লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
হিটলার এ. হালিম
মোট লেখা:২২
লেখা সম্পর্কিত
মোবাইলে কল ড্রপ বাড়ায় ক্ষতির মুখে গ্রাহক
বেড়ে গেছে মোবাইল ফোনে কল ড্রপ। দুটি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক কল ড্রপের ক্ষেত্রে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ বা এক মিনিট কল ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণার পর থেকেই বেড়ে গেছে কল ড্রপ। ফলে গ্রাহকের আর্থিক ক্ষতি আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও উদাসীন। সমাধানের আপাতত কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কল ড্রপ বেড়ে যাবে তা অপারেটর দুটো আগে থেকেই জানত। দেশের মোট মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর দুই-তৃতীয়াংশ গ্রাহক এই দুই অপারেটরের। জনরোষ থেকে বাঁচতে অপারেটর দুটো এ কৌশল নিয়েছে। তা না হলে ঘোষণা দেয়ার অব্যবহিত পরপরই কেনো কল ড্রপ বেড়ে যাবে।
ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগে ২৮ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে বাংলালিংক ঘোষণা দেয়, বাংলালিংকের গ্রাহকদের কথা বলার সময় কল ড্রপ হলে এক মিনিট ফেরত দেবে। গ্রাহকদের অবাধে কথা বলার সুযোগ নির্বিঘ্ন করতে ‘মিনিট ব্যাক অন কল ড্রপ’ শীর্ষক সেবাটি বাংলালিংকের প্রতি গ্রাহকের আস্থা বাড়াবে বলে ঘোষণা দেন অপারেটরটির প্রধান নির্বাহী জিয়াদ সাতারা।
একই দিন সন্ধ্যায় একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে গ্রামীণফোন ঘোষণা দেয়, অপারেটরটি কথা বলার সময় কল ড্রপ হলে গ্রাহককে ৬০ সেকেন্ড ফিরিয়ে দেবে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে গ্রামীণফোনের সিএমও অ্যালান বঙ্কে বলেন, আমাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্কের ওপর সবাই যেনো আস্থা রাখতে পারেন, সেজন্য গ্রামীণফোনের নেটওয়ার্কের আওতায় যেসব গ্রাহক ফোন কল ড্রপের মুখোমুখি হচ্ছেন, তাদের সেই ড্রপ হওয়া কলের জন্য ৬০ সেকেন্ড ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এটি ঈদুল আজহা উপলক্ষে গ্রাহকের জন্য একটি বিশেষ উপহার এবং আসন্ন উৎসবের একটি ছোট ইঙ্গিত বলেও তিনি জানান।
জানানো হয়, ১ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই অফারটি গ্রামীণফোনের নেটওয়াকের্র আওতায় সব কলের জন্য প্রযোজ্য হবে। তবে একজন গ্রাহক একদিনে সর্বোচ্চ ৩০০ সেকেন্ড বা পাঁচ মিনিট এই সুবিধা পাবেন।
আরও বলা হয়, গ্রামীণফোনের সব গ্রাহকই এই সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন এবং এজন্য কোনো নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই। ক্ষতিপূরণ করা হলে গ্রামীণফোন একটি এসএমএসের মাধ্যমে তা গ্রাহককে জানাবে। পোস্টপেইড গ্রাহকেরা তাদের মাসিক বিলের সাথে ক্ষতিপূরণ পাবেন।
আর সমস্যার শুরুও এই ঘোষণার পর থেকেই। ঈদের সময় এই ভোগামিত্ম চরমে ওঠে। সম্প্রতি গ্রামীণফোনের একটি অনুষ্ঠানে গ্রাহকেরা অভিযোগ করেন, কল ড্রপের পাশপাশি নেটওয়ার্কহীনতাও বেড়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, অনেক জায়গায় এখনও ঘরের ভেতর নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। যদিও অপারেটরটির দাবি, মোট জনসংখ্যার ৯৯ শতাংশ গ্রামীণফোনের কাভারেজের মধ্যে চলে এসেছে।
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী বিবেক সুদ অবশ্য কল ড্রপের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ঈদ ও পূজা উৎসবের সময় গ্রাহকের চাপ (কথা বলা) বেড়ে যাওয়ায় কল ড্রপ বেড়ে গিয়েছিল। তিনি ঈদের সময় বিরূপ আবহাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, ওই সময় দেশে প্রচ- প্রতিকূল আবহাওয়া (প্রচ- গরম) বিরাজ করছিল। এটাও কল ড্রপের একটি বড় কারণ। অন্যদিকে ভারি বর্ষাতেও নেটওয়ার্ক সমস্যা হতে পারে বলে তিনি জানান। তবে এখন কল ড্রপের বিষয়টি স্বাভাবিক হয়ে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, নেটওয়ার্ক উন্নয়নে আমরা বছরে ২ কোটি ডলার ব্যয় করছি।
এদিকে বাংলালিংকের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা কল ড্রপের কথা স্বীকার করে এ প্রতিবেদকে বলেন, গ্রাহকের কথা কী বলব। বাংলালিংক অফিসে বসে আমরাই কল ড্রপের শিকার হচ্ছি। নেটওয়ার্কের ধারণক্ষমতার চেয়ে গ্রাহকসংখ্যা বেশি হওয়ায় কল ড্রপ বেড়ে গেছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, শিগগিরই নেটওয়ার্ক সক্ষমতা বাড়ানো না হলে এর থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে।
তবে অপারেটর দুটি কল ড্রপ হলে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টিকে অনেকেই শুভঙ্করের ফাঁকি হিসেবে দেখছেন। একই অপারেটরের মধ্যে কথা বলার সময় কল ড্রপ হলে এক মিনিট ফিরিয়ে দিচ্ছে গ্রামীণফোন ও বাংলালিংক।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একই অপারেটরের মধ্যে কল ড্রপের হার খুবই কম। আর এর প্রচারণা এমনভাবে হয়েছে, সাধারণ গ্রাহকের পক্ষে বিষয়টি স্পষ্ট করে বোঝা বেশ শক্ত। তবে অন্য অপারেটরে কথা বলার সময় কল ড্রপ হলে ‘কোন পয়েন্টে কল ড্রপ’ হচ্ছে তা চিহ্নিত করতে না পারায় অপারেটরগুলো কোনো দায় নিচ্ছে না। ফলে বরাবরের মতো ক্ষতির মুখে পড়েছেন গ্রাহক।
এ প্রসঙ্গে গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী বলেন, দুটি অপারেটরের মধ্যে কথা বলার সময় কল ড্রপ হলে বোঝা যায় না কোন প্রামেত্মর ত্রম্নটির জন্য কল ড্রপ হয়েছে। ফলে কোনো পক্ষই এ দায় নিতে রাজি হয় না। আরও একটি কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এতে রাজস্ব ভাগাভাগিতে সমস্যা হবে। এ কারণে আমরা শুধু আমাদের অপারেটরের মধ্যেই কল ড্রপ হলে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছি।
মোবাইল অপারেটর রবির কল ড্রপের অবস্থাও একই। অপারেটরটি এখনও এ ধরনের কোনো ঘোষণা দেয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রবির মুখপাত্র মহিউদ্দিন বাবর জানান, কল ড্রপ হচ্ছে এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে কল ড্রপ যাতে কমিয়ে আনা যায় আমরা সে লক্ষ্যেই (নেটওয়ার্ক উন্নয়ন) কাজ করছি। আমরা মনে করি ক্ষতিপূরণ দেয়া কোনো সমস্যার সমাধান নয়। কল ড্রপ যাতে না হয় সেটা সমাধান করাই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য।
এদিকে এই কল ড্রপ সমস্যা নতুন নয়। এ সমস্যা থেকে গ্রাহককে মুক্তি দিতে ২০১২ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) একটি নির্দেশনা জারি করে। মোবাইল ফোন অপারেটরদের কারিগরি ত্রম্নটি ও নেটওয়ার্ক সীমাবদ্ধতার কারণে গ্রাহকের কল ড্রপ ভোগামিত্ম রোধে ১০ সেকেন্ড পালস সুবিধা চালুর নির্দেশনা দেয়া হয়। সব ধরনের প্যাকেজে ১০ সেকেন্ড পালস হারে টাকা কাটতে দেশের ৬ মোবাইল ফোন অপারেটরকে নির্দেশনা দেয় বিটিআরসি।
কল ড্রপের ভোগামিত্ম থেকে রক্ষা পেতে ওই নির্দেশনায় বলা হয়, মোবাইল ফোন গ্রাহকেরা কল করার পর নেটওয়ার্কের ত্রম্নটি বা অন্য কোনো কারণে কল ড্রপ হয় এবং পুনঃসংযোগের ক্ষেত্রে প্রতিবারই এক মিনিট বা পূর্ণ পালস হিসেবে বেশি হারে চার্জ দিতে হয়। ফলে গ্রাহকেরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ছাড়া অনেকে সংক্ষিপ্ত কথোপকথনে অভ্যস্ত। এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময়ের চার্জ দেয়া বাস্তবসম্মত নয়। ওই নির্দেশনা এখনও বলবৎ আছে, কিন্তু আগের তুলনায় বেড়ে গেছে কল ড্রপ।
অন্যদিকে মোবাইল ফোনের গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে নীতিমালা অনুমোদন দিয়েছে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি। গ্রাহক হয়রানি ঠেকাতে গত জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত কমিশনের ১৬৩তম বৈঠকে এ অনুমোদন দেয়া হয়। এজন্য ১৩টি কেপিআই (কি পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) নির্ধারণ করা হয়েছে।
কেপিআইয়ে গ্রাহকের কলের (ভয়েস) ৭৫ শতাংশ সফলতাকে ন্যূনতম মাপকাঠি হিসেবে রাখা হয়েছে। কোনো অপারেটরের কনজেশনের কী অবস্থা, ঘন ঘন কল ড্রপ হয় কি না, ভয়েস কোয়ালিটির অবস্থা কী- এ সবই থাকবে ইন্ডিকেটরে। এছাড়া ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঘোষিত গতির মধ্যে অন্তত ৭০ শতাংশ নিশ্চিত করতে বলেছে বিটিআরসি। অন্যান্য প্যারামিটারের মধ্যে এসএমএসের সফলতা, গ্রাহকসেবার মান, গ্রাহকের অভিযোগ জানানোর সুযোগ আছে কি না, সেটা গুরুত্ব পেলেও এখনও কমিশনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই
ফিডব্যক : hitlarhalim@yahoo.com