লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
ডিজিটাল বাংলাদেশ ও কমপিউটার জগৎ
সভাপতি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)
আমরা সবাই জানি, ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেদিন মাত্র একটি বাক্য উচ্চারণ করে তিনি দেশের স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়মত্মীর স্বপ্নটা পুরো জাতির সামনে তুলে ধরতে পেরেছিলেন। আমরা অনেকেই তাই ১২ ডিসেম্বরকেই ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনা বলে মনে করি। কিন্তু অনেকেই এই খবরটি রাখেননি যে, ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ হলেও এর ভিত রচনা হয়েছে অনেক আগে। জননেত্রী শেখ হাসিনা নিজেই সেই ভিত রচনা করেন। তিনি যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন তখনই সেই ভিত রচনা করেন। স্মরণ করুন ’৯৬ সালে অনলাইন ইন্টারনেট চালু, ’৯৭ সালে মোবাইলের মনোপলি ভাঙ্গা ও ’৯৮ সালে কমপিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করার কথা। ২০০১ সালে তিনি ক্ষমতায় না আসায় ২০০৮ অবধি তার সেই স্বপ্ন অন্ধকূপেই ছিল। ২০০৮ সালে তিনি তার সেই স্বপ্নটাকে ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে আখ্যায়িত করেন। আজ বাংলাদেশ তার ঘোষিত সেই পথ ধরেই চলছে। সেদিন যেটি ঘোষণা ছিল, ছিল স্বপ্ন; সেটি এখন বাস্তবতা। তবে আমরা অনেকেই জানি না, ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণার আগেই এই নামেই এর তাত্ত্বিক আলোচনা শুরু হয়েছিল। স্মরণ করতে পারি বগুড়ার দৈনিক করতোয়ায় ২৬ মার্চ ২০০৭ সালে এই প্রসঙ্গটি নিয়ে আমি প্রথম আলোচনা করি। তবে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপিত হয় মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর এপ্রিল ২০০৭ সংখ্যায়। বিস্তারিত জানতে আগ্রহীরা সে সংখ্যায় আমার লেখা ‘স্বাধীনতার সুর্বণজয়মত্মীতে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মর্সূচি’ শীর্ষক লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে আমি ডিজিটাল বাংলাদেশের বিস্তারিত রূপরেখা তুলে ধরি। সে লেখার বিস্তারিতে যাওয়ার অবকাশ এখানে একেবারেই নেই। তবে আসুন একটু পেছনে ফিরে দেখি সেই আলোচনায় কী ছিল তারই অংশবিশেষ।
‘সার্বিকভাবে এই মুহূর্তে প্রয়োজন বাংলাদেশের জন্য একুশ শতকের এমন এক কর্মসূচি, যার সহায়তায় এই দেশটি তার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়মত্মীতে দুনিয়াকে দেখানোর মতো একটি অবস্থায় থাকতে পারে। আমরা মনে করি, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই হবে আজকের দিনের অঙ্গীকার। এজন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচিই হতে পারে লক্ষ্য অর্জনের একমাত্র উপায়।’
উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের বিদ্যমান সমাজকে আরও উন্নত, সমৃদ্ধ ও দারিদ্র্যমুক্ত করে এখানে ন্যায়বিচার এবং সম্পদের সুষম বণ্টন ও মানুষের ন্যূনতম মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা বিধান করে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিমনস্ক, আত্মবিশ^াসী ও সফল ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। এই সমাজে জ্ঞানই হবে সব শক্তির ভিত্তি।
ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি : জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচি নিয়ে তাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। একে একটি সামাজিক আন্দোলন হিসেবে বিকশিত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে নিতে হবে। সরকারকে দেশের সব মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দেশটিকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সরকারের প্রচলিত পদ্ধতির বদলে ডিজিটাল সরকার স্থাপন করতে হবে। ডিজিটাল সরকার বলতে সরকারের সব তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ, সরাসরি ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন রিয়েলটাইম যোগাযোগ এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারের সব কাজ করাকে বোঝায়। এজন্য সরকারের থাকবে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ ও ন্যাশনওয়াইড নেটওয়ার্ক। সরকারের সব তথ্য থাকবে কেন্দ্রীয়/বিকেন্দ্রীকৃত ডাটাবেজে। কেন্দ্রীয়/স্থানীয় ডাটাবেজটির সব তথ্য স্তরভিত্তিক বিন্যস্ত হবে। যার যেসব তথ্য নিয়ে কাজ, সে সেসব তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াজাতকরণ বা ব্যবহার করতে পারবে। সরকারের সব অফিস, বিভাগ, মন্ত্রণালয়, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের সব স্তর এই নেটওয়ার্কে সরাসরি অনলাইনভাবে যুক্ত থাকবে। এমনকি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের হিসাব পর্যন্ত এই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকবে। সরকারের সংশিস্নষ্ট বিভাগ যেমন- আয়কর-দুর্নীতি দমন কমিশন সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে নাগরিকদের প্রাইভেসি বজায় রাখতে হবে।
এখন থেকে দুটি পর্যায়ে বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন হবে। প্রথম পর্যায়ে ডিজিটাল পদ্ধতির পাশাপাশি কাগজের ব্যাকআপ থাকবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করার পর কাগজের ব্যাকআপ ফাইল তৈরি করে রাখা হবে। এই পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য বিদ্যমান সরকারি কর্মচারীদের সরকার নিজ খরচে প্রশিক্ষণ দেবে। যারা প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী হবে না বা প্রশিক্ষণ নেয়ার পরও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না, তারা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অবসরে যাবেন এবং সে স্থানে নতুন কর্মীবাহিনী কাজে যোগ দেবে। সরকারের নতুন রিক্রুটমেন্ট হবে ডিজিটাল সরকার চালনায় সক্ষম ব্যক্তিদের মধ্য থেকে। সরকারের সব অগোপনীয় তথ্য সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে ও ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনগণ সরকারের যেকোনো স্তর পর্যন্ত যোগাযোগ বা আবেদন করতে পারবে এবং আবেদনের ফলাফল জানতে পারবে।
প্রতিটি মানুষের জন্য মাধ্যমিক মানের উপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করবে। বিদ্যমান অবকাঠামোর উন্নয়ন করে তথ্যপ্রযুক্তির ল্যাব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভা-ার তৈরি করে তার সাথে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কমদামী ডিজিটাল যন্ত্র দিয়ে যুক্ত করতে হবে। এই যন্ত্রকে অবলম্বন করে শিক্ষার্থীর বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ বা অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। কার্যত এই যন্ত্রটিই হবে শিক্ষার কেন্দ্র। এটি পাঠ্যপুস্তক, মূল্যায়ন যন্ত্র, পাঠাগার বা খেলার সামগ্রী সবকিছুই হবে। ছাত্র-শিক্ষকেরা এর সহায়তাতেই নতুন ডিজিটাল শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এরা পাঠ্যপুস্তককে সফটওয়্যার হিসেবে পাবে। বাড়িতে, স্কুলে, ক্লাসরুমে যেখানেই সে থাকুক পাঠাগার তার হাতের মুঠোয় থাকবে। শিক্ষকের সাথে তার যোগাযোগ ক্লাসরুমের বাইরে বিসত্মৃত হবে, হবে সর্বক্ষণিক।
ছাত্রছাত্রীদের হাতে ডিজিটাল যন্ত্র দেয়ার ফলে দেশের সার্বিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। ছাত্রছাত্রীরা অগ্রসেনানী হিসেবে কাজ করবে এবং তাদের অভিভাবকদের জন্যও নতুন জ্ঞানভা-ার খুলে দেবে। ছাত্রছাত্রীদের ল্যাপটপ থেকেই অভিভাবকদের ডিজিটাল যাত্রা শুরু হবে। তার প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাওয়ার পাশাপাশি এটি পরিবারের যোগাযোগযন্ত্রে পরিণত হবে। শিক্ষাদান পদ্ধতিতে নতুন এই উপকরণ ব্যবহার করার ফলে মূল্যায়ন ব্যবস্থারও পরিবর্তন হবে। শিক্ষার সর্বনিমণ স্তর থেকে ডিজিটাল প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের জন্য সামরিক, আধাসামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্যপ্রযুক্তিসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও অস্ত্র দিয়ে সজ্জিত করতে হবে। দেশের সীমারেখা, ধনসম্পদসহ সব কিছুর পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিরাপত্তা বিধান করা। রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক কোনো ধরনের সন্ত্রাস, হুমকি, চাঁদাবাজি, অ্যাসিড নিক্ষেপ, নির্যাতন বা রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হবে না। রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রে প্রয়োজনে বায়োমেট্রিক্স নিরাপত্তা বিধান করবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা করবে। একই সাথে রাষ্ট্র ব্যক্তির গোপনীয়তা বজায় রাখার নিশ্চয়তা দেবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশের সাথে সমন্বয় করে দেশের প্রচলিত আইনসমূহ পরিবর্তন করা হবে এবং নতুন আইনসমূহ জ্ঞানভিত্তিক সমাজের কথা চিমত্মা করেই প্রণীত হবে। পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষেতে সৃষ্ট নতুন ধরনের অপরাধ, সাইবার অপরাধ, সাইবার কমিউনিকেশন, নিউ মিডিয়া, মেধাসম্পদ ইত্যাদি বিষয়কে পর্যালোচনা করে অপরাধ সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধিসহ অন্যান্য আইন পরিবর্তন করা হবে। অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য নতুন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হবে। প্রয়োজনমতো বায়োমেট্রিক্স, জিন পরীক্ষা, অপরাধীর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, অপরাধীর ডাটাবেজ তৈরি করা ছাড়াও বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা হবে। আইনসমূহ অনলাইনে পাওয়ার পাশাপাশি, ডিএলআর অনলাইনে প্রাপ্য হবে। বিচারপ্রার্থী অনলাইনে বিচার প্রার্থনা করার পাশাপাশি তার মামলা কোথায় কী অবস্থায় আছে, তা অনলাইনে জানতে পারবেন। আইনজীবী অনলাইনে তার বক্তব্য পেশ করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের সহায়তায় বাদী-বিবাদীর বক্তব্য বা সাক্ষ্য নেয়া যাবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরির জন্য একটি নতুন অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। এর নাম হবে নিউ ইকোনমি বা নলেজ ইকোনমি বা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি। এটি বিদ্যমান অর্থনীতিকে প্রতিস্থাপিত করবে। অর্থনীতির চরিত্র হবে মিশ্র। এটি পুরোপুরি পুঁজিবাদী হবে না, আবার পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত হবে না। অর্থনীতি প্রতিযোগিতার সৃষ্টি করলেও প্রয়োজনে সরকার অর্থনীতির ক্ষেত্রবিশেষে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানা থাকবে, তবে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানকে অবশ্যই জনগণের অংশীদারিত্বের মধ্য দিয়ে বিকশিত হতে হবে। ৫ কোটি টাকা বা তার বেশি মূলধনের কোম্পানিকে অবশ্যই পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হতে হবে এবং শেয়ারবাজারে শেয়ার ছেড়ে জবাবদিহিমূলকভাবে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, পরিবার বা প্রতিষ্ঠান এককভাবে কোনো কোম্পানির শতকরা ৫ ভাগের বেশি শেয়ারের মালিক হতে পারবে না। সরকার বেসরকারি খাতের কাছে লাভজনক নয় অথচ জনকল্যাণমূলক এমন খাতে সরাসরি বিনিয়োগ করবে। রফতানি, জনকল্যাণমূলক, নিত্যপ্রয়োজনীয় ও কৃষিসহ জরুরি সেবাখাত রাষ্ট্র প্রয়োজনমতো ভর্তুকি দেবে। অর্থনীতির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অবশ্যই দুই ডিজিটের বা শতকরা ১০ ভাগের বেশি হতে হবে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারে উন্নীত করতে হবে। ধীরে ধীরে জিডিপির বৃহৎ অংশ সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেয়া হবে। তথ্যপ্রযুক্তি পণ্য ও সেবা, কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য, গার্মেন্টস এবং সেবাখাতের রফতানিকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করা হবে। প্রয়োজনে এসব খাতে অর্থের জোগান দেয়া হবে এবং রফতানি সহায়তাও করা হবে।
দেশ হিসেবে ছোট হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের আছে ঈর্ষণীয় সম্পদ। প্রথমত মেধাবী, পরিশ্রমী, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষেত জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের এক বিশাল সম্পদ। বিশেষ করে তথ্যযুগে-জ্ঞানভিত্তিক সমাজে মানবসম্পদ অফুরন্ত বস্ত্তগত ও মেধাসম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। বাংলাদেশকে এই মানবসম্পদ সঠিকভাবে সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়াও অন্যান্য ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এই সম্পদের সুরক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন- তেল, গ্যাস, কয়লা এবং বনজ সম্পদ অত্যন্ত পরিকল্পিত উপায়ে ব্যবহার করতে হবে।
পেছনের কথা
পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে পাই, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রথম ধারণাটি একটি জাতীয় সংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাবনাসহ জীবনের সব ক্ষেত্রেই যুক্ত ছিল। তবে পরবর্তী সময় ধারণাটির সব বিষয়কে ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাখিনি। বাস্তবতা হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রথম ধারণা সেই আগের ছকে আবর্তিত হয়নি। আমার উল্লিখিত প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন ঘোষণা করে এবং সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রণীত হয়।
স্মরণ করতে পারি, ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণাটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় গৃহীত হয়নি। নীতিমালার প্রণেতারা ধারণাটির কিছুই গ্রহণ করতে রাজি হননি। তবে সেই সময়ে প্রণীত তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালার খসড়ায় ডিজিটাল রূপান্তরের কর্মসূচি পরোক্ষে প্রতিফলিত হয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ নামটি খসড়া প্রণয়ন কমিটির কাছে গৃহীত হয়নি।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঘোষিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়ার জন্যই তাদের বহু পরিকল্পিত ইশতেহারটি আপডেট করে। ২০০৬ সালের নির্বাচনের জন্য প্রণীত ইশতেহারে শেষবারের মতো চোখ বুলানোর প্রয়োজন হয়। ৬ ডিসেম্বর ২০০৮ আওয়ামী লীগের ধানম--র অফিসে নূহ-উল আলম লেনিনের রুমে বসে ইশতেহারে রূপকল্প অংশে আমি লিখি ২০২১ সালে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা। ১১ ডিসেম্বর ২০০৮ আমি সেটি হংকংয়ের অ্যাসোসিও সম্মেলনে আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ করি। সেদিনই আওয়ামী লীগের নির্বাহী কমিটির সভায় নির্বাচনী ইশতেহার অনুমোদিত হয়। ১২ ডিসেম্বর ২০০৮ জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতির সামনে সেই ঘোষণা দেন। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৮ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে আমরা আয়োজন করি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ক প্রথম সেমিনার। স্থপতি ইয়াফেস ওসমান এর উদ্যোক্তা ছিলেন।
ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রথম খসড়ার পর আমি যে রূপরেখাটি প্রকাশ করি, তাতে ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মসূচিকে মাত্র তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ছকে উপস্থাপন করা হয়। দিনে দিনে এটি আরও পরিপক্বতা পায়।
আমি মনে করি, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার প্রথম সোপান ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমাদের প্রধান কৌশল হলো তিনটি। এই কৌশলগুলো- মানবসম্পদ উন্নয়ন, সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর এবং একটি ডিজিটাল জীবনধারা গড়ে তোলা ও বাংলাদেশকে জন্মের প্রতিজ্ঞায় গড়ে তোলা-বিষয়ক।
প্রথম কৌশলটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজের উপযোগী ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টি নিয়ে। আমরা এজন্য শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। দ্বিতীয় কৌশলটি সরকারের ডিজিটাল রূপান্তর বা একটি ডিজিটাল সরকার প্রতিষ্ঠাবিষয়ক। তৃতীয় কৌশলটি মূলত একটি ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন। একই সাথে একটি ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা ও সাম্প্রদায়িক চেতনার বিপরীতে একটি ভাষাভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র গড়ে তোলার স্বপ্ন। এই কৌশলটির একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে দেশের শিল্প-কল-কারখানা ও অর্থনীতির রূপটাকে ডিজিটাল করা বা সামগ্রিকভাবে একটি ডিজিটাল অর্থনীতিও গড়ে তোলা।
জরুরি করণীয়
বিগত সাত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে, সরকারের এই মুহূর্তে জরুরি কিছু করণীয় রয়েছে। আমরা সবাই জানি, নতুন সরকারের প্রথম করণীয় হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এরই মাঝে এই পথে সরকার যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে। একই সাথে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সঙ্কট দূরীকরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দেশের পোশাক শিল্পসহ অন্যান্য খাতের মতোই এই খাতেও সহায়তা দিতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কয়েকটি কাজ অতি জরুরিভাবে করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি-
০১. দেশব্যাপী সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমপিউটার ল্যাব তৈরিকে আরও বেগবান করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে ডিজিটাল ক্লাসরুম এবং সম্পন্ন করতে হবে ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরির কাজ। ০২. ডিজিটাল সরকার প্রকল্প বস্ত্তত দৃশ্যমান নয়। জাতীয় ই-আর্কিটেকচার গড়ে তুলে সচিবালয়সহ সরকারের সব মন্ত্রণালয়, দফতর ও বিভাগকে ডিজিটাল করতে হবে। ওয়েবসাইট তৈরি আর নেটওয়ার্ক প্রকল্প দিয়ে এই কাজ করা হচ্ছে বলে আমরা শুনছি। বস্ত্তত এখনও জোড়াতালির পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের ডিজিটাল রূপান্তরের কাজ চলছে। একটি পরিকল্পিত পথ ধরে ডিজিটাল সরকারের কাজ করতে হবে। ভূমি ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা ও সচিবালয় ডিজিটাল করার মতো কাজগুলোতে সরকারের ঢিলেমি দৃষ্টিকটু পর্যায়ে রয়েছে, সেগুলোকে সচল করতে হবে। এটি বোঝা দরকার, ডিজিটাল সরকার ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশ হবে না। ০৩. মহাখালী, কালিয়াকৈরসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যেসব হাইটেক পার্ক গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে, সেগুলোকে বাস্তবায়নের বাস্তব পদক্ষেপ আরও জোরদার করতে হবে। একই সাথে এসব হাইটেক পার্কের ব্যবহারও নিশ্চিত করতে হবে। ০৪. দেশের সব বাড়িতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট পৌঁছাতে হবে এবং ইন্টারনেটের মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মাঝে আনতে হবে এবং শিক্ষাক্ষেত্রে বিনামূল্যে ইন্টারনেট দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ০৫. মেধাসম্পদ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ওয়ানস্টপ আইপি অফিস স্থাপন করাসহ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে। শিল্পনীতিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন করতে হবে এবং বাণিজ্যসহ সব খাতে ডিজিটাল রূপান্তরের পাশাপাশি জ্ঞানভিত্তিক শিল্প-বাণিজ্য গড়ে তোলার পথে পা বাড়াতে হবে।
সার্বিকভাবে এই বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার, একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলাই বস্ত্তত সভ্যতার বিবর্তন ও যুগ পরিবর্তন। এটি খুব সহজসাধ্য কাজ নয়। ডিজিটাল রূপান্তর হচ্ছে তেমন একটি সমাজ গড়ে তোলার প্রধান সিঁড়ি। কিন্তু জ্ঞানভিত্তিক সমাজের সাথে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও অন্যান্য সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে। এখন থেকেই সেইসব বিষয় নিয়েও আমাদেরকে ভাবতে হবে।
মাসিক কমপিউটার জগৎ যখন তার বর্ষপূর্তি পালন করছে, তখন তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে যে, এই মুদ্রণমাধ্যমটি ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার প্রথম প্রকাশ থেকে প্রায় প্রতিটি স্তরের বিকাশ ও ২০১৭ সালের ধারণা পর্যন্ত উপস্থাপন করার সুযোগ দিয়েছে। বর্ষপূর্তিতে শুভকামনা মাসিক কমপিউটার জগৎ-কে
ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com