লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
হিটলার এ. হালিম
মোট লেখা:১৪
লেখা সম্পর্কিত
মোবাইল ফোন অপারেটরদের আপত্তিতেই বাতিল ভ্যাস লাইসেন্স
ভ্যাস থেকে অপারেটরগুলোর রাজস্ব আসে ৩০ শতাংশ
দেশের ৬ মোবাইল ফোন অপারেটরের প্রবল আপত্তির কারণেই বাতিল হয়েছে ভ্যাস (মূল্য সংযোজিত সেবা)। ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় মূলত অপারেটরদের দাবি মেনে নিয়ে চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা ভ্যাস লাইসেন্সিং গাইডলাইন-২০১২ বাতিল করে। ফলে ভ্যাসের শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়। যদিও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় বলেছে, ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের মার্কেট ও ভ্যালু চেইনের সাথে সংশ্লিষ্ট পক্ষকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন। আইপিআরসহ সব পক্ষের অধিকার ও প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ সুফল নিশ্চিত করে সব পক্ষের প্রাপ্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠা, নতুন প্রযুক্তির প্রচলন, কর্মসংস্থান এবং দেশীয় পেশাদারদের সক্ষমতা বাড়ানো ইত্যাদি বিবেচনায় এনে করণীয় নির্ধারণ করা যেতে পারে। এসব বিষয় পর্যালোচনার জন্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে মত দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এটি আসলে লোক দেখানো। মোবাইল ফোন অপারেটরদের ভ্যাস নিয়ে ব্যবসায় করার সুযোগ দেয়ার জন্যই নীতিমালা বাতিল করে লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছে। এর ফলে অপারেটরেরা একচেটিয়া ভ্যাস ব্যবসায় করতে পারবে।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা তথা বিটিআরসির এক পরিচালক জানান, মোবাইল ফোন অপারেটরদের ৩০ শতাংশ রাজস্ব আয় হয় ভ্যাস থেকে। যদিও এরা তা স্বীকার করে না। এরা কেনো এর নিয়ন্ত্রণ ও লাইসেন্স চাইবে- প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি বলেন, এয়ারটেল এখন ৮০ শতাংশ, রবি ৬০-৭০ শতাংশ রাজস্ব ভাগাভাগি করে ভ্যাস থেকে। গ্রামীণফোন করে ৫০ শতাংশ। লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া শুরু হলে ভ্যাসের বিশাল অংশ অপারেটরেরা নিতে পারবে না।
এদিকে মোবাইল কনটেন্ট নির্মাতাদের (সিপি) নিয়ন্ত্রণে ভ্যাস গাইডলাইন বা দিকনির্দেশনার খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকাকালে মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকের সিদ্ধান্তে তা বাতিল হয়। মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তৎকালীন সচিবের নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব, বিটিআরসির প্রতিনিধি, ৬ মোবাইল ফোন অপারেটরের প্রতিনিধি, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস), সিপিএএবি, অ্যামটবের প্রতিনিধি ও আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ভ্যাস লাইসেন্সের বিরুদ্ধে মোবাইল ফোন অপারেটরেরা জোরালো ভাষায় কথা বললেও এর পক্ষে অবস্থানকারীদের (বেসিস ও সিপিএএবি) বক্তব্য তেমন জোরালো ছিল না। অপারেটরদের দাবি, খসড়া গাইডলাইনে ভ্যাসের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। কীভাবে এ সেবা ব্যবহার হবে, কে এ থেকে কীভাবে উপকৃত হবে, সার্ভিসের উৎস ও ব্যবহারকারী কে হবে এবং কীভাবে আর্থিক বিষয়াদি নিষ্পন্ন হবে সেসবের স্পষ্ট ধারণা ছিল না।
অন্যদিকে টুজি লাইসেন্স নবায়নে অপারেটরদের প্রদেয় সেবার তালিকায় ভ্যাসের কথা উল্লেখ আছে। এ ছাড়া থ্রিজির মূলই হলো ভ্যাস। ভ্যাসের গাইডলাইনে মোবাইল অপারেটরেরা এ ধরনের সেবা দিতে পারবে না বলে যে শর্ত রয়েছে, বর্তমান বাজারের সাথে তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভ্যাস নীতিমালার খসড়া তৈরির আগে কেনো মোবাইল ফোন অপারেটরদের সাথে আলোচনা করা হয়নি সে বিষয়েও অপারেটরের প্রতিনিধিরা বিষোদগার করেন।
তাদের যুক্তি আইপিআর (মেধাস্বত্ব) সংরক্ষণের বিষয়ে গাইডলাইনে কোনো সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা নেই। শিল্পীদের রয়্যালিটি কীভাবে নিষ্পন্ন হবে সেসব বিষয় এতে উল্লেখ না থাকায় এটি কোনো ভালো গাইডলাইন হতে পারে না। বিদেশী বিনিয়োগ নিষিদ্ধ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট শর্ত নতুন প্রযুক্তি ও সেবা প্রচলনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করে মোবাইল ফোন অপারেটরেরা।
অন্যদিকে বেসিস ও সিপিএএবি প্রতিনিধিরা সভায় জানান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় ভ্যাসের লাইসেন্স দেয়া হয়। দেশেও এ লাইসেন্স দেয়া হলে কর্মসংস্থান বাড়াসহ ডেভেলপারদের সক্ষমতা আরও বাড়বে বলে এরা অভিমত দেন। ওই সভার সভাপতি কনটেন্ট প্রোভাইডারদের এসব শর্তে লাইসেন্স দেয়ার উদাহরণ অন্য কোনো দেশে থাকলে তা পর্যালোচনার পরামর্শ দেন। তিনি উল্লেখ করেন, লাইসেন্সের গাইডলাইনের শর্ত এমন হতে হবে যেনো এর সাথে জড়িত কোনো পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। মূলত এ কথার পরই লাইসেন্সপ্রত্যাশীদের কাছে মেসেজ স্পষ্ট হয়ে যায়, ভ্যাস লাইসেন্স আর হচ্ছে না।
সিটিসেলের প্রধান নির্বাহী মেহবুব চৌধুরী বলেন, অপারেটরেরা ভ্যাস ব্যবসায় করে না। আমরা এর অ্যাপিস্নকেশন ডেভেলমেন্টের দিকে নজর দিতে চাচ্ছি। অপারেটরেরা ভ্যাসকে সাপোর্ট দিতে চায়।
এ প্রসঙ্গে বিটিআরসি চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস বলেন, এখন ভ্যাস নীতিমালা না হলেও কোনো ক্ষতি নেই। সময়ের প্রয়োজনেই ভ্যাস নীতিমালা আসবে। তখন লাইসেন্সও দেয়া হবে। তিনি থ্রিজি প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, থ্রিজি চালু হলে যে পরিমাণ ভ্যাসের চাহিদা তৈরি হবে তখন অপারেটরগুলোকে বাইরে থেকে কনটেন্ট কিনতেই হবে। সে সময় তৈরি হবে প্রতিযোগিতা। ওই প্রতিযোগিতা যাতে সুষ্ঠু ও সুস্থ হয় সেটা আমরা দেখব। আমরাই তখন লাইসেন্সের কথা বলব। প্রয়োজনেই নীতিমালা তৈরি হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যে অপারেটর যত বেশি কনটেন্ট দিতে পারবে সেই অপারেটর তত বেশি গ্রাহক পাবে। এখন অপারেটর যদি গ্রাহক ধরতে চায় তাহলে তাকে বাইরে থেকে ভালো মানের কনটেন্ট কিনতেই হবে। তিনি সিপিগুলোকে হতাশ না হয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আহবান জানান
৮০০ কোটি টাকার কনটেন্ট বাজার
সম্প্রতি মোবাইল ফোনে নিউজ সার্ভিস, স্পোর্টস অ্যালার্ট, রিংটোন, ওয়েলকাম টিউন, গান, ওয়াল পেপার, অ্যানিমেশনসহ বিভিন্ন ধরনের কনটেন্ট পাওয়া এবং সংরক্ষণ করা স্টাইলে পরিণত হয়েছে। তৈরি হয়েছে বার্ষিক ৮০০ কোটি টাকার বাজার। দেশীয় কোম্পানির পাশাপাশি বিদেশী কোম্পানিও দেশে সিপি (কনটেন্ট প্রোভাইডার) হিসেবে ব্যবসায় করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, ভ্যাস বিষয়ক নীতিমালা তৈরি হলে মোবাইল ফোনের বাজার ধ্বংস হয়ে যাবে। যখন একটু একটু করে ভ্যাস বাজার বিকশিত হচ্ছিল, তখন ভ্যাসের লাইসেন্স দেয়ার এ ধরনের সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত ফল বয়ে আনতে পারে। এমনকি বিদেশী বিনিয়োগও কমে যেতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ডিএনএস সফটওয়্যার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী রিফাত কবির বলেন, কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকায় ব্যবহারকারী, গেম নির্মাতা, সঙ্গীতশিল্পী, মোবাইল ফোন কোম্পানি, ব্যাংক নিজেরা সিপি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক সিপিরা। তিনি আরও বলেন, দেশীয় সিপি হিসেবে মোবাইল ফোন অপারেটরদের কাছ থেকে আমরা শতকরা হারে যে পরিমাণ রাজস্ব ভাগাভাগি করি, বিদেশী কোম্পানিগুলো সে পরিমাণ রাজস্ব দেয় না। এরা মোবাইল ফোন কোম্পানির কাছ থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব পায়, তার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আমাদের সাথে ভাগাভাগি করে। অথচ ওই কোম্পানিগুলো তার নিজের দেশেই বেশি হারে রাজস্ব শেয়ার করে থাকে।
মন্ত্রণালয় বিপক্ষে বিটিআরসি পক্ষে
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি মোবাইল ফোন শিল্পের ভ্যাস উন্মুক্ত করে লাইসেন্স দিতে চাইলেও বাধা হয়ে দাঁড়ায় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বিটিআরসিতে চিঠি পাঠিয়ে সরকারের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের বর্তমান টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো ও বাজার পৃথক ভ্যাস লাইসেন্সের উপযুক্ত নয়।
লাইসেন্সিং গাইডলাইন অনুমোদন প্রসঙ্গে ওই চিঠিতে আরও বলা হয়, লাইসেন্সিং গাইডলাইনের খসড়া সরকারের অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলে মন্ত্রণালয় খসড়া গাইডলাইনের ওপর জনমত যাচাই করে। একই সাথে স্টেকহোল্ডারদের সাথে বিভিন্ন সময়ে মতবিনিময় করে। সবশেষ বিটিআরসিসহ ভ্যাস প্রদানের বিভিন্ন পক্ষের সাথে সভায় এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করেই সরকার এ সিদ্ধান্ত নেয়।
মোবাইল ফোন অপারেটরেরা ভ্যাস উন্মুক্ত করার বিপক্ষে অবস্থান নেয়। অপারেটরেরা এখন যেভাবে ভ্যাস নিয়ে ব্যবসায় করছে তারা সেভাবেই করতে চায়। মূলত তাদের পরামর্শ নিয়েই মন্ত্রণালয় ভ্যাস উন্মুক্ত করেনি। ভ্যাস বিষয়ে রবির প্রধান অর্থ কর্মকর্তা মাহতাব উদ্দিন আহমেদ জানান, তারা ভ্যাস গাইডলাইন চান না। তিনি বলেন, আমাদের মোট আয়ের ৫ শতাংশ আসে ভ্যাস থেকে। এটা এখনই করা হলে আমাদের ব্যবসায়ে প্রভাব পড়বে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) মহাসচিব রাসেল টি. আহমেদ বলেন, ভ্যাস উন্মুক্ত করা এখন সময়ের দাবি। এটা করা হলে নতুন নতুন উদ্ভাবন আসবে। স্থানীয় বাজার আরও বড় হবে। অর্থনীতিতে গতি আসবে।
সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রণ বা বিধিবিধান না থাকায় যে যার ইচ্ছেমতো এতদিন মোবাইল কনটেন্ট (ভ্যাস) নিয়ে ব্যবসায় করছে। এগুলোকে একটি নিয়মের মধ্যে এনে প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি এবং দেশীয় কনটেন্ট নির্মাতাদের (সিপি) প্রতিষ্ঠিত করতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। বিটিআরসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সিপিদের নিয়ন্ত্রণে কোনো গাইডলাইন না থাকায় যে যেভাবে পারছে ব্যবসায় করছে। এ সুযোগটা নিচ্ছে মোবাইল ফোন অপারেটরেরা। খসড়া নীতিমালায় ছিল, সরাসরি কোনো মোবাইল ফোন অপারেটর কনটেন্ট বা ভ্যাস নিয়ে ব্যবসায় করতে পারবে না। এরা থার্ড পার্টি সলিউশন প্রোভাইডারদের কাছ থেকে ভ্যাস কিনে সেবা দিতে পারবে।
কজ
ফিডব্যাক : hitlarhalim@yahoo.com