• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > স্টিভ জবস : ডিজিটাল যুগের ধ্রুবতারা
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১১ - নভেম্বর
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
স্টিভ জবস
তথ্যসূত্র:
ফিচার
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
স্টিভ জবস : ডিজিটাল যুগের ধ্রুবতারা

নশ্বর দুনিয়া থেকে স্টিভ জবস বিদায় নিলেন। তার মৃত্যুর পরপরই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘স্টিভ ছিলেন মহৎ আমেরিকান আবিষ্কারকদের একজন। তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী চিন্তা করার মতো সাহসী মানুষ। তিনি ভাবতেন, দুনিয়াটাকে তিনি বদলাতে পারেন। আর তার ছিল সেই মেধা, যা দিয়ে তিনি বিশ্বটাকে বদলে দিয়েছেন।’ মনে হয় না, স্টিভ জবস সম্পর্কে এত কম কথায় এরচেয়ে বেশি কিছু বলা যেতে পারে। আমরা যে ডিজিটাল দুনিয়ার কথা ভাবছি, মানবসভ্যতা যে ডিজিটাল সভ্যতায় যাত্রা করেছে, স্টিভ ছিলেন সেই যুগের ধ্রুবতারা। তিনি শুধু একজন মহান আমেরিকান আবিষ্কারক ছিলেন, এই কথাটি মার্কিন প্রেসিডেন্ট তো দাবি করবেনই। কারণ, এই দাবিটি তার দেশের জন্য গর্বের এবং পুরো দুনিয়ার কাছে অহঙ্কার করার মতো একটি বিষয়। তবে আমরা সারা দুনিয়ার মানুষ জানি, তার আবিষ্কার বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে স্পর্শ করেছে। তিনি সারা দুনিয়াকে নতুন সভ্যতার দিকে আলোর মশাল দেখিয়েছেন। আমার ধারণা, অনাদিকাল ধরে তিনি ধ্রুবতারার মতো আইসিটি খাত তো বটেই, ডিজিটাল দুনিয়াকে পথ দেখাবেন।

এরই মাঝে সবাই জেনে গেছেন, আমেরিকার অ্যাপল কমপিউটার কোম্পানির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রধান নির্বাহী স্টিভ জবস গত ৫ অক্টোবর ২০১১ তার নিজ বাড়িতে আপনজনের সামনে ক্যান্সার রোগে মারা গেছেন। এরই মাঝে অতি নীরবে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানও সম্পন্ন হয়েছে। তার মৃত্যু শুধু যে সারা দুনিয়ার আইসিটি খাতকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছে তাই নয়, বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাইকে তুমুলভাবে আন্দোলিত করেছে। বাংলাদেশেও যারা স্টিভসের প্রযুক্তির সুবাদে কমপিউটারে বাংলা লেখেন এবং অতি সাধারণ মানুষ; যারা কমপিউটার বিজ্ঞানী না হয়েও কমপিউটার চর্চা করেন, তাদের জন্য স্টিভ এক অনন্য সাধারণ মানুষ ছিলেন। বিচিত্র ও চ্যালেঞ্জিং জীবনের অধিকারী স্টিভ তার সিরীয় মুসলমান বাবা ও আমেরিকান মায়ের কাছ থেকে পরিত্যক্ত হওয়ার পর আর্মেনীয় অভিবাসী পল ও ক্লারা জবসের পালকপুত্র হিসেবে বেড়ে ওঠেন। শৈশবে তিনি চরম দারিদ্রে্যর মুখোমুখি হন। কথিত আছে, কোনো কোনো সময় তিনি হরেকৃষ্ণ মন্দিরে যেতেন বিনামূল্যের খাবার খেতে। তিনি স্কুলজীবন সমাপ্ত করার পর একটি কলেজে এক সেমিস্টার পড়াশোনা করেন। কিন্তু পরের সেমিস্টারের ফি দিতে না পারায় তিনি কলেজ জীবন সমাপ্ত করতে বাধ্য হন। তিনি পশ্চিমা জীবনযাপনে, সামাজিকতা ও ধর্মাচারে বিরক্ত হয়ে ভারতে আসেন এবং সেখানকার জীবনযাপন ও সংস্কৃতি তাকে এতটাই প্রভাবিত করে যে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন ও একজন বৌদ্ধ হিসেবেই মৃত্যুবরণ করেন। স্টিভ জীবনের শেষ সময়ে দুনিয়ার ৪২তম ধনী মানুষ ছিলেন, যার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা। রাস্তার বালক থেকে এমন সম্পদশালী হওয়ার ঘটনা দুনিয়াতে খুব বেশি নেই। শুধু তাই নয়, ডিজিটাল যুগের প্রধান প্রবাহ মেধাসম্পদকে বিত্তশালী হওয়ার অবলম্বন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রেও স্টিভের দৃষ্টান্ত ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

দারিদ্র্যকে জয় করা, প্রবল প্রতিকূল অবস্থার বিপরীতে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ানো ও সাধারণ মানুষের জন্য প্রযুক্তিকে উন্মুক্ত করায় স্টিভ জবস হলেন তুলনাহীন মানুষ। প্রায় তিন যুগ ধরে সারা দুনিয়ার আইসিটি খাতের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো অসাধারণ প্রতিভাধর স্টিভ জবসের বদৌলতে আমরা বাংলাভাষীসহ দুনিয়ার সব সাধারণ মানুষ আজ তার মাতৃভাষা নিয়ে গর্বের সাথে ডিজিটাল প্রযুক্তির অংশীদার হতে পেরেছি। আজ যে আমরা কমপিউটারে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে পারি, তার ভিত্তিটাও তিনিই প্রথম তৈরি করেন। মেকিনটশ কমপিউটারে মাল্টিপল ফন্ট ও নন রোমান ফন্ট ব্যবহারসহ অপারেটিং সিস্টেমের অনুবাদ করার সুযোগ তৈরি করে তিনি দুনিয়ার সব মাতৃভাষার ডিজিটাল যাত্রার সূচনা করেন। শুধু তাই নয়, সারা দুনিয়ার সব মাতৃভাষার জন্য একটি অভিন্ন এনকোডিং ব্যবস্থা; ইউনিকোড পদ্ধতি গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ নেয় তার প্রতিষ্ঠিত অ্যাপল কমপিউটার কোম্পানি।

১৯৮৪ সালে তিনি যখন মেকিনটশ কমপিউটার তৈরি করেন তখন এর ওএস-কে বাংলায় রূপান্তর করার সুযোগটি প্রথমে কাজে লাগান সাইফুদ্দাহার শহীদ। তিনি একই সাথে অ্যাপলের ম্যাকরাইট নামের একটি অ্যাপ্লিকেশনও বাংলায় অনুবাদ করেন। তারই নাম হয় শহীদলিপি। তবে মেকিনটশকে কেন্দ্র করে ডেস্কটপ পাবলিশিং বিপ্লবটির সূচনা হয় ১৯৮৭ সালের ১৬ মে, যেদিন আনন্দপত্র নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা মেকিনটশ কমপিউটার, অ্যাপল লেজাররাইটার, ম্যাকরাইট আর পেজমেকার দিয়ে প্রকাশিত হয়। এর পরের বছর ১৯৮৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় কিবোর্ড প্রবর্তিত হওয়ার পর বাংলা সংবাদপত্র, মুদ্রণ ও প্রকাশনার বিপ্লবটি চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে। স্টিভ জবসের মেকিনটশ ছাড়া বাংলার মতো শত শত মাতৃভাষা কমপিউটারের এই বিপ্লবে শরিক হতে পারত না। বিশেষ করে মেকিনটশ বাজারে আসার আগে এটি ভাবা যেত না, কমপিউটারের বিশেষ জ্ঞান ছাড়া এই যন্ত্রটি ব্যবহার করা যেতে পারে। ধরে নেয়া হয়েছিল, কমপিউটার যন্ত্রটি শুধু বিশেষ এক শ্রেণীর মানুষ যারা বাইনারি অঙ্ক আর প্রোগ্রামিং জানে, শুধু তারাই ব্যবহার করবে। সেই ডসের যুগের কথা ভাবুন যখন কমপিউটারের পর্দা ভরে থাকত সিনট্যাক্স এররে। মাথায় ভরে রাখতে হতো অসংখ্য কমান্ড আর সিনট্যাক্স। কিন্তু স্টিভ সেই ধারণাটিকে আমূল পাল্টে দেন। তিনি মেকিনটশ কমপিউটারের অপারেটিং সিস্টেমকে এমনভাবে তৈরি করেন যে, এটি ব্যবহার করার জন্য এমনকি সাধারণ ইলেকট্রিক্যাল ডিভাইস পরিচালনার জ্ঞানও দরকার হতো না। এদেশের কোনো একটি প্রকাশনা বা পত্রিকা ডেস্কটপ প্রকাশনার জগতে পা-ই রাখতে পারত না, যদি স্টিভ জবসের মেকিনটশ-ম্যাকরাইট, মাইক্রোসফটের ওয়ার্ড ও এলডাসের পেজমেকার এবং বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের জন্ম না হতো। প্রকাশকদের কাছে তখন ছিল কোটি কোটি টাকার ফটোটাইপসেটারের চমক। নতুন এক প্রযুক্তি, নতুন জনবল এবং অনভিজ্ঞতার মাঝে বিশেষত দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রকাশনা নিয়মিত অব্যাহত থাকবে কি না, সেটি ছিল চিন্তার বিষয়।



স্টিভ জবস ছিলেন ব্যতিক্রমী ভাবনার মানুষ। এই মেধাবী মানুষটির দূরদর্শিতা এতটাই ব্যতিক্রমী ছিল যে, সারা বিশ্বের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিত্বরা যা ভাবতেন এক যুগ পরে, তা তিনি প্রয়োগ করতেন সবার আগে। আশির দশকে ভিসক্যাল্ককে আলিঙ্গন করে তিনি পিসির বিপ্লবটা সম্পন্ন করেন। তিনি সাড়ে তিন ইঞ্চি ফ্লপি ড্রাইভ, মাউস, স্টাইলাস, সিডি ডিভিডি ড্রাইভ, ইউএসবি পোর্ট, ফায়ারওয়্যারসহ অসংখ্য প্রযুক্তি সবার আগে আলিঙ্গন করেন। আজকের আইসিটির যে দুনিয়াটাকে পার্সোনাল কমপিউটার-উত্তর যুগ বলা হয় বা যাকে ল্যাপটপ, ট্যাবলেট পিসি ও স্মার্টফোনের যুগ বলা হয় তিনি সেই যুগটিরও জনক।

কমপিউটার জগতের মানুষেরা যখন মেইনফ্রেম ও মিনিফ্রেম নিয়ে ব্যস্ত, তিনি তখন কমপিউটারকে ব্যক্তিগতকরণের বিপ্লবটি সম্পন্ন করেন। যখন সারা দুনিয়া টেক্সটভিত্তিক অপারেটিং সিস্টেম নিয়ে দারুণ খুশি, তখন তিনি পিসির ওএস-কে গ্রাফিক্স ও মাল্টিমিডিয়া দিয়ে ভরে তোলেন। দুনিয়ার কমপিউটার বিশেষজ্ঞরা যখন বাইনারি হিসাব-নিকাশ ও সিনট্যাক্সনির্ভর প্রোগ্রামিং করার কথা ভাবেন, তিনি তখন মাল্টিমিডিয়া প্রোগ্রামিংয়ের জগৎ তৈরি করেন। গণনা করার কমপিউটারে তিনি অডিও আর ভিডিওর সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। আবার যখন সারা দুনিয়া ডেস্কটপ পিসি নিয়ে ব্যস্ত, তখন তিনি ট্যাবলেট পিসি আর স্মার্টফোনের বিপ্লব করেন। আজ বিশ্বের মানুষ তাকে আইম্যাক, আইপড, আইফোন আর আইপ্যাডের জন্য চেনে। এসব পণ্যের প্রভাব দুনিয়াতে এখন এত বেশি যে, সবাই হয়তো মেকিনটশ, নেক্সটকিউব ইত্যাদির নামই ভুলে গেছে। কিন্তু তিনি শুধু যে কমপিউটার প্রযুক্তির মানুষ ছিলেন না, তার প্রমাণ পিক্সার নামের একটি প্রতিষ্ঠান এবং টয় স্টোরির মতো মুভি। তিনি বিনোদনের ডিজিটাল ধারণার জনক হিসেবেও আমাদের কাছে প্রাতস্মরণীয়।

দুনিয়াবাসী তাকে শুধু প্রথম সফল বাণিজ্যিক কমপিউটারের জনক হিসেবেই জানে না, তাকে জানে কমপিউটারে গ্রাফিক্যাল ইউজার ইন্টারফেস প্রবর্তক হিসেবে। তার হাতে কমপিউটার ব্যবহার যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি কমপিউটারের সাথে কমপিউটারের যোগাযোগ হয়েছে সহজতম। ১৯৮৭ সালে যখন নেটওয়ার্কিং মানে ছিল একজন বিশেষজ্ঞকে দিয়ে সেটআপ করানো। অথচ আমি বাংলাদেশে কমপিউটারের সাথে কমপিউটারের নেটওয়ার্ক স্থাপন করিয়েছি একজন অজ্ঞ অফিস সহকারী দিয়ে। এটি সম্ভব হয়েছিল অ্যাপলটেক নামের এক অসাধারণ প্রযুক্তির জন্য। কমপিউটারে গ্রাফিক্স ও মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার ছাড়াও তিনি কমপিউটারকে শিক্ষার বাহন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। প্রথমে অ্যাপল ও পরে মেকিনটশ কমপিউটারের ওপর ভর করে জন্ম নেয় শিক্ষামূলক ইন্টারেক্টিভ মাল্টিমিডিয়া সফটওয়্যার। তার প্রতিষ্ঠানের হাইপার কার্ড ছিল এক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি।

আমি নিজে একজন বাংলাভাষী এবং বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশের সাধারণ সৃজনশীল মানুষ হিসেবে স্টিভের কাছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মতোই ঋণী। আমি মনে করি, আমার জীবনটা পূর্ণ হতো যদি আমি স্টিভ জবসের সৃজনশীলতা ও মেধার স্পর্শ পেতাম।

আমি খুব দৃঢ়তার সাথেই জানি, তার জন্ম না হলে আমি ও আমাদের মাতৃভাষা ডিজিটাল বিশ্বের বাইরেই থেকে যেত। তার অনুপস্থিতিতে এই শূন্যতা আর কেউ কখনও পূরণ করবে কি না সেটি আমি জানি না। কিন্তু প্রত্যাশা করি, স্টিভ জবস যেন আবার জন্মগ্রহণ করেন। সর্বোপরি আমি বিশ্বাস করি, স্টিভ জবসের মতো নক্ষত্রের দিন কখনও শেষ হয় না। আজ তিনি যখন নেই, তখন আমরা দৃঢ়ভাবেই মনে করছি যে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ধ্রুবতারাটি আর দেখা যাচ্ছে না।


কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : mustafajabbar@gmail.com

পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস