লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০০৯ - ফেব্রুয়ারী
গণিতের অলিগলি পর্ব-৩৯
পাই-এর গল্প
নিঃসন্দেহে পাই (pi. pi) বিখ্যাত সব সংখ্যার মধ্যে অন্যতম। ২২-কে ৭ দিয়ে ভাগ দিলে ভাগফল হিসেবে যে সংখ্যাটি পাবো সেটারই নাম pi, অর্থাৎ pi (pi) = ২২/৭। গ্রিক বর্ণমালা পাই (pi) হচ্ছে এর সাঙ্কেতিক নাম। আসলে এই pi বা ২২/৭ একটি অনুপাত। আমরা জানি ছো্ট-বড় প্রতিটি বৃত্তেরই রয়েছে একটি ব্যাস ও একটি পরিধি। ছোট কিংবা বড় যেকোনো বৃত্তই নিই না কেনো, প্রতিটি বৃত্তের পরিধির দৈর্ঘ্যকে ব্যাসের দৈর্ঘ্য দিয়ে ভাগ করলে ভাগফল সব সময় দাঁড়ায় ২২/৭। আর এই ২২/৭ সংখ্যাটিকে দশমিকে প্রকাশ করলে তা একটি অবিরত ভগ্নাংশে পরিণত হয়। অর্থাৎ এই ভাগফল কখনোই শেষ হয় না। দেখা গেছে এর মান আসন্ন দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত মান ধরলে ২২/৭=৩.১৪ ধরা যায়। কিন্তু এর মান দশমিকের আরো বেশি ঘর পর্যন্ত বাড়াতে চাইলে তার শেষ খুঁজে পাওয়া যায় না। আজকের দিনের সুপার কমপিউটার ব্যবহার করে দশমিকের পর ৬৪০ কোটি ঘর পর্যন্ত অঙ্ক কষেও এর ভাগফলের শেষ পাওয়া যায়নি। অতএব ২২-কে ৭ দিয়ে ভাগ করলে কখনোই ভাগ প্রক্রিয়ার শেষ প্রামেত্ম আমরা পৌঁছতে পারবো না। সেজন্যই pi সংখ্যাটি অনেকের নজর কেড়েছে।
এই pi-এর অনুসন্ধান শুরু হয় মিসর ও ব্যাবিলনে। আজ থেকে ৪ হাজার বছর আগে। মিসরীয়রা প্রথম pi-এর মান বের করে (৪/৩)৪। আর ব্যাবিলনীয়দের কাছে এর মান ছিল ৩১/৮। একই সময়ে ভারতীয়রা মনে করতো এর মান ১০-এর বর্গমূলের সমান অর্থাৎ ৩-এর চেয়ে কিছুটা বেশি। তাদের উদ্ভাবিত এই pi-এর মানের পার্থক্যটা দেখা দেয় দশমিকের দ্বিতীয় ঘর থেকে।
(৪/৩)৪ = ৩.১৬০৪৯৩৮২৭...
৩১/৮ = ৩.১২৫
১০ = ৩.১৬২২৭৭৬৬...
প্রকৃতপক্ষে pi-এর মান ২২/৭ = ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫...
এর পর pi-এর মানের উপস্থিতি দেখা যায় বাইবেলে। সেখানে pi-এর মান ধরা হয় মোটামুটি ৩। যদিও এই মান মিসরীয়, ব্যাবিলনীয় ও ভারতীয়দের বের করা মানের মতো ততটা সঠিক ছিল না। তবুও পরিমাপের জন্য তখন এ মানই যথেষ্ট ছিল। ইহুদি পন্ডিতেরা মনে করতেন, এর চেয়ে আরো সঠিক মান রয়েছে pi-এর। এবং মূল হিব্রু ভাষায় তা গোপন রয়েছে। pi-এর আরো সঠিক মান নির্ণয়ের পদক্ষেপ নেন আর্কিমিডিস। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দের দিকে আর্কিমিডিস এ সমস্যা নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তিনি pi-এর মান আরো সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য আরো উন্নত একটি পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। তিনি দেখলেন pi-এর মান ৩ ১০/৭১-এর চেয়ে বড়, কিন্তু ৩ ১০/৭০-এর চেয়ে ছোট।
আজকের দিনে আমরা pi-এর মান ধরি ২২/৭। আমরা মনে করি এটিই pi-এর যথার্থ মান। সময়ের সাথে মানুষ pi-এর বেশি থেকে বেশি সঠিক মান বের করতে শুরু করে। ১৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে মিসরের আলেক্সান্দ্রিয়ার বিখ্যাত গণিতবিদ টলেমি বলেন, pi-এর মান হচ্ছে ৩৭৭/১২০। আর ৫০০ খ্রস্টাব্দের দিকে চীনা গণিতবিদ সু চুং-চি এর মান ৩৫৫/১১৩ বলে উল্লেখ করেন। এই মান যথাক্রমে দশমিকের ৩ থেকে ৬ ঘর পর্যন্ত সঠিক।
৩৭৭/১২০ = ৩.১৪১৬৬৬৬৭...
২২/৭ = ৩.১৪২৮৫৭১৪৩...
৩৫৫/১১৩ = ৩.১৪১৫৯২৯২...
pi = ৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫...
pi-এর একদম সঠিক মান বের করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। আজকের মানুষ জানতে পেরেছে pi একটি স্বাভাবিক সংখ্যা নয়, এটি একটি অমূলদ সংখ্যা। ল্যাম্বার্ট তা প্রমাণ করেন ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৮২ সালে লিন্ডেমিন প্রমাণ করেন pi অমূলদের চেয়ে বেশি কিছু। এটি শুধু অমূলদ বা সংখ্যাই irrational নয়, সেই সাথে এটি Transcendental নাম্বারও। অর্থাৎ এটি কোনো পলিনমিয়েল সমীকরণের পূর্ণসংখ্যার সহগবিশিষ্ট কোনো সমাধান নয়।
এ কারণে :
০১. একটি বৃত্তকে বর্গে পরিণত করা যায় না। অর্থাৎ একটি স্কেল, কম্পাস ও পেন্সিল দিয়ে কখনোই একটি বৃত্তের ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট কোনো বর্গ অাঁকা সম্ভব নয়। দুই হাজার বছর আগে গ্রিকরা এ সমস্যাটিকে সামনে নিয়ে আসেন। লিন্ডেম্যানের আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এ সমস্যার সমাধান বেরিয়ে আসে।
০২. pi- এর মান কখনোই পুরোপুরি বর্গমূল আকারে, অর্থাৎ ২, ৩, ৭ কিংবা ৫ + ৯ ইত্যাদি আকারে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
সে সময় থেকে মানুষ চেষ্টা করতে শুরু করে pi-এর মান যত বেশিসংখ্যক দশমিকের ঘর পর্যন্ত বের করা যায় কি না। ভারতীয় গণিতবিদ রামানুজন pi-এর বেশ কয়েকটি মান বের করেন :
(১+৩/৫)/৭/৩= ৩.১৪১৬২৩৭১...
(৮১+১৯২)২২১/৪ = ৩.১৪১৫৯২৬৫৩...
৬৩(১৭+১৫৫)/২৫(৭+১৫৫)= ৩.১৪১৫৯২৬৫৪...
pi = ৩.১৪১৫৯২৬৫৪...
আসলে একটা বৃত্তের পরিধির দৈর্ঘ্যকে এর ব্যাসের দৈর্ঘ্যকে ভাগ করলে যে মান পাওয়া যায়, সেটাই হচ্ছে pi-এর মান। বৃত্তের ব্যাস একটি সরলরেখা। এর দৈর্ঘ্য নির্ণয় সহজ। কিন্তু বৃত্তের পরিধি একটি বক্ররেখা। এই পরিধির দৈর্ঘ্য সঠিকভাবে নির্ণয় কঠিন। এক্ষেত্রে ব্যর্থতাই pi-এর মান নির্ণয়ে এতসব জটিলতা। এমনকি আজকের দিনের ইলেকট্রনিক কমপিউটার দিয়ে মাপতে গিয়েও এ জটিলতা রয়ে গেছে। এদিকে বৃত্তের পরিধি-রেখার পুরুত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। রেখার বাইরের কিনারা দিয়ে মাপলে যে দৈর্ঘ্য পাওয়া যাবে, ভেতরের কিনারা দিয়ে মাপলে সে দৈর্ঘ্য আরো কম হবে। যখন আমরা pi-এর মান আসন্ন দশমিকের কোটি কোটি ঘর পর্যন্ত সঠিকভাবে বের করতে চাই, তখন এ প্রশ্নটা তো আসতেই পারে।
যাই হোক আমরা বিজ্ঞান বাইয়ে আজকাল এই pi শত শত ফর্মুলার মধ্যে ব্যবহার করি।
যেমন : বৃত্তের পরিধি = ২pi ব্যাসার্ধ
বৃত্তের ক্ষেত্রফল = pi (ব্যাসার্ধ)২
গোলকের আয়তন = ৪/৩ pi (ব্যাসার্ধ)৩
এসব ক্ষেত্রে আমরা pi-এর মান ২২/৭ বা ৩.১৪ (আসন্ন) ধরে হিসেব করি। দুই দশমিক স্থান পর্যন্ত pi-এর মান ৩.১৪ ধরে চলে আমাদের হিসাব নিকাশ।
দশমিকের আগের ৩-কে বছরের মাস সংখ্যা ধরলে বাইরে তৃতীয় মাস হচ্ছে মার্চ। আর দশমিকের ডানের ১৪-কে তারিখ ধরলে ৩.১৪-এর সাথে মার্চের ১৪ তারিখের একটি মিল খুঁজে পাই। তাই বিশ্বের মানুষ প্রতিবছর ১৪ মার্চ পালন করে pi দিবস। অর্থাৎ এই pi দিবস চলে একটা উৎসবমুখর পরিবেশে। সেদিন pi-এর মজার মজার নানা তথ্য জানার যেমন আয়োজন থাকে, তেমনি থাকে এ নিয়ে বিনোদনের ব্যবস্থাও। আসলে pi সম্পর্কে এমন সব মজার তথ্য রয়েছে, তা জানাতে গেলে তা যেনো শেষ হবার নয়। এ লেখায় pi সম্পর্কে কয়েকটি তথ্য জানিয়েই এ লেখার ইতি টানতে চাই।
০১. আপনি যদি আপনার হ্যাটের চারপাশের, পরিধির দৈর্ঘ্যকে আসন্ন এক-অষ্টমাংশ ইঞ্চি পর্যন্ত বিবেচনায় এনে তাকে pi দিয়ে ভাগ করেন, তাহলে আপনি জেনে নিতে পারেন আপনার হ্যাটের সাইজ কত।
০২. একটি হাতির পা থেকে কাঁধ পর্যন্ত উচ্চতা = ২pi এর পায়ের ব্যাসার্ধ।
০৩. একটি বৃত্তের কোনো কোণ নেই না বলে বরং যথার্থ হবে যদি বলি বৃত্তের অসংখ্য কোণ রয়েছে।
০৪. pi-এর সঠিক ভগ্নাংশ হচ্ছে ১০৪৩৪৮/৩৩২১৫। এর সঠিকতর মাত্রা ০.০০০০০০০১০৫৬ শতাংশ।
০৫. খ্রিস্টের জন্মের ২০০০ বছর আগে মানুষ প্রথম pi-এর মান জানতে পারে।
০৬. বাইবেলে pi-এর মান ৩ বলে উল্লেখ আছে।
০৭. এ পর্যন্ত pi-এর দশমিকের ৬৪০ কোটি স্থান পর্যন্ত নির্ণয় করা হয়েছে।
০৮. যদি pi-এর মান একশ’ কোটি দশমিক স্থান পর্যন্ত লেখা হয় তবে এর দৈর্ঘ্য হবে নিউইয়র্ক নগর থেকে কানসাস অঙ্গরাজ্যের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত।
০৯. এক সময় মানুষ বৃত্তের ক্ষেত্রফলের সমান বর্গক্ষেত্র আকঁতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এ চেষ্টাকে একটা রোগ বলে আখ্যায়িত করে এর নাম দেয় Morbus Cyclometucus.
১০. টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ক্যানাডা ১৯৯৯ সালে pi-এর সবচেয়ে যথার্থ মান বের করে ২০৬, ১৫৮, ৪৩০, ০০০ দশমিকের স্থান পর্যন্ত। এর আগের রেকর্ড ছিল ১৫০০০ কোটি দশমিক স্থান পর্যন্ত।