প্রতিটি দেশেই এমন কিছু ব্যক্তিত্ব রয়েছেন, যারা তাদের কর্মজীবনের মাধ্যমে নিজেদের স্মরণীয়-বরণীয় করে তুলেছেন। জাতি তাদের জীবদ্দশায় কিংবা মরণোত্তর পর্যায়ে নানাভাবে সম্মানিত করে থাকে। বাংলাদেশেও রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী ব্যক্তিদের সম্মানিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পদক প্রদানের মাধ্যমে প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ের কৃতী সন্তানদের সম্মানিত করা হয়। এবছরেও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে ধারণা করা যায়।
৩ জুলাই, ২০১০ মরহুম অধ্যাপক আবদুল কাদেরের সপ্তম মৃত্যু বার্ষিকী উপলক্ষে লিখতে গিয়ে, আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে মনে হয়েছে, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক বলে খ্যাত ও মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম অধ্যাপক আবদুল কাদের তেমনি একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি তার কর্মসূত্রেই একুশে পদক কিংবা স্বাধীনতা পদক পাবার দাবি রাখেন।
অধ্যাপক মরহুম আবদুল কাদের স্কুলজীবন থেকেই ছিলেন প্রচন্ডভাবে প্রযুক্তিপ্রেমী। স্কুলজীবনেই তিনি ‘টরেটক্কা’ নামে একটি মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি নিয়মিতভাবে প্রতি মাসে প্রকাশিত হতো প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও। অধ্যাপক আবদুল কাদের মৃত্তিকা বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও কমপিউটারের প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে কমপিউটারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ম্যাগাজিন সংগ্রহ করে পড়তেন এবং নিজে কমপিউটারের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ‘কমপিউটার লাইন’ নামে একটি কমপিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু করেন ১৯৮৯ সালে আজিমপুর চায়না বিল্ডিংয়ের গলিতে ।
অধ্যাপক আবদুল কাদের
কমপিউটার যে দারিদ্র্য বিমোচনের হাতিয়ার হতে পারে সে উপলব্ধিতে আবদুল কাদের তার পত্রিকা কমপিউটার জগৎ-এর প্রথম প্রকাশনা শুরু করেন ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’ স্লোগান নিয়ে। এখন সরকার ঘোষিত যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে এটি মূলত কমপিউটার জগৎ-এর মূল স্লোগান বা দাবি ‘জনগণের হাতে কমপিউটার চাই’-এর ধারাবাহিক ফসল বা বলা যেতে পারে আধুনিক সংস্করণ।
অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ আবদুল কাদের তখন থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ ক্ষেত্রটি এগুতে পারবে না। তখন কমপিউটার সম্পর্কে এদেশে মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। আর সরকারি মন্ত্রী-আমলাদেরও কমপিউটার সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।
অধ্যাপক আবদুল কাদের কমপিউটার জগৎ প্রকাশনার শুরু থেকে পরিকল্পনা করেন কমপিউটারের সুফল জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। সেজন্য কমপিউটারপ্রযুক্তি প্রোগ্রামগুলোর ওপর বাংলা ভাষায় সহজবোধ্য করে কিছু বই প্রকাশের চিন্তা করেন। কমপিউটারপ্রযুক্তিবিষয়ক বাংলা বই প্রকাশ সেসময় ছিল এক দুঃসাহসিক কাজ। এমনকি তা কল্পনা করাও ছিল এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। আবদুল কাদের সাহসিকতার সাথে ৮টি বিষয়ে বাংলায় বই প্রকাশের উদ্যোগ নেন। সেগুলো ছিলো ডস, ওয়ার্ডস্টার, লোটাস, ডিবেজ, উইন্ডোজ, ওয়ার্ড পারফেক্ট, ট্রাবলশূটিং ও ডিটিপি। তিনি এই বইগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে বাইরে বিক্রি না করে কমপিউটার জগৎ-এর গ্রাহকদের ফ্রি দিতেন। তিনি মনে করতেন, পাঠক বাড়লে, কমপিউটারের ব্যাপারে জনসচেতনতা যেমন বাড়বে, তেমনি এ সংশ্লিষ্ট যৌক্তিক দাবিগুলোর প্রতি জনসমর্থনও বাড়বে, যা প্রযুক্তি আন্দোলনকে বেগবান করবে। উপরোল্লিখিত আলোচনায় বলা যায়, আবদুল কাদের দেশে কমপিউটারবিষয়ক পাঠক বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, যা পরবর্তী পর্যায়ে নতুন নতুন পত্রিকার সৃষ্টি বা সূচনা করতে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে। এভাবে তিনি সৃষ্টি করে এক বিরাট আইসিটি বিষয়ক পাঠক গোষ্ঠি। সহজ কথায় বলা যায়, আজ বাংলাদেশের আইসিটি বিষয়ক যে পাঠকগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে তার প্রসব বেদনা এককভাবে ভোগ করেন অধ্যাপক আবদুল কাদের।
এ শিল্প সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি একাধিক সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন, আয়োজন করেছেন বিভিন্ন ক্যুইজ প্রতিযোগিতা, গুণী ও মেধাবীদের সম্মানিত করে জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, কমপিউটারকে সর্বসাধারণের মধ্যে পরিচিত করার লক্ষ্যে তিনি ঢাকার জিঞ্জিরায়, কুমিল্লার মুরাদনগর ও ভোলায় কমপিউটার নিয়ে যান। দেশের তরুণ মেধাবীদের উৎসাহিত করতে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ইন্টারনেট সপ্তাহ ও কমপিউটার প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করতে যেমন- ফাইবার অপটিক ক্যাবলের ওপর একাধিক সংবাদ সম্মেলন, মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রসারের জন্য সর্বপ্রথম জোরালো দাবি তুলে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন করেছেন- ‘স্ট্যাটাস সিম্বল নয়, চাই ব্যাপক জনগোষ্ঠীর হাতে মোবাইল ফোন’ যা সে সময় ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। এভাবে নিজস্ব স্যাটেলাইটের দাবি, Y2K সমস্যা, ইউরোমানি কনভার্সন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু জাতির সামনে তুলে ধরেন।
সর্বস্তরে কমপিউটারে বাংলা প্রয়োগ, বিজ্ঞানসম্মত বাংলা কী-বোর্ড ইত্যাদি বিষয় কমপিউটার জগৎ প্রকাশনার শুরুর বছরেই জাতির সামনে তুলে ধরেন অধ্যাপক আবদুল কাদের।
কজ ওয়েব