লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
নাম নয় কাজই সব
প্রযুক্তি সমৃদ্ধির সুবর্ণ রেখা
ব্যক্তিভেদে চিন্তাগত বৈচিত্র্য থাকবেই। তারপরও সমৃদ্ধির যাত্রায় পথ যতই বৈচিত্রময় হোক তা একটি বিন্দুতে সমান্তরাল। আর সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জন্য সেই রেখাটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন তাতে আজ কারো দ্বিমত নেই। একই কারনে আর সবকটি খাতের চেয়ে এই ক্ষেত্রে গণমানুষের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েছে বিদায়ী মহাজোট সরকার। প্রতিয়মান হয়েছে প্রযুক্তি সমৃদ্ধির সুবর্ণ রেখা। তাই বলতে হয়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রচারণা পর্বে আমরা সফল হয়েছি। তবে এখন আর ‘মন জয়’ পর্বে আটকে থাকলে চলবে না। এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাজগুলোর সমন্বয় করতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনার গ--তে আবর্তিত না হয়ে আরও দৃঢ়ভাবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে জীবনমানের উন্নয়নে এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে। অতিক্রম করতে হবে ফেলে আসা সময়ের সীমাবদ্ধতা। অপূর্ণতা পূরণের পাশাপাশি দূর করতে হবে অসঙ্গতি। উন্নত বিশ্বের সাথে বাজি ধরে হাতে-হাত, কাঁধে-কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে আগামীর পথে। বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে শানিত করতে হবে সমৃদ্ধির রূপরেখা। এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের অভিজ্ঞজন এবং সব মত ও পথের নাগরিক অভিপ্রায়কে। তাহলেই স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তির আগেই আমরা পৌঁছতে পারব সমৃদ্ধির সুবর্ণরেখায়।
পূর্ণ হোক অপূর্ণতা
শুধু আমাদের দেশই নয়, গোটা বিশ্বকেই আজ বদলে দিচ্ছ তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। তারহীন ইন্টারনেটের আলিঙ্গনে বিনির্মাণ করছে নতুন কাঠামো। পাল্টে দিচ্ছে মানবসমাজের বৈশ্বিক রূপ। সঙ্গত কারণেই ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ স্লোগান বাসত্মবায়নের জন্য পাঁচ বছরের ম্যান্ডেট পায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। অক্টোবর মাসে পূর্তি হয় এ সরকারের মেয়াদ। অবশ্য স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পূর্তির মাইলফলকে পা রাখতে এখনও বাকি রয়েছে আট বছর। স্বাভাবিক নিয়মেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আবির মেখে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ বর্তে যাচ্ছে পরবর্তী সরকারের ওপর। আগামী সরকারের প্রজ্ঞা, দক্ষতা আর নিষ্ঠার ওপর নির্ভর করছে ইতিহাসের বাঁক ঘুরিয়ে দেয়ার সাফল্য। এজন্য বিদায়ী সরকার যে যে ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি, সেখান থেকেই আগামী সরকার শুরু করবে বলে প্রত্যাশা প্রযুক্তিবোদ্ধাদের।
তারা মনে করেন, হাইটেক পার্ক নিয়ে বছরের পর বছর যে কারসাজি চলেছে, দ্রুততম সময়ে তার সুরাহা হওয়া দরকার। প্রয়োজন রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নির্মীয়মাণ সফটওয়্যার টেকনলোজি পার্কের ঝুলমত্ম দশার অবসান। দেশজুড়ে বেশুমার ‘টেকনলজি পার্ক’ প্রকল্প তৈরির মতো লেজেগোবরে না করে যেনো পরিকল্পিতভাবে একেকটি প্রকল্প বাসত্মবায়নের মাধ্যমে নতুন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। গুরুত্ব দেয়া হয় মহাসমারোহে বাজারে আসা সরকারের ‘দোয়েল’ প্রকল্প নিয়ে বিদ্যমান কল্পকথার ইতি টেনে এগিয়ে যাওয়ার দিকে। ‘ভ্যাস’ নিয়ে কনটেন্ট প্রোভাইডার আর টেলিকম অপারেটরদের হ্যান্ডশেক করাতেও যেনো ভূমিকা রাখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে যেনো বাণিজ্যিক আগ্রাসনে মেধাস্বত্ব বিকিয়ে দেয়া না হয়। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি-কে মুনাফা ভাগাভাগির সাথে সংশ্লিষ্টতায় প্রতিষ্ঠানটি যেনো দন্তহীন বাঘে পরিণত না হয়, সেজন্য মন্ত্রণালায় আর সংসদীয় কমিটির মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব কমিয়ে আনার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন অভিজ্ঞজনেরা। তাদের মতে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করা কমপিউটার কাউন্সিলকে শক্তিশালী করে এর সাথে সংশ্লিষ্টদের সমান্তরাল যোগাযোগ স্থাপন করতে না পারলে অচিরেই কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এজন্য বিদ্যমান নীতিমালা ও আইন রিভিউ করে ব্যবসায় এবং গ্রাহকবান্ধব সুযোগ প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছন সংশ্লিষ্টরা। একই সাথে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের সংশোধনী নিয়ে তীব্র সমালোচনা করে অবিলম্বে এর সংশোধন এবং ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রযুক্তিবোদ্ধারা। সুধীজনের প্রত্যাশা, ইউনিয়ন তথ্য সেবাকেন্দ্রগুলোকে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীত করার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে সরকারের ই-সেবার মানোন্নয়নে মনোযোগী হওয়া উচিত হবে আগামী সরকারকে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথকে সুগম করতে ই-বাণিজ্য-কে এগিয়ে নিতে এখন একটি প্লাটফর্মে গুছিয়ে আনতে গুরুত্বারোপ করেছেন বেশিরভাগ প্রযুক্তি বিশ্লেষক। তাদের মতে, বেশুমার ওয়েবসাইট তৈরির চেয়ে এই ব্যবসায় শুরু করতে একটি ন্যূনতম যোগ্যতা-বিধি তৈরি করা উচিত। বাজার ভারসাম্য রাখতে ব্যাঙের ছাতার দশা থেকেও বেরিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। সংশিস্নষ্টদের দাবি, অনলাইন কেনাকাটায় মানুষের আস্থা তৈরির পাশাপাশি ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে আর্থিক ঝুঁকি কমাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে সরকার। অ্যাপিস্নকেশন উন্নয়ন বিষয়েও সমান্তরাল মত দিয়েছেন প্রযুক্তিবোদ্ধারা। এরা মনে করেন, দেশে বেসরকারি উদ্যোগে নিয়মিত মোবাইল অ্যাপস নিয়ে প্রতিযোগিতা হলেও বিষয়টিকে টেকসই করতে সরকারের বিশেষ তহবিল গঠন করা উচিত। একই সাথে এসব অ্যাপসের মেধাস্বত্ব প্রতিষ্ঠা এবং অপেক্ষমাণ বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আশা করা যায়, বিদায়ী সরকার যেখানে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে, সেখান থেকেই যদি আগামী সরকার শুরু করে, তাহলে নতুন সরকারের প্রথম বছরেই পোশাক শিল্প খাতকেও ছাড়িয়ে যাবে দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত। এতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কমবে জনবৈষম্য। জাতীয় উন্নয়ন ধারায় সমামত্মরালভাবে অবদান রাখতে সম্ভব হবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠী। কমে যাবে শহরমুখী গ্রোত। আসবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ। জীবন হবে আরও রঙিন।
মূল্যায়িত হোক প্রযুক্তিবিদদের পরামর্শ
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধ দেশ গঠনের মাধ্যমে জীবনমানের উন্নয়ন নিয়ে দেশের প্রযুক্তিবিদ, পরামর্শক ও সংশ্লিষ্ট খাতের উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীরা মনে করেন- বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার এটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে টেকসই এবং সহজ রাসত্মা। এ ক্ষেত্রে বিদায়ী সরকারের আগ্রহের কমতি না থাকলেও সার্বিক মূল্যায়নে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বলেই মনে করেন বেশিরভাগ বিশেস্নষক। তাদের ভাষায়, সরকারের প্রথম দিকে গতি থাকলেও দিন দিন তা শস্নথ হয়েছে। তাই আগামী সরকারকে কথার ফুলঝুরির চেয়ে বাসত্মবায়নের দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। তাদের ভাষায়, বিগত পাঁচ বছরের মেয়াদে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে নেয়া উদ্যোগ এবং পদক্ষেপ প্রত্যেকেই সাধুবাদ জানাবেন। তবে যতটা গর্জেছে ততটা বর্ষণ হয়নি। প্রচারে প্রসার হলেও মূল্যায়িত হয়েছে কমই। কেননা বছরজুড়েই নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছার প্রচেষ্টায় যথেষ্ট ফাঁক ছিল। ছিল সঠিক স্থানে সঠিক ব্যক্তি নিয়োগে দুরদর্শিতার অভাব, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, একের পর এক উদ্যোগ গ্রহণ করে তার ফলাফল পূর্বানুমানের সীমাবদ্ধতা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উদ্যোগ বাসত্মবায়নে শেষ পর্যমত্ম গতি হারিয়ে ফেলা এবং সর্বোপরি কাজে সমন্বয়ের অভাব। তাই স্বদিচ্ছা থাকলেও পূর্ণতা পায়নি সরকারের ‘ডিজিটাল’ স্বপ্ন।
নির্মোহ মূল্যায়নে, সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বপ্নগুলো হয়ে ওঠে কল্পনার পরীর মতো। তবে এ কাজকে এগিয়ে নিতে সবসময় উচ্চকিত থেকেছেন আমাদের প্রযুক্তি পরামর্শক ও বিশ্লেষকেরা। পিছিয়ে থাকেনি তরম্নণেরাও। বরং তাদেরকেই দেখা গেছে সবচেয়ে বেশি অগ্রগামীর ভূমিকায়। তাদের প্রচেষ্টায় আউটসোর্সিং করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে নতুন কর্মক্ষেত্র। মুক্তপেশাজীবী হয়ে বেকারত্বের ভারমুক্ত হতে চলেছে আগামী প্রজন্ম। আবহমান কালের বিজ্ঞান সেলফোনের নানামাত্রিক অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা করছেন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেটের দাম নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে ই-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। বাড়ছে তরুণ উদ্যোক্তার সংখ্যা। এসবই আশা জাগানিয়া এক মহাকাব্য। এই নকশীকাঁথাকে আরও কারু কার্যময় করতে আগামী সরকারকে চলমান উদ্যোগ এগিয়ে নিতে বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন দেশের প্রযুক্তিবিদেরা।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ মনে করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ অভিধারণাটি সময়োপযোগী ও টেকসই হলেও এর সুফল আমরা এখনও পাইনি। এ ক্ষেত্রে আমাদের সামগ্রিক সাফল্য খুবই সীমিত। অভিধারণাটি জ্ঞানভিত্তিক হলেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সংযুক্ত না করায় এ দেউলিয়াত্বের কারণ বলে
উলেস্নখ করেন এ শিক্ষক। তিনি বলেন, শিক্ষা-প্রশিক্ষণ ও গবেষণার ওপর গুরম্নত্ব না দিলে ডিজিটালাইজেশনের যে অভিধারণা তা বায়বীয় বক্তব্যে পরিণত হয়। হয়েছেও তাই। এখন আমরা শুধু প্রযুক্তি ভোক্তায় পরিণত হচ্ছি। উদ্ভাবনে পিছিয়ে পড়ছি। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আগামী সরকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ই-কার্যক্রমের সাথে সংযুক্ত করার পরামর্শ দিয়ে প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ওপর গুরম্নত্বারোপ করেন ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ। তিনি বলেন, স্বদেশী সফটওয়্যার ব্যবহার, দেশেই প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদন এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ওপর এখন সবচেয়ে বেশি গুরম্নত্ব দিতে হবে। স্বদেশী পণ্য ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে নতুন বাজার তৈরি না করে নিজেরাই যেনো আর বাজারে পরিণত না হই সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী যদি মিশুকে চড়তে পারেন তবেই দেশও তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নত হতে পারবে। তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে না পারলে সব উদ্যোগই অন্তসারশূন্য হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি উচ্চকিত প্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জববারের মূল্যায়ন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা ২০২১ সালে। মোট ১৩ বছর সময়ের মাঝে পাঁচ বছর অতিক্রামত্ম হলো মাত্র। মোট সময়ের তুলনায় এটি মোট সময়ের মাত্র ৩৮.৪৬ শতাংশ। আমার হিসাব মতে, এ সময়ে আমরা যা যা অর্জন করেছি তার মাঝে প্রথমটি হলো এ স্লোগানটি জনগণ গ্রহণ করেছে। দ্বিতীয়টি হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার ভিতটি রচিত হয়েছে। এই সময়ে আরও বেশ কিছুটা অগ্রগতি হতে পারত। সেটি আমাদের প্রত্যাশা ছিল। আমাদের বোঝার দরকার যে সবার সব প্রত্যাশা নাও পূরণ হতে পারে।
উত্তরের সপক্ষে যুক্তি টেনে বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির সভাপতি বলেন, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদেরকে মানসিকভাবে প্রস্ত্তত করাই ছিল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ায় একমাত্র অন্তরায়। তার মতে, স্বাভাবিকভাবেই জরাজীর্ণ আমলাতন্ত্র ও ঘূণে ধরা রাজনীতি বিদায় নেবে। সামাজিকভাবে ওরা চাপের মুখে পড়ে তাদের অবস্থান বদলাতে বাধ্য হবে। সরকারকে এদের বদলানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া ইন্টারনেটের দাম কমাতে সরকারকে বাধ্য করার পাশাপাশি পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে ডিজিটাল করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
বিদায়ী সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক কাজের মূল্যায়ন করতে গিয়ে ঢাকা চেম্বার্স অব কমার্স সভাপতি সবুর খান বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ সেস্নাগানটি অনেক ক্ষেত্রেই পূর্ণতা পায়নি। প্রথম দিকে গতি থাকলেও শেষ পর্যমত্ম সরকারের বক্তৃতা কাজে প্রতিফলিত হয়নি। অ্যাটিচুড ভালো থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিস্রুতিতে ঘুরপাক খেয়েছে। ফলে আশা দিয়ে হতাশা বাড়িয়েছে। কাজগুলো পূর্ণতা পায়নি।
নানা উদ্যোগ কাজে বাসত্মবায়িত না হওয়ার পেছনে সংশিস্নষ্টদের অদূরদর্শিতা, অদক্ষতা, পরিসংখ্যানের অভাব, বিদেশী বিনিয়োগ নীতিমালার অভাবকে চিহ্নত করেন তিনি। সবুর খান বলেন, আগামীতে যে দলই সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিক, তাদের সবার আগে আইটি ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এমন কর্মীদের দিয়ে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার তা বাসত্মবায়ন করবে বলে আশা রাখি।
দীর্ঘমেয়াদে সুফল পেতে ‘ইম্পোর্ট সাবস্টিটিউট পণ্য’ যেমন কিবোর্ড, মাউস, ক্যাসিং ইত্যাদি আমদানি না করে দেশেই পস্ন্যান্ট স্থাপন করে তা উৎপাদনে আগামী সরকারকে গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেন সবুর খান। তিনি আরও বলেন, বাজারকে সমৃদ্ধ করতে এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গ্রহণে সহায়তার জন্য নিয়মিত জরিপ পরিচালনা করে হালনাগাদ পরিসংখ্যান তৈরি ও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কমপিউটার কাউন্সিল, বেসিসি ও বিসিএসকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
ভবিষ্যৎ সরকারকে উদ্দেশ্য করে সবুর খান বলেন- তারা যা কিছু বলেন, প্রতিশ্রম্নতি দেন, তা যেনো বাসত্মবায়ন করেন। তা না হলে হতাশা বাড়বে।
সরকারের মেয়াদ পূর্তি শেষে মূল্যায়ন সম্পর্কে এশিয়ান ওশানিয়ান কমপিউটিং ইন্ডাস্ট্রি ওরগানাইজেশনের চেয়াম্যান আবদুলস্নাহ এইচ কাফী বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নের প্রচারের তুলনায় অগ্রগতি হয়নি। তবে তৃণমূল পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
তিনি বলেন, পুরোটা সময়ে সরকার এবং ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে ঘনিষ্ঠতা ছিল কম। অবকাঠামোগত উন্নয়নও আশা-জাগানিয়া পর্যায়ে ছিল না। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অনেকাংশেই উপেক্ষিত থেকেছে। সঠিক গবেষণা ও বাণিজ্যিক কৌশল এবং অভিজ্ঞতার অভাবে সাড়া ফেলেও ব্যর্থ হয়েছে সরকারের ‘দোয়েল প্রকল্প’।
প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের সমমান দেশ থাইল্যান্ডের ‘স্মার্ট থাইল্যান্ড’ প্রকল্পের উদাহরণ টেনে আবদুল্লাহ এইচ কাফী বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি সে দেশের সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য বছরে ১.৭ লাখ ট্যাব ফ্রি দিয়েছে। এসব থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া উচিত।
বিগত পাঁচ বছরে আলোচিত হলেও কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক তৈরি না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এরপরও দেশজুড়ে আইটি পার্ক করার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেগুলো আলোর মুখ দেখার আগেই এর উপযোগিতা হারাতে পারে। এছাড়া কালিয়কৈরের চেয়ে ঢাকার মহাখালীতে অধিগ্রহণ করা পাঁচ বিঘা জমির ওপর ভারতের সল্টলেকের আদলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস, হাইস্পিড ইন্টারনেট ইত্যাদি সুবিধার সমন্বয় ঘটিয়ে একটি বহুতল ভবন করলে অধিক সুফল আসবে বলে মনে করেন এ প্রযুক্তিবাজার বিশ্লেষক।
তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়নামারে সেন্ট্রাল ইয়াঙ্গুনের একটি আইটি পার্কে ৫৪টি বিদেশী কোম্পানি কাজ করছে। এদের মধ্যে জাপানি কোম্পানি ফুজিৎসু সেখানে একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। এ প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের কল্যাণে দেশটিতে দক্ষ জনশক্তি তৈরি হচ্ছে।
পরবর্তী সরকারকে উন্নয়ন ধারাবাহিকতা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দেশে ব্যবসায় করছে এমন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোকে তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ জনবল গড়ে তোলার কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে আইসিটি ইনস্টিটিউট গড়ে তুলে অবকাঠামোগত উন্নয়নে মনোনিবেশ করতে হবে। বরাবরের মতো কথার ফুলঝুরিতে না থেকে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে একের পর এক প্রকল্প বাসত্মবায়ন করতে হবে। মনোনিবেশ করতে হবে সফটওয়্যার প্রোগ্রামার তৈরি ও সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগের বিষয়ে।
এ কাজ সরকারের জন্য মোটেই কঠিন কিছু নয় মমত্মব্য করে তিনি বলেন, বাইরের দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অনায়াসে সরকার একটি বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ করতে পারে। বিদেশী অনেক কোম্পানি এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে মুখিয়ে আছে। সরকারকে এ সুযোগ কাজে লাগাতে হবে।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সেস্নাগান বাসত্মবায়ন বিষয়ে বিদায়ী সরকারের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বেসিস সভাপতি শামীম আহসান বলেন, বেসিসের সহায়তায়ই আইসিটি পলিসি তৈরি, আইসিটি মন্ত্রণালয় গঠন, এটুআইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা, ন্যাশনাল পোর্টাল ফ্রেমওয়ার্কের মাধ্যমে ২৫ হাজার ওয়েবসাইট তৈরি, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক গঠন, বিভিন্ন সরকারি দফতর (উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর) অটোমেশন ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য কাজ করেছে সরকার। তবে এই সময় জাতীয় বাজেটে আইটি খাত উন্নয়নে উলেস্নখযোগ্য বরাদ্দ ছিল না এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন যেমন কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক চালু করা হয়নি। এছাড়া সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র যেমন ই-কমার্সের ওপর থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ও ইন্টারনেটের ওপর ভ্যাট কমানো এবং সুপ্রতিষ্ঠিত একটি সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক গঠন হয়নি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম সমৃদ্ধ দেশ ভুটানেও হাইটেক পার্ক রয়েছে। ভারতে অসংখ্য সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক ও হাইটেক পার্ক রয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবাই আইটি ব্যবসায়ের প্রাণশক্তি আর এটি শুধু অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে নিশ্চিত করা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্ক চালুর মাধ্যমে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। অনেক সময় অবকাঠামো উন্নয়নের পরিবর্তে উপরিকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো জোর দিয়ে থাকে, যা মোটেও কাম্য নয়।
এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে না পারা, সফটওয়্যার ও আইটি সেবা ক্রয় নীতিমালায় জটিলতা, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের পরিবর্তে বিদেশী পরামর্শকদের পরামর্শে অপেক্ষাকৃত কঠিন শর্ত আরোপ মূল প্রতিবন্ধকতা ছিল বলে মনে করেন তিনি। পাশাপাশি আইসিটি নীতিমালা বাসত্মবায়নে বিশেষ করে ৭০০ কোটি টাকার আইসিটি তহবিল গঠন, দক্ষ আইটি জনশক্তি গড়ে তুলতে প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক অর্থ বরাদ্দ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে আসছে। এর পাশাপাশি মন্ত্রণালয়কে আরও শক্তিশালী করা, এটুআইয়ের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা ও গতিশীলতা বজায় রাখা, গার্টনারের রিপোর্টে উল্লিখিত আইটি অবকাঠামো উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেয় ইত্যাদির মাধ্যমে এসব অমত্মরায় দূর করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেন বেসিস সভাপতি।
শামীম আহসান বলেন, তথ্যপ্রযুক্তিই একমাত্র খাত, যার মাধ্যমে আধুনিক নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবন-যাপনকে সহজ ও সুন্দর করবে। তাই এ খাতের উন্নয়নে সরকারের সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রয়োজন। এ খাতে রফতানি আয় সম্প্রতি ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে এবং আমরা আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে আমাদের ১০ লাখ দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন হবে, সেই সাথে সারাদেশের মানুষের জন্য ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে হবে। একই সাথে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জিডিপির ১ শতাংশ তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকেই আসবে বলে আশা করছি আমরা। প্রকৃত অর্থে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বেসিসের এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরকারকে আমত্মরিক হতে হবে। আমরা আশা করব, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিষয়গুলো গুরম্নত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করবে এবং সরকার গঠনের পর তা বাসত্মবায়নে আন্তরিক হবে।
বিনোদিত হওয়ার থেকে ইন্টারনেটের বহুমুখী ব্যবহারের বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিতে আগামী সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন আইএসপিবি সভাপতি আক্তারুজ্জামান মঞ্জু। তিনি বলেন, শিক্ষা, কৃষি এবং স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইন্টারনটের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এজন্য সংশিস্নষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিশেষজ্ঞ পেশাজীবীদের সমন্বয়ে একটি অনলাইন সেবা টিম গঠন করতে হবে। আর এ সেবার জন্য পর্যাপ্ত দেশী কনটেন্ট তৈরির পথ সুগম করতে হবে। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে ভ্যাস নীতিমালা নিয়ে কনটেন্ট ডেভেলপার ও সেলফোন অপারেটরদের মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে মুনাফা অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে তৈরির নীতিমালার বাসত্মবায়ন করতে হবে।
দেশে ব্যক্তি উদ্যোগে অনলাইনে আইএসএন সেবা চালুর প্রথম উদ্যোগ নেয়া এ প্রযুক্তিবোদ্ধা মনে করেন, টেলিকম বিজ্ঞাপনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে এসে সেবার বিষয়ে অধিক মনোযোগী হতে হবে। ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আগামী সরকার অধিক শক্তিশালী করবে। একই সাথে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের ১৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা, বাজেটে স্বতন্ত্র বরাদ্দ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া, হাইস্পিড ডাটা সুবিধা, সেলফোন অ্যাপস তৈরিতে সরকারি প্রণোদনা চালু, সরকারি ওয়েবসাইটগুলোকে আরও ইন্টার্যাইক্টিভ, নিয়মিত তথ্য হালনাগাদ রাখা, ইংরেজি ভাষা শিক্ষার বিসত্মার ও ইউনিয়ন তথ্যসেবাগুলোকে প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের পরামর্শ দেন তিনি।
গণমাধ্যম কর্মী ও প্রযুক্তিবিদ জাকারিয়া স্বপন প্রত্যাশা করেন, সেলফোনে তৃতীয় প্রজন্মের উচ্চগতির নেটওয়ার্ক ব্যবস্থার সুফল কাজে লাগাতে সেলফোন অ্যাপিস্নকশনের উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে। এজন্য সরকার অথবা টেলিকম অপারেটরগুলো প্রণোদনা নিয়ে এগিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই বেসরকারি পর্যায়ে অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তবে সঠিক পরিকল্পনার অভাব আর পর্যাপ্ত সহায়তা না থাকায় আমাদের অর্জনের খাতা মোটেই সমৃদ্ধ হয়নি। শূন্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। কেননা বহুল ব্যবহৃত এমন ১০টি অ্যাপসের নামও বলা মুশকিল। তাই শুধু প্রতিযোগিতা নয়, প্রয়োজন অ্যাপ্লিকেশন উৎসবের আয়োজন করা, যেখানে গুরম্নত্ব পাবে অ্যাপসের ব্যবহারোপযোগিতা। আর এজন্য তরম্নণ অ্যাপস নির্মাতাদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। জাকারিয়া স্বপন বলেন, আমাদেরকে এখন গ্রেফ ব্যবসায় ধারণা থেকে বেরিয়ে উৎপাদন কাজে মনোযোগী হতে হবে।
তরম্নণ তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন, সঠিক পরিকল্পনা আর ধৈর্যের অভাবে বিদায়ী সরকার চেষ্টা করলেও প্রত্যাশিত উন্নয়ন হয়নি। এ সময়ে সরকারের চেয়ে বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়ন বেশি হয়েছে। নীতিমালা, লাইসেন্সিং এবং সর্বশেষ আইসিটি আইন সংশোধনে যথেষ্ট গলদ থাকা আর বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্ত আমাদের ইপ্সিত লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে দিয়েছে। সঠিক জায়গায় উন্নয়ন হয়নি।
বিদায়ী সরকারের মেয়াদে ‘রাজস্ব ভাগাভাগি’র অংশীদার হওয়ায় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি অধীনদের নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাহকদের অধিকার আদায়ে অনেকটা ম্রিয়মাণ থেকেছে মমত্মব্য করে তিনি বলেন, আইজিডব্লিউ, আইআইজি, আইসিএক্স- এই স্ট্রাকচার তৈরিও ছিল ভুল। টেলিকম খাতে চলমান অসুস্থ পরিবেশের জন্য অবাধ লাইসেন্সের সিদ্ধান্ত অনেক ক্ষেত্রেই দায়ী। এর ফলেই একদিকে যেমন রাজস্ব আয় কমেছে, একই সাথে দুর্নীতিও বেড়েছে।
এ কারণেই নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের আগে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতামত নিয়ে এবং তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে তারপর এগুলো পাস করতে ভবিষ্যৎ সরকারকে পরামর্শ দেন সুমন আহমেদ সাবির। বিগত সরকারের সময়ে যে ভুলগুলো হয়েছে তা উত্তরণ করে নেটওয়ার্ক বিসত্মৃতির উদ্যোগ হিসেবে অবকাঠামোগত উন্নয়নে আগামী সরকারকে মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
আগামীর প্রত্যাশা
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সমৃদ্ধির পথে হাঁটতে শুরম্ন করেছে বাংলাদেশ। এখন বিদ্যমান কাঁচা-পাকা সড়কগুলোকে মিলিয়ে দিতে হবে মহাসড়কের সাথে। কাজে লাগাতে হবে তারম্নণ্যের অবিচল উচ্ছ্বাস, উদ্যোক্তাদের আগ্রহ এবং বিশ্বকর্মীদের প্রচেষ্টাকে। যূথবদ্ধ করতে হবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টাকে। আর এজন্য রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকদের কাছে সুনির্দিষ্ট কিছু প্রত্যাশা রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। বিশিষ্টজনেরা মনে করেন, পেছনে তাকানোর আর সময় নেই। এখন শুধুই এগিয়ে যেতে হবে আগামীর পথে। অবশ্য এজন্য তাদের রয়েছে সুস্পষ্ট কিছু পরামর্শ। দেশের শীর্ষস্থানীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিদ ও সংশ্লিষ্ট খাতের নিরলস কর্মী এবং স্টেকহোল্ডারদের সাথে আলাপকালে প্রকাশ পেয়েছে কিছু মৌলিক প্রস্তাবনা। এ প্রস্তাবনাগুলো নিঃসন্দেহে আগামী সরকারের জন্য সহায়ক হবে।
ক. শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ : প্রযুক্তিবিদেরা মনে করেন, উচ্চতর শিক্ষা কারিকুলামকে ইন্ডাস্ট্রির কর্মী চাহিদার পরিপূরক করা উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশিস্নষ্ট করে বাধ্যতামূলক ইন্টার্নি বা শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ চালু রাখা এবং বিশেষ করে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ পদ্ধতি চালু করে প্রয়োজনে শিক্ষানবিশদের সম্মানির অর্ধেক সরকারের পক্ষ থেকে সরবরাহ করা।
খ. পেপারলেস মাল্টিমিডিয়া স্কুল প্রতিষ্ঠা : শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ফ্রি ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়ার পাশাপাশি কাগজের বইয়ের চেয়ে কনটেন্ট ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে পেপারলেস মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রম্নম তৈরিতে সবচেয়ে বেশি গুরম্নত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন প্রযুক্তিবিদেরা। তাদের মতে, এতে প্রতিবছর কাগজের পাঠ্যবই ছাপার খরচ বাঁচিয়ে সরকার দীর্ঘমেয়াদে শিক্ষাপদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করতে পারবে। শিক্ষার্থীরাও লেখাপড়ায় আরও মনোযোগী হয়ে উঠবে।
গ. আইসিটি ক্যাডার : তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশকে ত্বরান্বিত ও স্থায়ী করতে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে ‘আইসিটি ক্যাডার’ সংযুক্তির দাবি জানিয়েছেন অভিজ্ঞজনেরা। পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাটিয়ে এ ক্যাডারের অধীনে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে সক্রিয় করে তোলা উচিত।
ঘ. প্রযুক্তিবান্ধব ব্যবসায় নীতিমালা : বিদেশী যেসব কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যবসায় করছে, সেগুলোকে এ দেশে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে কিছু প্রণোদনা পদ্ধতি চালুর ওপর গুরম্নত্বারোপ করেছেন সংশিস্নষ্টরা। তারা মনে করেন, দেশী প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে পস্ন্যান্ট স্থাপনে সহযোগিতার জন্য মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিকে প্রণোদিত করতে পারে সরকার। একইভাবে তাদেরকে এ দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে ব্যবসায় মুনাফা অনুপাতে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলার মতো বিষয়ে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে স্বতন্ত্র নীতিমালার আওতায় উভয় পক্ষের দায়, অধিকার, মুনাফা বা বিনিয়োগ প্রত্যাহারের বিষয়টি সুস্পষ্ট করতে হবে।
ঙ. গবেষণা ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে হলে অবিলম্বে গবেষণা ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার দিকে জোর দিয়েছেন অধিকাংশ প্রযুক্তিচিমত্মাবিদ। নিয়মিত সার্ভের মাধ্যমে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের উদ্যোগ নিতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কাজ করার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন তারা। প্রযুক্তিবিদেরা মনে করেন, বিদেশে অবস্থান করা সংশ্লিষ্ট খাতের বিশেষজ্ঞদের দেশে ফিরিয়ে আনা অথবা তাদেরকে পরামর্শক নিয়োগ করে এ খাতের উন্নয়নে অবদান রাখতে হবে। অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য স্কুলভিত্তিক প্রশিক্ষণে তাদের আগ্রহী করে তুলতে হবে।
চ. তথ্য ও যোগাযোগ আইন সংশোধন : সংশোধিত ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধন করে তা যুগোপযোগী করা এবং আইনের অপপ্রোয়গ রোধে ফরেনসিক ল্যাব স্থাপন করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন বেশিরভাগ প্রযুক্তিবোদ্ধা। নিয়মিত সেমিনারের মাধ্যমে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করা না হলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে।
ছ. তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সমন্বয় কমিটি : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি কমিটি গঠন এবং এ কমিটির প্রতি তিন মাস অন্তর বৈঠকে কার্যক্রমের রিভিউ প্রকাশ করা না হলে অগ্রগতির ধারা হবে বলে মনে করেন প্রযুক্তি বিশস্নষকেরা। তাদের অনেকের মতেই, বিদ্যমান ডিজিটাল টাস্কফোর্সের নিষ্ক্রিয়তার পেছনে সরকারপ্রধানকে এ কমিটিতে রাখাটা অন্যতম। কেননা দেশের প্রধানমন্ত্রী নানা কাজে ব্যসত্ম থাকবেন- এটাই স্বাভাবিক। তাই এ ক্ষেত্রে কমিটিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে নিয়ে প্রযুক্তিবিদ, স্টেকহোল্ডার, সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম কর্মী ও উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে নিয়মিত বৈঠক করলে অগ্রগতি আরও সহজ হতো।
জ. মেধাস্বত্ব স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন : বুদ্ধিবৃত্তিক ও উদ্ভাবনী কাজে উৎসাহিত করতে মেধাস্বত্ব স্বীকৃতিকে সহজতর করা এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন বিশ্লেশকেরা। তাদের মতে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতের উদ্ভাবনী কাজের স্বীকৃতি না দিলে এবং পুঁজি বিনিয়োগকারীদের সাথে মুনাফা ভাগাভাগির বিষয়টি সুনির্ধারিত না হলে সম্ভাবনাময় প্রযুক্তিসেবা মুখ থুবড়ে পড়বে। এজন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি বোর্ড থাকা জরুরি। এ বোর্ডকে আইনী অধিকার ও স্বীকৃতি দেয়ার পাশাপাশি সেবার মান যাচাই করে আইএসও সনদ দেয়া নিশ্চিত করতে হবে। এতে করে সেবা রফতানির নতুন দুয়ার যেমন খুলবে, তেমনি ভোক্তা আস্থা নিশ্চিত করাও সহজতর হবে।
ঝ. স্বতন্ত্র বাজেট : তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়নে জাতীয় বাজেটে স্বতন্ত্র খাত উন্নয়নের বিষয়ে জোর দিয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হলে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করেন বেশিরভাগ প্রযুক্তিবিদ। তাদের মতে, সমৃদ্ধ দেশ গঠনে বাজেট বিন্যাস ও বরাদ্দ প্রকল্প বাসত্মবায়নের পথ সুগম করে। বাজেটে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারের পাশাপাশি উদ্যোক্তা প্রণোদনা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল তৈরি এবং প্রশিক্ষণ প্রকল্প থেকেই পণ্য ও সেবা উৎপাদনের মাধ্যমে বাজেটের বহুমুখী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
ঞ. উৎপাদন : আমদানি পণ্যের মধ্যে যেসব অংশ দেশেই উৎপাদন সম্ভব, তা তৈরি করতে সরকার ইপিজেডের আদলে দেশেই একটি উৎপাদন স্থান তৈরি করবে বলে প্রত্যাশা করেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞেরা। তারা মনে করেন, দেশে ব্যবহৃত কমপিউটার, ল্যাপটপ, সেলফোন, ট্যাব ইত্যাদির মতো প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনে স্থানীয় ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর মধ্যে সমন্বয় ঘটাতে ভূমিকা রাখবে। ট্যাক্স রিবেট, ঋণ প্রণদোনার মতো উদ্যোগ নিয়ে ট্রেডিং সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে ম্যানুফ্যাকচারের দিকে এগিয়ে যাবে। আর এটাই হবে প্রযুক্তিতে টেকসই উন্নয়ন যাত্রার বহির্প্রকাশ
ফিডব্যাক : netdut@gmail.com