আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাই। সে লক্ষে আমরা নানা কর্মসূচি নিই। প্রকল্প গ্রহণ করি। কিন্তু এসব কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে আমাদের থাকে সীমাহীন অবহেলা, থাকে নানা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা। ফলে দেশ-জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজটি গতি হারায়। কখনও পুরো কর্মসূচি বা প্রকল্পটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় কিংবা নানামুখী ক্ষতির মুখে পড়ে। দেশের ডিজিটাল ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মনে হয় তেমনটিই ঘটছে।
সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিক জানিয়েছে, ডিজিটাল ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে চলমান অবহেলা আর কারসাজির এক উদ্বেগজনক খবর। খবর মতে, জমি-জমা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষকেই নানা ধরনের জটিল সমস্যায় পড়তে হয়। এসব সমস্যা থেকে বাঁচার পথ এদের জানা নেই। এ থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে কয়েকশ’ বছরের পুরনো ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক তথা ডিজিটাল করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে কিছুই ঘটছে না। দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালায়নের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ সরকার নিলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখছে না। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এসব-বিষয়ক যাবতীয় প্রকল্প। এর পেছনে সরকারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলার পাশাপাশি যুগ যুগ ধরে জমির দলিলপত্র নিয়ে কারসাজি করে টাকা রোজগারের অসাধু চক্রগুলোর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ।
গত কয়েক বছরের বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালায়নের ওপর জোর দিয়ে অর্থ বরাদ্দ রেখেছেন বললেও তা খাতাপত্রেই রয়ে গেছে। এবারও বাজেট বক্তব্যে ভূমি ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন করতে ১৫২টি উপজেলার ‘ল্যান্ড জোনিং ম্যাপ’ সংবলিত প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী। আরও ৪০টি উপজেলায় তা প্রণয়নের কাজ চলছে বলে জানান। এছাড়া জামালপুর সদর উপজেলার তিনটি মৌজায় ডিজিটাল ভূমি জরিপ সম্পন্ন করা হয়েছে মূলত ভূমি মালিকানা সনদ চালু করার জন্য। বরগুনা জেলার আমতলী ও রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলায় একই কার্যক্রম চলছে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমির নকশা ও খতিয়ান তৈরির জন্য ঢাকা জেলার সাভার উপজেলার পাঁচটি মৌজায় একটি পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলার ৪৮টি মৌজায় একটি কার্যক্রম চলছে।
কিন্তু একটি জাতীয় দৈনিক এর নিজস্ব অনুসন্ধানসূত্রে জানতে পেরেছে- সাভার ও পলাশ উপজেলায় পাইলট প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলছে। প্রকল্প কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতি ও ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঘুষের বিনিময়ে সরকারি জমি ব্যক্তির নামে, আবার ব্যক্তির জমি সরকারের নামে রেকর্ড করার মতো গুরুতর অভিযোগ আছে। সাভারের রাজ ফুলবাড়িয়া গ্রামের অধিবাসী হাফিজুর রহমানের অভিযোগ, কয়েক বছর আগে ২০ হাজার টাকা দিয়ে তিন বিঘা জমির রেকর্ড করিয়েছেন। এখন আবার ডিজিটাল জরিপের জন্য জরিপ কর্মকর্তারা ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করছেন। নরসিংদীর পলাশে ২০০৯ সালে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নকশা ও খতিয়ান তৈরির কাজ শুরু হয়। কিন্তু অবহেলা ও দুর্নীতির কারণে ছয় বছরেও তা শেষ হয়নি। এভাবে নানা প্রকল্পে অবহেলা আর দুর্নীতি পাশাপাশি হাত ধরে চলছে। ফলে সরকারের ভূমি ব্যবস্থাপনা ডিজিটালায়নের কাজ বিলম্বিত হচ্ছে কিংবা বলা যায় মুখ থুবড়ে পড়েছে। অবসরপ্রাপ্ত সচিব এসএম জহিরুল ইসলাম ওই দৈনিকটিকে জানান, ‘দেশের ভূমি ব্যবস্থাপনা গোড়াতেই অব্যবস্থাপনায় ডুবে আছে। বিশেষ করে জমি জরিপ ঘিরে দুর্নীতির যে বীজ বপন করা হয়, তা দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে হয়। ঘুষের বিনিময়ে একজনের জমি আরেকজনের নামে রেকর্ড করার ফলে লাখ লাখ মামলার সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশ রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। এজন্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভূমি জরিপ পরিচালনা করতে পদক্ষেপ নেয়া হলেও নানা অজুহাতে সে পদক্ষেপ এখনও খাতাপত্রেই সীমাবদ্ধ। অধিদফতরের ভেতরে থাকা একটি শক্তিশালী চক্র চাইছে না তাদের কার্যক্রম ডিজিটায়িত হোক। কারণ, তাহলে তাদের দীর্ঘদিনের ঘুষ-দুর্নীতি তখন বন্ধ হয়ে যাবে।
আমরা মনে করি, ভূমি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা-ঘুষ-দুর্নীতি দূর করতে হলে এর সামগ্রিক কার্যক্রমকে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতায় আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তাই এই ডিজিটালায়নের পথে বিদ্যমান সব বাধা দূর করে এ সম্পর্কিত কর্মসূচি ও প্রকল্প বাস্তবায়নে গতি ফিরিয়ে আনতে হবে। যারাই এ কাজে বাধা সৃষ্টি করবে, তাদের কঠোর শাসিত্মর আওতায় আনতে হবে।