এতদিন আমরা জেনে এসেছি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ওপর ভর করে একটি দেশ তার অর্থনৈতিক অবস্থার চেহারা পাল্টে ফেলতে পারে। এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণের অবকাশ নেই। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি সরাসরি প্রভাব বিসত্মার করেছে তা নয়, বরং রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করা, দলকে সুসংগঠিত করা, জনসমর্থন অর্জনসহ নির্বাচনী প্রচারাভিযানেও ব্যাপকভাবে অবদান রাখছে। আর তাই প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব পেয়েছে ব্যাপকভাবে। আমাদের দেশে কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের প্রধানকে প্রায়ই টেলিকনফারেন্সের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানের দলীয় কর্মীদের সংগঠিত করা ও নির্দেশনা দিতে কিছু প্রয়াস দেখা গেলেও আমেরিকায় সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের তুলনায় খুবই নগণ্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইসিটির ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আগামী ২০ জানুয়ারি তার দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বভার নেবেন। বারাক ওবামার ই-গভর্নেন্স নিয়ে রয়েছে এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী এজেন্ডা। বারাক ওবামা তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে অত্যমত্ম সফলতার সাথে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করেন।
বারাক ওবামা তার নির্বাচনী প্রচারাভিযানে যেভাবে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করেছিলেন, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, www.barackobama.com সাইটের তথ্য অনুযায়ী আমরা জানতে পারি ২ লাখ ৮০ হাজার জনের বেশি অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়, ইউজাররা ৬ হাজার ৫০০-এর বেশি তৃণমূল পর্যায়ের স্বেচ্ছাসেবী গ্রুপ এবং ওয়েবসাইট ব্যবহার করে। ১৩ হাজারের বেশি অফ-লাইন ইভেন্ট আয়োজন করা হয় এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ১৫ হাজারের বেশি নীতি-ধারণা বা পলিসি আইডিয়া পরিবেশিত হয়। এসব ক্ষেত্রে ইন্টারনেট পরিচালনার তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন ৯৫ জন। ওবামা তৈরি করেন একশ’ কোটির বেশি সমর্থকের এক বিশাল ডাটাবেজের তথ্যভান্ডার। ওবামার নির্বাচনী প্রচারাভিযানের মূল বিষয় ছিল পরিবর্তন বা ‘Change’। তাই তার ট্রানজিশন সাইটের নাম দেয়া হয় Change শব্দটি অনুসরণে। http:\\change.gov\. ওবামা যদি শেষ পর্যমত্ম ভালোয় ভালোয় একবার হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেন, তখন আমেরিকানরা তার কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করবে আইটি ও ই-গভর্নেন্সের ক্ষেত্রে’।
তাহলে বারাক ওবামার ই-গভর্নেন্স এজেন্ডা কী? সংক্ষেপে তা হচ্ছে ‘উমুক্ত সরকার‘ বা ‘ওপেন গভর্নমেন্ট’। বারাক ওবামার ই-গভর্নেন্স কার্যক্রমের মূল এজেন্ডা দশটি :
০১. ট্রান্সপারেন্ট এবং কানেকটেড ডেমোক্র্যাসি :
এ এজেন্ডার প্রসত্মাব হচ্ছে বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকারি কাজে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করা। এর মধ্যে আছে সবার প্রবেশযোগ্য ফরমেটে সরকারি তথ্য অনলাইনে সহজলভ্য করা, যাতে করে দেশের জনগণ এ ডাটা ব্যবহার করার মাধ্যমে মমত্মব্য, মূল্যবান সিদ্ধামত্ম গ্রহণ, নিজেদের সমাজের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে এবং ওয়াশিংটনে যেসব গোপন চুক্তি সম্পাদিত হয় তা ওয়েবসাইট, সার্চ ইঞ্জিন এবং অন্যান্য ওয়েব টুলের মাধ্যমে তুলে ধরা। এর ফলে খুব সহজেই জনগণ অনলাইনে ফেডারেল গ্র্যান্ড, চুক্তি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে লবিস্টদের যোগাযোগ সম্পর্কে জানতে পারবে।
০২. ওপেন গভর্নমেন্ট :
ফেডারেল গভর্নমেন্টকে পুরোপুরি উন্মুক্ত করার জন্য পাওয়া সব ধরনের প্রযুক্তি প্রক্রিয়া ব্যবহারের সুযোগ করে দিতে হবে। ‘ওয়াশিংটনে যেভাবে কাজ পরিচালনা করা হয়, তাতে নাগরিক সাধারণের মতামত প্রকাশ ও সিদ্ধামত্ম গ্রহণে অংশ নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। এখানে সরকারি সুচিমিত্মত কাজে এবং সিদ্ধামত্ম নেয়ার ক্ষেত্রে আমেরিকাবাসীদের এমনভাবে এক সুযোগ দিতে হবে, যা কয়েক বছর আগেও সম্ভব ছিল না। এ লক্ষ্য বোঝার জন্য সর্বাধুনিক যোগাযোগ অবকাঠামো ব্যবহার করা হবে। এ এজেন্ডার দর্শনগত দিক হলো : সরকারি গোপন কর্মকান্ডের অনুশীলনকে উন্মুক্ত করে দিয়ে তাতে বৃহত্তর নাগরিক সাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
০৩. ফেডারেল চিফ টেকনোলজি অফিসার :
এই এজেন্ডার প্রসত্মাব হচ্ছে জাতির প্রথম চিফ টেকনোলজি অফিসার বা সিটিও নিয়োগের বিষয় নিশ্চিত করা, যাতে করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এবং এর সব এজেন্সির যথাযথ অবকাঠামো থাকে, একুশ শতকের উপযোগী নীতি ও সেবা। সিটিও নিশ্চিত করবে যুক্তরাষ্ট্রের নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা। সিটিও নেতৃত্ব দেবে আমত্মঃএজেন্সি পদক্ষেপে। প্রত্যেক ফেডারেল এজেন্সির চিফ টেকনোলজি অফিসার এবং চিফ ইনফরমেশন অফিসার প্রত্যেকে নিশ্চিত করবে যে, তারা সেরা টেকনোলজি ব্যবহার করবে এবং ভাগ বসাবে সেরা অনুশীলনে।
০৪. ইন্টারনেটের উন্মুক্ততা :
ইতিহাসের সেরা উন্মুক্ত নেটওয়ার্ক হিসেবে ইন্টারনেটের গুরুত্ব অনুধাবন করে এ এজেন্ডায় প্রসত্মাব করা হয়েছে ইন্টারনেটের উন্মুক্ততা বজায় রাখার। এতে নেটওয়ার্কের নিরপেক্ষতা রক্ষা কঠোরভাবে মেনে চলার নীতি সমর্থন করা হয়েছে, যাতে করে ইন্টারনেটে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার সুবিধা সংরক্ষণ করা যায়। ব্যবহারকারীদের অবাধে কনটেন্টে প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করতে দিতে হবে, পার্সোনাল ডিভাইস সংযুক্ত করতে দিতে হবে। সার্ভিস প্ল্যান সংক্রামত্ম নির্ভুল এবং যথাযথ তথ্য পাওয়ার অধিকার তাদের থাকতে হবে। এই এজেন্ডা বেসিক নীতি সাপোর্ট করে। নেটওয়ার্ক প্রোভাইডাররা কোনো চার্জ দাবি করতে পারবে না কনটেন্ট বা কিছু ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন এবং ইন্টারনেট অ্যাপ্লিকেশনের জন্য।
০৫. শিশুদের নিরাপদ রাখা :
আলোচ্য এজেন্ডার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইন্টারনেটে শিশুদের নিরাপদ রাখা। এ এজেন্ডায় প্রসত্মাব রয়েছে ‘অভিভাবকদের সহায়ক টুল’ দেয়ার জন্য কাজ করতে হবে, যাতে করে প্রোগ্রাম গ্রহীতাদের প্রতিহত করতে পারবে, যা টেলিভিশন ও ডিজিটাল মিডিয়ার জন্য অশালীন। এ এজেন্ডা কাজ করবে বিচারবুদ্ধির সুস্থতার জন্য, কিন্তু সেন্সরশিপের জন্য নয়।
০৬. পাবলিক মিডিয়া ২.০ :
এ এজেন্ডা উৎসাহিত করবে পাবলিক মিডিয়া ২.০ গড়ে তুলতে, যা হবে পরবর্তী প্রজন্মের পাবলিক মিডিয়া। পরবর্তী প্রজন্মের পাবলিক মিডিয়া সৃষ্টি করবে ডিজিটাল যুগের প্রবেশের সহজ পথ। ফলে ভিডিও এবং ইন্টারেকটিভ প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষা বিসত্মার করা যাবে।
০৭. প্রাইভেসির অধিকার :
এ এজেন্ডায় উল্লেখ করা হয়, কমপিউটিং ক্ষমতার নাটকীয় উন্নয়ন, স্টোরেজ খরচ কমে যাওয়া এবং তথ্যের ব্যাপক প্রবাহ প্রভৃতি ডিজিটাল যুগের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেছে, দিয়েছে ব্যাপক সুবিধা। তবে এগুলোর অপব্যবহারের ক্ষেত্রও সৃষ্টি হয়েছে যথেষ্ট মাত্রায়। নতুন ডায়নামিক বিশ্বে দরকার যথাযথ সেফ গার্ড, যা গোপনীয়তাকে রক্ষা করবে। তাই এই এজেন্ডায় প্রসত্মাব করা হয়েছে ডিজিটাল যুগের জন্য গোপনীয়তা রক্ষার এক শক্তিশালী ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে, যার ফলে সরকারি ও ব্যবসায়িক এবং ব্যক্তিগত কর্মকান্ডে থাকবে সুরক্ষিত ও নিরাপদ।
০৮. পরবর্তী প্রজন্মের ব্রডব্যান্ড :
এ এজেন্ডায় ব্রডব্যান্ডের গুরুত্বের কথা ফুটে উঠেছে স্পষ্টভাবে। ব্রডব্যান্ডের ব্যাপক ব্যবহার সমৃদ্ধ করতে পারে গণতান্ত্রিক গতিবিধি, বাড়াতে পারে প্রতিযোগিতা, অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে এবং উল্লেখযোগ্যভাবে ভোক্তার সুবিধা দিতে পারে। উপরন্তু অবকাঠামো উন্নয়ন করে ইন্টারনেট এক্সেসের জন্য প্রতিযোগিতার বাজার সম্প্রসারিত করবে, যা এই অবকাঠামোর ওপর সার্ভিসসমূহ চালিত হবে।
০৯. দেশে ও দেশের বাইরে মেধাস্বত্ত্ব অধিকার রক্ষা করা :
মেধাস্বত্ব অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে এ এজেন্ডায় বলা হয়, ডিজিটাল যুগ হলো মেধাস্বত্বের, যা শিল্প যুগে ছিল পণ্যের জন্য। এতে জোর দেয়া হয় কপিরাইট ও প্যাটেন্ট সিস্টেমের হালনাগাদ ও সংস্কারে যাতে করে নাগরিকরা উৎসাহিত হবে উদ্ভাবন ও অর্থ বিনিয়োগে। এক্ষেত্রে মেধাস্বত্বের বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়।