• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতীয় আলোচনা, বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করেই হচ্ছে এ আইন : তথ্যমন্ত্রী
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: গোলাপ মুনীর
মোট লেখা:২৩৩
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৭ - অক্টোবর
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতীয় আলোচনা, বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করেই হচ্ছে এ আইন : তথ্যমন্ত্রী
খসড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে জাতীয় আলোচনা,
বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত করেই হচ্ছে এ আইন : তথ্যমন্ত্রী
গোলাপ মুনীর
২০০৬ সালে দেশে বাস্তবায়ন করা হয় আইসিটি আইন। এর উদ্দেশ্য ছিল ইলেকট্রনিক সিগনেচারকে বৈধ করে তোলা। সেই সাথে মানুষের ডিজিটাল নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা। কিন্তু ২০১৩ সালে এ আইনে সংযোজন করা হয় ৫৭ ধারা, এই আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে। কিন্তু এই ৫৭ ধারা সারাদেশে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। সরকারের বাইরের প্রায় সব মহল থেকে ৫৭ ধারার সমালোচনায় বলা হয়- এটি মানুষের সব ধরনের বাক-স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছে।
এদিকে গত বছরের ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত একটি সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক বক্তব্য রাখার সময় ৫৭ ধারার সমালোচনার মুখে ঘোষণা দেন, সরকার একটি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে ৫৭ ধারা সম্পর্কিত সব সমালোচনার অবসান ঘটবে বলে মন্ত্রী উল্লেখ করেন। সরকারের নতুন আইসিটি আইনে এ ধরনের সমালোচনার কোনো সুযোগ থাকবে না। সরকার দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। সেই সূত্রে এরই মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬-এর তৃতীয় খসড়া প্রকাশ করেছে।
প্রস্তাবিত এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬ নিয়ে নানা দিকে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এমনি প্রেক্ষাপটে গত ২৫ সেপ্টেম্বর বুয়েটের কমপিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এবং বাংলাদেশ ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ফোরাম (বিআইজিএফ) আয়োজন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬-এর খসড়া নিয়ে পরামর্শমূলক জাতীয় আলোচনা সভা। এই আয়োজনে আয়োজকদের সহায়তায় ছিল ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশনে অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি), বাংলাদেশ এনজিও’স নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), দৃক আইসিটি লিমিটেড ও মাসিক কমপিউটার জগৎ। এই পরামর্শ বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আর্টিকেল ১৯, বাংলাদেশ ও দক্ষেণ এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক তাহমিনা রহমান। এতে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। আলোচনায় অংশ নিয়ে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কমপিউটার সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক মো: মাহফুজুল ইসলাম, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি রাজিব আহমেদ, সিটিও ফোরামের সভাপতি তপন কামিত্ম সরকার, ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে অপারেটরস্ ফোরামের চেয়ারম্যান একেএম শামসুদ্দোহা, আইনি সংস্থা বস্নাস্টের কর্মসূচি সমন্বয়ক শরাবান তহুরা জামান, স্মার্ট টেকনোলজিস বিডি লিমিটেডের ম্যানেজার লিগ্যাল এফেয়ার্স মোহাম্মদ সোহেল রানা আখন্দ, মেট্রোনেটের সিইও সৈয়দ আলমাস কবীর, বিএনএনআরসি’র সিইও এএইচএম বজলুর রহমান এবং দৃক আইসিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএম আলতাফ হোসাইন। এতে বুয়েটের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিআইজিএফের মহাসচিব মোহাম্মদ আবদুল হক অনু। বুয়েটের কমপিউটার প্রকৌশল বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সোহেল রহমান অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন
তথ্যমন্ত্রী যা বললেন
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, বাক ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা নিশ্চিত রেখেই সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় ডিজিটাল আইন প্রণীত হবে। তিনি বলেন- এ আইন ডিজিটাল জগৎ নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়, নিরাপত্তার জন্য। ডিজিটাল বাংলাদেশকে নিরাপদ করতেই এ আইন তৈরির কাজ চলছে।
প্রস্তাবিত আইনের বিশেষ দিকগুলোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, মৌলিক মানবাধিকার, নারী-শিশুসহ সবার ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা এ আইনে গুরুত্বের সাথে বিবেচিত। কমপিউটার, ইন্টারনেট ও আইসিটি ব্যবহারের অধিকারও নিশ্চিত করবে আইসিটি আইন। সাইবার অপরাধ দমনে ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধানও এতে থাকবে বলে জানান তথ্যমন্ত্রী।
তথ্যমন্ত্রী আরও বলেন, যেহেতু সাইবার অপরাধ দমনের জন্য আইন হচ্ছে, তাই শুধু আইন করলে হবে না। সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথেও চুক্তি করতে হবে। ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সাথে কথা হয়েছে। ফেসবুক অভিযুক্ত আইডি মুছে ফেলবে বলে জানিয়েছে। আর ইউটিউব কনটেন্ট মুছে দেবে।
মূল প্রবন্ধে তাহমিনা রহমান
আলোচ্য পরামর্শমূলক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আর্টিকেল ১৯, বাংলাদেশ ও দক্ষেণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক তাহমিনা রহমান। প্রঙ্গত উল্লেখ্য, আর্টিকল ১৯ হচ্ছে একটি ব্রিটিশ মানবাধিকার সংগঠন। এর সুনির্দিষ্ট ম্যান্ডেট হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বাক-স্বাধীনতা ও তথ্যের স্বাধীনতার উন্নয়ন ও সংরক্ষণ। সংগঠনটি এ লক্ষে্য ১৯৯৭ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
তাহমিনা রহমান তার উপস্থাপিত প্রবন্ধের শুরুতেই যথার্থভাবে উল্লেখ করেন- যদিও প্রস্তাবিত আইনটি তথ্যপ্রযুক্তিকেন্দ্রিক, এরপরও এ আইনটির নানান দিক গণমাধ্যম এবং সাধারণ জনগণের ইন্টারনেটে প্রবেশযোগ্যতা, ব্যবহার ও মত প্রকাশের অধিকারকে প্রভাবিত করবে বলেই প্রস্তাবিত এ আইনকে ঘিরে গণমাধ্যম, সাধারণ জনগণ, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং বৃহত্তর যুবসমাজের ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। তিনি জানান, ২০১৫ সালে প্রস্তাবিত এ আইনটির প্রথম খসড়া জনসাধারণের মত প্রকাশের জন্য ওয়েবসাইটে দেয়া হয়। তখন তিনি সে খসড়াকে সামনে রেখে এর একটি বিশেস্নষণ প্রকাশ করেছিলেন। সে বিশেস্নষণের আইনি দিকগুলো এখনও প্রাসঙ্গিক।
তিনি বিষয়টির প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন- বিগত দশকে অনলাইন বা ইন্টারনেট পৃথিবীর সব দেশেই ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। অপরদিকে রাষ্ট্র ইন্টারনেটকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন অনুভব করছে। আর নাগরিক ইন্টারনেট স্বাধীনভাবে ব্যবহার করে কী করে বাক-স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা যাবে, সে প্রয়োজন বোধও বাড়ছে। প্রস্তাবিত খসড়া আইনটি এ ধারাবাহিকতারই ফল। এর প্রথম খসড়া প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। বিভিন্ন অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে আমরা এর দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ তৃতীয় খসড়া দেখতে পাচ্ছি।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
তাহমিনা রহমান তার প্রবন্ধে সংক্ষেপে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬-এর তৃতীয় খসড়ার কথা তুলে ধরেন। তিনি জানান, প্রস্তাবিত ডিজিটাল আইন, ২০১৬-এর তৃতীয় খসড়ায় রয়েছে ৪৫টি ধারা। এ ধারাগুলো সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করে উপস্থাপন করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে ধারা ২(১) থেকে ২(৩৭) পর্যন্ত ধারায় বিভিন্ন বিষয়ের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। আর ধারা ১(১) থেকে ১(৩) পর্যন্ত ধারায় আইনের শিরোনাম, প্রয়োগ ও কার্যকর করার কথা উলিস্নখিত হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ের ৩ নম্বর ধারায় আইনের প্রাধান্য ও ৪ নম্বর ধারায় আইনের অতিরাষ্ট্রিক প্রয়োগের বর্ণনা উলিস্নখিত হয়েছে।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে রয়েছে ধারা ৫, ধারা ৬ এবং এ ধারাগুলোর উপধারাগুলো। ৫ নম্বর ধারায় বর্ণিত হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি এবং এর গঠন ও কার্যাবলি সম্পর্কে। ধারা ৬-এ বর্ণিত হয়েছে জাতীয় ডিজিটাল নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠন ও এর কার্যাবলি।
তৃতীয় অধ্যায় রয়েছে দুইটি ধারা- ধারা ৭ ও ধারা ৮। তৃতীয় অধ্যায়ের বিষয়বস্ত্ত অতিগুরুত্বপৃর্ণ তথ্য পরিকাঠামো (সিআইআই)। ৭ নম্বর ধারায় নির্দিষ্ট কিছু কমপিউটার সিস্টেম অথবা নেটওয়ার্ককে জাতীয় অতিগুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ৮ নম্বর ধারায় রয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর নিরীক্ষা ও পরিদর্শনের বিষয়াবলি।
চতুর্থ অধ্যায়টি অপরাধ ও দ- সম্পর্কিত। এতে রয়েছে ৯ থেকে ২৩ নম্বর ধারা। ধারা ৯-এ বলা হয়েছে অতিগুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে অপরাধের শাস্তির কথা। ধারা ১০-এ বর্ণিত রয়েছে কমপিউটার, মোবাইল ও ডিজিটাল সংক্রান্ত জালিয়াতির দ- কী হবে, তা। ১১ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে কমপিউটার ও মোবাইল সংক্রান্ত প্রতারণা বা হুমকি দেয়ার অপরাধের দ--র কথা। ধারা ১২-এ উল্লেখ রয়েছে পরিচয় প্রতারণা দ--র মাত্রা। ১৩ নম্বর ধারায় জরুরি পরিস্থিতিতে মহাপরিচালকের নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতার বিষয়টি। ১৪ নম্বর ধারায় সম্ভাব্য লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে মহাপরিচালকের নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ দানের ক্ষমতার বিষয়টি। ১৫ ধারার বিষয় ডিজিটাল বা সাইবার সন্ত্রাসী কার্য। ধারা ১৬-এ রয়েছে উলিস্নখিত ডিজিটাল বা সাইবার সন্ত্রাসী কাজের দ- প্রসঙ্গে। ১৭ নম্বরে বর্ণিত হয়েছে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের জন্য শাস্তির বিষয়টি। ধারা ১৮-এ বর্ণনা করা হয়েছে পর্নোগ্রাফি, শিশু পর্নোগ্রাফি এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধসমূহের শাস্তির বিষয়টি। ১৯ নম্বর ধারায় বর্ণণা রয়েছে মানহানি, মিথ্যা ও অশস্নীল, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত সম্পর্কিত অপরাধের বিবরণ ও এর শাস্তি। ২০ নম্বরে বর্ণনা করা হয়েছে শত্রম্নতা সৃষ্টি ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো সংক্রান্ত অপরাধের বর্ণনা ও এর শাস্তির বিষয়। ধারা ২১-এ বর্ণিত হয়েছে কমপিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনে সহায়তা দেয়ার অপরাধ ও এর দ--র কথা। ২২ নম্বর ধারায় উলিস্নখিত হয়েছে কোনো কোম্পানির কৃত অপরাধ সংঘটনের বিবরণ ও এর শাস্তির কথা। ধারা ২৩-এ বর্ণিত হয়েছে নেটওয়ার্ক সেবাদাতা দায়ী না হওয়া সম্পর্কিত অপরাধ ও এর দ--র বিষয়।
পঞ্চম অধ্যায়ের বিষয়বস্ত্ত হচ্ছে তদন্ত ও তল্লাশি সংক্রান্ত। এ অধ্যায় রয়েছে ১৫টি ধারা। ধারা ২৪ থেকে শুরু করে ধারা ৩৮ পর্যন্ত। ২৪ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে অপরাধের তদন্ত সম্পর্কিত পদ্ধতি-প্রক্রিয়া সম্পর্কিত বিষয়াবলি। ২৫ নম্বর ধারায় বর্ণিত হয়েছে তদন্তের সময়ে প্রবেশের ও পরীক্ষণের অধিকার সম্পর্কিত বিষয়টি। ২৬ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে পরোয়ানার মাধ্যমে প্রবেশের, তল্লাশির ও জব্দের বিষয়। ধারা ২৭-এ বর্ণনা রয়েছে পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের বিষয়টি। ধারা ২৮ হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত একটি ধারা। ২৯ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে কমপিউটারের সাধারণ ব্যবহার ব্যহত না করা বিধানটি। ৩০ নম্বর অনুচ্ছেদে রয়েছে তল্লাশি ইত্যাদির পদ্ধতি। ধারা ৩১-এ অনুসন্ধান বা তদন্তে সহায়তা দেয়ার বিধান বর্ণিত রয়েছে। ৩২ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে অনুসন্ধান বা তদন্তে তথ্য গোপন রাখার বিষয় সম্পর্কিত বিধানাবলি। ৩৩ নম্বর ধারায় অপরাধ বিচারার্থে গ্রহণ ইত্যাদি সম্পর্কিত আইনি বিধান। ধারা ৩৪-এর বিষয়বস্ত্ত সাইবার ট্রাইব্যুনাল ও সাইবার আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন সংক্রান্ত আইনি বিধান। ৩৫ নম্বর ধারায় বর্ণিত হয়েছে মামলা নিষ্পত্তির নির্ধারিত সময়সীমার কথা। ধারা ৩৬-এ উল্লেখ রয়েছে অপরাধের আমলযোগ্যতা ও জামিনযোগ্যতা সম্পর্কিত বিধান। ৩৭ নম্বর ধারার বিষয়বস্ত্ত জামিন সংক্রান্ত বিধান। ধারা ৩৮-এ উল্লেখ আছে বাজেয়াপ্তির বিষয়।
ষষ্ঠ অধ্যায়ের বিষয় হচ্ছে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা। এই অধ্যায়ে একটিমাত্র ধারায় অর্থাৎ ৩৯ নম্বর ধারায় এ বিষয়টির বর্ণনা রয়েছে।
সবশেষ অধ্যায় হচ্ছে সপ্তম অধ্যায়। এ ধারায় বর্ণিত হয়েছে বিবিধ বিষয়। এ অধ্যায় রয়েছে ৬টি ধারা- ধারা ৪০ থেকে ধারা ৪৫। ৪০ নম্বর ধারার বিষয়বস্ত্ত সরল বিশ্বাসে করা কাজকর্ম। ৪১ নম্বর ধারাটি অসুবিধা দূর করা সংক্রান্ত। ৪২ নম্বর ধারায় রয়েছে ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাব প্রতিষ্ঠা করা, তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি, হস্তক্ষেপ পর্যালোচনা এবং ডিক্রিপশন রক্ষা। আর ৪৩ নম্বর ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে সাক্ষ্যগত মূল্য সম্পর্কে। ধারা ৪৪-এ রয়েছে হেফাজত ও সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইনি বিধান। সবশেষ ধারা ৪৫-এ বর্ণনা আছে ইংরেজিতে অনূদিত পাঠ প্রকাশ বিষয়ে।
প্রসঙ্গ : সংবিধান ও বাক-স্বাধীনতা
সংবিধান ও বাকস্বাধীনতা প্রসঙ্গে তাহমিনা রহমান তার মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করেন- বাংলাদেশের সংবিধানে ৩৯ অনুচ্ছেদে চিমত্মা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনের প্ররোচনা সম্পর্কে আইন দিয়ে আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিশেষ আরোপ করা যাবে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন- বাংলাদেশ ২০০০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসে (আইসিসিপিআর) অনুস্বাক্ষর করে। ফলে আইসিসিপিআরের আর্টিকল ১৯-এর অন্তর্ভুক্ত মত প্রকাশের স্বাধীনতাবিষয়ক সে বিধি রয়েছে, তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ দায়বন্ধ। উপরন্তু ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটিতে গৃহীত সাধারণ মন্তব্যটি সুস্পষ্টভাবে স্বীকার করে, আইসিসিপিআরের আর্টিকল ১৯ সব ধরনের ইলেকট্রনিক ও ইন্টারনেটভিত্তিক অভিব্যক্তি এবং প্রচারের মাধ্যমকে রক্ষা করে। অনলাইনের বিধিনিষেধ যদি করতেই হয় তবে তা আইনের মাধ্যমেই করতে হবে। সুস্পষ্ট বৈধ কোনো কারণে, যেমন- রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা মানহানি ঠেকাতে আইন করা যাবে। তবে এই আইন সুনির্দিষ্ট ও সমানুপাতিক হতে হবে। আর বাকস্বাধীনতা সংক্রান্ত অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তি হবে ন্যূনতম এবং কারাদ- না হওয়াই ভালো। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধ দমন, প্রতিরোধ তদন্ত ও মামলা দায়েরবিষয়ক ÿমতাগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ
তাহমিনা রহমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৬-এর তৃতীয় খসড়ার বিভিন্ন ধারা পর্যালোচনা করে বেশ কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছেন। তিনি ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক জালিয়াতি সংক্রান্ত ২(১৭) নম্বর ধারাটি সম্পর্কে বলেন- অনধিকার চর্চার মাধ্যমে ডিজিটাল ডাটায় যেকোনো পরিবর্তনকে এই ধারায় ‘ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক জালিয়াতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসারে এ ধরনের পরিবর্তনকে শুধু তখনই জালিয়াতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যখন এ ধরনের পরিবর্তনের পেছনে পরিবর্তিত তথ্যকে আইনি কার্যক্রমে সঠিক তথ্য হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্য বিদ্যমান থাকে। এর ভিত্তিতে তার সুপারিশ হচ্ছে- ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক জালিয়াতের সংজ্ঞায় ‘আইনি কার্যক্রমে সঠিক তথ্য হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্য’ কথাগুলো যুক্ত করা হোক।
দ্বিতীয় ও চতুর্থ অধ্যায়ের ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি সম্পর্কিত ধারা ৫, ১৩ ও ১৪ সম্পর্কে তাহমিনা রহমানের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে- এই আইনের ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থা থাকবে, এর একজন মহাপরিচালক থাকবেন, যার ক্ষমতা ১৩ নম্বর ধারা (জরুরি পরিস্থিতিতে নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা) এবং ধারা ১৪ (সম্ভাব্য লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ দানের ক্ষমতা) অনুযায়ী পরিচালিত হবে। ধারা ১৩ মতে, জরুরি পরিস্থিতিতে আদেশ দিয়ে সরকারের কোনো শৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো কমপিউটার রিসোর্সের মাধ্যমে কোনো তথ্য সম্প্রচারে বাধা দেয়ার নির্দেশ দিতে পারবেন। কিন্তু উলিস্নখিত সংস্থা/ব্যক্তিকে কোনো তথ্য ইন্টারসেপ্ট, মনিটর/ডিক্রিপ্ট করার জন্য বাধ্য করতে পারবেন। নির্দেশ অমান্যকারীকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর এবং সর্বনিমণ এক বছর কারাদ- ও সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদ- অথবা উভয় দ-- দ--ত করতে পারবেন। কিন্তু এ ক্ষমতা প্রয়োগের পদ্ধতিগত সুরক্ষাগুলো কী হবে তা বলা হয়নি। ব্যাপক ক্ষমতা প্রয়োগের কোনো প্রয়োজনীয় বিচারিক প্রক্রিয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়নি। তাই এ ব্যাপারে তার সুপারিশ হচ্ছে- টেলিযোগাযোগ আইন, ২০০১-এর ৯৭(ক)-তে জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সরকারকে অনুরূপ ক্ষমতা দেয়া আছে। সুতরাং ১৩ ও ১৪ ধারা এখানে অপ্রয়োজনীয়। এ দুটি ধারা রহিত করা হোক। উলিস্নখিত ধারায় বর্ণিত ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক মানদ--র আলোকে সুনির্দিষ্ট বিধি প্রণয়নের শর্তে সংযুক্ত করা হোক।
চতুর্থ অধ্যায়ের অপরাধ ও দ- সম্পর্কিত ধারা ৯ থেকে ২৩, ৩০, ৩১ ও ৩২ ধারা সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণে তাহমিনা রহমান বলেন- ধারা ৯ থেকে ২৩ পর্যন্ত ধারায় অপরাধ ও দ- সংক্রান্ত বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধের সাজা হিসেবে অর্থদ- এবং কারাদ- নির্ধারণ করা হয়েছে ২ থেকে সর্বোচ্চ ১৪ বছর, যা বিভিন্ন অপরাধের তুলনায় সমানুপাতিক নয়। এর অনেকগুলো দীর্ঘমেয়াদি। প্রস্তাবিত এই অপরাধ ও দ- বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি অনুপস্থিত।
উদ্বেগের বিষয় হলো, সাইবার সন্ত্রাসের যে বিষয়গুলো আনা হয়েছে প্রস্তাবিত আইনের ১৫(৪), ১৫(৫) ও ১৫(৬) ধারায়, তা সন্ত্রাসে কী সম্পর্ক তা স্পষ্ট নয়। এ ক্ষেত্রে ধারাগুলোকে ধোঁয়াশা বলে অভিহিত করা যায়। এর ফলে এগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের সুযোগ থেকে যায়। সে জন্য এ ব্যাপারে তার সুপারিশ হচ্ছে, এসব ধারা পর্যালোচিত হোক।
প্রস্তাবিত খসড়া আইনের ১৯ ও ২০ ধারা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন- তাদের উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় যা ছিল, সেগুলোই ১৯ ও ২০ ধারায় আনা হয়েছে। অবশ্য একটি পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে, দ-বিধিতে এই অপরাধ সংক্রান্ত যে সুরক্ষা রয়েছে সেগুলোসহ আনা হয়েছে। এরপরও মানহানির জন্য এবং অশস্নীলতার জন্য ফৌজদারি শাস্তির আওতায় ২ বছরের কারাদ--র বিধান বলবৎ রাখা হয়েছে। তিনি এ ধারা পর্যালোচনা করার সুপারিশ রেখেছেন। এ ছাড়া তিনি ধারা ৩০, ৩১ ও ৩২-কে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ--র পরিপন্থী বলে চিহ্নিত করেছেন। বিচার বিভাগীয় সুরক্ষা এতে অনুপস্থিত। তিনি মনে করেন- এ বিষয়গুলো পর্যালোচনার ভিত্তিতে সুরক্ষাসমূহ যুক্ত করা প্রয়োজন। এ উপলব্ধির ভিত্তিতে এসব বিষয়ের আলোকে তার সুপারিশ হচ্ছে- আন্তর্জাতিক আইন/মানদ- অনুসারে এখনও এই আইনের নানা দিক পরিবর্তন ও সমৃদ্ধ করার অনেক সুযোগ আছে।
তিনি ধারা ২(১৯) (খ) সম্পর্কে বলেন, নৈতিকতার বিষয়গুলো শুধু গোষ্ঠী, ধর্ম ও দর্শনের ভিত্তিতে না হয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈষম্যহীনতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তিনি ধারা ৬, ১৫ ও ১৬-এর পর্যালোচনা চান। তিনি রহিত করার দাবি তোলেন ধারা ৬, ১৫ ও ১৬-এর। ধারা ৮, ১৯ ও ২০-এর কারাদ--র বিধিগুলোর পর্যালোচনাও দাবি করেন।
এছাড়াও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৬-এর খসড়া নিয়ে পরামর্শমূলক জাতীয় আলোচনা সভায় অধিকাংশ বক্তাই একাধিক সাইবার ট্রাইব্যুনাল স্থাপন এবং এতে নিযুক্ত বিচারকেরা যেন সাইবার জগৎ সম্পর্কে ভালো জ্ঞান রাখেন, এমন মতামত দেন


পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
২০১৭ - অক্টোবর সংখ্যার হাইলাইটস
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস
অনুরূপ লেখা