লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
ই-কমার্সে বাংলাদেশ বাজারের কিছু বৈশিষ্ট্য
বাজার গবেষণা হচ্ছে বাজার থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা, যাতে ব্যবস্থাপক বাজার সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বিদেশে রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের জন্য শত শত কোটি ডলার খরচ করে নতুন বাজারে প্রবেশ করা হয়। নতুন পণ্য বা সেবা বাজারে নিয়ে আসা হয়। এর ফলও হয় অনুমিত। মানে গবেষণা করে নামা ব্যবসায়ের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আশাতীত ব্যবসায় করে। তবে আমাদের দেশে বাজার গবেষণার জন্য অর্থ ব্যয় করতে তেমন শোনা যায় না। কিন্তু বাজার গবেষণা ভালোভাবে না করে ব্যবসায় শুরু করে দিলে সফল হওয়ার সম্ভাবনা যে খুবই কম, তা বলাই বাহুল্য। কেননা, আপনি জানেন না- যে পণ্য বা সেবা নিয়ে বাজারে আসতে চাচ্ছেন, তার বর্তমান বাজারটি কত টাকার, এর ভবিষ্যৎই বা কী, এর ক্রেতা কারা, ক্রেতারা আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছ থেকে না নিয়ে আপনার কাছ থেকে কেন নেবে, নতুন কোনো বাজার আছে কি না, বাজারের গতিধারা কী- এসব না জেনে ব্যবসায় নামার পরিণতি হবে অর্থ বা সময় দুটোরই অপচয় মাত্র। অথচ বাজার গবেষণার মাধ্যমে এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাবেন, যার কিছু নিমণরূপ :
* বিদ্যমান ক্রেতাদের প্রয়োজন বোঝা এবং কেনো তারা আপনার পণ্য বা সেবা পছন্দ করবে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীর পণ্য/সেবা রেখে।
* নতুন বাজার সুযোগ চিহ্নিত করা এবং মার্কেট ট্রেন্ড অনুধাবন করা।
* বাজার সম্প্রসারণের নতুন ক্ষেত্র এবং ক্রেতাভিত্তি বাড়ানো।
* সম্ভাব্য ক্রেতাদের এবং তাদের প্রয়োজন খুঁজে বের করা, যা আপনার পণ্য বা সেবার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
* ব্যবসায় প্রবৃদ্ধি, বিক্রি এবং নতুন পণ্য বা সেবা তৈরি করতে অর্জনযোগ্য লক্ষ্য নির্ধারণ করা।
* পণ্যের সঠিক দাম ঠিক করা।
* কত লোক পণ্যটি কিনতে পারবে তার ধারণা পেতে।
* কোন জায়গা থেকে ক্রেতারা কেনেন জানতে, তা প্রতিযোগীদের সম্পর্কে তথ্য জানতে। প্রমোশন কৌশল, যা সবচেয়ে উপযোগী।
* আপনার ব্যবসায়ের সমস্যার জায়গাটি চিহ্নিত করতে হবে।
বাংলাদেশে ই-কমার্সের বাজারের ওপর এখন পর্যন্ত তেমন কোনো গবেষণা বা জরিপ চালানো হয়নি। ই-কমার্স নয়, শুধু কমার্স বা ঐতিহ্যগত বাণিজ্যের ওপরও আমাদের তেমন কোনো গবেষণাকর্ম বা জরিপ নেই। তারপরও নতুন যেকোনো ব্যবসায় বিশেষ করে ই-কমার্স ব্যবসায় নামার আগে অবশ্যই বাজার সম্পর্কে সঠিক ও বাস্তব ধারণা নিয়ে নামা উচিত। সে ক্ষেত্রে বাজার সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য নেয়া যেতে পারে অনলাইন বা অফলাইন বিভিন্ন জরিপ বা গবেষণাকর্মের। এর সাথে আপনার নিজস্ব উদ্যোগে বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কেও ধারণা নিতে হবে। এ লেখায় আমরা বাংলাদেশের সামগ্রিক বাজার সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা নেব, যা ই-কমার্স ব্যবসায় শুরু করতে আমাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবে। ইউরোমনিটর ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রখ্যাত জরিপ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ২০ বাজারের একটি বলে মন্তব্য করেছে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে এই দেশটির রয়েছে সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি এবং যা দেশটিকে পরিণত করেছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দেশগুলোর একটিতে। কিন্তু এখানে বাজারতথ্য খুবই সীমিত ও ব্যবসায় পরিবেশ বেশ জটিল। বাংলাদেশে ৫০-এর ওপর ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর ভোক্তা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের বাজারের উল্লেখযোগ্য কিছু বৈশিষ্ট্য নিচে দেয়া হলো-
-অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈচিত্রতা ভোগ বাড়াতে ভূমিকা রাখছে।
-২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেখা গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বেশ শক্ত অবস্থানে ছিল। এ সময়টাতে দেশের গড় জিডিপি বাড়ার হার ছিল ৬ শতাংশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এ হার এখনও উন্নতির দিকেই আছে। আশা করা যাচ্ছে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে জিডিপির হার ৭ শতাংশ হয়ে যাবে। তৈরী পোশাক খাতকে বলা হয়ে থাকে দেশের অর্থনীতির মেরুদ-। যদিও এখন কর্তৃপক্ষ চাচ্ছে অর্থনীতির এ ধারা পরিবর্তন হোক এবং সেজন্য ইলেকট্রনিক, ফ্রোজেন ফুড, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং এবং শক্তি উৎপাদন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো হচ্ছে।
-২০২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জনসংখ্যা পৌঁছে যাবে ১৮ কোটিতে। ২০১৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৫ কোটি ৭০ লাখ, যা দেশের মোট ভূমির তুলনায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর অন্যতম। মাত্র ৩০ শতাংশ জনসংখ্যা সে সময় পর্যন্ত শহরাঞ্চলে বসবাস করত। ক্রমবর্ধমান তৈরী পোশাক খাত এবং চাকরির সুযোগ অনেক লোককে এখন শহরে বাস করতে উৎসাহিত করছে।
আধুনিক খুচরা বিক্রির হার বাড়া
খুচরা ব্যবসায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত ব্যবসায়, তবে আধুনিক খুচরা (আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে যে খুচরা বিক্রি) বিক্রির হার মোট বিক্রির মাত্র ১০ শতাংশ। তবে এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। গবেষণা কাজ চলাকালের হিসেবে দেখা গেছে, প্রতিবছর ১৫ শতাংশ হারে আধুনিক খুচরা বিক্রি বাড়ছে। আশা করা যাচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে আধুনিক মাধ্যম ব্যবহার করে বিক্রির পরিমাণ বর্তমানের চারগুণ হয়ে যাবে। অর্থের মানদ-- যার পরিমাণ ৩৭ বিলিয়ন ডলার। সব ধরনের ভোক্তা শ্রেণী বেড়ে চলায় ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত সময়ে দেখা গেছে- বাংলাদেশে ভোক্তা শ্রেণীগুলো বেশ ভালোভাবে তাদের কাজ সম্পাদন করছে। এ হার সামনের দিনগুলোতে বজায় থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পণ্যের মানের ওপর বেশি নজর দিচ্ছে
ভোগ্যপণ্যের বেলায় দেশী পণ্যগুলো বিদেশী পণ্যের সাথে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। অনেক ক্ষেত্রেই কম মূল্যের কারণে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের সাথে পেরে উঠছে না। তাই বিদেশী কোম্পানিগুলো টার্গেট করছে শহরাঞ্চলের মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে। এর বাইরে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের ভোক্তাদেরকে এই বার্তা দিতে চাচ্ছে, বিদেশী ব্র্যান্ডগুলো সবচেয়ে গুণগত মানের হয়ে থাকে।
ব্যবসায় পরিবেশ উন্নতিকল্পে অবকাঠামোগত বাধা দূরীকরণ
ব্যবসায় করার জন্য বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে আকর্ষণীয় দেশগুলোর একটি। কিন্তু খুবই নাজুক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ হচ্ছে ব্যবসায়ের প্রধানতম সমস্যাগুলোর অন্যতম। আশা করা যাচ্ছে, আসছে বছরগুলোতে অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। সরকার পরিবহন খাতে উন্নতি আনতে বাইপাস, ফ্লাইওভার, সেতু, মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং গণপরিবহন খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। এর বাইরে বাংলাদেশের আছে সুগঠিত একটি রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা আর আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় আমত্মঃদেশীয় জল যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা সড়কপথে যোগাযোগের ভালো বিকল্প হতে পারে। নতুন পাবলিক এবং প্রাইভেট বিদ্যুৎ কারখানা স্থাপনের মাধ্যমে ২০১৬ সালের মধ্যেই বিদ্যুৎ সমস্যারও সমাধান আশা করা যাচ্ছে।
উপরের আলোচনায় বাংলাদেশের সামগ্রিক বাজারের একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়া গেছে, যা থেকে আমরা বাজারের একটি ধারণা পেতে পারি। এখন আপনি যে পণ্য বা সেবা নিয়ে ব্যবসায় করতে আগ্রহী, তাই নিয়ে আপনাকে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, যাতে আপনি সুনির্দিষ্ট পণ্য বা সেবার বাজার, ভোক্তা, চাহিদা, ভবিষ্যৎ ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। খুঁটিনাটি সব তথ্য নিয়ে বাজারে প্রবেশ করলে তখন বাজারে অবস্থান হবে লাভজনক। অন্যথা না জেনে-শুনে হুট করে বাজারে প্রবেশ করলে আবার হুট করেই বাজার থেকে বের হয়ে আসতে বাধ্য হতে হবে