নতুন ইংরেজি সাল ২০১১-এ পা দিয়ে বর্তমান মহাজোট সরকার তার দুই বছরের শাসনকাল পূরণ করলো। গণমাধ্যমে বর্তমান সরকারের এই দুই বছর কেমন কাটলো, এর নানাধর্মী পর্যালোচনা-আলোচনা-সমালোচনা বিভিন্ন মহল থেকে চলছে। সাধারণত রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে বিশ্লেষণই চলেছে বেশি। কিন্তু এ সরকারের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যে অন্যতম একটি প্রতিশ্রুতি ছিল দেশের মানুষকে তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ একটি বাংলাদেশ উপহার দেয়া, যা আখ্যায়িত হচ্ছে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নামে। ২০২১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ তার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব পালন করবে। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত করা হবে এক তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ হিসেবে। এটাই ছিল বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বেশি আলোচিত নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। সরকার ক্ষমতায় বসে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার বিষয়টিকে আরো জোরালো পর্যায়ে তুলে আনে। মুখে মুখে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কথাটি চলতে শুরু করে। সরকার সমর্থকেরা যেমনি এর মাঝে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের নির্বাচনী সাফল্যের উপাদন খুঁজে পায়, তেমনি সরকারবিরোধীরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ নিয়ে নেতিবাচক সমালোচনার উপাদান খুঁজে পায়। সরকার পক্ষ অবশ্য ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-কে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে নিয়ে এক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ আয়োজন নিতে শুরু করে। তৈরি করে ‘ভিশন ২০২১’ তথা ‘রূপকল্প ২০২১’। সোজা কথায় ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার রূপরেখা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে মহাজোট সরকারের এই দুই বছরে কেমন চলেছে প্রত্যাশিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কর্মকান্ড।
যদি সরকারকে প্রশ্ন করা হয়, এই দুই বছরে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় কী কী সাফল্য অর্জিত হয়েছে? তখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হবে গৃহীত নানা পদক্ষেপ ও অর্জিত নানা সাফল্যের কথা। এই পদক্ষেপের ও অর্জিত সাফল্যের তালিকা যথাসম্ভব দীর্ঘায়িত করার একটা প্রয়াসও থাকবে। অর্জিত সাফল্য তুলে ধরে নিশ্চয় বলা হবে : ২০০৯ সালে জাতীয় আইসিটি নীতিমালা ২০০৯ প্রণয়ন করা হয়েছে; আইসিটি আইন সংশোধন করা হয়েছে; ডিজিটাল স্বাক্ষর চালু করার জন্য ২০১০ সালে ‘তথ্যপ্রযুক্তি (সার্টিফিকেট প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ) বিধিমালা ২০১০’ প্রণয়ন করা হয়েছে; প্রাথমিকভাবে ৫টি প্রতিষ্ঠানকে সিএ লাইসেন্স দেয়া হয়েছে; সরকার হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের অফিস স্থাপনের প্রস্তাব অনুমোদন করেছে; বিসিসি তথা বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিল গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়/অধিদফতর/বিভাগ এবং আইসিটি ইনকিউবেটরে ইন্টারনেট সুবিধা সম্প্রসারণ করেছে; ২০০৯-১০ অর্থবছরে আইসিটি বিষয়ে ৩৮০ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে; বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থার ৭২ জনকে ওয়েবসাইট রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে; বিসিসি’র অনলাইন হেল্পডেস্ক কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা হয়েছে; নাগরিকদের জন্য আইসিটি সেবা সম্প্রসারণ করা হয়েছে; ৬৪ জেলায় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আইসিটি উপকরণসহ ল্যান স্থাপন করা হয়েছে; ২০০৯-১০ অর্থবছরে ১৪৭টি উপজেলায় ই-সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে; ২০১১ অর্থবছরে ৮৫৯টি বিদ্যুৎবিহীন ইউনিয়ন ই-সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে; ৫০ মন্ত্রণালয়ে ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট কেন্দ্রীয়ভাবে বিসিসি-তে হোস্ট করা হয়েছে; সরকারি পর্যায়ে ইন্টারনেট সুবিধা বাড়ানোর জন্য ৪ এমবিপিএস ব্যান্ডউইডথ ১৬ এমবিপিএস-এ উন্নীত করা হয়েছে; আইপি অ্যাড্রেস সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে; বিসিসি-তে জাতীয় ডাটা সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে; গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্কের মৌলিক অবকাঠামোর সম্প্রসারণ করা হয়েছে; মহাখালীসহ দেশের সব বিভাগে এসটিপি স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে; দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ওয়াই-ফাই জোন স্থাপন করা হয়েছে; ২০০৯-১০ অর্থবছর বিসিসি ২১ বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে সাইবার সেন্টার গড়ে তুলেছে; ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিসিসি’র বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে ১৬১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে; ২০১০-১১ অর্থবছরে তা করা হয়েছে ১৯২টি স্কুলে; ১০৮৮ জন শিক্ষককে কমপিউটার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে; ১৬১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্থাপিত কমপিউটার ল্যাব সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য কমপিউটার ট্রাবলশূটিং প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে; বিসিসি’র বিভাগীয় কেন্দ্র ও ৬৪ জেলায় গড়ে তোলা ১৯২টি কমপিউটার ল্যাব ব্যবহার করে শিক্ষক/শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে; দুই হাজারেরও বেশি ইন্টার্ন প্রার্থীকে দেশীয় আইসিটি কোম্পানিতে ইন্টার্নশিপের জন্য নিয়োজিত করা হয়েছে; ৩০ জন ২০১০-এ বাংলাদেশ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের প্রাতিষ্ঠানিক সদস্যপদ অর্জন করে; BDS 1520; ২০০০ ইউনিকোড ৬-ভিত্তিক বিষয়বস্ত্ত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; প্রস্তাবিত কী-প্যাড বাংলাদেশ মান হিসেবে ঘোষণার জন্য বিএসটিআই-এ পাঠানো হয়েছে ও সচেতনতামূলক ওয়ার্কশপে/ সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে দেশে-বিদেশে।
লক্ষ করলে দেখা যাবে, এখানে যেসব সাফল্যের কথা বলা হলো, তাতে শুধু আইসিটি সেবার সম্প্রসারণকেন্দ্রিক তৎপরতা ছাড়া সামগ্রিক আইসিটি তথা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ও উন্নয়ন এবং আইসিটি খাতে জাতীয় পর্যায়ে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার তেমন কোনো উদ্যোগে কথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অর্জিত সাফল্য তালিকায় অনুপস্থিত। যদি বলি আইসিটি উন্নয়নে গবেষণা কর্মসূচির কী হলো এই দুই বছরে? তখন লা-জবাব। যদিও সরকারপক্ষ জিব শুকিয়ে গলা টেনে একটা জবাব দেয়ার চেষ্টা করে, তবে হয়তো বলা হবে : বাংলা স্পেল চেকার উন্নয়ন, টেক্সট টু স্পিচ, স্পিচ টু টেক্সট সফটওয়্যার উন্নয়ন এবং বাংলা ওয়ার্ড সর্টিং সফটওয়্যার উন্নয়ন ইত্যাদি গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়নে কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, আইসিটি খাতে কি আর কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে আমরা গবেষণা কার্যক্রম চালাতে পারি? আসলে তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে গবেষণা যে অন্যতম মুখ্য কাজ, সে উপলব্ধি আমাদের কম। সেজন্যই দুই বছরের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কার্যক্রমে এই গবেষণার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। সেই সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অপরিহার্য কারিগর তথা দক্ষ আইসিটি মানবসম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোগ-আয়োজনের দৈন্য ক্ষমাহীন পর্যায়ে। শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কমপিউটার চালানো, ইন্টারনেট ব্যবহার ও ওয়েবসাইট তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং সীমিতসংখ্যক ইন্টার্নশিপ কর্মসূচির মাধ্যমে আইসিটি মানবসম্পদ তৈরির কাজে আমরা ব্যস্ত। কিন্তু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে জোরদার শিক্ষা কর্মসূচির বাস্তবায়নের মাধ্যমে জাতিকে একটি দক্ষ আইটি মানবসম্পদ উপহার দেয়ায় তেমন কোনো সাফল্য নেই। দিন দিন তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান খাতে ছাত্রভর্তি কেনো কমে যাচ্ছে, কেনো এই নেতিবাচক প্রবণতা, এই নেতিবাচক প্রবণতা কিভাবে ঠেকানো যায়- সেদিকে আমাদের লক্ষ্য নেই।
সুখের কথা, সরকার তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ায় আন্তরিক। কিন্তু ভুল দর্শন মাথায় নিয়ে সেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়া কি সম্ভব? কখনই তা সম্ভব নয়। সঠিক দর্শন নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ায় এগিয়ে যেতে হলে জানতে হবে- প্রযুক্তি কী, আর প্রযুক্তি কী নয়। জানতে হবে- বিজ্ঞান কী, আর বিজ্ঞান কী নয়। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার ঐকান্তিক ইচ্ছে থাকলেও সঠিক দর্শন আর দূরদৃষ্টি নিয়ে আমাদের বলা উচিত ছিল ‘চাই বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ’। তাহলে দেখা যেতো ‘বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ পাওয়ার পাশাপাশি আমরা পেয়ে যেতাম আমাদের কাঙ্ক্ষিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি থাকলে আমাদেরকে এ সত্য মানতেই হবে। সেজন্যই বলছি জানতে হবে : বিজ্ঞান কী, বিজ্ঞান কী নয়, প্রযুক্তি কি, প্রযুক্তি কী নয়।
বিজ্ঞান হচ্ছে ভৌত বিশ্বের উৎপত্তি, প্রকৃতি ও প্রক্রিয়ায় দৃশ্যবান কিংবা উপলব্ধির পর্যবেক্ষণিক ব্যাখ্যা তুলে ধরে, এ ব্যাখ্যা সর্বজনস্বীকৃত হলেই তা বিজ্ঞান। গুরুত্বের সাথে মাথায় রাখতে হবে : বিজ্ঞান প্রযুক্তি নয়-‘সায়েন্স ইজ নট টেকনোলজি’। আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে একসাথে গুলিয়ে ফেলি। ফলে বিজ্ঞান তার যথার্থ গুরুত্বটুকু আমাদের কাছ থেকে পায় না। বিজ্ঞানকে পাশে ঠেলে শুধু প্রযুক্তি নিয়ে আমরা মাতামাতি করি। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, বিজ্ঞান কোনো পণ্য তৈরি করে না। একটি মাইক্রোওভেন উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞানটুকু বিজ্ঞান আমাদের জানিয়ে দেয়, কিন্তু মাইক্রোওভেন তৈরির কাজ বিজ্ঞানীর নয়। বিজ্ঞানীরা জ্ঞানদান করেন। প্রকৌশলীরা ও প্রযুক্তিবিদেরা সে জ্ঞানভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করেন প্রযুক্তিপণ্য, যার ব্যবসায়িক মূল্য আছে। সেজন্যই বলা হয় : Technology is the commercial extension of science- প্রযুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞানের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ। তাহলে আমরা দেখলাম, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি এক নয়। বিজ্ঞান জন্ম দিতে পারে প্রযুক্তির, কিন্তু প্রযুক্তি জন্ম দিতে পারে না বিজ্ঞানের। প্রযুক্তি জন্ম দেয় প্রযুক্তিপণ্যের। বিজ্ঞান ছাড়া প্রযুক্তি অচল, প্রযুক্তি ছাড়া বিজ্ঞান অচল নয়। বিজ্ঞান বিকশিত হলে এর উপজাত হিসেবে প্রযুক্তিরই বিকাশ ঘটবে, পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব হবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ। অতএব বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে, বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বাদ দিয়ে কখনই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব নয়। অথচ এ সত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ভুল দর্শনকে অবলম্বন করে শুধু প্রযুক্তিকে বিকশিত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাইছি। মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান হচ্ছে প্রসূতি আর প্রযুক্তি তার সন্তান।
বিজ্ঞান সম্পর্কে দার্শনিক বার্টলম্যান একটি মূল্যবান কথা বলে গেছেন। সে কথাটি আমাদের গুরুত্বের সাথে মনে রাখতে হবে। তিনি বলেছেন, ‘দর্শন যখন পথ হারায়, বিজ্ঞান তখন পথ দেখায়। আর বিজ্ঞান যখন পথ হারায়, দর্শন তখন পথ দেখায়’। তাই নানা মত, নানা পথ আর নানা দর্শনের ঠেলাঠেলিতে জাতি যখন আজ দিশেহারা, তখন উন্নয়নের হাতিয়ার করতে হবে আমাদের বিজ্ঞানকেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার হাতিয়ারও এ বিজ্ঞানই। একথা যেনো আমরা ভুলে না যাই।
সেজন্যই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ায় আমরা যারা আন্তরিক প্রয়াসী, তাদের প্রযুক্তির গবেষণায় যেমন মনোযোগী হতে হবে, তেমনি তার চেয়েও শতগুণ বেশি মনোযোগী হতে হবে বিজ্ঞান গবেষণায়। বিজ্ঞান গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে শতগুণ। অন্যান্য দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় জিডিপি’র কত অংশ খরচ করছে সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। গবেষণায় সুযোগ বাড়ালে আমরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কার উদ্ভাবনে সাফল্য পাবো। যেমনটি আমাদের বিজ্ঞানীরাই আবিষ্কার করতে পেরেছেন পাটের জিনোম সিক্যুয়েন্স, কৃত্রিম কিডনি। তখন আমরা আর শুধু প্রযুক্তির ভেন্ডর হয়ে থাকবো না, অন্যের প্রযুক্তি কিনে কিনে ফতুর হবো না। নিজেদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি নিজেরাই ব্যবহার করব। ঘুচবে বাইরের প্রযুক্তি ব্যবহারের দৈন্য। হাতের মুঠোয় ২০২১ সালের আগেই পাব ডিজিটাল বাংলাদেশ। এজন্য প্রয়োজন ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগানের পাশাপাশি ‘বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ নামের স্লোগানটিও মনেপ্রাণে ধারণ।
আমরা যদি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আর ‘বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ স্লোগানকে সমান্তরালভাবে এগিয়ে না চলি, তবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষ মানবসম্পদ কখনই গড়ে তুলতে পারব না। দক্ষ মানবসম্পদ না থাকলে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার সৈনিক আমরা পাব কোথায়? সে জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান নেতিবাচক প্রবণতার অবসান ঘটানো আমাদের জন্য অগ্রাধিকারমূলক করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্য সবের মাঝে এক্ষেত্রে বিদ্যমান বড় মাপের একটা নেতিবাচক প্রবণতা হচ্ছে বিজ্ঞান বিষয়ে ছাত্রসংখ্যা কমে যাওয়া। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের খবরে বিজ্ঞান শিক্ষায় পিছুটানের আত্মঘাতী প্রবণতার একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। যারা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ অভিধার সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন, কিংবা দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, বার বার স্বপ্নভঙ্গের পরও যাদের স্বপ্ন দেখা থেমে নেই, তাদের নিশ্চিতভাবেই খবরটি উদ্বিগ্ন করবে। খবরটির শিরোনাম ছিল-‘বাণিজ্য শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে শিক্ষার্থীরা : বিজ্ঞান পিছিয়ে’। খবরটিতে বলা হয়েছে, বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এদেশের শিক্ষার্থীরা। পরিবারের পক্ষ থেকেও এখন আর বিজ্ঞান পড়তে আগ্রহী করে তোলা হয় না। ফলে এ শিক্ষায় এক ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। এই যদি হয় অবস্থা, তবে এ সঙ্কটের অবসান না ঘটিয়ে কী করে সম্ভব হবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ পাওয়া। কোথায় পাবো আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ জনবল?
রিপোর্টটিতে এ সঙ্কটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের তুলনায় বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের চাকরির সুযোগ কম। চাকরি পাওয়া কঠিন। অপরদিকে বাণিজ্য বিভাগে চাকরির সুযোগ বেশি, তাই সে বিভাগে ছাত্রসংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। চাকরির বাজারে এখন কদর এমবিএ আর বিবিএ ডিগ্রিধারীদের।
রিপোর্টটিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যানের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, গত ৩ বছরে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী কমেছে ৩১ দশমিক ৬৩ শতাংশ। অপরদিকে বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) দেয়া পরিসংখ্যানমতে, গত এক দশকে এসএসসি পর্যায়ে ব্যবসায় শিক্ষায় শিক্ষার্থী বেড়েছে ১৮ শতাংশ। এ সময়ে বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থী কমেছে ১১ শতাংশ।
সারকথা
তাহলে সারকথা যা দাঁড়ায় তা হলো :
০১.
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে হলে সঠিক দর্শন নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে, যা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি অনুপস্থিত।
০২.
সেই সঠিক দর্শনটি হচ্ছে বিজ্ঞানকে যথাগুরুত্ব দিয়ে বিজ্ঞানসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য-কর্মসূচি বাস্তবায়নের পথ বেয়েই আমাদের গড়তে হবে কাঙ্ক্ষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ।
০৩.
অন্যদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি কিনে আমরা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে পারব না- এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।
০৪.
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য নিজস্ব গবেষণা উদ্যোগ জোরদার করতে হবে।
০৫.
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণায় বাজেট বরাদ্দ ব্যাপক বাড়াতে হবে।
০৬.
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় ছাত্রভর্তি কমে যাওয়ার নেতিবাচক প্রবণতা ঠেকাতে হবে।
০৭. ডিজিটাল বাংলাদেশের স্থিতিশীল পদচারণা অব্যাহত রাখার জন্য চাই নিজস্ব দক্ষ আইসিটি জনবল।
০৮.
ডিজিটাল তথ্যসেবাকে শুধু মোবাইল ফোন আর কমপিউটারকেন্দ্রিক রাখলে চলবে না।
০৯.
এমন সব সেবার সুযোগ বাড়াতে হবে, যাতে গ্রামের গরিব মানুষও সহজে প্রবেশ করতে পারে।
১০.
সরকার ইন্টারনেট ব্যান্ডউইডথের দাম কমালে, তাতে প্রান্তিক ব্যবহারকারীরা যেনো উপকৃত হয়, সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
১১.
উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত দক্ষ আইটি পেশাজীবী গড়ে তুলতে হবে।
১২.
প্রযুক্তি উদ্ভাবনামূলক উদ্যোগে সরকারি সহযোগিতা বাড়াতে হবে।
কজ ওয়েব