লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
কমপিউটার জগৎ-এর উপদেষ্টা কীর্তিমান জামিলুর রেজা চৌধুরীর চলে যাওয়া
কমপিউটার জগৎ-এর উপদেষ্টা কীর্তিমান
জামিলুর রেজা চৌধুরীর চলে যাওয়া
গোলাপ মুনীর
আল-কোরআনের ঘোষণা : প্রতিটি মানুষকে এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। অবধারিতভাবে মৃত্যুর স্বাদ তাকে নিতেই হবে। এ থেকে কারও রেহাই নেই। সৃষ্টিকর্তার বেঁধে দেয়া অমোঘ নিয়মেই প্রতিটি মানুষকে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়। কিন্তু কোনো মানুষ যখন আমাদের মাঝ থেকে চিরদিনের জন্য মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই বিদায় নেন, তখন তিনি স্মরিত হন তার কর্মফল দিয়ে। যদি কোনো ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় তার কর্মসাধনার মধ্য দিয়ে হয়ে ওঠেন কোনো জাতীয় ব্যক্তিত্ব, তখন তার এই বিদায় তার পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি গোটা জাতিকেই শোকাভিভ‚ত করে। তার বিদায়ে কাঁদে দেশ, কাঁদে জাতি। জামিলুর রেজা চৌধুরী ছিলেন তেমনি আমাদের এক জাতীয় ব্যক্তিত্ব। তাই তার ইন্তেকালে গোটা জাতি আজ শোকে মুহ্যমান। সন্দেহ নেই, তিনি ছিলেন আমাদের অনন্য এক কীর্তিমান মানুষ। যার সরাসরি তত্ত¡াবধানে এদেশের অসংখ্য স্থাপনা গড়ে উঠেছে। তিনি ছিলেন এ দেশের খ্যাতনামা এক প্রকৌশলী। সেই সাথে তিনি ছিলেন গবেষক, শিক্ষাবিদ, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও একজন সচেতন দেশচিন্তক। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপারে ছিল তার বিশেষ আগ্রহ। ছিলেন সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। তিনি নিরন্তর কাজ করে গেছেন দেশোন্নয়নের এক নিরলস কারিগর হিসেবে।
গত ২৮ এপ্রিল, ২০২০ মঙ্গলবার ভোররাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর। সেহরির সময় তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। তাকে ডাকাডাকি করে কোনো সাড়া না পেয়ে সাথে সাথে হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসকেরা তখন জানান, হাসপাতালে নেয়ার আগেই ভোররাত ৪টার দিকে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। এভাবেই চলে গেলেন আমাদের প্রিয় মানুষ জামিলুর রেজা চৌধুরী।
তার জন্ম ১৯৪৩ সালের ১৫ নভেম্বর, সিলেট শহরে। বাবা আবিদ রাজা চৌধুরীও ছিলেন একজন পুরকৌশলী। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তিন বছর বয়সে পরিবারের সাথে চলে যান আসামের জোড়হাটে। ১৯৪৭ সালের আগস্টে আবার ফিরে আসেন সিলেটে। বাবার চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন স্থানে তার শৈশব কাটে। স্কুলের লেখাপড়া চলে ময়মনসিংহ ও ঢাকায়। ১৯৫৯ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ভর্তি হন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, যা আজকের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা বুয়েট। ১৯৬৩ সালে সেখান থেকে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে পাস করেন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং। ১৯৬৪ সালে বার্মাশেল বৃত্তি নিয়ে যান ইংল্যান্ডে। সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি করেন অ্যাভান্সড স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে। থিসিসের বিষয় ছিল কংক্রিট বিমে ফাটল। ১৯৬৮ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন ‘কমপিউটার এইডেড ডিজাইন অব হাইরাইজ বিল্ডিং’ বিষয়ে। ১৯৭০ সালের ২০ অক্টোবর ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয় জামিলুর রেজা চৌধুরীকে সম্মানসূচক ডক্টর অব ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি দেয়।
১৯৬৩ সালে তার কর্মজীবন শুরু বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। পরের বছরই তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান। পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরে ১৯৬৮ সালে বুয়েটে যোগ দেন সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। পদোন্নতি পেয়ে ১৯৭৩ ও ১৯৭৬ সালে যথাক্রমে হন সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক। অধ্যাপক হিসেবে সেখানে কর্মরত ছিলেন ২০০১ সাল পর্যন্ত। এর মধ্যে ছিলেন বিভাগীয় প্রধান ও ডিন। বুয়েটের কমপিউটার সেন্টার পরিচালক ছিলেন প্রায় ২০ বছর। ১৯৭৯ সালে কয়েক মাস ব্যাংককে ছিলেন ইউনেসক্যাপ পরামর্শক। ১৯৭৮-৭৯ সালে কমনওয়েলথ বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাজ্যের সারে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ভিজিটিং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। ২০০১-১০ সময়ে ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। ২০১৮ সালের ১৯ জুন সরকার তাকে নিয়োগ দেন জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে। ১৯৯৭-০৩ সময়ে চট্টগ্রাম বিআইটির গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ছিলেন।
বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংকের পরিচলনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন বছর দুয়েক। ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন যুক্তরাজ্যের ‘সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের ফেলো, যুক্তরাজ্যের একজন চার্টার্ড ইঞ্জিনিয়ার ও বাংলাদেশ কমপিউটার সোসাইটির ফেলো। ১৯৯২-৯৩ সময়ে ছিলেন বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সভাপতি। ছিলেন বাংলাদেশ আর্থকোয়াক সোসাইটি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দেলন (বাপা), বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সভাপতি। তিনি ১৯৯৭-০২ সময়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সফটওয়্যার রফতানি এবং আইটি সার্ভিস রফতানিবিষয়ক টাস্কফোর্সের চেয়ারম্যান। ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর আইসিটি টাস্কফোর্সের একজন সদস্য। ২০১২ সালে হন বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মনোনীত হন এর চেয়ারম্যান এবং ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সে দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া তিনি আরও অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। ২০১২ সালের ২ মে থেকে তিনি আমৃত্যু এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।
তিনি তার ব্যাপক কর্মজীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামোর বেশ কয়েকটি পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ছিলেন বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রধান পরামর্শক। তিনি উপক‚লীয় অঞ্চলের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। ১৯৯৩ সালের জাতীয় বিল্ডিং কোড তৈরির স্টিয়ারিং কমিটিতে ছিলেন। ছিলেন পদ্মা সেতুর আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞমন্ডলীর প্রধান। পরামর্শক ছিলেন প্রথম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে, কর্ণফুলী নদীর সুরঙ্গ, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়েসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের পরামর্শক। সর্বোপরি তিনি ছিলেন ১৯৯৬ সালে গঠিত সাবেক তত্ত¡াবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা।
দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে তার ৭০টিরও বেশি মৌলিক প্রবন্ধ ও গবেষণাকর্ম প্রকাশিত হয়েছে। তার প্রকাশনার মধ্যে রয়েছে সুউচ্চ ভবন নির্মাণ, কম-খরচের আবাসন, ভ‚মিকম্প-সহনীয় ভবন তৈরি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, রেট্রফিটিং ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক প্রকাশনা।
এই বিরাট কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন এক অনন্য-সাধারণ জাতীয় ব্যক্তিত্বে। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও ছিল তার সুখ্যাতি। সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ ব্লকচেইন অলিম্পিয়াড পুরস্কার’-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড’। তিনি ব্লকচেইন অলিম্পিয়াডের উপদেষ্টা ছিলেন।
জীবনে বহু পুরস্কার লাভ করেন। তার মধ্যে আছে : ২০১৭ সালে একুশে পদক, ২০১০ সালে শেলটেক পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন স্বর্ণপদক, ১৯৯৭ সালে ড. রশিদ স্বর্ণপদক, ২০০০ সালে রোটারি সিড অ্যাওয়ার্ড, লায়নস ইন্টারন্যাশনাল (ডিস্ট্রিক্ট ৩১৫) স্বর্ণপদক, জাইকা স্বীকৃতি পদক এবং ২০১৮ সালে পান জাপান সরকারের সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক পদক অর্ডার অব দ্য রাইজিং সান (গোল্ড রে অ্যান্ড নেক রিবন) পদক।
কর্মবীর এই মানুষটিকে হারিয়ে আমরা হারালাম অনন্য এক জাতীয় ব্যক্তিত্বকে। বিশেষ করে কমপিউটার জগৎ পরিবার হারাল তার এক অকৃতিম বন্ধু ও পথ-প্রদর্শককে। সম্প্রতি প্রকাশিত হলো কমপিউটার জগৎ-এর ৩০তম বর্ষশুরু সংখ্যা। এই প্রায় তিন দশক তিনি ছিলেন কমপিউটার জগৎ-এর উপদেষ্টা পরিষদের প্রধানতম জন। এই সুদীর্ঘ সময় তিনি আমাদের সাথে ছিলেন এক আলোকবর্তিকার মতো। তার এই চলে যাওয়া তাই সত্যিই আমাদের জন্য বড় ধরনের শোকাঘাত। আল্লাহ রাব্বুল আল-আমিনের কাছে আমাদের প্রার্থনা, মহান আল্লাহ যেন তাকে বেহেশত নসিব করেন। আমিন।