লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৬ - ফেব্রুয়ারী
লেখার ধরণ:
প্রযুক্তি ভাবনা
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি বিপ্লব
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব : ডিজিটাল
অনেকেই পড়ে থাকবেন খবরটি- দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকা গত ২৩ জানুয়ারি খুব গুরুত্ব দিয়ে এটি প্রকাশ করেছে। দেশের অন্য মিডিয়াতেও এর প্রভাব পড়েছে। এই খবরের ওপর ভিত্তি করে একটি মিডিয়া থেকে আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসে নানা প্রশ্ন তুলে ধরেছিল আমার সামনে। আমি ধারণা করি, যারা সচেতন তাদের অনেকেই এই খবরটি পড়ে নিজের মাঝেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছেন। কেউ কেউ হয়তো বন্ধু-বান্ধবকে প্রশ্ন করেছেন বা কেউ কেউ হয়তো গুগলে খুঁজেছেন এই খবরের পেছনের খবর পেতে।
আসুন, আগে খবরটির ভূমিকাটি পাঠ করি- ‘মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারাবিশ্বের গতিপথ। প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ডিজিটাল বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। এটিকে এখন বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।’
ডিজিটাল বিপ্লবকে কেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বলা হচ্ছে, সেটি নিয়ে আলোচনার জন্য সারাবিশ্বের রাজনৈতিক নেতা, বহুজাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী, উদ্যোক্তা, প্রযুক্তিবিদ ও বিশেস্নষকেরা জড়ো হয়েছিলেন সুইজারল্যান্ডের দাভোসে। সেখানে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। ডিজিটাল শিল্পবিপ্লবকে নিয়ে সেখানে হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা ও বিশেস্নষণ।
ইতোমধ্যেই ২০-২৩ জানুয়ারি সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। মূলত এই সম্মেলনের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। চারদিনের এই সম্মেলনে ব্যাপকভাবে বিষয়টি আলোচিত হয় এবং সম্মেলনে চমৎকার সব উপাত্ত প্রকাশিত হয়। http://www.weforum.org/events/world-economic-forum-annual-meeting-2016। খবরটি আমাকে কিছুটা অবাক করেছে। কারণ, দুনিয়ার এত বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী মানুষেরা এতদিন পরে ডিজিটাল বিপ্লবের বিষয়টি টের পেলেন, আর এটাকে আরও একটি শিল্পবিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করলেন কেন? মানবসভ্যতার ইতিহাস ব্যাখ্যা করতে এদের তো ভুল হওয়ার কথা নয়। এর আগে অ্যালভিন টফলারের মতো মানুষেরা মানবসভ্যতার বিকাশে কৃষিযুগের পর একটি শিল্পবিপ্লবের কথাই বলেছেন। তিনি ডিজিটাল বিপ্লবকে মানবসভ্যতার তৃতীয় বিপ্লব বলেছিলেন। তার হিসাবটি ছিল- মানুষ কৃষিবিপ্লব করেছে, এরপর শিল্পবিপ্লব করেছে এবং তৃতীয় বিপ্লবটিই হচ্ছে ডিজিটাল বিপ্লব। ১৯২৮ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কে জন্ম নেয়া অ্যালভিন টফলার তার ধারণা প্রকাশ করেছেন এভাবে- ‘‘First Wave is the society after agrarian revolution and replaced the first hunter-gatherer cultures. Second Wave is the society during the Industrial Revolution (ca. late 17th century through the mid-20th century). The main components of the Second Wave society are nuclear family, factory-type education system, and the corporation.
Toffler writes : “The Second Wave Society is industrial and based on mass production, mass distribution, mass consumption, mass education, mass media, mass recreation, mass entertainment, and weapons of mass destruction. You combine those things with standardization, centralization, concentration, and synchronization, and you wind up with a style of organization we call bureaucracy.” টফলারের এই বিবরণের কোনো তুলনা নেই। তিনি খুব সামান্য কথায় এত সুন্দরভাবে শিল্পবিপ্লব ও তার পরের সমাজ ও সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন যা মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। তিনি পরের বিপ্লবটাকেই তৃতীয় বিপ্লব বলেছেন। তার নিজের কাছে এই তৃতীয় বিপ্লবটি হচ্ছে তথ্য যুগ, মহাকাশ যুগ, ইলেকট্রনিক যুগ, গ্লোবাল ভিলেজ বা প্রযুক্তি যুগ। Third Wave is the post-industrial society. According to Toffler, since the late 1950s, most nations have been moving away from a Second Wave Society into what he would call a Third Wave Society, one based on actionable knowledge as a primary resource. His description of this (super-industrial society) dovetails into other writers' concepts (like the Information Age, Space Age, Electronic Era, Global Village, technetronic age, scientific-technological revolution), which to various degrees predicted demassification, diversity, knowledge-based production, and the acceleration of change (one of Toffler’s key maxims is "change is non-linear and can go backwards, forwards and sideways").
টফলার ডিজিটাল যুগটির পুরো চরিত্র ব্যাখ্যা করতে সক্ষম না হলেও অন্তত এটি বোঝাতে পেরেছেন যে, উৎপাদন ব্যবস্থা জ্ঞানভিত্তিক হবে।
তবে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নেতাদের ভাষ্য আমাকে হতাশ করেছে। তাদের মতামত অনুসারে শুধু বিদ্যুৎ একটি শিল্পবিপ্লব সংঘটিত করেছে বলে মনে করি না। বরং বাষ্পীয় ইঞ্জিন থেকে আজ পর্যন্ত মেকানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেই শিল্পবিপ্লব গড়ে উঠেছে। ইন্টারনেট একটি শিল্পবিপ্লব সংঘটিত করেছে নাকি একটি সভ্যতার জন্ম দিয়েছে, সেটিও আমাদেরকে স্থির করতে হবে। অন্যদিকে একটি শিল্প বিপ্লবকেই আবিষ্কারসমূহ আরও গতিশীল করেছে কি না, সেটি উপলব্ধি করার বিষয়। আমার নিজের কাছে বিস্ময়ের বিষয়, তারা কি টফলারের বইটিও পড়েননি?
প্রথম আলোর খবরে উল্লেখ ছিল- ‘‘ডব্লিউইএফের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে বলেছেন- ‘আমরা চাই বা না চাই, এতদিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এই বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনও হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া। ডিজিটাল বিপ্লব কী, সে বিষয়টিরও বিশদ একটি ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন ক্লাউস শোয়াব।’ স্মার্টফোনের মাধ্যমে সারাবিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পরিবর্তন, ইন্টারনেট অব থিংস, যন্ত্রপাতি পরিচালনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ, রোবটিকস, জৈবপ্রযুক্তি, কোয়ান্টাম কমপিউটিংয়ের মতো বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে বলে তিনি মনে করেন। ডিজিটাল বিপ্লবের এই শক্তির চিত্রটি বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন একদিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়।
ডিজিটাল বিপ্লব সম্পর্কে বহুজাতিক মোবাইল অপারেটর ডিজিসেলের চেয়ারম্যান ডেনিস ও ব্রায়েন বলেন, ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হিসেবে ডিজিটালাইজেশন আমাদের কাজের সব ক্ষেত্রে ইতোমধ্যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। তবে এই পরিবর্তনকে আমি দেখি সূচনা হিসেবে। আগামী ১০ বছরে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে আমরা এমন সব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, যা এর আগে ৫০ বছরে সম্ভব হয়নি।’ চতুর্থ এই শিল্পবিপ্লব সারাবিশ্বের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কী প্রভাব ফেলবে, সেটি নিয়ে দুই ধরনের মত পাওয়া যাচ্ছে। একদল বিশেষজ্ঞ বলছেন, এর ফলে সব মানুষেরই আয়ের পরিমাণ ও জীবনমান বাড়বে। বিশ্বের পণ্য সরবরাহ প্রক্রিয়াতেও ডিজিটাল প্রযুক্তি আনবে ব্যাপক পরিবর্তন। এক দেশ থেকে আরেক দেশে পণ্য পাঠানোর খরচ অনেক কমে আসবে। ইতিবাচক প্রভাব পড়বে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। তবে আরেক দল অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ডিজিটাল বিপ্লব বিশ্বের অসাম্য ও দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে আরও দুর্বিষহ পর্যায়ে নিয়ে যাবে। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ার ফলে মানুষের মাধ্যমে সম্পন্ন অনেক কাজ রোবট ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সম্পন্ন করা হবে। এর ফলে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে তা সমস্যা তৈরি করবে। এছাডা শ্রমবাজারে অল্প কর্মদক্ষ শ্রমিকদের চাহিদা ও বাজার কমে যাবে, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বেশি করে সমস্যায় ফেলবে। ডিজিটাল বিপ্লবের আরও একটি সমস্যা নিয়ে বেশ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এর ফলে সারাবিশ্বে সম্পদ বৈষম্য আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাড়বে বলে অনেকের আশঙ্কা। ডিজিটাল প্রযুক্তির আবিষ্কারক, বিনিয়োগকারী দেশগুলো এর থেকে যতটা লাভবান হবে, অন্য দেশগুলো সেটা থেকে বঞ্চিত হবে। বিষয়টিকে জয়ী পক্ষের সব ছিনিয়ে নেয়ার সাথে তুলনা করা হয়েছে। ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল বিপ্লবের প্রভাব হবে ব্যাপক। ব্যতিক্রমী পণ্যসেবার পাশাপাশি নিয়ত পরিবর্তনশীল গ্রাহক চাহিদা পূরণে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্বোচ্চ দক্ষতা অর্জন করতে হবে। সরকার পরিচালনা ও নীতিনির্ধারণেও ডিজিটাল বিপ্লব আনবে বড় পরিবর্তন। প্রযুক্তি বিপ্লব সরকারি সেবাকে একদিকে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে নিয়ে আসবে, অন্যদিকে বিধ্বংসী মারণাস্ত্রের সহজলভ্যতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ঝুঁকিও বাড়াবে। নিরাপত্তা ঝুঁকির এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবই যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা করবে, সেই আশঙ্কাও করছেন বিশেস্নষকেরা।’’
অর্থনীতি ফোরামের নেতারা নিজেদেরকে অনেক প--ত বিবেচনা করে এসব নিয়ে এতদিনে আলোচনা করলেও দুনিয়ার বহু মানুষ এই সময়টিকে ডিজিটাল সভ্যতার সময় হিসেবে অনেক আগেই চিহ্নিত করেছেন। খোদ জাতিসংঘ একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের কথাও বলেছে। সম্মেলন-কর্মসূচি প্রতিদিনই ডিজিটাল বিপ্লবকে ঘিরেই প্রণীত হচ্ছে। আমি অবাক হই, তারা এতদিন ঘুমিয়ে ছিলেন কেন? তারা কি গুগলের প্রধান নির্বাহী এরিক স্মিথ এবং পরিচালক জারড কোহেনের দি নিউ ডিজিটাল এজ বইটিও পড়েননি? তারা কি এটিও জানেন না, বাংলাদেশের মতো একটি দেশ ২০০৮ সালে ডিজিটাল রূপান্তরের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে? আমাদের অবশ্যই জানতে হবে, তারা শেষাবধি ডিজিটাল বিপ্লবকে কেমনভাবে আলিঙ্গন করার কথা ভাবছেন।
অর্থনীতি ফোরামের সম্মেলনের পর তাদের ওয়েবসাইট থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা গেছে, তার মধ্য থেকে কিছু মন্তব্য আমাদের চোখে পড়েছে। সাইটে আটটি বিশেষ মন্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে। সেগুলো বস্ত্তত বিশ্বের ডিজিটাল রূপান্তরকেই প্রকাশ করে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ও প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস শোয়াব মন্তব্য করেছেন, “We must develop a comprehensive and globally shared view of how technology is affecting our lives and reshaping our economic, social, cultural, and human environments. There has never been a time of greater promise, or greater peril.” আমি ধারণা করি, এই মন্তব্য আমাদেরকে সারা দুনিয়ার ডিজিটাল রূপান্তর সম্পর্ক একটি সাধারণ ধারণা পেতে সহায়তা করবে। শোয়াব সারা দুনিয়ার জন্য সুস্পষ্ট ও বিশ্বব্যাপী বিসত্মৃত ধারণা তৈরি করার জন্য অনুরোধ করেছেন, যাতে সবাই বুঝতে পারে প্রযুক্তি কেমন করে মানুষের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি ও মানবিক পরিবেশকে বদলাচ্ছে। তিনি মনে করেন, এমন সুযোগ বা চ্যালেঞ্জ এর আগে আর কখনও আসেনি।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সণায়ুবিজ্ঞান গবেষক দিলীপ জর্জ মন্তব্য করেছেন, “Imagine a robot capable of treating Ebola patients or cleaning up nuclear waste.” দিলীপ সবাইকে ভাবতে বলেছেন, এমনও হতে পারে রোবট ইবোলা ভাইরাসের রোগীদের চিকিৎসা করবে ও পারমাণবিক বর্জ্য পরিষ্কার করবে।
একটি অসাধারণ তথ্য দিয়েছেন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এনরিক পেনা নিয়েটো। তিনি জানিয়েছেন, মেক্সিকো হচ্ছে দুনিয়ার প্রথম দেশ, যে দেশ ব্রডব্যান্ড প্রাপ্তিকে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার বলে সংবিধানে স্বীকৃতি দিয়েছে।
“Mexico is one of the only nations whose constitution recognizes the right of its people to a broadband internet connection.”
এটি নিঃসন্দেহে একটি অসাধারণ অর্জন। দুনিয়াবাসী অন্তত একটি দৃষ্টান্ত পেয়েছে যে- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সাথে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে থাকতে পারে। অন্যদিকে কিছু হতাশার চিত্রও আছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশ যে সমভাবে হয়নি, সেই কথাও বলা হয়েছে। লয়েডসের প্রধান নির্বাহী ইনগা বিয়েল মনে করেন, দুনিয়ার বহু মানুষের স্মার্টফোনটাই একমাত্র কমপিউটার। “For many people, the smartphone is the first and only computer they have.”
ডেলয়েট কনসাল্টিংয়ের সিনিয়র গ্রাহক পরামর্শক গ্যারি কোলম্যান মনে করেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখনও অাঁতুর ঘরে আছে। তবে ব্যবসায় ও সমাজে দ্রুত পরিবর্তন এবং প্রভাবের জন্য এতে যোগ দেয়ার এখনই সময়। “The Fourth Industrial Revolution is still in its nascent state. But with the swift pace of change and disruption to business and society, the time to join in is now.”
কুদেলস্কি গ্রুপের প্রধান নির্বাহী আন্দ্রে কুদেলস্কি বলেন, একজন দক্ষ প্রকৌশলী যেকোনো সংযুক্ত যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে। সমাজ এই সক্ষমতার প্রভাব এখনও অনুভব করতে পারেনি। “Any skilled engineer can take control remotely of any connected 'thing'. Society has not yet realized the incredible scenarios this capability creates.”
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক নোবেল বিজয়ী রবার্ট জে শিলার বলেন, আপনি আগুনের বীমা করার জন্য ঘর পোড়া অবধি অপেক্ষা করতে পারেন না। আমরা সমাজে চরম অস্থিতিশীলতার জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। “You cannot wait until a house burns down to buy fire insurance on it. We cannot wait until there are massive dislocations in our society to prepare for the Fourth Industrial Revolution.”
নরওয়ের নাগরিক বিশ্ব রোয়িংয়ের চ্যাম্পিয়ন রবার্ট বারগিট কারস্টেইন বলেন, বিশ্বের চতুর্থ শিল্পবিপ্লব প্রতিবন্দ্বীদের জন্য সুপার পাওয়ার দেবে। “For people with a disability, the Fourth Industrial Revolution will give us super powers.”
একসেনটিওরের প্রধান নির্বাহী পিয়েরে নানটার্ম বলেন, শুধু ডিজিটাল রূপান্তরের কারণে ২০০০ সালের পর ফরচুন ৫০০ কোম্পানির অর্ধেক হারিয়ে গেছে। “Digital is the main reason just over half of the companies on the Fortune 500 have disappeared since the year 2000.”
অপ্রিয় হলেও সত্য, বাংলাদেশ বর্ণিত ও কথিত তিনটি শিল্পবিপ্লবের কোনোটিতেই যথাসময়ে অংশ নিতে পারেনি। এই সেদিনও আমরা কৃষিনির্ভর একটি দেশ ছিলাম। কৃষিযুগের সব লক্ষ্মণ আমাদের সমাজে, অর্থনীতিতে, রাজনীতিতে তথা জীবনধারায় স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল। ১৯৬৪ সালে আমরা কমপিউটারের যুগে পা দিলেও এর প্রয়োগ ছিল খুবই সীমিত। ব্রিটিশ-পাকিস্তান তাদের ঔপনিবেশিক শাসনে কখনও আমাদেরকে শিল্পযুগের উপযুক্ত হওয়ার সুযোগ দেয়নি। বাংলাদেশের রূপান্তরের সময়টি শুরুই হয়েছে ১৯৭২ সালে। তার মাঝেও ’৭৫ থেকে ’৯১ সময়কালের সামরিক শাসন দেশটির সামনে চলার পথকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ’৯১-পরবর্তী সরকারও দেশের আর্থ-সামাজিক রূপান্তর বিষয়ে দূরদৃষ্টি নিয়ে তেমন কিছু ভাবতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ডিজিটাল রূপান্তরটি নিয়ে পদক্ষেপ নিতে থাকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০০১ থেকে ২০০৮ সময়কালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা বজায় না থাকায় ২০০৯ থেকে দেশটির সামনে যাওয়ার পথটা আবার সুগম হয়। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা করে এই অঞ্চলই নয়, সারা দুনিয়াকে প্রথম একটি ডিজিটাল সভ্যতা গড়ে ওঠার আভাস দেন। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র, কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশের এই ঘোষণা শুধু দূরদৃষ্টিসম্পন্নই ছিল না, এটি ছিল দুনিয়াকে চোখে আঙুল দিয়ে একটি নতুন সভ্যতার জন্যকে দেখিয়ে দেয়া। সবাই জানেন, বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও ভারত ডিজিটাল রূপান্তরের কর্মসূচি ঘোষণা করে। আমার নিজের কথা যদি বলি, তবে ডিজিটাল রূপান্তরের চর্চাটি শুরু করি ১৯৮৭ সালে। গণনা যন্ত্র দিয়ে মুদ্রণ ও প্রকাশনাকে বদলে দিয়ে শিক্ষাকে ডিজিটাল করার সরাসরি উদ্যোগ গ্রহণ করি ১৯৯৯ সালে। ডিজিটাল সভ্যতার রূপরেখা প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ-এপ্রিল মাসে নানা মিডিয়াতে। তবে বড় সফলতা অর্জন করতে পারি শব্দটিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করতে পেরে। যেহেতু শেখ হাসিনা সেই ঘোষণার পর সরকার গঠন করেন এবং নতুন প্রজন্ম অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে শেখ হাসিনার ঘোষণাকে স্বাগত জানায়, সেহেতু ডিজিটাল বাংলাদেশের চাকা সামনে যেতেই থাকে। হতে পারে, আমরা যে গতিতে যেসব খাতে যে ধরনের পরিবর্তন চেয়েছিলাম, সেইসব পরিবর্তন আমরা করতে পারিনি। তবে এটি মানতেই হবে, ঘোষণার পর সাত বছর ধরে বাংলাদেশ তার প্রচলিত কৃষিভিত্তিক সমাজকে ডিজিটাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।
পুরো কাজটিতেই আমাদের অনেক ত্রম্নটি-বিচ্যুতি আছে। একটি ঔপনিবেশিক কাঠামোর আমলাতন্ত্র, কৃষি সমাজের রাজনীতি ও পুঁজিবাদী ধারার গতানুগতিক অর্থনীতির চাপে পড়ে আমরা আমাদের কাঙিক্ষত ফল পাচ্ছি না। জনগণের মাঝে সচেতনতার অভাব এবং প্রথম শিল্পবিপ্লবের শিক্ষাব্যবস্থার ফলে সামনে যাওয়াটা ক্রমাগতই থমকে যায়।
যদিও আমাদের প্রধানমন্ত্রী জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছেন এবং অর্থনীতিকে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের কথা বলা হচ্ছে। তবুও কায়িক শ্রমকে মেধাশ্রম ও এনালগ শিল্পকে মেধাশিল্পে রূপান্তরের চেষ্টা খুব ক্ষীণ। অনেক সময়েই অপ্রয়োজনে প্রকল্প গ্রহণ ও সেগুলো বাস্তবায়নের ঘটনাও ঘটছে। কখনও কখনও হুজুগ তোলা হচ্ছে এবং তাতে নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্তও হচ্ছে। অন্যদিকে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসারের পাশাপাশি ডিজিটাল অপরাধও বাড়ছে। ঔপনিবেশিক আইনের আইনগুলো এসব অপরাদের জন্য উপযোগী নয়। ফলে নতুন আইন করতে হচ্ছে। মিডিয়ার রূপান্তরের জন্য নতুন আইন ও নতুন নীতিমালা করতে হচ্ছে।
তবে এটি গর্ব করার মতো, সারা দুনিয়া যখন ডিজিটাল বিপ্লবের কথা বলছে, তখন আমরা সেটি থেকে বিচ্ছিন্ন নই। আমাদের প্রচুর চ্যালেঞ্জ রয়েছে এই রূপান্তরে। বিশেষ করে আমরা যদি আমাদের মানবসম্পদকে ডিজিটাল যুগের উপযোগী করে গড়ে তুলতে না পারি, তবে আমাদের অবস্থান দুনিয়ার তলানিতে থাকবে। তবে আমাদের সুযোগটা হচ্ছে আমাদের জনসংখ্যা নবীন এবং তারা আমাদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা দেবে। আমরা যেহেতু এখন আর পশ্চাৎপদ থাকতে চাই না, সেহেতু আমাদের সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। আমি নিজে মনে করি, মেধাসম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারলে আমরা দুনিয়াতে পিছিয়ে পড়তে পারি না। অন্যদিকে আমাদেরকে অনুভব করতে হবে, ব্যক্তিগত বৈষম্য থেকে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বৈষম্যের ধারাটিও কার্ল মার্কসের সংজ্ঞায় থাকবে না। রাষ্ট্রের সীমানা, সংজ্ঞা বা অসিত্মত্ব ডিজিটাল যুগে ভিন্নতর হবে- এটি মাথায় রেখে এখনই সেই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কৌশল নির্ধারণ করতে পারি। আমি আমার নিজের মতো করে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার কৌশলগুলোর বিবরণ খুব সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
আমি মনে করি, ডিজিটাল বিপ্লবে বা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে শামিল থাকতে হলে আমাদের প্রধান কৌশল হলো তিনটি। এই কৌশলগুলো মানবসম্পদ উন্নয়ন, সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর এবং একটি ডিজিটাল জীবনধারা গড়ে তোলা ও বাংলাদেশকে জন্মের প্রতিজ্ঞায় গড়ে তোলাবিষয়ক।
অ. ডিজিটাল রূপান্তর ও মানবসম্পদ। আ. ডিজিটাল সরকার। ই. ডিজিটাল জীবনধারা ও জন্মের ঠিকানায় রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা।
প্রথম কৌশলটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টি নিয়ে। আমরা এজন্য শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। দ্বিতীয় কৌশলটি সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর বা একটি ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠাবিষয়ক। তৃতীয় কৌশলটি মূলত একটি ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন। একই সাথে একটি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে একটি ভাষাভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন। এই কৌশলটির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দেশের শিল্প-কলকারখানা ও অর্থনীতির রূপটাকে ডিজিটাল করা বা সামগ্রিকভাবে একটি ডিজিটাল অর্থনীতিও গড়ে তোলা।
আমি বিশ্বাস করি, অতীতের মতো বিপ্লব থেকে দূরে থাকার ভুলটা আমরা আর করব না।
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com