লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
তথ্যসূত্র:
প্রযুক্তি ধারা
ধারণার চেয়ে দ্রুতগতির রদবদল
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নতুন একটা মাত্রায় উপনীত হচ্ছে! না, এতদিন যেভাবে বলা হচ্ছিল- সুনির্দিষ্ট পুরনো ধারায় হিসাব-নিকাশ করে- সেভাবে যেন হচ্ছে না। এবারের গতিটা একটু অন্যরকম, আগেই বলে নেয়া ভালো, এর সামাজিক ভিত্তিটা খুবই সুদৃঢ়! খানিকটা রাজনৈতিক উপযোগিতাও যেন দেখা যাচ্ছে! সাদামাটা বা ঢালাওভাবে এটুকু বলেই সেরে দেয়া যাচ্ছে না এই বিশেষ অবস্থাটাকে। কারণ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির কলাকৌশলগত উন্নয়ন এবং এর ব্যবহার উপযোগিতা যে বহুমাত্রিকতা পেতে যাচ্ছে, তা আগের যেকোনো সময়ের সব গতিশীলতাকে অতিক্রম করে গেছে।
এই যে এতদিন টুজি বা থ্রিজি বিষয়ক ধারণাটা ছিল, সেটাকেই অতিক্রম করে যাচ্ছে এই প্রজন্ম। বিষয়টা কি খুব বেশি নীরব? যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে এ বিষয়ে। কারণ, বাস্তবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির উপযোগিতা যেভাবে বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছে এবং আরও সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, তাতে করে কৌশলগত যান্ত্রিক উন্নয়নের ধারাতেও এসেছে একটা ধারণাগত পরিবর্তন। ধারণাগত বলছি এই কারণে যে, প্রজন্মের সামাজিক চাহিদা এখন বদলে যাচ্ছে, বা উন্নত হচ্ছে প্রযুক্তি। একেবারে কেন্দ্রের চিপসেট থেকে নিয়ে অবয়ব-আকৃতিতেও পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
একসময় ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল, পার্সোনাল কমপিউটারই একবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত আধিপত্য বিস্তার করবে। এর পরিবর্তিত রূপ হিসেবে বড়জোর আমরা পাব উন্নত ল্যাপটপ বা ট্যাবলেট পিসি। আর এরই উপযোগী হিসেবে তৈরি হতে থাকবে চিপসেট-মাদারবোর্ড, উন্নত করা হবে অপারেটিং সফটওয়্যার। সেই মুরস-ল’র কথা তো নিশ্চয়ই মনে আছে। আরও অনেক নিয়মের গন্ডিতে বেঁধে ফেলার চেষ্টা হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিকে। হয়তো তাও নয়, বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো এই প্রযুক্তির পেছনের বিজ্ঞানটাকেও একটা স্থিতিশীল দৃশ্যমানতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, এই বিজ্ঞানটা যে সাইবারনেটিকস!
কেউ কেউ হয়ত প্রশ্ন তুলতে পারেন, সাইবারনেটিকস- তাই কী হাল। এর কী কোনো নিয়মনীতি থাকবে না? তা থাকবে না কেন? সাইবারনেটিকস বা গণিতবিদ্যাই যে চালাচ্ছে অন্য সবকিছুকে- এর নিজস্ব নিয়ম তো আছেই। আসলে সাইবারনেটিকসের নিয়মটাই আমাদের কাছে অভূতপূর্ব। হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত বলতে হবে অভূতপূর্বই! কারণ, আগে দেখা যায়নি এর স্বরূপটা। এখনই কী দেখা যাচ্ছে? মনে হয় একটু একটু দেখা যেতে শুরু করেছে মাত্র।
ইতিহাসটা তো আসলে খুব বেশি দিনের নয়, কমবেশি ৬০ বছরের মতো, যদি কমপিউটার তৈরির সময় থেকে ধরা হয়। তবে সাইবারনেটিকসের কিছু প্রত্যয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আরও প্রায় বছর চল্লিশেক আগে। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর প্রথম পর্বে গণিতবিদেরা তাদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের জন্য যখন সাইবারনেটিকস শব্দটিকে গ্রহণ করেন, তখন দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন : এক. মানুষের সব কর্মকান্ডকে একসময় পরিচালনা করবে সাইবারনেটিকস, আর দুই. প্রতিটি মানুষের হাতে চলে যাবে কমপিউটার।
আজকের বিশ্বটার দিকে তাকিয়ে দেখুন, ইতোমধ্যে মানুষের অনেক কর্মকান্ড বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় অধিকাংশ কর্মকান্ডের মধ্যে প্রবেশ করেছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি। মানুষের যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম-শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, আইন, বিচার এমনকি বিনোদন, খেলাধুলার মধ্যেও ঢুকে পড়েছে আইসিটি।
আসলে ঢুকে পড়েছে কথাটা ঠিক নয় বরং বলা ভালো এসব কর্মকান্ড পরিচালনায় ভার নিয়েছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি তথা বিজ্ঞান হিসেবে সাইবারনেটিকসই। আর দ্বিতীয় প্রত্যাশাটি? দেখুন মোবাইল ফোনভিত্তিক প্রযুক্তির উন্নয়নের দিকে- সবার হাতে একটি করে কমপিউটার পৌঁছানো কী অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে?
এই লেখার প্রথমদিকে সামাজিক ভিত্তির একটা কথা বলেছিলাম, প্রযুক্তি আর ব্যবহার উপযোগী মানবসভ্যতায় সামাজিক উপযোগিতা সবচেয়ে বেশি ছিল এতদিন কাগজ-কলম, ডাক আর যানবাহনের। এখনকার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করুন, দেখবেন ওই ব্যাপারগুলোকেও প্রতিস্থাপিত করে ফেলেছে সাইবারনেটিকস। গুরুতর তথ্য কিংবা স্পর্শকাতর মানবীয় তথ্য- সবকিছুই এখন একই গতিতে চলছে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবে। বাণিজ্যিক তথ্য থেকে নিয়ে প্রেমের মতো বিষয়- সবকিছুই গাণিতিকভাবে বিশ্লেষিত হচ্ছে, কখনও সঙ্কুচিত হচ্ছে, কখনও প্যাকেট হচ্ছে, কখনও ভার্চুয়াল ট্রাফিক হিসেবে চলছে সাইবার স্পেসে। আজ কী কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা বিরহে কাতর হয়ে বসে থাকে চিঠির অপেক্ষায়? বিরহের সময়টা এখন সঙ্কুচিত হয়ে গেছে- এরও তো একটা সামাজিক প্রভাব আছে। পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধন, তথ্য, অর্থের প্রয়োজন দ্রুত মেটানো- এসব তো সাইবারনেটিকসের কল্যাণেই চলছে। এখন যাদের বয়স কুড়ি- তারা কী ভাবতে পারে কাগজ, ডাকটিকেট, খাম, ব্যাংক ড্রাফট, পে অর্ডার, চেকবই এসব নিয়ে প্রাণান্তকর কী ছোটাছুটিই না ছিল মানুষের? এসবের প্রভাব সমাজে পড়েনি? মানুষের অভ্যাস তো বটেই, আবার আবরণেই কী পরিবর্তন আসেনি? এই প্রজন্মের কাছে ই-মেইলও পুরনো ব্যাপার বলে মনে হয়। এসএমএস, এমএমএস এদের তথ্যের চাহিদা মেটায় দ্রুত। কাতরতা না থাকা, ধৈর্য ধরতে না পারা কিংবা চিন্তা করে না লেখা এসবের জন্য সহিষ্ণুতা কমছে বলে অভিযোগ তোলেন অনেকে, কিন্তু সবটাই কী নেতিবাচক ব্যাপার? এর ফলে সামাজিক সম্পর্কের সহজসাধ্যতা আর দৃঢ় বন্ধনের ব্যাপারটাকে কী অস্বীকার করা যায়?
খেলার মতো বিষয়ের দিকে তাকান, দেখবেন কমপিউটারের খেলাগুলো তো আছেই, এমনিতে আগের খেলা বা প্রচলিত খেলা যেগুলো মাঠে গড়ায় কিংবা ইনডোরে কসরত করে খেলা হয়- সেগুলো পরিচালনাতেও তো ঢুকে পড়েছে সাইবারনেটিকস কিংবা বলা যায় সাইবারনেটিকসকে ভরসা করেই এগুলোর উন্নতি ঘটছে। বিতর্ক এড়ানোর উপায় পাওয়া গেছে।
সামাজিক যে সমস্যাগুলো আগে দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে দগ্ধ করত, সেগুলো এখন খোলামেলা চলে আসছে ব্লগে। সমাধান পাওয়ার উপায় নিয়ে যেখানে আগে সমস্যাকে জগদ্দল পাথর মনে করা হতো তা তো এখন আর নেই। সাইবারনেটিকস কী তাহলে মানুষের সমাজকে দৃঢ় সংবদ্ধ করেনি? আসলে সাইবারনেটিকস হাল ধরেছে সবকিছুর। অর্থাৎ সাইবারনেটিকসের আক্ষরিক অর্থ হলো- হাল।
আসলে এই বিষয়ের অবতারণা করে এ লেখাটির একটি উদ্দেশ্য আছে। সেটা হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি নিয়ে আমাদের মূল্যায়ন। আমার যেটা মনে হচ্ছে, সামাজিক প্রেক্ষাপটে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির যে প্রভাব ও চাহিদা রয়েছে সে বিষয়ে সম্যক ধারণা তাদের নেই যারা বিভিন্ন বিষয়ের নীতিনির্ধারণ করছেন। নীতিনির্ধারণী কাগুজে কাজগুলো যদিও তারা কমপিউটার ব্যবহার করেই করছেন, কিন্তু তারপরও ওই প্রযুক্তিটা কতটুকু সামাজিক বলয়কে প্রভাবিত করছে তার কতটুকু হিসাব তাদের কাছে আছে?
এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে আমরা একটা স্লোগানকে সামনে নিয়ে এগুচ্ছি- ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। এই বিষয়টাও কিন্তু গাণিতিক। অর্থাৎ সেই সাইবারনেটিকস- এরই ব্যাপক সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রের ব্যাপার। কিন্তু বাস্তব অবস্থা আমরা যেটা দেখছি, তা হচ্ছে এগুলোর গতিটা বিশ্বমানের নয়। আমরা যেন অনেকটা ভাববাদ নিয়ে ডিজিটাল কাজগুলো করতে চাচ্ছি। মূলত যা করা দরকার তা হচ্ছে- প্রযুক্তির ভেতরে ঢোকা। এর সার্থক ব্যবহারের জন্য যা যা করা দরকার সে কাজগুলো করা। দরকারি বিষয়গুলো এতদিনে না বোঝার কথা নয় নীতিনির্ধারকদের। কারণ, তারা জানেন গণমাধ্যম ও বাণিজ্যিক কর্মকান্ডে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অপরিহার্য। এও তারা জানেন- ভবিষ্যতে মানুষের পেশাগত জীবনের উন্নয়ন করতে হলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সুযোগ সর্বস্তরে পৌঁছানোর বিকল্প নেই। আর এখন যেটা পৌঁছাতে হবে সেটা আধুনিকতমটাই।
এই যে এখন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযক্তি নতুন একটা মাত্রায় উপনীত হচ্ছে এই বাস্তবতাটা সংশ্লিষ্ট সবারই উপলব্ধি করা উচিত। যে হিসাবটা আগে ছিল সে হিসাবটা আর মিলছে না। এখন অনেক দ্রুতগতিতে ও আগের ধারণার চেয়ে ভিন্ন পথে এগুচ্ছে প্রযুক্তির বাস্তবতা। কদিন আগের একটি খবর ছিল- মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ২০১২ সালের নির্বাচনের জন্য প্রচারাভিযানমূলক পরিদর্শনে ফেসবুক কার্যালয় পরিদর্শন করেছেন। মূল লক্ষ্যটা কী? না- তরুণ প্রজন্মের সমর্থন আদায়। বাস্তবতাটা লক্ষণীয়। গত নির্বাচন অর্থাৎ চার বছর আগেও কিন্তু বাস্তবতটা এরকম ছিল না। ফেসবুক তখন পাসটাইম আর বন্ধুত্বেরই ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন দেশে দেশে মানুষের রাজনৈতিক মতামত বিনিময়ের মাধ্যমও হয়ে উঠেছে ফেসবুক, টুইটার ইত্যাকার সব ব্লগ সাইট। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিভিত্তিক সামাজিক-রাজনৈতিক নয়া মূল্যবোধের প্রসারকে মূল্যায়ন না করে এগুলো করা যাবে না। বিতর্ক তোলা যেতে পারে- মার্কিন মুলুকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি, সেখানে অন্যভাবে শিক্ষিত মানুষরা বিষয়টিকে মূল্যায়ন করে। ব্যাপারটা সত্যি, তবে আমাদের জন্যও কিছু সত্যি ব্যাপার আছে। এখানে যত কম মানুষই তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহারকারী থাকুক না কেনো, তাদেরও কিছু গণতান্ত্রিক মতামত আছে। এবং প্রযুক্তির যে মোড় ঘোরার প্রক্রিয়া চলছে তাতে মোবাইল ফোনভিত্তিক রাজনৈতিক উদ্বুদ্ধকরণ প্রক্রিয়া এখানে অসম্ভব নয়। কয়েকটি সূচক এখানে উল্লেখ্য, বাংলায় ফেসবুক ব্যবহারের সম্ভাবনা বাড়ছে, অ্যান্ড্রোয়িড বা সমমানের অপারেটিং সিস্টেমভিত্তিক মোবাইল ফোনের ব্যাপক দাম কমছে, যাদের হাতে এখনও যন্ত্রটি নেই তারাও সহজেই পেয়ে যাবে এবং নতুন প্রযুক্তির উন্নয়ন গোস্যা করে ঠেকানো যাবে না।
এদেশে অনেক সময়ই নতুন প্রযুক্তি নিয়ে নানা বিতর্ক হয়েছে- ভিওআইপি এবং থ্রিজি যার অন্যতম। দেখা যাচ্ছে এগুলোর সুরাহা ঠিকমতো হতে না হতেই অন্যান্য নতুন প্রযুক্তির চাপ এসে পড়ছে। এটা অবশ্যম্ভাবী। চাওয়া-না চাওয়ার কোনো মূল্য নেই এসব ক্ষেত্রে। কাজেই খুব সহজ এবং খোলা মন নিয়ে বুঝতে হবে প্রযুক্তির মোড় বা মাত্রা বদলকে, বুঝতে হবে যে সমাজে-রাজনীতিতেও এর প্রভাব-প্রতিক্রিয়া অমোঘ।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : abir59@gmail.com