বর্তমান সরকারের নির্বাচনী স্লোগান ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। এই ডিজিটাল শব্দটি নতুন প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। নতুন প্রজন্ম যেনো হতাশা থেকে বের হয়ে পেলো একটি প্রযুক্তিমনষ্ক নেতৃত্বের গন্ধ। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের পূর্বশর্ত হচ্ছে- নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণের জন্যও একটি নির্দিষ্ট রূপরেখা থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভিডিও কনফারেন্সিং আর তার সাথে অফিস-আদালতে ইন্টারনেট সংযোগকেই বুঝে নিয়েছে।
আমাদের বুঝতে হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে শুরুতেই দেশের ভেতরে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও বিকাশ ঘটাতে হবে। তবে এক্ষেত্রে আশার কথা হচ্ছে, খুব শিগগির বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে চালু হতে যাচ্ছে ‘ডাটা সেন্টার’। ডাটা সেন্টার প্রকল্পের কর্মসূচির পরিচালক তারেক এম বরকতুল্লাহ বললেন- আমরা আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি।
ডাটা সেন্টারের শর্ত :
আন্তর্জাতিক মানের একটি ডাটা সেন্টার তৈরি করতে হবে বেশ কিছু নিয়মনীতি মেনে। বিশেষ করে খেয়াল রাখতে হবে এর নিরাপত্তার বিষয়টি। সাইবার সিকিউরিটির সাথে সাথে ভৌত যন্ত্রপাতির নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হয়। তাই স্থান বাছাই একটি বড় বিবেচ্য। সেই সাথে চাই পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ। আর ডাটা সেন্টারের ডাটা নিয়মিতভাবে আপডেট রাখার জন্যও প্রয়োজন দক্ষ জনবল। যেকোনো স্থান থেকে ঝামেলাহীনভাবে ব্যবহারকারীরা যাতে তথ্য পেতে পারে, সেই বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
ডাটা সেন্টারের জন্য পরিকল্পনা, অডিট এবং ডাটা সেন্টার তৈরির জন্য আইনী কাজগুলো সেরে নেয়া খুবই জরুরি। দ্বিতীয়ত, ডাটা সেন্টারের একটি পরিকাঠামো তৈরি করে নির্মাণ কাজ শুরু করা। তৃতীয়ত, প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ইনস্টল ও নেটওয়ার্কের সঠিক ব্যবস্থাপনা করতে পারা। এসব কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা।
আন্তর্জাতিক মানের একটি ডাটা সেন্টার নির্মাণের জন্য প্রয়োজন সঠিক একটি পরিকল্পনা। সারাবিশ্বে ডাটা সেন্টার ভাগ করা হয়েছে টায়ার-১ থেকে টায়ার-৪ নীতি মেনে।
বাংলাদেশে সার্টিফাইড ডাটা সেন্টার নির্মাণের লক্ষ্যে টায়ার-৩/৪ ব্যবহার করা যেতে পারে বলে অনেক দিন থেকে বলে আসছিলেন অনেকে। কারণ, ধাপটি বাংলাদেশের অনলাইন খাতের সব চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে। সেটা সরকারি এবং বেসরকারি খাত যা-ই হোক না কেনো। একবার যদি এই শেয়ারিং করা ডাটা সেন্টার তৈরি হয়ে যায়, তবেই অনলাইনে ব্যবসায় থেকে শুরু করে সরকারি অনেক কাজ আরও সহজ হবে বলেও ধারণা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে ডাটা সেন্টার :
এসব বিষয়ের ওপর লক্ষ রেখেই বাংলাদেশে চালু হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত ডাটা সেন্টার। টায়ার-৩ সার্টিফাইড করে এই ডাটা সেন্টার নির্মাণ হচ্ছে। যেহেতু শুরুতেই বলা হয়েছে, বর্তমানে শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বে নেটওয়ার্কের মাধ্যমে হ্যাকাররা ঢুকে যাচ্ছে এবং নিয়ে যাচ্ছে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য, যা সাইবার বিশ্বে অপরাধের শামিল। বলে রাখা ভালো, বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে এটাই প্রথম এবং দেশে টায়ার ৩ সার্টিফাইড কোনো ডাটা সেন্টার। এই প্রকল্পটির কর্মসূচি পরিচালক তারেক এম বরকতুল্লাহ এটি নির্মাণের কথা বলতে গিয়ে বললেন- EMPAP-এর একটি প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংককে তাদের একটি পরিকল্পনা জমা দেন। ২০০৯ সালের ২ নভেম্বর এই প্রকল্পের টেন্ডার দেয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ করে ৫ নভেম্বর বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটিকে বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর অনেকটাই হুমকির মুখে পড়ে যায় ডাটা সেন্টার নির্মাণ প্রকল্প। তবে বর্তমান সরকার ডাটা সেন্টারের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছে বলে মনে হয়। কারণ, বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এই প্রকল্পটি বন্ধ না করে সরকারি অর্থায়নে চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই লক্ষে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবার টেন্ডার ঘোষণা করা হয়। ৩১ মার্চ টেন্ডার জমা হয় এবং সবশেষে এপ্রিল ২০১০-এ এসে যোগ্য ও সর্বনিম্ন দরদাতাকে এই কাজটি দেয়া হয়। এরপর স্বপ্নের চাকা আবারো ঘুরতে শুরু করে। কাজ শুরু করে দেয়া হয় মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। ডাটা সেন্টারটি তৈরি করছে স্পেক্ট্রাম। যেহেতু সার্টিফাইড ডাটা সেন্টার বাংলাদেশে এবারই প্রথম তৈরি হতে যাচ্ছে, সেহেতু স্পেক্ট্রামের জন্যও এটা একটি নতুন অভিজ্ঞতা। ডাটা সেন্টারটি তৈরি করতে খরচ হবে ১৪ কোটি টাকা। এই ডাটা সেন্টারে সরকারের সব তথ্য থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রকল্পের পরিচালক এবং সারাদেশের মানুষ ডাটা সেন্টার থেকে সুবিধা পাবে। মানুষের হাতের মুঠোয় চলে আসবে তথ্য। বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের চতুর্থ তলায় ডাটা সেন্টারের কাজ হচ্ছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা, নিরবছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা রেখেই তৈরি হচ্ছে এ ডাটা সেন্টার। কারা কারা এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত, এমন প্রশ্নের জবাবে তারেক বললেন, বিভিন্ন পর্যায়ে এর সাথে অনেকেই যুক্ত আছেন। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা থেকে সহযোগিতার হাত বাড়ানো হয়েছে। বিসিসির নির্বাহী পরিচালক মো: মাহফুজুর রহমান এ প্রকল্প নিয়মিত বাস্তবায়ন, অগ্রগতি, মনিটরিং এবং নির্দেশনা দেন। তার অনুপ্রেরণা বিসিসির সব কাজেই ফুটে উঠেছে। ২৪ ঘণ্টা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে তৈরি হতে থাকা এই ডাটা সেন্টারে কী ধরনের ডাটা থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তরে তারেক বরকতুল্লাহ বলেন, এটা সম্পূর্ণ সরকারের বিষয়। তারা কী ধরনের ডাটা রাখবে, এটা তারা সিদ্ধান্ত নেবে। তবে অবশ্যই জনগণ যাতে সুবিধা ভোগ করতে পারে সেই চিন্তা করেই তথ্য এখানে রাখা হবে। ডাটা সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে অনেক কাজ হচ্ছে। তার সব কিছুই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আবার অনেক সময় তথ্য সঠিক সময়ে পাওয়াটাও দুষ্কর হয়ে পড়ে। তাই এ সব তথ্য একটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। যেখানে সব ধরনের তথ্য থাকবে। যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে যাতে সবাই তথ্য পেতে পারেন সে ব্যবস্থা থাকবে। তাই ডাটা সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
বর্তমানে যে তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা অনেকটাই বেসরকারি উদ্যোগে এবং সমন্বয়হীনভাবে। সরকারি খাতের অবস্থা আরো করুণ। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে এখনো কোনো একক নেটওয়ার্ক নেই, যা সব মন্ত্রণালয়কে যুক্ত করে। একইভাবে সচিবালয়ের সাথে বিভিন্ন দফতর-অধিদফতরের যোগাযোগের কোনো নেটওয়ার্কও স্থাপিত হয়নি। তাই আশা করা হচ্ছে, এ ডাটা সেন্টার চালু হলে সরকারের মাঝে একটি স্বচ্ছতা তৈরি হবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sire143@yahoo.com