• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > সন্ত্রাসবিরোধী আইন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত মিডিয়া ও আইসিটি
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মো: জাবেদ মোর্শেদ চৌধুরী
মোট লেখা:২৫
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৩ - আগস্ট
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ক্রিস্টাল রিপোর্ট
তথ্যসূত্র:
রির্পোট
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
সন্ত্রাসবিরোধী আইন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত মিডিয়া ও আইসিটি
ন্ত্রাসবিরোধী আইন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, মুক্ত মিডিয়া ও আইসিটি

মোহাম্মদ জাবেদ মোর্শেদ চৌধুরী

বর্তমানে বাংলাদেশে ‘সন্ত্রাসবিরোধী ও তথ্যপ্রযুক্তি আইন’ নিয়ে চিন্তাশীল মহলে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। যুক্তিসঙ্গত কারণেই এটি হচ্ছে। এ আইন প্রণয়নের ফলে সাধারণ মানুষ, যারা কোনো ধরনের সন্ত্রাসী বা রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকা-- জড়িত নন, কিন্তু আইসিটির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, তাদেরও হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

এ কথা সত্য, পৃথিবী যত বেশি আইসিটিনির্ভর হচ্ছে, হ্যাকিংসহ সাইবার অপরাধ তত বেশি বাড়ছে। এটি কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউবা গোপনে পরিচালনা করছে। ব্যক্তি পর্যায়ে বা রাষ্ট্রীয়ভাবেও এই হ্যাকিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আবার কখনও কখনও এই আইসিটি তথা ফেসবুক, টুইটার, ই-মেইল ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোনো কোনো স্বৈরশাসকের অপশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক বছরে মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্ত নামের আন্দোলন, সম্প্রতি দিলিস্নতে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, বাংলাদেশে শাহবাগ ও শাপলা চত্বর আন্দোলন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শুধু স্বৈরশাসকই নয়, বিশ্বে শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো কীভাবে সামরিক শক্তির অপব্যবহার করে দেশে দেশে তাদের পছন্দের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে বা অপচ্ছন্দের সরকার উৎখাতে ষড়যন্ত্র করছে, তা দ্রম্নতই সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে আইসিটির কল্যাণে। বলাবাহুল্য, এ ধরনের ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকা--র মূল শিকার হচ্ছে বিশ্বের বিপুলসংখ্যক নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ শান্তিকামী সাধারণ মানুষ।

আমরা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও তার উইকিলিকসের কথা জানি। কীভাবে আমেরিকা ও তার মিত্ররা বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে থাকে, তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বে সিআইএ যে শত শত গোপন নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে এবং এর সাথে কোন কোন রাষ্ট্র ও ব্যক্তি জড়িত তাও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। যাহোক, বিশ্বের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও নির্যাতনকারীদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্য অ্যাসাঞ্জকে যেখানে বিশ্ববাসীর পক্ষ থেকে বিরোচিত সংবর্ধনা দেয়া উচিত ছিল, সেখানে তার নামে সুইডেনে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, অনৈতিক একটি মামলা দেয়া হলো। আর আমেরিকা তার অপকর্ম ফাঁস হয়ে যাওয়ার ক্ষোভে-দুঃখে অ্যাসাঞ্জকে যেকোনোভাবে তাদের আয়ত্তে নিয়ে শাস্তি দিতে চাচ্ছে। বর্তমানে তাকে লন্ডনে ইকুয়েডরের দূতাবাসে অন্তরীণ অবস্থায় দুর্বিষহ জীবন-যাপন করতে হচ্ছে।

অতিসম্প্রতি সিআইএ’র সাবেক এজেন্ট অ্যাডওয়ার্ড সেণাডেন ব্রিটেনের গার্ডিয়ান এবং আমেরিকান ওয়াশিংটন পোস্টের কাছে যে তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে, তা আরও বেশি বিস্ময়কর, গুরুত্বপূর্ণ ও জঘন্য-ঘৃণ্য। যে হ্যাকিংয়ের জন্য আমেরিকা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে শাস্তি দিতে চাচ্ছে, সেই একই কাজ এরা নিজেরাই ব্যাপকভাবে করে যাচ্ছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। অবাক বিস্ময়ে বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছে, সারাবিশ্বের মানুষের যাবতীয় ফেসবুক, ই-মেইল যোগাযোগ, মোবাইল বা ফোন কল, টেক্সট মেসেজসহ যাবতীয় তথ্য এরা চুরি করছে। যে তথ্য বা ব্যক্তিগত গোপন কোনো বিষয় সে পৃথিবীর কাউকে জানাতে চায় না, তাও কেউ না কেউ দেখে চুলচেরা বিশেস্নষণ করছে অর্থাৎ ব্যক্তির প্রাইভেসি বলতে আর কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। এ ধরনের জঘন্য কর্মকা--হ্যাকিংয়ের পক্ষে এরা সাফাই গাইছে এই বলে, এর মাধ্যমে নাকি এরা এদের দেশ আমেরিকাকে অনেক হামলার পরিকল্পনা থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। যদিও এ সংক্রান্ত সিনেট কমিটি তাদের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। আর এই ধরনের কাজে যুক্তরাজ্য সিআইএ-কে সাহায্য করেছে বলে জানা গেছে। হয়তো বিশ্বের আরও অনেক গোয়েন্দা সংস্থা বা রাষ্ট্র বা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী আমেরিকাকে এ কাজে সাহায্য করেছে। শুধু তাই নয়, আমেরিকা ও তার সহযোগীরা তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধানত চীনকে অনেক দিন থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে তার বিভিন্ন সর্বাধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান চুরি করার অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছে। এখন দেখা যাচ্ছে, অভিযোগকারী আমেরিকা নিজেই চীনের বিভিন্ন সামরিক ও প্রযুক্তিজ্ঞান সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাকেন্দ্র থেকে হ্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মূল্যবান তথ্য চুরি করে আসছে। চীন জাতিসংঘের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছে। এখানে উল্লেখ্য, গত শতকের নববই দশকে সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে বাংলাদেশকে যুক্ত না করার পক্ষে তৎকালীন সরকার এ তথ্য চুরির বিষয়টি তুলে ধরেছিল।

আমরা স্বীকার করছি, আইসিটির অপব্যবহার করে বেশ কিছু সন্ত্রাসী কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে। তবে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- প্রতিহত করার অজুহাতে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো তাদের নানামুখী বৈধ-অবৈধ পন্থায় ব্যক্তিমানুষের প্রাইভেসির তোয়াক্কা না করে, কোনো ধরনের নীতি-নৈতিকতার তোয়াক্কা না করে তার যাবতীয় কর্মকা- মনিটর করবে, তথ্য চুরি করে সংরক্ষণ করবে এবং সময়ে সময়ে তার অপব্যবহার করবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

আমরা আরও জানি, তৎকালীন সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিটিআরসি ২০০৮ সালে আইজিডবিস্নউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে), আইসিএক্স (ইন্টারন্যাশনাল এক্সচেঞ্জ), আইআইজি (ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে) এবং পরে ২০১২ সালে নতুন করে আরও কয়েকটি আইজিডবিস্নউ, আইসিএক্স, আইআইজি লাইসেন্স প্রদান করেছে। এ আইজিডবিস্নউ, আইসিএক্স ও আইআইজির মধ্যে এলআই সলিউশন নামে একটি বিষয় ছিল, তা হলো লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিটি কোম্পানিকে এনএসআইয়ের সদর দফতরে এবং বিটিআরসিতে বাংলাদেশে আসা ও যাওয়া কল, ই-মেইল, ভিডিও ইত্যাদি মনিটর করার জন্য ওয়ার্কস্টেশন বসাতে হবে। অর্থাৎ বর্তমানে ২০১৩ সালে বিটিআরসি যে মনিটরিং কাজটি করছে, তা এভাবেই করছে, ঠিক যেভাবে আমেরিকা গোপনে সারাবিশ্বের কল, ই-মেইল, ভিডিও ইত্যাদি মনিটর ও ভবিষ্যতে অপব্যবহারের জন্য সংরক্ষণ করছে।

তাই এখন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইন এবং তথ্য অধিকার আইন ও সংবাদপত্র তথা মিডিয়ার স্বাধীনতা অর্থাৎ মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি কীভাবে মোকাবেলা করা যাবে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশ যেখানে অন্তত অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে আইনের শাসন পুরোদমে চালু আছে, তার অনুসরণে তৃতীয় বিশ্বের দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি চরম অনিয়মের দেশে, আইনের অপব্যবহারের দেশে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের তথ্যপ্রযুক্তি ধারাটির ব্যাপক অপব্যবহার নিয়ে আমরা শুধু শঙ্কিতই নই, বেশআতঙ্কিত। কারণ সাধারণ মানুষ, সরকার বা ক্ষমতাশালীদের পক্ষে ফেসবুক বা ওয়েবে লিখলে তা সাইবার ক্রাইমের পর্যায়ে পড়লেও তাকে কিছুই বলা হবে না। আর বিপক্ষে কিছু একটা লিখলেই বা বললেই বা সমর্থন জানালেই তাকে নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হবে।

তবে সাইবার ক্রাইম কমাতে ও বিশেষ করে এর আইনগত ভিত্তি দিতে এ আইন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ফেসবুক বা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমে যদি কোনো দাঙ্গা ঘটে, তবে তার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে এ আইন একটি ভিত্তি হতে পারে। এ আইনে ডিজিটাল তথ্য-উপাত্তকে সাক্ষ্য হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আইনের ২১(৩) উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সত্তার ব্যবহৃত ফেসবুক, স্কাইপি, টুইটার বা যেকোনো ইন্টারনেটের মাধ্যমে আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা তাহাদের অপরাধ-সংশ্লিষ্ট স্থির বা ভিডিওচিত্র পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো মামলার তদন্তের স্বার্থে যদি আদালতে উপস্থাপন করা হয়, তাহা হইলে সাক্ষ্য আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেনো, পুলিশ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক উপস্থাপিত উক্ত তথ্যাদি আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হইবে।’

আইনের ধারা নিয়ে তেমন আপত্তি না থাকলেও এখন প্রশ্ন হলো নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর কীভাবে আমরা দেব,

০১. এটি যে সন্ত্রাস বাড়াতে ব্যবহার হবে না, তার নিশ্চয়তা কী?

০২. খুব সহজেই যেখানে হ্যাক করা যায়, সেখানে হ্যাকিং বা সফটওয়্যারের মাধ্যমে মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণ তৈরি করে ভিন্নমতাবলম্বীদের নিপীড়ন করা হবে না তো?

০৩. ডিজিটাল সাক্ষ্যপ্রমাণ বৈধ করায় যেকেউই যেকাউকে হয়রানির জন্য যার-তার ফেসবুক বা মেইলে হ্যাক করে তার ক্ষতির চেষ্টা করতে পারে?

০৪. মিথ্যা সাক্ষ্যপ্রমাণ যতদিন না আদালতে প্রমাণিত হবে, ততদিন অভিযুক্ত জামিন অযোগ্যভাবে হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হলে কী হবে?

০৫. নিছক অনলাইনে মত প্রকাশ বা প্রতিবাদকে সন্ত্রাসে উস্কানি বা সহায়তা বলে চিহ্নিত করার পরিবেশে মত প্রকাশের অধিকার বলে আর কিছু থাকবে কী?

অর্থাৎ এ আইনে যেকাউকে ফাঁসিয়ে দেয়ার একটা সুযোগ থাকবে। এখন এটা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও আদালতের দক্ষতা, স্বচ্ছতা বা নিরপেক্ষতার ওপর নির্ভর করবে আইনের ব্যবহারটা কেমন হবে।

রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিষয়টি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতাও গুরুত্বপূর্ণ। এখন এ আইন আমাদের বাকস্বাধীনতা ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এ দুটি বিষয়ের মধ্যে কীভাবে সুষম সাম্যাবস্থা বজায় রেখে চলতে পারবে সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ।

আমরা যেমন আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত তথ্যের বা মতামতে ভুল ব্যাখ্যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে চাই না, তেমনি একইভাবে চাই রামুতে ফেসবুক ব্যবহার করে যে ধর্মীয় দাঙ্গা হয়েছে তার যথাযথ বিচার এবং সেই বিচারে ফেসবুকের দেয়া তথ্য ও চিত্র যাতে কোর্টে সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয়। এ প্রশ্নের উত্তর নির্ভর করছে এই আইন কীভাবে ব্যবহার হচ্ছে তার ওপর

আমরা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও তার উইকিলিকসের কথা জানি। কীভাবে আমেরিকা ও তার মিত্ররা বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে, অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে থাকে, তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিশ্বে সিআইএ যে শত শত গোপন নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তুলেছে এবং এর সাথে কোন কোন রাষ্ট্র ও ব্যক্তি জড়িত তাও প্রকাশ হয়ে পড়েছে।

কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : jabedmorshed@yahoo.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৩ - আগস্ট সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস