ধরুন টেলিভিশনে রান্নার কোনো অনুষ্ঠান চলছে। আপনি টেলিভিশন সেটটি চালু করলেন। রান্নার বিভিন্ন পর্যায়ে তেল, মসলাসহ অন্যান্য জিনিস মাখিয়ে পাত্র করে যখন চুলায় দেয়া হলো, তখন সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে থাকলো নানা ধরনের সুঘ্রাণ। আপনি সেটের সামনে বসেই রান্নার সেই ঘ্রাণ পেলেন। তাহলে কেমন হয়? নিশ্চয়ই অসাধারণ একটা ব্যাপার হবে সেটি। আপনাকে অসাধারণের সেই স্বাদ সম্ভবত দিয়েই ছাড়বেন গবেষকেরা। তারা এখন সেই বিষয়টি নিয়েই কাজ করছেন।
ভবিষ্যতে আপনি টেলিভিশন দেখার পাশাপাশি ঘ্রাণও পাবেন। সেই আয়োজনই চলছে। একই সাথে গোলাগুলি বা সহিংস কোনো অবস্থার অনুভূতিও পাবেন কি না তা অবশ্য এখনই দিব্যি করে বলা যাচ্ছে না। তবে খুব সহসাই এমনটি হচ্ছে না। এজন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে বেশ কিছুদিন। প্রযুক্তির উন্নয়নের পথ ধরে একদিন ঠিক হাজির হবে এমনটি। কেমন হবে সেই প্রযুক্তি- বিশ্বব্যাপী আজকের ভাবনা সেটাই।
থ্রিডি অর্থাৎ ত্রিমাত্রিক প্রযুক্তিকে এখন আর ভবিষ্যতের কোনো প্রযুক্তি বলে মানছেন না কেউ। কারণ, ইতোমধ্যেই এটি পৌঁছে গেছে আপনার দুয়ারে। যদিও ব্যাপকভাবে এটি ছড়িয়ে পড়েনি। থ্রিডি চলচ্চিত্র বা অনুষ্ঠান দেখতে হলে এখনো চোখে পরে থাকতে হয় বিশেষ ধরনের চশমা, যা বিরক্তিকর বলে মনে করছেন দর্শকরা। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসারও উপায় খোঁজা হচ্ছে। কারণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে চোখে বিশ্রি ধরনের চশমা পরে থাকায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার কারণ নেই। থ্রিডি ছাড়াও অধিক স্বচ্ছ ছবি প্রদর্শনের জন্য আগেই উদ্ভাবিত হয়েছে এইচডি অর্থাৎ হাইডেফিনিশন প্রযুক্তি। কিন্তু এটিকেও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি বলার উপায় নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সম্প্রসারিত হয়েছে এই এইচডি প্রযুক্তি। তাই ভবিষ্যতে কোন প্রযুক্তি আসতে যাচ্ছে, সে দিকেই তাকিয়ে আছে প্রযুক্তিপ্রেমীরা।
এই উভয় প্রযুক্তিরই মূল উদ্দেশ্য হলো চলচ্চিত্র, গেম বা বিনোদনমূলক যেকোনো অনুষ্ঠানের বাস্তব অনুভূতি দর্শকদের কাছে তুলে ধরা। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও এ কাজে এই প্রযুক্তিদ্বয়কে যথেষ্ট সফল বলা চলে। দ্বিমাত্রিকের চেয়ে ত্রিমাত্রিকে গিয়ে দর্শকরা এখন অনেক বেশি রোমাঞ্চকর অনুভূতির সাথে উপভোগ করতে পারছে চলচ্চিত্রসহ নানা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠন। তারা নিজেদের প্রকৃত অর্থেই চলচ্চিত্র বা গেমের অংশীদার করতে পারছে। অর্থাৎ চলচ্চিত্র বা গেমে নিজেদের একাকার করে ফেলছে। তাই অনুভূতির দিক দিয়ে দর্শকরা হয়ে যাচ্ছে ওই সবের অংশ। ফলে গেম ও বিনোদনপিয়াসীরা এদিকেই আগ্রহী হয়ে উঠছে।
চলচ্চিত্র পরিচালকরাও এখন ত্রিমাত্রিক ছবি তৈরির দিকে ঝুঁকছেন। এরা ঠিকই উপলব্ধি করতে পারছেন যে, ভবিষ্যৎ বাজার রয়েছে এদিকেই। তাই যতটা এগিয়ে থাকা যায়। ইতোমধ্যেই বক্স অফিস হিট করা চলচ্চিত্র অ্যাভাটার এবং এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে থ্রিডি ফরমেটে। আইপিএলের সেমিফাইনাল খেলাটিও সম্প্রচার করা হয় থ্রিডি প্রযুক্তিতে। এনভিডিয়া থ্রিডি ভিশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখা যাচ্ছে কিছু থ্রিডি সমর্থিত গেম। কিন্তু দর্শকরা এতে সন্তুষ্ট নয়। কারণ, ত্রিমাত্রিক কিছু দেখতে হলে তাদের চোখে সারাক্ষণ পরে থাকতে হচ্ছে বিশেষ ধরনের চশমা, যা তাদের স্বাচ্ছন্দ্য দিচ্ছে না।
তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। সিইএস ২০১০-এ এমন কিছু প্রযুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে, যা আশা জাগানিয়া। এমন টেলিভিশন আসতে যাচ্ছে যার মাধ্যমে ঘরে বসেই উপভোগ করা যাবে ত্রিমাত্রিক অনুষ্ঠান, যা দেখতে দর্শন চশমা পরার প্রয়োজন হবে না।
বিখ্যাত চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্টেল চলতি বছর ইসিএসে চশমা ছাড়া থ্রিডি প্রযুক্তি দেখিয়েছে অ্যালিওস্কোপি স্ক্রিনে। তারা এজন্য ৮টি বুথ স্থাপন করে। এই বুথের ৮টি অবস্থান থেকে স্ক্রিনে চিত্রের গভীরতা প্রদর্শন করা হয়। ৮টি অবস্থান থেকেই একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। তারা একে বলছে অটো স্টেরিওস্কোপিক ডিসপেস্ন। এনইসি, স্যামসাং এবং ফিলিপসসহ বহু প্রতিষ্ঠান এ ধরনের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের গবেষকরা এ কাজে যথেষ্ট এগিয়েও গেছেন বলে দাবি করা হয়।
থ্রিডি আই সলিউশন্স নামের এমন প্রতিষ্ঠানও রয়েছে যারা যেকোনো ফুটেজকে থ্রিডিতে কনভার্ট করতে সক্ষম। তাই অদূর ভবিষ্যতে যে থ্রিডি টিভি চ্যানেলের আবির্ভাব ঘটবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যেই বহু প্রতিষ্ঠান থ্রিডি ফরমেটের অনুষ্ঠান তৈরি ও সম্প্রচার শুরু করেছে। ভবিষ্যতে যে এই সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপটিক্যাল সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক নাসের পিগহ্যামবারিয়ান উন্নয়ন ঘটাচ্ছেন এমন ধরনের স্ক্রিনের, যা বেশ কয়েক মিনিটে নিজে নিজেই রিফ্রেশ হতে সক্ষম। প্রচলিত ‘হলো টিভিতে’ প্রতি সেকেন্ডে কয়েকবার রিফ্রেশ হতে হয়। এদিকে মোশন প্যারালাক্সকে ভাবা হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মের প্রযুক্তি হিসেবে। এ নিয়ে এখনও তেমন কাজ হয়নি। তবে গবেষকদের বিশ্বাস একদিন এ প্রযুক্তি দখল করবে বিশ্ব বাজার। এ জন্য এখন কেবল অপেক্ষার পালা।
গেম খেলার সময় যাতে খেলোয়াড় গেমের সত্যিকার পরিস্থিতি অনুভব করতে পারে সে জন্য থ্রিডি স্পেস ভেস্ট তৈরি করেছে টিএন গেমস। এটি এমন ধরনের জ্যাকেট যা পরে থাকলে গেম খেলার সময় গোলাগুলি গায়ে লাগলে যেমন অনুভূতি হয় ঠিক তেমনটাই পাওয়া যাবে। মাথায় গুলি লাগলে কেমন হয় অনুভূতি তা বুঝতে তারা তৈরি করছে এইচটিএক্স হেলমেট। শিগগিরই এটি বাজারে আসছে। এ সব কিছুই উদ্ভাবন করা হচ্ছে ব্যবহারকারীকে কোনো পরিস্থিতির বাস্তব অনুভূতি দেয়ার জন্য। এই সাথে ব্যবসায়ের বিষয়টি তো রয়েছেই।
ফিলিপসের গবেষকরা উন্নয়ন ঘটিয়েছেন অ্যামবিয়ান্ট এক্সপেরিয়েন্স সংক্ষেপে অ্যামবিএক্স প্রযুক্তির। এর মাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছে ‘সেন্সরি সারাউন্ড’ বিনোদন অভিজ্ঞতা। অ্যামবিএক্স কনটেন্টে পাওয়া যাচ্ছে গেমের প্রকৃত স্বাদ। ফিলিপসের বেশ কিছু গেমিং সরঞ্জাম ইতোমধ্যেই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, যা ব্যবহারকারীদের দিচ্ছে গেম খেলার বাস্তব অনুভূতি। এই খাতে তারা আরো কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে।
ভার্চুয়াল রিয়েলিটি নিয়েও অনেক কাজ করা হচ্ছে। বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পকাহিনীতে হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নানা দৃশ্য। বাস্তব অস্তিত্ব নেই, তবু ভেসে আছে চোখের সামনে। কখনো কখনো তাদের কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে স্পর্শের অনুভূতি। বিজ্ঞান আমাদের ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, ভাবতে অবাক লাগে। ভবিষ্যতে যে এমন আরো বহু অবাক করা বিষয় আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই।
টেলিভিশন সেটের সামনে বসে রান্নার অনুষ্ঠান দেখার সময় যখন সেই রান্নার ঘ্রাণ আপনাকে মোহিত করবে, তখন আপনি অবাক হলেও বিজ্ঞান থেমে থাকবে না। এক সময় হয়তো ঘ্রাণের সাথে সাথে আপনি পেয়ে যাবেন রান্নার স্বাদও। তবে সহসাই সেই দিন আসছে না। এজন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com