• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > এবারের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ পেল একটি ব্রোঞ্জপদক
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মুনির হাসান
মোট লেখা:৩
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১০ - আগস্ট
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
অ্যাওয়ার্ড
তথ্যসূত্র:
প্রতিযোগিতা
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
এবারের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ পেল একটি ব্রোঞ্জপদক


প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় গণিতবিষয়ক প্রতিযোগিতার নাম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড- আইএমও। ১৯৫৯ সালে রুমানিয়ায় শুরু হওয়া এ অলিম্পয়াড এখন বিশ্বের প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সবচেয়ে বড় মর্যাদার লড়াই। একে বলা হয়, কিং অব অল অলিম্পিয়াড’। গত ৪ থেকে ১৪ জুলাই মধ্য এশিয়ার কাজাখস্তানের রাজধানী আস্তানায় অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫১তম আইএমও। বিশ্বের ৯৭টি দেশের খুদে গণিতবিদদের সাথে সেখানে হাজির ছিল বাংলাদেশের পাঁচ খুদে গণিতবিদ। তারিক আদনান মুন, প্রাণন রহমান খান, কাজী হাসান জুবায়ের, নাফিজা আনজুম প্রমি ও হক মুহম্মদ ইশফাক ষষ্ঠবারের মতো বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে যায় আইএমওতে।

আনন্দ উল্লাস আর কনসার্ট দিয়ে শুরু

আনন্দ-উল্লাস আর কনসার্টের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আইএমও। ৬ জুলাই মঙ্গলবার আস্তানায় স্বাধীনতা প্রাসাদের কংগ্রেস হলে ৫১তম আইএমও’র উদ্বোধন করা হয় দেশটির প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নাজারবায়েভের শুভেচ্ছা বাণীর মাধ্যমে। শুভেচ্ছা বাণী পড়ে শোনান শিক্ষামন্ত্রী জানশিত তুইমেবায়েভ। প্রেসিডেন্ট নুরসুলতান নাজারবায়েভ তাঁর বক্তব্যে আশা প্রকাশ করেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আজকের তরুণেরা আগামী দিনের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলবে।

স্বাধীনতা চত্বরে ৯৮টি দেশের জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়। সেখানে শোভা পায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকাও। বক্তৃতা পর্বের পর রীতি অনুসারে নিজ নিজ দেশের পতাকা নিয়ে মঞ্চে প্যারেড করেন প্রতিযোগীরা। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের পাঁচ প্রতিযোগীও বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। তাঁরা সবাই ‘বাংলাদেশ’ বলে হাঁক দিয়ে মঞ্চ থেকে নেমে আসেন। অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী কাজাখ সঙ্গীত দল গান গেয়ে সবাইকে স্বাগত জানায় এবং শিশুদের দলীয় নৃত্য দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সবশেষে ছিল কনসার্ট।

৬টি সম্পূর্ণ নতুন গাণিতিক সমস্যা

৭ ও ৮ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছে পরীক্ষাপর্ব। প্রথম দিনের পরীক্ষায় তিনটির মধ্যে বীজগণিত, সংখ্যাতত্ত্ব ও জ্যামিতির। দ্বিতীয় দিনে জ্যামিতি, কম্বিনেটরিকস আর বীজগণিতের। আইএমওর নিয়ম হলো এমন ছয়টি সমস্যা দেয়া হবে, যা হবে পুরোপুরি নতুন। পৃথিবীর কোনো বই, ইন্টারনেট কিংবা পরীক্ষা কোথাও এ সমস্যা আগে আসেনি। প্রতিদিন ৩টি করে দুইদিনে সব সমস্যার সমাধান করতে হয়। প্রতিটি সমস্যা সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ নম্বর ৭। তবে, আংশিক নম্বর পাওয়া যায়। প্রতিদিন সময় থাকে ৪ ঘন্টা করে। সমস্যাগুলো নতুন হলেও এর সমাধানের জন্য যে পদ্ধতি ও তত্ত্ব জানা দরকার তা প্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জানার কথা। বিশ্বব্যাপী গণিতের শিক্ষাক্রমে যে পরিবর্তন হয়েছে, সে অনুযায়ী কমবেশি সবদেশেই বিষয়গুলো স্কুল-কলেজে পড়ানো হয়। ১৯৮০-র দশকের গণিত সিলেবাসের পরিবর্তন যেহেতু আমরা ধরতে পারিনি, সেহেতু আমাদের দেশে এর ব্যাতিক্রম। খাতা দেখার সময় বিবেচনায় আনা হয় শিক্ষার্থী সমস্যাটির মূল বিষয়টি ধরতে পেরেছে কী না। কখনোই দেখা হয় না বিশেষ কোন নিয়মের সমাধান! কারণ একটি সমস্যা সমাধানের হাজারো পদ্ধতি থাকতে পারে।



মূল্যায়নের সময় দেখা গেল, ১ নম্বর সমস্যাটি সবচেয়ে সহজ ছিল আর এর পরে ৪ নম্বর। ৬ নম্বর সমস্যা ছিল সবচেয়ে কঠিন। ১ নম্বর সমস্যা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে প্রায় সব দেশেরই। কারণ, শতাধিক ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে এ সমস্যার সমাধান করেছে শিক্ষার্থীরা, যার বেশির ভাগই সঠিক! ফলে নম্বর দেয়া নিয়ে দলনেতাদের সাথে সমন্বয়কারীদের ঝগড়া লেগেই ছিল শেষ সময় পর্যন্ত। আর সমন্বয়ের বেলায় সবচেয়ে সহজ হয়েছে ৪ নম্বর। জ্যামিতির এই সমস্যাটিরও ৫০টির বেশি সঠিক সমাধান ছিল, তবে তেমন কোনো বিতর্ক হয়নি। আমাদের শিক্ষার্থীরা যথাক্রমে মুন ২০, ইশফাক ১৩, জুবায়ের ১২, প্রমি ৭ ও প্রাণন ২ নম্বর অর্থাৎ বাংলাদেশ দলের মোট অর্জন হয় ৫৪ পয়েন্ট।

সমন্বয় শুরু হওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ৮ জুলাই এবারের অলিম্পিয়াডের সবচেয়ে দুঃখজনক পর্ব। গভীর রাতে বিচারকদের এক জরুরি সভায় জানানো হয়, উত্তর কোরিয়ার শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রে অসঙ্গতি লক্ষ করা গেছে। তাদের ৩ ও ৫ নম্বর সমস্যার সমাধানের সঙ্গে সরকারি সমাধানের ‘হুবহু’ মিল রয়েছে। উত্তর কোরিয়ার দলনেতা গোপনীয়তার নীতি ভঙ্গ না করলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। উপস্থাপিত তথ্যের ভিত্তিতে ভোটাভুটিতে উত্তর কোরিয়ার অংশ নেয়া বাতিল করা হয়। ১৯৯১ সালে একই কারণে উত্তর কোরিয়ার অংশ নেয়া বাতিল হয়েছিল। বিচারকদের শেষ সভায় অংশগ্রহণ বাতিল করার পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বাংলাদেশের দলনেতা মাহবুব মজুমদার। দীর্ঘক্ষণের অনির্ধারিত আলোচনায় প্রতীয়মান হয়, কোনো দলের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণের বিষয়টি বর্তমান নিয়মে যথাযথ নয়। সিদ্ধান্ত হয় আগামী বছর থেকে অলিম্পিয়াডের নীতিমালা সংশোধনের।



অন্যদিকে অনানুষ্ঠানিক মূল্যায়নে দেখা যায়, উত্তর কোরিয়ার শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই খুবই ভালো ফল করত। উত্তর কোরিয়ার দুঃখজনক বিদায় ছাড়া এবারের মূল্যায়নকালে কোনো বড় ধরনের ঝামেলা হয়নি।

ছয় স্বর্ণপদক ও ১৯৭ পয়েন্ট পেয়ে চীন গণিতের সেরা

বিচারকদের শেষ সভায় ফলাফল চূড়ান্ত করা হয়। অন্যদিকে ফলাফল ঘোষণার সময় দেখা গেল, ১৬ নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীদের পদক দেয়া হলে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পদক পায়। নিয়মানুযায়ী ৫০ শতাংশের কম পদক দেয়ার কথা। পরে জার্মানির দলনেতার প্রস্তাব অনুসারে ১৫ নম্বরে পদক দেয়ার সিদ্ধান্ত হলে ৫১ শতাংশ শিক্ষার্থী পদক পায়। এবারের আইএমওতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ৪২-এর মধ্যে ২৭ বা এর বেশি নম্বর পেয়েছে, তারা স্বর্ণপদক; যারা ২১-এর বেশি কিন্তু ২৭-এর কম পেয়েছে, তারা রৌপ্যপদক এবং যারা ১৫-এর বেশি কিন্তু ২১-এর কম পেয়েছে, তারা ব্রোঞ্জপদক জিতেছে। গেল কয়েকবারের মতো চীনের শিক্ষার্থীরা ছয়টি স্বর্ণপদক পেয়ে প্রথম স্থান লাভ করেছে। তাদের মোট অর্জন ১৯৭ পয়েন্ট। চারটি সোনা, দুটি রৌপ্য এবং মোট ১৬৯ নম্বর নিয়ে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে রুশ ফেডারেশন। তিনটি স্বর্ণ ও তিনটি রৌপ্যপদক নিয়ে তৃতীয় স্থানে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এবারের আইএমওতে চীনের শিক্ষার্থী জিপেই নিই ৪২-এর মধ্যে ৪২ পেয়ে সেরাদের সেরা হয়েছে।

উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে দুটি রৌপ্য, একটি ব্রোঞ্জপদক এবং মোট ৯৮ পয়েন্ট নিয়ে ভারতের দলীয় অবস্থান ৩৬তম। শ্রীলঙ্কা একটি ব্রোঞ্জপদক ও ৭৮ পয়েন্ট নিয়ে ৫১তম এবং বাংলাদেশ একটি ব্রোঞ্জ পদক ও ৫৪ পয়েন্ট নিয়ে ৬৯তম স্থান লাভ করেছে। তবে এবার বাংলাদেশ গণিত দলে ছয় জন প্রতিযোগীর জায়গায় পাঁচজন আইএমওতে অংশ নিয়েছে। উপমহাদেশের অন্য দেশ পাকিস্তান কোনো পদক পায়নি। ১৯ পয়েন্ট নিয়ে পাকিস্তানের দলীয় অবস্থান ৮৯তম।

এবারের আইএমওতে সৌদি আরব দুটি ব্রোঞ্জপদক পেয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গণিতবিদদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে নয় মাসের প্রশিক্ষণে এই ফল অর্জন করা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন সৌদি দলনেতা। এবার মোট ৯৮টি দেশ অংশ নিলেও উত্তর কোরিয়া মাঝপথে ডিসকোয়ালিফাই হয়ে যায়। ফলে ৯৭টি দেশের ৫১৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মূল লড়াই হয়েছে।

বাংলাদেশ দলের পক্ষে তারিক আদনান ২০ পয়েন্ট পেয়ে ব্রোঞ্জপদক লাভ করেছে। ১ পয়েন্টের জন্য রৌপ্যপদক পায়নি সে। দলের বাকি চার সদস্যের মধ্যে হক মুহাম্মদ ইশফাক ১৩, কাজী হাসান জুবায়ের ১২ ও নাফিজা আনজুম ৭ পয়েন্ট পেয়ে অনারেবল ম্যানশন লাভ করেছে। আর দলের অন্য সদস্য প্রাণন রহমান খান ২ পয়েন্ট পেয়েছে।

যেতে হবে বহুদূর

২০০১ সালে দৈনিক প্রথম আলোর বিজ্ঞান প্রজন্ম পাতায় নিউরনে অণুরণন নাম দিয়ে দেশে প্রথম গণিত অলিম্পিয়াড কার্যক্রম শুরু। ২০০৪ সালে প্রথম আলোর সাথে ডাচ বাংলা ব্যাংক এগিয়ে আসে পৃষ্ঠপোষকতায়। শুরু হয় দেশব্যাপী গণিত উৎসবের আয়োজন। ২০০৫ সালে আমাদের প্রথম আইএমওতে অংশ নেয়া। গেল বছর আমরা প্রথম পদক পেয়েছি আর ২০১০ সালে আমাদের এই কার্যক্রমের এক দশক পূরণ হলো। যে দেশের এসএসসি পরীক্ষায় ইউক্লিডের পদ্ধতি পীথাগোরাসের উপপাদ্য প্রমাণ করতে দেয়া হয়, মুখস্ত বিদ্যাকে যে দেশে বিদ্যার্জনের মূল হাতিয়ার ভাবা হয় সে দেশে গণিতের চমৎকার সৌন্দর্যে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করা এবং তাদেরকে পাঠ্যপুস্তকের বাইরের গণিতের জগতের সাথে সম্পৃক্ত করা একটি কঠিন কাজই বটে। তারপরও গত এক দশক ধরে একদল স্বেচ্ছাসেবী এই্ কাজটিকেই তাদের ব্রত হিসাবে নিয়েছে। তাদের হাত ধরেই একটু একটু করে দিনবদলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বাংলাদেশ।

কঠিন কাজ, তবে অসম্ভব নয়।
একদিন নিশ্চয় আমরা জয় করবো।

[দেশে যারা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে চান তারা এ বিষয়ে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির ওয়েবসাইটে (www.matholympiad.org.bd) খোঁজ রাখতে পারেন। ]
মুনির হাসান : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

কজ ওয়েব
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস
অনুরূপ লেখা