জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯ এবং প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বর্তমান বিশ্বে উন্নয়নের অন্যতম উপাদান হিসেবে পরিগণিত এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজের মূল চালিকাশক্তি এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি সম্প্রসারণ ও বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে একটি স্বচ্ছ, দায়বদ্ধ ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারের কর্ম-প্রক্রিয়া, ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বর্তমান সরকার জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯ গ্রহণ করেছে। একটি মাত্র রূপকল্প, ১০টি উদ্দেশ্য, ৫৬টি কৌশলগত বিষয়বসুত এবং ৩০৬টি করণীয় বিষয়কে এ নীতিমালায় পিরামিড আকারে ক্রমবিভক্ত করে সাজানো হয়েছে। জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯ বাস্তবায়নে করণীয় বিষয়সমূহকে স্বল্প (১৮ মাস বা তার কম সময়), মধ্য (৫ বছর বা তার কম সময়) ও দীর্ঘ (১০ বছর বা তার কম সময়) মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/দফতর/ সংস্থাভিত্তিক বিন্যস্ত করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ‘রূপকল্প ২০২১ : ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার কাজ ত্বরান্বিত হবে বলে আমরা আশা করছি। এ নীতিমালা রাষ্ট্রের সব পরিকল্পনাবিদ এবং নির্বাহী কর্মকর্তার জন্য একটি পালনীয় নির্দেশিকা। একই সাথে এটি ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনিয়োগ, এনজিও এবং সুশীল সমাজের জন্য সামাজিক উদ্যোগ এবং ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে জনসেবা প্রদানের জন্য একটি সার্বিক নির্দেশনা। অর্থাৎ তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার বাড়ানোর মাধ্যমে তার সুফল সর্বস্তরের মানুয়ের কাছে পৌঁছে দেবার লক্ষ্যে জনপ্রশাসনের জন্য পালনীয় নির্দেশিকাই হচ্ছে জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯।
বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের ওয়েবপেজে (www.bcc.net.bd) পিডিএফ ফরমেটে দেয়া উক্ত নীতিমালায় দেখা যায় সরকার নিয়ন্ত্রিত ৪৯টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থাওয়ারী, কৌশলগত বিষয়বস্ত্ত, নীতিমালার ক্রমিক নম্বর, করণীয় বিষয়, প্রাথমিক ও সহায়ক বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, প্রত্যাশিত ফল এবং একই সাথে বাস্তবায়নের সময় ইত্যাদি বিষয় আলাদা করে টেবিল আকারে দেখানো হয়েছে যা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এতে করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান খুব সহজে তাদের করণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে অবহিত হয়ে প্রত্যাশিত ফল প্রপ্তির লক্ষ্যে সার্বিক নির্দেশনা বাস্তবায়নের পথে এগুতে পারবে সুচারুভাবে।
৪৯টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থাওয়ারী করণীয় বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক করণীয় বিষয় হিসেবে নীতিমালার ক্রমিক নম্বর ৯৬কে দেয়া হয়েছে যেখানে বলা আছে ‘সরকারি পর্যায়ের সব প্রতিষ্ঠানে আইসিটি পেশাজীবী দিয়ে সজ্জিত আইসিটি সেল স্থাপন। এ সেলের জন্য আইসিটি সংশ্লিষ্ট পদ সৃজন করা। সরকারি পর্যায়ের সব আইসিটিসংশ্লিষ্ট পদকে কারিগরি পদ হিসেবে চিহ্নিতকরণ’। এখানে একটি প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক আর তা হলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের জন্য আইসিটি সেলের ন্যূনতম আকার/কাঠামো কেমন হওয়া উচিত বা এ সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা কোথাও আছে কি না? এটা স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন বলে আমার ধারণা।
আইসিটি পেশাজীবীর মাধ্যমে সজ্জিত আইসিটি সেল স্থাপন করার কথাও এখানে বলা হয়েছে, কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে উল্লেখ করতে হচ্ছে ১৯৮৫ সালে তৎকালীন সরকারের প্রণীত কমপিউটার প্রফেশনাল রিক্রুটমেন্ট রোলস, ১৯৮৫ (NO. S.R.O 104-L/85/ME/RI/R-9/84)-এ কমপিউটার প্রফেশনাল (সহকারী প্রোগ্রামার/প্রোগ্রামার/সিস্টেম অ্যানালিস্ট/সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্ট/সিস্টেম ম্যানেজার) হিসেবে আবেদন করতে/নিয়োগ পেতে যোগ্যতা হিসেবে যেকোনো বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি বা বিএসসি (ইঞ্জিনিয়ারিং) অথবা কমপিউটার সায়েন্সে ডিগ্রি। অথবা ক্ষেত্রবিশেষে নির্দিষ্ট কিছু পদে কমপিউটার সায়েন্স ছাড়া অন্যান্য কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করে মাস্টার্স ডিগ্রি চাওয়া হয়েছে। ১৯৮৫ সালে যখন আইনটি করা হয়েছিল তখন কমপিউটার সায়েন্স/ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত প্রার্থী পাওয়া যাবে না বিবেচনা করে হয়তোবা এমনটা করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশেই প্রতিবছর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আট-দশ হাজার কমপিউটার সায়েন্স/ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে গ্র্যাজুয়েট তৈরি হচ্ছে। সুতরাং আইনটি পুনর্বিবেচনা করে সময়োপযোগী করা প্রয়োজন। অন্যথায় আইসিটি পেশাজীবী দিয়ে সজ্জিত আইসিটি সেল স্থাপন করা সম্ভব নাও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে নীতিমালায় উল্লিখিত-প্রত্যাশিত ফলপ্রাপ্তিতে ব্যত্যয় হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আশার কথা বিজ্ঞান এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নীতিমালা-২০০৯-এর নির্দেশনা অনুযায়ী বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের আইসিটি কার্যক্রমের বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য ফোকাল পয়েন্টদের সমন্বয়ে প্রায়শ সভার আয়োজন করে থাকে। এতে করে কিছুটা হলেও স্ব স্ব মন্ত্রণালয়/বিভাগের আইসিটি কার্যক্রমের বাস্তবায়ন অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত হওয়া সম্ভব। বিজ্ঞান মন্ত্রণালয় চাইলে উক্ত সভায় আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরামের সদস্য/ বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদেরও আমন্ত্রণ জানাতে পারে, যারা এসব কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়ে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে গণমানুষের কাছে সেবার বাণীগুলো পৌঁছে দিতে পারবেন। এতে করে সরকারের আইসিটিবিষয়ক কার্যক্রম ও সেবা সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অবহিত হয়ে তা ব্যবহার করে খুব সহজে সুফল ভোগ করতে পারবেন। স্ব স্ব মন্ত্রণালয়/বিভাগের ফোকাল পয়েন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আইসিটি জ্ঞানসম্পন্ন কর্মকর্তাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। অভিজ্ঞ ও ওষুধ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানসম্পন্ন ডাক্তারই দিতে পারেন একজন অসুস্থ ব্যক্তির জন্য তার রোগের সঠিক চিকিৎসা পরামর্শ।
মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ
...........................................................................................
সত্যিই কি পাবো ১০-১২ হাজার টাকায় ল্যাপটপ
প্রতি শিশুর হাতে একশত ডলারের ল্যাপটপের দাবি জানিয়ে কয়েক বছর আগে কমপিউটার জগৎ-এ একটি লেখা ছাপানো হয়েছিল। যা পড়ে আমি মনে মনে হেসে ছিলাম, শিশুদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে ‘ওয়ান ল্যাপটপ পার চিলড্রেন অ্যাসোসিয়েশনের’ এক উদ্যোগ ছিল এটি। এ কর্মকান্ড চালু করেন নিকোলাস নেগ্রোপন্টে। তখন আমার কাছে মনে হয়েছে এটি নিছকই পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। এমনটি বিশ্বের সব দেশের জন্য প্রযোজ্য হলেও বাংলাদেশের জন্য সম্ভব নয়। এটি আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি।
আমার এ বধ্যমূল ধারণার ভিত কিছুটাও টলাতে পারেনি অক্টোবর ২০০৯-এ কমপিউটার জগৎ-এ প্রকাশিত খবর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেশিস তৈরি করবে মোবাইল ফোনসেট ও ল্যাপটপ। যেহেতু বাংলাদেশের কোনো কাজ সরকারি উদ্যোগে যথাসময়ে সম্পন্ন হয়নি আজ পর্যন্ত। সুতরাং এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হবে না।
কমপিউটার জগৎ মার্চ ২০১০-এ প্রকাশিত আরেক খবর পড়ে জানা যায়, জুনের মধ্যেই পাওয়া যাবে ১২ হাজার টাকার ল্যাপটপ যা তৈরি করবে টেলিশিল্প সংস্থা তথা টেশিস। টেশিস আগামী জুন মাসের মধ্যে মালয়েশিয়ার প্রতিষ্ঠান থিঙ্ক ফিল্ম ট্রানজিস্টার তথা টিএফটির সাথে যৌথ উদ্যোগে ১২ হাজার টাকায় ল্যাপটপ তৈরি ও বিক্রি করবে। মাসে ১০ হাজার ল্যাপটপ তৈরির প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের বেশিরভাগই স্থানীয়ভাবে তৈরি করা হবে।
এ খবর আমার কাছে অভিশ্বাস্য মনে হলেও বিশ্বাস করতে মন চাইছে। কেননা এ সরকার এক প্রযুক্তিবান্ধব সরকার। সরকারের লক্ষ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া। এ লক্ষ্যে সরকার বেশ কাজ করছে যা ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা ২০১০-এ সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। সরকার ও দেশের জনগণের মধ্যে যে আইসিটি নিয়ে প্রণোদনা সৃষ্টি হয়েছে, আমার মতো অনেকেই আশা করতে পারেন অন্তত এবার কথার সাথে কাজের সমন্বয় ঘটবে। আমরা অতীতের মতো এবার অন্তত আশাহত হতে চাই না। সুতরাং টেশিস যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে তা যেন বাস্তবায়িত হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
রজিম
চাষাঢ়া, নারায়ণঞ্জ