মহাকাশযান ডিসকোভারিতে করে আগামী সেপ্টেম্বরে যে ৬ নভোচারী কক্ষপথে যাবেন তাদের সাথে আরো একজন থাকবেন। তিনি হলেন রোবনাট ২। সংক্ষেপে আর ২। এটি একটি সেমি হিউম্যানয়েড বা আধা মানুষের মতো রোবট। তৈরি করেছে যৌথভাবে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা এবং জেনারেল মোটরস তথা জিএম। ওজন ৩০০ পাউন্ড বা ১৩৭ কিলোগ্রাম। এটাই হবে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে তার প্রথম সফর। একই রকমের আরেকটি আর ২ থাকবে পৃথিবীতে, যাকে নিয়ে আরো গবেষণা করা হবে। মহাকাশেও যে মানুষ ও রোবট কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে পারে আর ২-এর এই সফর হবে তারই একটি ধাপ মাত্র। এর রয়েছে রোবট মাথা, দেহ এবং ৫ আঙ্গুলসহ দুইটি হাত। শূন্য মধ্যাকর্ষণে রোবটটি কি ধরনের আচরণ করে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
নাসার এক্সপ্লোরেশন সিস্টেমস ইন্টিগ্রেশন অফিসের পরিচালক জন অলসন বলেছেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রোবট যে পৃথিবীতে এবং মহাকাশে মানুষের পাশাপাশি দায়িত্ব পালন করে যাবে তার একটি উদাহরণ এটি। তবে রোবট কখনোই মানুষের স্থান দখল করতে সক্ষম হবে না। মানুষের সহযোগী হিসেবে কাজ করবে মাত্র। তিনি বলেন, মানুষ এবং রোবটের এই যৌথ কর্মকান্ড যেকোনো কাজে সঠিকতা ও সাফল্য এনে দেবে। এই সাফল্যের মাত্রা হতে পারে এমন, যা আজকের দিনে কেউ ভাবতেই পারছেন না।
অত্যাধুনিক রোবট তৈরির জন্য দীর্ঘদিন ধরেই নাসার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে জিএম। তারই পথ ধরে উদ্ভাবিত হয়েছে রোবট ২। এটি এখন পরীক্ষা করে দেখার জন্য প্রস্ত্তত রয়েছে। মহাকাশযান, স্টেশন কিংবা স্বয়ংক্রিয় কারখানায় রোবট হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি টুল বা উপাদান।
নাসার কাছে ইতোমধ্যেই কানাডার নির্মিত একটি রোবট রয়েছে, যা অত্যন্ত দক্ষ এবং এর রয়েছে কুশলী হাত। নাম ডেক্সটার। মহাকাশ স্টেশনের বাইরেও কাজের জন্য এটি তৈরি রয়েছে। এখন আর ২ সেই ডেক্সটারের কার্যক্রমকে একটি নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। জিএম-এর গ্লোবাল রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যালান টাউব বলেছেন, মহাকাশ মিশনের জন্য যেসব রোবট প্রয়োজন হয়, তাদের ঠিক কি ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়, তা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। সমস্যার বিষয়গুলো চিহ্নিত করে তা সমাধানের কাজ করা হবে। জিএম-এর এখন প্রয়োজন এমন হাতওয়ালা রোবট যারা নমনীয় জিনিসপত্র তুলতে ও স্থানান্তর করতে সক্ষম হবে। এমনকি প্রয়োজনে তা ধ্বংস করে দিতে পারবে। এমন কিছু নমনীয় পদার্থ রয়েছে যা নড়াচড়া মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সেই কাজগুলো যদি বিশেষভাবে নির্মিত রোবট দিয়ে করা যায়, তাহলে মানুষের ঝুঁকি বহুগুণে কমে যাবে। নভোচারীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ এমন কিছু কাজ রোবটকে দিয়ে করানো নভোচারীরা গবেষণা কাজে অধিক সময় দিতে পারবেন।
টাউব বলেন, মহাকাশ স্টেশনে কোনো মেরামতের কাজে রোবট ব্যবহার জরুরি হয়ে পড়েছে। নভোচারীরা এ কাজটিকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। কিন্তু আর ২ এখনো পুরোপুরিভাবে তৈরি নয়। এর প্রাথমিক সংস্করণ বা প্রটোটাইপ বানান হয়েছে মাত্র। ফলে তাকে দিয়ে এখনই স্পর্শকাতর কাজ করানো যাচ্ছে না। এটি মহাকাশের বৈরী আবহাওয়ায় নিজেকে টিকিয়ে রাখার মতো সামর্থ্য এখনো অর্জন করেনি। তাই আগামী সফরে আর ২-কে মহাকাশ স্টেশনের ভেতরে স্থাপিত ডেসটিনি ল্যাবরেটরিতেই বসে থাকতে হবে। এখন যেটি বোঝা যাবে তা হলো ওজন শূন্য অবস্থায় এর অবস্থা কি হয় এবং তেজস্ক্রিয়তা সে কিভাবে মোকাবেলা করে।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে এখন বায়ুশূন্য অবস্থায় আর ২-এর আচরণ এবং কম্পন মোকাবেলার সামর্থ্য পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এক সময় এই আর ২ একইভাবে চষে বেড়াবে মহাকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। পৃথিবীতে যেমন দক্ষতার সাথে কাজ করবে, মহাকাশেও দেখা যাবে তার একই রূপ। মানুষ এবং রোবট ডেক্সটার যেভাবে মহাকাশ স্টেশনের বাইরে পদচারণা করে থাকে আর ২ও তাই করবে।
রোবনাট ২ ঠিক কতটা পথ যেতে পারবে সে ব্যাপারে নাসা এবং জিএম-এর কোনো ভবিষ্যদ্বাণী নেই। আছে কেবল আশাবাদ। এই ফিল্ডে নাসার সাথে যে কেবল জিএম আছে তা নয়। ফোর্ড এবং ইউনাইটেড স্পেস অ্যালায়েন্সও এ কাজে বহুদূর এগিয়ে গেছে। তাই আগামী দিনে আমাদের সামনে আসতে যাচ্ছে অগ্রসর প্রজন্মের হিউম্যানয়েড রোবট। ইউনাইটেড স্পেস অ্যালায়েন্স নাসাকে সাথে নিয়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সিমুলেশন সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছে। মহাকাশযান কিংবা গাড়ি তৈরির আগে নকশার ফাইন টিউন করার জন্য ওই সফটওয়্যার ব্যবহার করা যেতে পারে।
হিউম্যানয়েড রোবট রোবনাট ২ যেমন তৈরি করেছেন নাসা এবং জিএম-এর প্রকৌশলীরা একত্রে গবেষণা করে। তেমনি নাসার সাথে অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান যুক্ত হচ্ছে তারাও উদ্ভাবনে সক্ষম হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রযুক্তিপণ্য। রোবনাট ২ কাজ করবে মানুষের অতিরিক্ত সাহায্যকারী হিসেবে, মানুষের বিকল্প হিসেবে নয়। এর আগে নাসা এবং পেন্টাগনের ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি তৈরি করে রোবনাট। রোবনাট ২ হচ্ছে তারই আধুনিক সংস্করণ। নাসার রোবনাট প্রকল্পের ব্যবস্থাপক রন ডিফলার বলেছেন, রোবনাট ২-এর মানবদেহ, মাথা, বাহু, হাত ও আঙ্গুল রয়েছে। এখন তার পায়ের বিষয়টি নিয়ে ভাবা হচ্ছে, যাতে করে তার পক্ষে দ্রুত চলাচল সম্ভব হয়। আপাতত চলাচলের জন্য চাকা বা একটি পায়ের ব্যবস্থা হতে পারে। চলাচলের একাধিক বিকল্প রাখার কথাও ভাবা হচ্ছে। দেহের নিচের অংশটা হবে ভিন্ন ধরনের, প্রচলিত রোবটের মতো নয়। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে কর্মরত রোবটদের এমন পা থাকা দরকার, যাতে করে তার পক্ষে পা রাখার গর্তে (ফুট হোল) পা আটকে রাখা সম্ভব হয়। মানুষের জন্য ওই গর্ত রয়েছে। এখন রোবটের যদি একটি পা থাকে তাহলে সে খুব সহজেই প্রয়োজনের সময় ফুট হোলে পা আটকে রাখতে পারবে। নভোচারীদের যেমন কখনো কখনো হামাগুড়ি দিয়ে পথ চলতে হয়, তেমনি রোবটেরও তা প্রয়োজন হতে পারে। এক্ষেত্রে রোবটের নকশা করতে হবে এমনভাবে, যাতে করে তার পক্ষে মানুষের মতোই হামাগুড়ি দিয়ে পথচলা সম্ভব হয়।
কারখানায় যেসব রোবট ব্যবহার হয় তাদের জন্য চলাচলের সামর্থ্য থাকা জরুরি নয়। অ্যালান টাউব বলেন, হাত এবং আঙ্গুলগুলো রোবটের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোনো কিছু ধরার এবং স্থানান্তরের জন্য তার থাকতে হবে নমনীয় আঙ্গুল। রোবনাট ২-এর ক্ষেত্রেও সেই শর্ত পূরণ করা হয়েছে। যতটা সম্ভব মানুষের মতো হাত তৈরি করা হয়েছে আর ২-এর।
জিএম-এর পরিকল্পনা অনুযায়ী তার ভবিষ্যৎ রোবটেরা হবে স্বায়ত্তশাসিত। মানুষের নির্দেশনা ছাড়াই তারা নিজ দায়িত্ব পালন করে যাবে। যদিও নাসা এখন চাইছে দূর নিয়ন্ত্রিত রোবট। একটা পর্যায়ে এসে রোবট হতে পারে নভোচারীদের বিকল্প। তার আগে রোবটকে সহযোগী হিসেবেই রাখতে চায় নাসা। নভোচারীদের গবেষণা কাজ কিংবা স্টেশনের মেরামত কাজে রোবট তার ক্যামেরা ও সেন্সর দিয়ে কাজটি নিখুঁত করতে সহায়তা করতে পারে। আপাতত এটাই প্রয়োজন।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com