপক আবদুল কাদের
তথ্যসূত্র:
স্মরণ
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
প্রযুক্তি জগতের অনন্য এক প্রেরণাপুরুষ




বাংলাদেশটির পরিচয় এখনও একটি স্বল্প আয়ের দেশ হিসেবে। অভাব আমাদের পায়ে পায়ে। পরনির্ভরশীল আমাদের জাতীয় অর্থনীতি। অথচ দুঃসহ এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটা পথ আমাদের জন্য বরাবর খোলা ছিল। সে পথ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথ। সে পথ তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়ক। কিন্তু আমরা সে পথে পা রাখিনি। সে মহাসড়ক ধরে চলবার দূরদর্শিতা দেখাতে পারিনি। ফলে আমাদে জাতীয় অগ্রগমন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ঘটেনি। বিষয়টি যে কোনো সচেতন দেশপ্রেমিক মানুষের জন্য পীড়াদায়ক। তেমনি একজন মানুষ ছিলেন মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি জগতের প্রেরণাপুরুষ অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদের। তার সম্যক উপলব্ধি ছিল আর সব দেশ থেকে পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশকে দ্রুত সামনে এগিয়ে নিতে হলে মোক্ষম হাতিয়ার হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি। তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো গত্যন্তর নেই।

সে উপলব্ধিতাড়িত হয়েই তিনি ১৯৯১ সালের মে মাসে সূচনা করেন মাসিক কমপিউটার জগৎ প্রকাশনা। এর প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি এ দেশে তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক প্রথম সাময়িকীরই শুধু সূচনা করেননি, সেই সাথে সূচনা করেন একটি আন্দোলনের। এ আন্দোলন এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে সামনে এগিয়ে নেয়ার আন্দোলন। এ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতসংশ্লিষ্ট সবাই জানেন এবং অকপটে স্বীকার করেন মরহুম আবদুল কাদের এ আন্দোলনে অসমান্তরাল অবদান রেখে গেছেন। তার অবদানসূত্রেই তিনি বাংলাদেশে সব মহলে অভিহিত হচ্ছেন ‘বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক’ অভিধায়।



মরহুম আবদুল কাদের মনে করতেন বরং বলা ভালো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, মাসিক কমপিউটার জগৎ শুধু একটি পত্রিকা নয়, এটি একটি আন্দোলনের নামও। একটি পত্রিকা হতে পারে আন্দোলনের বাহন। আর সে বিশ্বাসের ওপর ভর করেই তিনি কমপিউটার জগৎ-এর প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনাম করেন ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’। এ দাবিধর্মী প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের মাধ্যমেই কার্যত তিনি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নেয়ার আন্দোলনের সূচনা করেন। সেই যে শুরু, আমৃত্যু ছিলেন আন্দোলনেই। আমরা যারা এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলাম, তাদের তিনি ছিলেন প্রেরণাপুরুষ। সামনের সারিতে এসে নিজেকে প্রকাশ্যে এনে নয়, পেছনে থেকে অন্যদের প্রতি প্রেরণা আর সাহস জোগানোতেই তার আগ্রহ ছিল সমধিক। কারও কারও মতে, এ ক্ষেত্রে তার ভূমিকা ছিল নেপথ্য-নায়কের।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার স্বার্থে তাকে প্রচলিত সাংবাদিকতার অর্গল ভাঙতে হয়েছে। প্রতিমাসে একটি করে পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি তিনি সময়ের চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনে যখন যা দরকার, সাধ্যমতো তাই করেছেন। সে জন্য আমরা তাকে দেখেছি ডিঙি নৌকায় করে কমপিউটার নিয়ে যেতে বুড়িগঙ্গার ওপারের স্কুলের ছাত্রদের কাছে। তিনি নিজে ও আরেক প্রযুক্তিপ্রেমী মানুষ প্রখ্যাত সাংবাদিক নাজিম উদ্দিন মোস্তান স্কুলছাত্রদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, কমপিউটার আসলে কী। এ দেশে কমপিউটারের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে বৈশাখী মেলায় সূচনা করেছেন কমপিউটার মেলার। দেশে সূচনা করেছেন প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা। প্রয়োজনে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করেছেন গাঁটের পয়সা খরচ করে। আয়োজন করেছেন নানা বিষয়ের ওপর সেমিনার-সিম্পোজিয়াম। পত্রিকার বাইরে তথ্যপ্রযুক্তি-বিষয়ক বই প্রকাশ করে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন কমপিউটার জগৎ পাঠকদের মাঝে। আসলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি তার ভালোবাসা ছিল স্বভাবজাত। তাই আমরা তাকে ছাত্রজীবনেও ‘টরেটক্কা’ নামে স্বল্পজীবী একটি বিজ্ঞান পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করতে দেখেছি। তবে কমপিউটার জগৎ তার এ ক্ষেত্রে সফল উদ্যোগ। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এ পত্রিকাটি এ দেশের নিয়মিত, সর্বাধিক প্রচারিত ও সবচেয়ে প্রভাবশালী পাঠকপ্রিয় প্রযুক্তি মাসিক হওয়ার গৌরব নিয়ে প্রকাশিত হয়ে আসছে। আর এই বিশ বছরের কমপিউটার জগৎ-এর শব্দ-মিছিলে অবধারিতভাবে বেরিয়ে আসে একজন আবদুল কাদেরের মুখ। কমপিউটার জগৎ-এর পাঠকমাত্রের উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয় না- অধ্যাপক কাদের কী করে গেছেন আর কী করতে প্রয়াসী ছিলেন।

ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার ব্যাপারে নির্মোহ এই অধ্যাপক আবদুল কাদেরের জন্ম ঢাকায়, ১৯৪৯ সালের ৩১ ডিসেম্বরে। তিনি আমাদের ছেড়ে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন ২০০৩ সালের ৩ জুলাই। বাবা মরহুম আবদুস সালাম। সরল জীবনযাপন আর উঁচুমাপের চিন্তা-চেতনার ধারক এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন অধ্যাপক কাদের। লেখাপড়ার শুরু ঢাকার নওয়াবগঞ্জের নবাববাগিচা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬৪ সালে ঢাকার ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল থেকে এসএসসি। ১৯৬৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৮ সালে বি.এসসি এবং ১৯৭০ সালে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিষয়ে এম.এসসি। তিনি বেশ কিছু প্রশিক্ষণ কোর্সও সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করেন। এর মধ্যে আছে : ঢাকা বিএমডিসি থেকে পার্সোনাল ম্যানেজমেন্ট কোর্স এবং ঢাকার সাভারের বিপিএটিসি থেকে উন্নয়ন প্রশাসন কোর্স। এ ছাড়া নিয়েছিলেন কমপিউটার-বিষয়ক ২০টি অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামের ওপর প্রশিক্ষণ। শিখেছিলেন বেশ কয়েকটি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজও।

কর্মজীবন শুরু ১৯৭২ সালের ১ অক্টোবরে সোহরাওয়ার্দী কলেজের প্রভাষক হিসেবে। পদোন্নতি পেয়ে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে এ কলেজে ছিলেন ১৯৯৫ সালের ২ আগস্ট পর্যন্ত। সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে চলে যান সরকারি পটুয়াখালি কলেজে। সেখান থেকে তাকে নবায়ন ও উন্নয়ন প্রকল্পের উপ-পরিচালক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতরের কমপিউটার সেলের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়। সেখানে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৫ সালের ২০ নভেম্বর থেকে ১৯৯৭ সালের ২ জুলাই পর্যন্ত। এরপর তিনি দায়িত্ব পান এই অধিদফতরের নির্বাচিত সরকারি কলেজে কমপিউটার চালুকরণ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে। ২০০০ সালের ২২ জুলাই পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি অসুস্থতার জন্য ছুটি কাটান। ছুটিশেষে এ অধিদফতরের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ দায়িত্ব হিসেবে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন এ অধিদফতরের প্রশিক্ষণ-বিষয়ক উপ-পরিচালক।

অনেকেই দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করেন, অধ্যাপক কাদের তার কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে অনেক ওপরে তুলে রেখে গেছেন। তিনি একজন ব্যক্তিত্ব নন, একটি প্রতিষ্ঠান। একটি ইনস্টিটিউশন। এ ইনস্টিটিউশন কাজ করে গেছেন একটি মাত্র লক্ষ্য নিয়ে : এ জাতিকে সব মহলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। আর এ ক্ষেত্রে তিনি প্রধানতম হাতিয়ার করতে চেয়েছিলেন তথ্যপ্রযুক্তিকে। সেখানেই তিনি ছিলেন অনন্য এক প্রেরণাপুরুষ। তিনি জাতিকে যা দেয়ার দিয়ে গেছেন হৃদয় নিংরে। আজ জাতির কাছে তার কিছু চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে তিনি। তবে জাতি হিসেবে আমাদের ওপর তাগিদ বর্তেছে তার প্রতি যথাযথ সম্মান আর শ্রদ্ধা জানানোর। সেই সাথে তাগিদ আসে তার অবদানের জাতীয় স্বীকৃতির। আমাদের জাতীয় নেতৃবর্গ সে তাগিদে কীভাবে সাড়া দেবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।

কজ ওয়েব
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস