গণিত জেনে সিদ্ধান্ত নিতে হয়
ধরা যাক, আপনাকে মাত্র ৩০ দিনের বা ১ মাসের জন্য একটা চাকরির প্রস্তাব কেউ দিলেন। এক মাস পর সে চাকরি থাকবে না। এই ৩০ দিনের বেতনের ব্যাপারে আপনাকে দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রস্তাব দেয়া হলো। বলা হলো, আপনাকে এর যেকোনো একটি বেছে নিতে হবে এবং সে অনুযায়ী আপনার বেতন পরিশোধ হবে।
প্রথম প্রস্তাব হচ্ছে : প্রথম দিনের বেতন ১ পয়সা, দ্বিতীয় দিনের বেতন প্রথম দিনের দ্বিগুণ অর্থাৎ ২ পয়সা, তৃতীয় দিনের বেতন দ্বিতীয় দিনের বেতনের দিগুণ অর্থাৎ ৪ পয়সা। এভাবে প্রতিদিনের বেতন আগের দিনের বেতনের দ্বিগুণ হবে। এভাবে ৩০ দিন শেষে মোট বেতন যা হবে, তা-ই পরিশোধ করা হবে।
দ্বিতীয় প্রস্তাবে কোনো হিসেব-নিকেশের বালাই নেই। সোজা এক মাস চাকরি শেষে মোট ১ লাখ টাকা বেতন পরিশোধ করা হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন প্রস্তাবটি আপনি গ্রহণ করবেন? প্রথমটি না দ্বিতীয়টি? ধরা যাক ১ লাখ টাকা বেতনের কথা শুনেই আপনি খুশিতে লাফ দিয়ে উঠলেন। কোনো হিসেব-নিকেশ না করে জানিয়ে দিলেন- আপনি দ্বিতীয় প্রস্তাবে রাজি। চাকরিদাতা পক্ষও তা মেনে নিলো। স্থির হলো আপনি তাদের ওখানে ৩০ দিন চাকরি করবেন, চাকরি শেষে বেতন হিসেবে ১ লাখ টাকা নিয়ে চলে যাবেন।
মাসে ১ লাখ টাকা বেতন। আপনি তো মহাখুশি। বাড়িতে গিয়ে যখন এ খুশির খবর ছোটভাইকে জানালেন, তখন ছোটভাই এ খুশিতে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন- আপনি ‘মহাবোকামি’ করেছেন প্রথম প্রস্তাবটি গ্রহণ না করে। প্রথম প্রস্তাব মেনে নিলে আপনি এক লাখের চেয়ে অনেক অনেক বেশি টাকা পেতেন। কারণ, ছোটভাই গণিত জানা লোক। গণিতের হিসেব-নিকেশ করেই তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেন। আপনি প্রথম প্রস্তাবটি মেনে নিলে এই এক মাস কাজ করে কত টাকা বেতন পেতেন তা হিসেব কষেই আপনার বোকামিটি ধরিয়ে দিলেন। পুরো হিসেবটা যখন তুলে ধরা হলো, শুধু তখনই বুঝতে পারলেন, আসলেই আপনি বোকামিটা করে ফেলেছেন।
আসুনটা বেতনের সে হিসেবটা কেমন ছিল, তা একটু দেখে নিই।
১ম দিনের বেতন ১ পয়সা, ২য় দিনের ২ পয়সা, ৩য় দিনের ৪ পয়সা, ৪র্থ দিনের ৮ পয়সা, ৫ম দিনের ১৬ পয়সা, ষষ্ঠ দিনের ৩২ পয়সা ও ৭ম দিনের ৬৪ পয়সা। অতএব প্রথম ১ সপ্তাহে মোট = (১+২+৪+৮+১৬+ ৩২+৬৪) পয়সা = ১২৭ পয়সা = ১.২৭ টাকা। দ্বিতীয় সপ্তাহে এসে ৮ম দিনের বেতন ৬৪ পয়সার দ্বিগুণ ১.২৮ টাকা, নবম দিনের ২.৫৬ টাকা, ১০ম দিনের ৫.১২ টাকা, একাদশ দিনের ১০.২৪ টাকা, দ্বাদশ দিনের বেতন ২০.৪৮ টাকা, ত্রয়োদশ দিনের ৪০.৯৬ টাকা, চতুর্দশ দিনের ৮১.৯২ টাকা।
অতএব প্রথম ১৪ দিন শেষে মোট বেতন দাঁড়ায় = (১.২৭+১.২৮+২.৫৬ +৫.১২+১০.২৪+২০.৪৮+৪০.৯৬+৮১.৯২) টাকা = ১৬৩.৮৩ টাকা।
তৃতীয় সপ্তাহে এসে ১৫ তারিখের বেতন ১৬৩.৮৪ টাকা, ১৬ তারিখের ৩২৭.৬৮ টাকা, ১৭ তারিখের ৬৫৫.৩৬ টাকা, ১৮ তারিখের ১৩১০.৭২ টাকা, ১৯ তারিখের ২৬২১.৪৪ টাকা, ২০ তারিখের ৫২৪২.৮৮ টাকা, ২১ তারিখের ১০৪৮৫.৭৬ টাকা। তাহলে তিন সপ্তাহ শেষে ২১ দিনের মোট হবে = (১৬৩.৮৩+১৬৩.৮৪+৩২৭.৬৮+৬৫৫.৩৬+১৩১০. ৭২+২৬২১.৪৪+৫২৪২.৮৮+১০৪৮৫.৭৬) টাকা = ২০৯৭১.৫১ টাকা।
চতুর্থ সপ্তাহে এসে ২২ তারিখের বেতন ২০৯৭১.৫২ টাকা, ২৩ তারিখের ৪১৯৪৩.০৪ টাকা, ২৪ তারিখের ৮৩৮৮৬.০৮ টাকা, ২৫ তারিখের ১৬৭৭৭২.১৬ টাকা, ২৬ তারিখের ৩৩৫৫৪৪.৩২ টাকা, ২৭ তারিখের ৬৭১০৮৮.৬৪ টাকা, ২৮ তারিখের ১৩৪২১৭৭.২৮ টাকা, ২৯ তারিখের ২৬৮৪৩৫৪.৫৬ টাকা এবং শেষ দিন ৩০ তারিখের বেতন ৫৩৬৮৭০৯.১২ টাকা।
অতএব ৩০ দিন পর আপনা মোট বেতন দাঁড়ায় = (২০৯৭১.৫১ + ২০৯৭১.৫২+৪১৯৪৩.০৪+৮৩৮৮৬.০৮+১৬৭৭৭২.১৬+৩৩৫৫৪৪.৩২+৬৭১০৮৮.৬৪+১৩৪২১৭৭.২৮+২৬৮৪৩৫৪.৫৬+৫৩৬৮৭০৯.১২) টাকা = ১০৭৩৭৪১৮.২৩ টাকা।
তাহলে দেখুন প্রথম প্রস্তাব গ্রহণ করলে আপনি ৩০ দিন চাকরি শেষে মোট বেতন পেতেন ১ কোটি ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৪১৮ টাকা ২৩ পয়সা। গণিতের এই সহজ হিসেবটা পরখ না করে হুট করে ১ লাখ টাকা বেতনে চাকরির প্রস্তাবটা গ্রহণ করে কী বোকামিটাই না আপনি করলেন, এখন নিশ্চয়ই বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না।
প্রাসঙ্গিক আরেকটি উদাহরণ দেয়া যাক। ধরুন, আপনার বাবার ইচ্ছে তিনি আপনাকে ১০০ বর্গগজ জায়গা আপনাকে দেবেন। তিনটি এলাকায় আপনার বাবার তিনটি আলাদা আলাদা জায়গা রয়েছে। তিনটির আকার ভিন্ন ভিন্ন হলেও তিনটিরই ক্ষেত্রফল একই, অর্থাৎ তিনটিরই আয়তন ১০০ বর্গগজ করে। অতএব আপনার বাবা সরল মনে বললেন, ‘আমার তিন সন্তানকে এই তিনটি সমান ক্ষেত্রফলবিশিষ্ট জায়গার একেক জনকে একটি দেব। তবে আমার ছোট ছেলে (ধরুন আপনি) প্রথম তার পছন্দমতো এই তিনটি জায়গার যেকোনো একটি নেবে। বাকি দুটির মধ্য থেকে মেঝো ছেলে পছন্দমতো একটি নেবে। অবশিষ্ট যেটি থাকবে সেটি পাবে বড় ছেলে’।
আপনি ছোট ছেলে হওয়ার সুবাদে প্রথম পছন্দমতো যেকোনো একটি জায়গা বেছে নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এখানেও গণিতের হিসেব-নিকেশ দরকার হবে। এখানে গণিতের জ্ঞান খাটিয়ে বুদ্ধিমানের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারলে আপনি বিজয়ী হবেন, নইলে বোকামি করে বসতে পারেন। যদিও ক্ষেত্রফলের দিক দিয়ে তিনটিরই ক্ষেত্রফল সমান অর্থাৎ ১০০ বর্গগজ। এবার জেনে নেয়া যাক জায়গা তিনটির আকার, যা থেকে একটি বেছে নিতে হবে আপনাকে। প্রথমটি বর্গাকার, প্রতি বাহুর দৈর্ঘ ১০ গজ। দ্বিতীয় ক্ষেত্রটির দৈর্ঘ্য ২৫ গজ, প্রস্থ ৪ গজ। তৃতীয় ক্ষেত্রটির দৈর্ঘ্য ২০ গজ, প্রস্থ ৫ গজ।
এখন বলুন তো কোনটি আপনি বেছে নেবেন? আগেই বলেছি এখানেও আছে গণিতের বুদ্ধিভিত্তিক হিসেব-নিকেশ। নইলে ঠকবার সমূহ সম্ভাবনা। লক্ষ করুন, প্রতিটি ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্যকে প্রস্থ দিয়ে গুণ করলে ক্ষেত্রফল দাঁড়ায় ১০০ বর্গগজ। অতএব সবক্ষেত্রেই জায়গা সমান। অতএব ক্ষেত্রফল বিবেচনা করে যেকোনো একটি ক্ষেত্র নিলে কোনো লাভ বা ক্ষতি নেই। কিন্তু দরুন, যে জায়গাটি নেবেন সে জায়গাটিতে আপনি বেড়া বা সীমানা দেয়াল দিয়ে সংরক্ষণ করতে চান। তাহলে প্রথম ক্ষেত্রে বেড়া বা দেয়াল দিতে হবে ৪০ হাত, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বেড়া বা দেয়াল দিতে হবে ৫৮ হাত এবং তৃতীয় ক্ষেত্রে বেড়া বা দেয়াল দিতে হবে ৫০ হাত। অতএব তিনটি ক্ষেত্রে বেড়ার খরচ কোনটায় কম কোনটায় বেশি হবে। অতএব বেড়ার বা দেয়ালের খরচ কমাতে হলে আপনাকে প্রথম ক্ষেত্রটিই বেছে নিতে হবে।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ করে এ লেখার ইতি টানতে চাই। ধরুন, আপনি আপনার কিছু নিচু জায়গায় মাটি ভরাট করার জন্য অন্য কারো উঁচু জায়গার থেকে মাটি কিনতে চান। ধরা যাক, চুক্তি হলো আপনি তার কাছ থেকে ১০০ হাত চওড়া, ১০০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০০ হাত গভীর জায়গার মাটি নেবেন। দাম ১ লাখ টাকা। কিছু মাটি কেটে নেয়ার পর বুঝতে পারেন আপনার এত বেশি মাটির প্রয়োজন নেই। মাটি বিক্রেতাকে গিয়ে বললেন, আপনার দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, গভীরতায় দশ ভাগের এক ভাগ জায়গার মাটিটুকু নিলেই চলবে। অর্থাৎ এখন ১০ হাত চওড়া, ১০ হাত দৈর্ঘ্য ও ১০ হাত গভীর স্থানটুকুর মাটিই কিনবেন। এজন্য আপনি আগের দাম ১ লাখ টাকার ১০ ভাগের ১ ভাগ অর্থাৎ ১০ হাজার টাকা এর মূল্য হিসেবে মাটিওয়ালাকে দিলেন। কিন্তু মাটিওয়ালা ছিলেন গণিত জানা সৎ লোক। তিনি আপনাকে বললেন, আপনি এখন যে মাটি নিচ্ছেন তার দাম ১০ হাজার টাকা নয়, মাত্র ১ হাজার টাকা। আপনি তো অবাক। আপনি বললেন, আমি আগের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা সবই তো দশ ভাগের এক ভাগ করেছি। অতএব দামও আগের দামের দশ ভাগের এক ভাগ হবে। অতএব দাম হবে ১০ হাজার টাকা।
এবার মাটি বিক্রেতা হিসেব কষে আপনার ভুলটা ভাঙ্গালেন। তিনি দেখালেন: প্রথমে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আপনি নেবেন ১০০×১০০×১০০ ঘনহাত মাটি = ১০০০০০০ ঘনহাত মাটি, পরে সিদ্ধান্ত পাল্টে বাস্তবে নিলেন ১০×১০×১০ ঘনহাত মাটি = ১০০০ ঘনহাত মাটি, যা আগের তুলনায় এক হাজার ভাগের এক ভাগ। অতএব এর দামও আগের ১ লাখ টাকার এক হাজার ভাগের এক ভাগ হবে। মাটি বিক্রেতা সৎ হওয়ায় আপনি বেঁচে গেলেন।
তাহলে জীবনের সব ক্ষেত্রেই গণিতের হিসেব কষে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। নইলে ঠকবার সমূহ সম্ভাবনা শতভাগ।
কজ ওয়েব
গণিতদাদু