মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটানোর চেষ্টা প্রযুক্তিবিদরা চালিয়ে আসছেন দীর্ঘদিন ধরেই। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সাফল্য এখনো ধরা দেয়নি। তার পরও বিক্ষিপ্তভাবে কাজ অব্যাহত আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পৌঁছানো গেছে সাফল্যের কাছাকাছি। দৃশ্যত মনে হচ্ছে সেদিন হয়তো দূরে নয়, যেদিন মানবদেহে সংযোজিত হবে নানা যন্ত্রাংশ। আর ওই যন্ত্রাংশ হয়ে যাবে দেহেরই অংশ। দেহের স্বাভাবিক অঙ্গ যেমন নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে দেয়, ওই যন্ত্রও তাই করবে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে এমন যন্ত্র মানবদেহে হরহামেশাই দেখা যায়। তবে বাস্তবে এমনটি পেতে অপেক্ষায় থাকতে হবে আরো কিছুকাল।
কানাডার টরেন্টোভিত্তিক তথ্যচিত্র নির্মাতা রব স্পেন্স এমনি একটি প্রকল্প নিয়ে অনেক দিন ধরেই কাজ করছেন এবং তার দাবি অনুযায়ী তিনি পৌঁছে গেছেন চূড়ান্ত সাফল্যের কিনারায়। শিশুকালে এক দুর্ঘটনায় তিনি তার একটি চোখ হারান। অপর একটি চোখ নিয়েই বেড়ে উঠেছেন তিনি। প্রযুক্তি তাকে আশার আলো দেখিয়েছে। হারানো চোখের স্থানে তিনি বসাচ্ছেন বিশেষভাবে নির্মিত ক্যামেরার চোখ। আসল চোখের প্রায় কাছাকাছি কাজ করবে এটি। চূড়ান্ত সাফল্য পেলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তা হবে চাঞ্চল্যকর খবর। তারা ওই ‘ক্যামেরার চোখ’ ব্যবহার করে দেখতে পারবেন পৃথিবীর আলো-অন্ধকার, ভালো-মন্দ সব। ওই কৃত্রিম চোখ লাগানোর ঘোষণাটি রব স্পেন্স এক বছর আগেই দিয়েছিলেন। এখন তিনি উদ্যোগটিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার কাজ করছেন।
রব স্পেন্স বলেন, এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং শ্রমসাধ্য একটি প্রক্রিয়া। তার পরও সৌভাগ্যের ব্যাপার, আমরা এটি করতে পেরেছি এবং তৈরি হয়েছে একটি প্রাথমিক সংস্করণ বা প্রটোটাইপ। তিনি ওই ওয়্যারলেস ক্যামেরা তার নষ্ট চোখে স্থাপন করবেন এবং তৈরি করবেন চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র। মানুষের কারণে যেসব শূটিং বা ভিডিও রেকর্ডিং ব্যাহত হয় ওই ক্যামেরার চোখ তা করে দেবে নির্বিঘ্নে। তবে ওই চোখে এত ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়েছে যে, এখনই তা দেহে সংযুক্ত করা সম্ভব হবে না। ব্যবহার উপযোগী হতে হলে এর আরো কিছু সংস্কার করতে হবে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা ব্যবহার করতে হবে এবং আকার করতে হবে ক্ষুদ্র, যা চোখে মানানসই হয়। এজন্য অপেক্ষার বিকল্প আপাতত নেই।
স্পেন্স নিজেকে ‘আইবর্গ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার মতে, তার দেহ এবং মেশিন একে একাকার হয়ে যাবে। দেহে স্থাপনের পর মেশিন আর মেশিন থাকছে না। সেটি হয়ে যাচ্ছে দেহেরই অংশ এবং নির্দেশনা পালন করবে যেভাবে বলা হবে সেভাবেই।
‘দ্য বডি ইলেকট্রিক : অ্যান অ্যানাটমি অব দ্য নিউ বায়োনিক সেন্সেস’ গ্রন্থের রচয়িতা জেমস গেরি বলেছেন, মানুষ এবং যন্ত্রের সম্মিলন এখন কেবল বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক উপন্যাস এবং চলচ্চিত্রেই সীমিত থাকছে না। সত্যিকার অর্থেই প্রযুক্তি জায়গা করে নিচ্ছে মানবদেহে। এতে করে মানুষের সেন্স বা চেতনা বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণ। মানুষ যখন গুহাবাসী ছিল তাদের তখনকার সেন্স এবং আজকের মানুষের অবস্থা নিঃসন্দেহে এক নয়। মানুষের এই যে বিবর্তন বা পরিবর্তন তা এসেছে প্রযুক্তির হাত ধরে। এই প্রযুক্তিই মানুষকে নিয়ে যাবে আরো বহু দূরে। মানবদেহে ভর করে এই প্রযুক্তি মানুষকে দিচ্ছে বহু ক্ষমতা, মানুষ তার নানাবিধ দুর্বলতা কাটিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মহামানুষ হওয়ার গন্তব্যে। তিনি বলেন, মানবদেহের কোনো অঙ্গ ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আবার তা ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। সেই শূন্য স্থানে যদি বসিয়ে দেয়া যায় কোনো প্রযুক্তি যন্ত্র, তাহলে আসল অঙ্গের ঘাটতি অন্তত কিছুটা দূর হয়। সেই যন্ত্রে যদি ত্রুটি দেখা দেয় তাহলে তা মেরামত বা প্রয়োজনে পরিবর্তন করার সুযোগ থাকে। সেন্সকেও করে তোলা যায় চৌকস। বধির, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীসহ নানা শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য যন্ত্র হয়ে উঠতে পারে আশীর্বাদ। ইতোমধ্যেই এমন কিছু যন্ত্রের সুবিধা পাচ্ছে প্রতিবন্ধীরা। তবে প্রতিবন্ধীত্ব নির্মূলের জন্য এসব নিয়ে আরো গবেষণা করতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রযুক্তির কল্যাণে তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে ক্ষুদ্র, অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্র। তাই ওইসব যন্ত্র এখন আর দেহের বাইরে স্থাপনের প্রয়োজন হবে না। বরং তা স্থাপন করা যাবে দেহের ভেতরে। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় থাকবে না যে দেহের ভেতরে থেকে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কোনো যন্ত্র। ক্যালিফোর্নিয়ার কোম্পানি সেকেন্ড সাইট এমন একটি যন্ত্রের উন্নয়ন ঘটিয়েছে, যা কিছু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর সীমিত দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে সক্ষম। এটি এখনো ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা পর্যায়ে রয়েছে। সফল হলে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য এটা হবে বড় আশার আলো। ওই যন্ত্রে রয়েছে একটি ক্যামেরা, যা বসানো রয়েছে একজোড়া গ্লাসের ওপর। ওই ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি পাঠানো হবে রেটিনায় স্থাপিত ইলেকট্রোডে। সেখান থেকে তা যাবে মস্তিষ্কে।
রেটিনা ইমপ্লান্ট, মন নিয়ন্ত্রিত অঙ্গ, মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো ইলেকট্রোডপরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তির অল্প কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এগুলো মানুষ এবং মেশিনের মধ্যে মিথস্ক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো বিজ্ঞানী ড. মিগুয়েল নিকোনোলিস এক দশক ধরে মস্তিষ্ক এবং যন্ত্রের কার্যক্রমের মধ্যকার সংযোগ নিরীক্ষা করে দেখেছেন। তার গবেষণা মূলত ছিল ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস বিষয়ে। তিনি আশা করছেন, এই ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে পারলে মননিয়ন্ত্রিত অঙ্গ তৈরি করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি যাদের মস্তিষ্ক এবং পেশী অচল হয়ে পড়েছে প্রযুক্তি তাদের সেই প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে সহায়ক হবে।
বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই দেখেছেন বানরের মস্তিষ্কের ভেতরে যন্ত্র বসিয়ে সেই বানরের মনের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃত্রিম বাহু নড়াচড়া করানো সম্ভব হয়েছে। নিকোনোলিস বলেন, তারা দেখেছেন ইলেকট্রোডের ধারণ করা সংকেতে কমপিউটার সফটওয়্যার বিঘ্ন ঘটাতে সক্ষম। তাই ব্রেইন মেশিন ইন্টারফেস স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিসহ এধরনের সব রোগীর স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে সহায়ক হবে। তিনি ওয়াক এগেইন নামে একটি প্রকল্পে কাজ করছেন। ওই প্রকল্প হচ্ছে পক্ষাঘাতগ্রস্তরা যাতে মস্তিষ্কের সংকেত ব্যবহার করে হাঁটতে পারে তেমন যন্ত্রের উন্নয়ন ঘটানোবিষয়ক।
মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের বস্ত্ত বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড মার্টিন বলেছেন, মানুষের মস্তিষ্কে নিরাপদে ইলেকট্রোড এবং যন্ত্র প্রতিস্থাপনের বিষয়ে এখনো বেশ জটিলতা রয়েছে। বিজ্ঞানীরা অবশ্য নিরাপদ উপায়ের সন্ধান অব্যাহত রেখেছেন। যন্ত্রগুলো সাধারণত হয় ধাতুর তৈরি শক্ত এবং ফ্ল্যাট। তাই জীবন্ত টিস্যুর মধ্যে এটি স্থাপন বেশ জটিল কাজ। কোনো কোষ ক্ষতিগ্রস্ত না করে কিভাবে দেহে যন্ত্র স্থাপন করা যায় তার নিরাপদ উপায় বের করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com