• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের চার বছর
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মানিক মাহমুদ
মোট লেখা:২৪
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১০ - আগস্ট
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
সার্ভিস সেক্টর
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ২
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের চার বছর



ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র তথা ইউআইএসসি নিয়ে গত প্রায় তিন বছরে নানান প্রশ্ন ঘুরেফিরে এসেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল, ইউআইএসসি টেকসই হবে তো? কিভাবে টেকসই হবে? ইউএনডিপির মতো প্রতিষ্ঠানের গবেষণা-প্রসূত কোনো উদ্যোগ টেকসই হবে এবং এক পর্যায়ে তা সরকারি উদ্যোগে পরিণত হবে, এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সমগ্র দেশে, বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের সুবিধা ও অধিকারবঞ্চিত মানুষের দৈনন্দিন জীবনে- তা অনেকের কাছেই ছিল অকল্পনীয় এক বিষয়। পৃথিবীজুড়েই শহর-গ্রাম, ধনী-গরিবের মধ্যে বিদ্যমান যে ডিজিটাল ডিভাইড, বাংলাদেশের মতো গরিব দেশে, তাও আবার ইউনিয়ন পরিষদের মতো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে, তা কমাতে এই উদ্যোগ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা ছিল এক ধরনের স্বপ্নের বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সব সন্দেহ মিথ্যে প্রমাণিত করে দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদে ইউআইএসসি গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০২টি ইউআইএসসি চালু রয়েছে এবং ১০০০ ইউআইএসসি গড়ে তোলার পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। চ্যালেঞ্জ নিয়েই তা শুরু হয়েছে, চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার সম্ভাব্য সব কৌশল কাজে লাগাবার কোনো ঘাটতি রাখা হয়নি। শুধু শুরু হয়েছে এটা বলা যথেষ্ট নয়, সরকার এ উদ্যোগকে জনগণের দোরগোড়ায় সরকারি সেবা পৌঁছাবার সবচেয়ে বড় উদ্যোগ এবং একটি পরিমাপক হিসেবে দেখছে। সরকারের এ সাহসী উদ্যোগ নেয়ার কারণ এর সাথে ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় প্রশাসন যুক্ত। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো স্থানীয় জনগোষ্ঠী এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় এবং এটি টেকসই করার সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত।

২০০৭ : যেভাবে শুরু

কমিউনিটি ই-সেন্টার তথা সিইসি এবং ‘২০০৭ সাল’ ইউএনডিপি বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দু’টি পদবাচ্য। এ বছরেরই মে মাসে সিইসি নামে পাইলট প্রজেক্ট শুরু হয়, তৃণমূল মানুষের হাতের নাগালে আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে কিভাবে সহজে, সুলভে ও দ্রুত তথ্য ও সেবা পৌঁছে দেয়া যায় সে বিষয়ে গবেষণার জন্য। এই গবেষণা শুরু হয় ‘ডেমোক্রেটিক গভর্নমেন্ট থিমেটিক ট্রাস্ট ফান্ড’ (ডিজিটিটিএফ)-এর অর্থায়নে দু’টি ইউনিয়নে। এরপর সিইসি ইউএনডিপির অর্থায়নে Access to Information (A2I) Programme-এর একটি Driver Project হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সিদ্ধান্ত হয় ২০০৭-এর ডিসেম্বরে নীতিনির্ধারকদের পরামর্শ সভায়। Driver Project-এর কাজ শুরু হয় ২০০৮-এর মার্চে। পাইলট প্রজেক্ট শুরু হয় দিনাজপুর জেলার সেতাবগঞ্জ উপজেলার মুশিদহাট ইউনিয়ন পরিষদ এবং সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়ন পরিষদে। সিরাজগঞ্জের মাধাইনগর ইউনিয়ন পরিষদ বেছে নেয়া হয় এই বিবেচনায়, এখানে ইউএনডিপির অর্থায়নে একাধিক কার্যক্রম চালু রয়েছে। তুলনামূলক একটি অগ্রসর ইউনিয়ন পরিষদ, যেখানে বিভিন্ন সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে। এখানে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে, এমন একটি অগ্রসর ইউনিয়ন পরিষদে আইসিটির ব্যবহার কত দ্রুত বিস্তৃত করা যায়।

সিইসি পাইলট প্রকল্প

এই পাইলট প্রজেক্টের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তিনটি। গবেষণার মাধ্যমে :

০১. এমন একটি কমিউনিটি মডেল খুঁজে বের করা, যার মাধ্যমে তৃণমূল মানুষের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর একটি সহজ প্রক্রিয়া বের হবে এবং যে মডেলে থাকবে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত টেকসই হবার সব উপাদান।

০২. এই মডেল নিশ্চিত করবে ইউনিয়ন পরিষদের স্বয়ংক্রিয় নেতৃত্ব এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মালিকানার মধ্য দিয়ে সিইসি হয়ে উঠবে একটি স্থায়ী স্থানীয় সমৃদ্ধ জ্ঞানভান্ডার।

০৩. এই মডেল সরকারি উদ্যোগে সারাদেশের সব ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ার এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হবে।

হরাইজন স্ক্যানিং পরিচালনা :

ইউএনডিপির অর্থায়নে ২০০৭ সালে টেলিসেন্টারের ওপর একটি হরাইজন স্ক্যানিং পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যায়, টেলিসেন্টারের তথ্যভান্ডার ও সেবার ধরন এক টেলিসেন্টার থেকে অন্যটি বেশ আলাদা। হরাইজন স্ক্যানিং থেকে বেরিয়ে আসে টেলিসেন্টারের শক্তি ও দুর্বলতা।

টেলিসেন্টারের শক্তিগুলো ছিল :

স্থানীয় তথ্যকর্মী সৃষ্টি, যাদের পক্ষে সহজে ও দ্রুত স্থানীয় মানুষের তথ্যচাহিদা জানা এবং তা পূরণ করা সম্ভব। স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তথ্যসচেতন ও সংগঠিত করাও তাদের জন্য সহজ। এই তথ্যকর্মীদের তথ্যসেবা দেয়ার মান দিন দিন বাড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তির ওপর তাদের দখল বাড়ার কারণে তাদের পক্ষে মানুষকে সর্বাধুনিক তথ্যসেবা দেয়া সহজ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে একজন মোবাইল লেডি সহজে প্রত্যন্ত এলাকার কোনো নারীর কাছে পৃথিবীর সর্বাধুনিক তথ্যসেবা পৌঁছে দিতে পারছেন।

টেলিসেন্টারের দুর্বলতাগুলো ছিল :

টেলিসেন্টারগুলোতে মবিলাইজেশন প্রক্রিয়া নেই বললেই চলে। যদিও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে তথ্যসচেতনতা ও তথ্যচাহিদা সৃষ্টি করতে মবিলাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ তথ্যসচেতন না হলে, মানুষের মধ্যে ব্যাপক তথ্যচাহিদা না সৃষ্টি হলে কোনো টেলিসেন্টারের পক্ষে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। টেলিসেন্টারের বেশিরভাগ তথ্যভান্ডার মানুষের কাছে এখনো সহজে বোধগম্য নয়। এই তথ্যভান্ডার কতটা কার্যকার হচ্ছে, তা পরিমাপ করার কোনো পদ্ধতিও এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেশিরভাগ টেলিসেন্টার দাতানির্ভর। টেলিসেন্টারগুলো যদি নিজেরা অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারে, তবে তাদের তথ্যসেবার মান গণমুখী করে তোলা কঠিন। তৃণমূল পর্যায়ে টেলিসেন্টারের প্রচারের মান বেশ দুর্বল। যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করে তাদের ধারণা সীমিত বিষয়ের ওপর বলেই এটা হচ্ছে। তথ্যভান্ডারের অনেক তথ্য স্থানীয় মানুষের কাছে নতুন নয়, অর্থাৎ জানা বিষয়। লোকজ জ্ঞানবিষয়ক বেশি তথ্য নেই। তথ্যভান্ডার নিয়মিত হালনাগাদ হবার সুযোগ নেই বললেই চলে। একই তথ্যভান্ডার অনেকে তৈরি করছে।

স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার অভিজ্ঞতা :

সিইসি পাইলট প্রজেক্ট চলার সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো গণগবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা ও মালিকানা গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা। গণগবেষণা হলো মানুষের সাথে মুক্তচিন্তা/স্বাধীনভাবে যৌথ আলোচনা করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম। ২০০৭ সালে ইউএনডিপির উদ্যোগে বাংলাদেশে বিদ্যমান টেলিসেন্টারগুলোর ওপর একটি বেজলাইন সার্ভে পরিচালনা করা হয়। এতে দেখা যায়, তখন পর্যন্ত সরকারি উদ্যোগে কোনো টেলিসেন্টার গড়ে ওঠেনি। তবে বেসরকারি উদ্যোগে একাধিক প্রতিষ্ঠান টেলিসেন্টার পরিচালনা করছে। কিন্তু এসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তখনো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্তায় টেলিসেন্টার পরিচালনায় তাদের মালিকানা গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা অর্জন করেনি। এসব টেলিসেন্টারের ওপর সার্ভে থেকে যে বিষয়টি সবচেয়ে দুর্বলতা হিসেবে উঠে আসে তা হলো, এসব টেলিসেন্টার গড়ে তোলার চাহিদা নির্ণয়ে এবং পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা একেবারেই নেই। কিভাবে টেলিসেন্টার পরিচালনা করলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য বেশি সুবিধা বয়ে আনবে, কোন ধরনের তথ্য ও সেবা টেলিসেন্টারে সবচেয়ে বেশি দরকার, এর ওপর কোনো গবেষণা হয়নি। ফলে সেখানে স্থানীয় মানুষের মধ্যে এই বিষয়ে যেমন কোনো সচেতনতা তৈরি হয়নি, অন্যদিকে তারা সম্পৃক্ত হবার মতো কোনো উৎসাহও পায়নি।

চার ধাপে গণগবেষণা পরিচালিত হয় : যৌথচিন্তা, কাজ, স্বমূল্যায়ন ও যৌথসিদ্ধান্ত।

যৌথচিন্তা :

গণগবেষণা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যৌথচিন্তা নিশ্চিত করে। যৌথচিন্তা যৌথ মালিকানা অর্জন সহজ করে তোলে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা যৌথচিন্তার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় তাদের জন্য তথ্যসেবা পাবার যেসব উপকরণ ইউনিয়ন পরিষদে আছে, কিভাবে এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব। যৌথ আলোচনার মধ্য দিয়ে বের হয়- কী ধরনের তথ্যসেবা তাদের জন্য দরকার এবং তথ্যভান্ডারে যা আছে, তার বাইরে আরো যেসব তথ্য থাকা দরকার তা কিভাবে পাওয়া যেতে পারে। যৌথচিন্তা করে স্থির করা হয়- কেমন ব্যবস্থাপনা হলে ইউনিয়নের যেকোনো মানুষ তার মতো করে ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে তথ্যসেবা পেতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদের স্বয়ংক্রিয় ভূমিকা কেমন হবে- কী পরিবর্তন করা দরকার, যাতে করে ইউনিয়নবাসী মনে করতে পারে তথ্যসেবা দেবার জন্য যেসব উপকরণ ইউনিয়ন পরিষদে আছে তা তাদেরই সম্পদ।

কাজ :

যৌথচিন্তা থেকে যৌথসিদ্ধান্ত। যৌথসিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দরকার কাজ। যৌথচিন্তার মাধ্যমে যেসব সিদ্ধান্ত হয় বা নতুন পথ খুঁজে বের করা হয়, তা বাস্তবায়নের জন্য শুরু করা হয় কাজ। ইউনিয়ন পরিষদের স্বয়ংক্রিয় নেতৃত্ব এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মালিকানাবোধ, তথ্যসচেতনতা, তথ্যচাহিদা নির্ধারণ করার জন্য কী ধরনের কাজ করা দরকার- সেসব কাজের মধ্যে কোন কাজ কে করবে, কাজের প্রক্রিয়া কী হবে, তাও স্থির করা হয় এই যৌথচিন্তার মাধ্যমে। কোনো উদ্যোগকে টেকসই করতে হলে দরকার সে কাজের প্রক্রিয়ায় সর্বোচ্চসংখ্যক স্থানীয় মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক অংশগ্রহণ, যা তাদের মালিকানা নিশ্চিত করে। গণগবেষণার এ শিক্ষা সিইসিতে কাজে লাগাতে স্থির করা হয় তথ্যসচেতনতা ও তথ্যচাহিদা নির্ধারণের কাজ গ্রামবাসী নিজেরাই করবে, স্বেচ্ছায়। এই সামর্থ্য বিকাশে কী ধরনের বাইরের সহযোগিতা দরকার তাও স্থির করা হয় স্থানীয়ভাবে যৌথ আলোচনার মাধ্যমে।

স্বমূল্যায়ন :

সিইসির অগ্রগতি বৈচিত্র্যময়। কারণ, গণগবেষণা নিশ্চিত করে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ এবং নিজেকে প্রকাশ করার সহায়ক পরিবেশ। ইউনিয়ন পরিষদের একটি অন্যতম লক্ষ্য হলো- তথ্যসেবাকে ইউনিয়ন পরিষদের প্রাতিষ্ঠানিক অংশ করে তোলা এবং এটা নিশ্চিত করা, স্থানীয় মানুষ বলতে শুরু করবে তথ্যসেবা পাওয়া তার একটি অধিকার। এ লক্ষ্য অর্জন কতটুকু হলো তার মূল্যায়ন বাইরে থেকে তৈরি কোনো পরিমাপক দিয়ে করা সম্ভব নয়। যারা এ প্রক্রিয়ায় সরাসরি যুক্ত, এ কাজের মাধ্যমে যারা আন্দোলিত, অনুপ্রাণিত, যারা এ কাজের অনুঘটক, তারাই শুধু বলতে পারে, ব্যাখ্যা করতে পারে, বিশে­ষণ করতে পারে সত্যিকারের পরিবর্তন কী হচ্ছে। গণগবেষণায় সবার অংশগ্রহণ অনিবার্য হওয়ায় যে ব্যক্তি সবচেয়ে কম ভূমিকাও পালন করেছে, তার কাছ থেকেও সাবলীলভাবে ব্যাখ্যা আসে। এই সাবলীলতার মধ্যেই তাদের স্বীকৃতি মেলে। স্বেচ্ছাব্রতী মানসিকতা গড়ে ওঠার একটি ভিত্তিও এখানে নিহিত।

নতুন চিন্তা :
মূল্যায়নের পর নতুন ধারণা, নতুন অভিজ্ঞতা আসে। এই অভিজ্ঞতা নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করে। নতুন চিন্তা আর নতুন অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে আবার শুরু হয় যৌথচিন্তা। প্রথমে যেভাবে চিন্তা শুরু হয়, সেই চিন্তার ধারাবাহিকতায় যে অগ্রগতি ঘটে এবার শুরু হয় তার ওপর দাঁড়িয়ে নতুন স্তরে যাত্রা শুরু করার লক্ষ্যে যৌথচিন্তা। হরাইজন স্ক্যানিং থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশে টেলিসেন্টারের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বলতম অংশ হলো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ। যে মানুষের জন্য তথ্যসেবা নিশ্চিত করতে এত আয়োজন, তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে অদূর ভবিষ্যতে এ প্রক্রিয়া থেকে কোনো উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত ও সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে- এমনটা ভাবা অযৌক্তিক। একই সাথে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সবার কাছে সহজে ও সুলভে তথ্যসেবা পৌঁছে দেবার কোনো মডেল বের করা সম্ভব না হলে সরকার এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নিতে আগ্রহী হবে না- এটাই স্বাভাবিক।

২০০৮ সাল টেকসই মডেল

সিইসি কী করে টেকসই হবে, সিইসি কী করে জাতীয় মূল স্রোতধারার অংশ হয়ে উঠবে, ২০০৮ ছিল তা উদ্ভাবনের বছর। গবেষণার মধ্য দিয়ে এ বছরেই উদ্ভাবিত হয় সফল মডেল, নির্ণীত হয় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য কী ধরনের তথ্য ও সেবা দরকার, কিভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা ও মালিকানা দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে, কিভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর একটি অংশ এই মালিকানাবোধ তৈরির প্রক্রিয়ায় স্বেচ্ছাশ্রম বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হবে, কিভাবে সরকারি মাঠকর্মীরা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সেবা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখতে শুরু করবে প্রভৃতি।

সাফল্যের ৫ স্তম্ভ :

সিইসি গবেষণার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হলো ‘সফলতার ৫ স্তম্ভ’ খুঁজে বের করা। এই ৫ স্তম্ভ ইঙ্গিত করে কিভাবে আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় সহজে, দ্রুত ও সুলভে সেবা পৌঁছে দেয়া যায়, বিশেষ করে সুবিধা ও অধিকারবঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে। একই সাথে সেবা দেয়ার এই মাধ্যম কিভাবে টেকসই হবে, কিভাবে এতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা বাড়তে থাকবে অর্থাৎ সিইসি’র সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হয়ে ওঠার অন্তর্নিহিত যে শক্তি- তা নিহিত রয়েছে এই ৫ স্তম্ভের মধ্যেই।

তথ্যভান্ডার ও সেবা :

কোনো টেলিসেন্টারের জন্য তথ্যভান্ডার শুধু সহজে বোধগম্য হওয়াটাই যথেষ্ট নয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কাছে তথ্যভান্ডার ও সেবা হতে হবে নতুন, যা তাদের প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম। সেজন্য তথ্যসেবাকে হতে হবে চাহিদাভিত্তিক। এমন তথ্য নয়, যা তাদের জানা। যেকোনো টেলিসেন্টারের একটি মূল্যবান তথ্যভান্ডার হলো লোকজ জ্ঞান। এ ধরনের জ্ঞান এলাকার ও এলাকার বাইরে থেকে খুঁজে বের করার এবং তা থেকে শিক্ষা নেবার একটি প্রক্রিয়া চলমান রাখা খুবই জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা জরুরি যে, লোকজ জ্ঞান তথ্যভান্ডারের একটি মূল্যবান অংশ। মাধাইনগর আর মুশিদহাট ইউনিয়নে পরিচালিত বেজলাইন সার্ভে থেকে বেরিয়ে আসে বিদ্যমান টেলিসেন্টারগুলোতে যে ধরনের তথ্যভান্ডার ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বেশিরভাগই সরবরাহভিত্তিক। সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে এই দূরত্ব। মানুষের দোরগোড়ায় তথ্যসেবা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে এক বিরাট বাধা হিসেবে কাজ করে। দেখা যায়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবন-জীবিকায় তথ্যপ্রযুক্তি যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, সে সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো ধারণাই নেই। এর প্রধান কারণ তাদের তথ্যসচেতনতার অভাব। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি এখনো এখানকার বেশিরভাগ মানুষের কাছে বিস্ময়ের পর্যায়েই রয়ে গেছে। তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আগ্রহী। তবে প্রবীণদের মধ্যে প্রযুক্তিভীতি কাজ করে বেশ। তাদের মন্তব্য- ‘ভালোই তো চলছে, কী দরকার এসবের।’ শিক্ষিত অগ্রসরদের মতামত হলো- ‘আধুনিক প্রযুক্তি আমাদের বিশেষ করে তরুণদের ধ্বংস করে দেবে।’ এই ভীতি বেশি কাজ করে যারা কোনো না কোনোভাবে নেতৃত্বের সাথে জড়িত। অথচ মানুষ হাতের কাছে তথ্য ও সেবা চায়। স্থানীয় মানুষ মনে করে, অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের তুলনায় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা সহজ। তারা মনে করে, ইউনিয়ন পরিষদে তথ্য থাকার সুবিধা হলো আমরা যখন-তখন সেখানে যেতে পারব, প্রয়োজনে পরামর্শ করতে পারব। সুবিধা ও অধিকারবঞ্চিত মানুষদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তথ্য সংগ্রহ করার জন্য তাদের উপজেলা সদর পর্যন্ত যেতে হয়।

লাগসই প্রযুক্তি :

সিইসি’র অভিজ্ঞতা হলো- তথ্যকেন্দ্রের প্রযুক্তি হতে হবে অবশ্যই সহজে ব্যবহারযোগ্য, সুলভ মূল্যের এবং যা স্থানীয় বাজারে সবসময় পাওয়া যায়, এককথায় লাগসই প্রযুক্তি। তথ্যকেন্দ্রের তথ্যভান্ডার (অফলাইন ও অনলাইন) এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে করে প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রাথমিক ধারণা বা অভিজ্ঞতা আছে তার পক্ষেও সহজেই মানুষের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্য দ্রুত খুঁজে দেয়া সম্ভব হয়। তৃণমূল মানুষের উপযোগী প্রযুক্তিবিষয়ক তথ্য থাকতে হবে পর্যাপ্ত। এই প্রযুক্তি কাজে লাগাবার জন্য যে ধরনের উপকরণ দরকার, তা যদি মানুষ স্থানীয়ভাবেই সংগ্রহ করতে না পারে, তবে সেই প্রযুক্তির তথ্য হাজির করা অযৌক্তিক হবে। মানুষ যে ধরনের প্রযুক্তির ধারণা পাবে, সেই প্রযুক্তিকেও হতে হবে এমন, যার সাথে লোকজ জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষের পক্ষেই ফলাফলে অভিনব পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়।

অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব :

সিইসির আয়ের মূল উৎস বাণিজ্যিক সেবা। যেমন- ই-মেইল করা, ইন্টারনেট ব্যবহার, কম্পোজ, প্রিন্টিং, ফটোগ্রাফি, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ভাড়া প্রভৃতি। প্রশিক্ষণ থেকেও আয় করা সম্ভব- কমপিউটার প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ। কমপিউটার প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সতর্কতার বিষয় হলো এর চাহিদা ব্যাপক থাকলেও তা করা উচিত সীমিত পরিসরে, ধাপে ধাপে। প্রচলিত কোর্স পরিচালনা করে কিছু দিন আয় বাড়ানো সম্ভব। তবে এ আয়কে স্থায়ী করতে হলে বয়স ও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স তৈরি করতে হবে এবং এর ব্যয় হতে হবে অবশ্যই সুলভমূল্যে। প্রশিক্ষণ থেকে এ আয়কে স্থায়ী করে তুলতে আর একটি উদ্যোগ নিতে হবে তা হলো এ প্রশিক্ষণের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা। প্রশিক্ষণ পরিচালনায় স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে এ গ্রহণযোগ্যতা সহজেই আনা সম্ভব।

সরকারি-বেসরকারি মাঠকর্মীদের তথ্যকর্মীর ভূমিকা : সিইসিকে এগিয়ে নিতে স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাও সম্পৃক্ত হয়েছিলেন যা সত্যিকার অর্থেই এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করে। গ্রামের মানুষের মধ্যে অনেক আস্থা তৈরি হতে শুরু করল যখন তারা দেখল শিক্ষকরা সিইসিতে এসে কমপিউটার-ইন্টারনেট শিখছেন, ছাত্রছাত্রীদেরও অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে। শিক্ষকদের এই সম্পৃক্ততা ছাত্রছাত্রীদের আইসিটি অ্যাম্বাসেডর হয়ে উঠতে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছিল। সিইসিতে সরকারি-বেসরকারি মাঠকর্মীদের যুক্ত হবার ঘটনা ছিল সত্যিকারের আর একটি নতুন মাত্রা। তারা সিইসিতে নিয়ম করে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে বসতে শুরু করে। এ ঘটনা খুবই সারা ফেলল। কারণ, মানুষ যাদের দেখাই পেত না, দেখা পেলেও পাত্তা পেত না, তাদের কি-না এখন সিইসিতে পাওয়া যাবে এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ করা যাবে কোনো রকমের হয়রানি ছাড়াই। পাশাপাশি সিইসির কারণে এই মাঠকর্মীরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি অভিজ্ঞ, দক্ষ, তৎপর।

টেকসই হবার নতুন পথ : শুরু থেকেই সিইসির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল কি করে তার অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিশ্চিত হবে। বিষয়টি ছিল নতুন, কারণ বাংলাদেশে তখনো পর্যন্ত কোনো টেলিসেন্টারের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ঘটনা ঘটেনি। অন্যদিকে সিইসির বাস্তবতা হলো এই অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা ঘটতে হবে ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততায়। মাধাইনগর ও মুশিদহাট ইউনিয়নে সিইসি সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে শুরু করেছে, যার ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে একটি শক্তিশালী মবিলাইজেশন প্রক্রিয়া। নিবিড়ভাবে মবিলাইজেশন করা সম্ভব হয়েছে বলেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর একটি অগ্রাধিকার ভাবনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল কি করে সিইসি অর্থনৈতিকভাবে টেকসই হবে। টেলিসেন্টারের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য দরকার একটি সুষ্ঠু ব্যবসায় পরিকল্পনা। মাধাইনগর ও মুশিদহাট ইউনিয়ন সিইসির জন্য আলাদা আলাদা ব্যবসায় পরিকল্পনা তৈরি করে। এই ব্যবসায় পরিকল্পনার আলোকেই তাদের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রক্রিয়া অগ্রসর হতে থাকে- সেখানে দৃষ্টান্তমূলক একাধিক অভিজ্ঞতা অর্জন হতে থাকে।

পারিবারিক তথ্যসেবা কার্ডের নমুনা

২০০৯ : সরকারি উদ্যোগে ইউআইএসসি, জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি স্থানীয় সরকার বিভাগ শুরু করে ২০০৮ সালেই। ২০০৮ সালের শেষ দিকেই স্থানীয় সরকার বিভাগের সাথে আলোচনা শুরু হয় কিভাবে সিইসির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদে তথ্য ও সেবা দেয়ার প্রক্রিয়ার বিস্তৃত ঘটানো যায়। সিদ্ধান্ত হয় কুইক উইন উদ্যোগ হিসেবে স্থানীয় সরকার বিভাগ এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এটুআই-স্থানীয় সরকার বিভাগের মধ্যে স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরে এনআইএলজির উদ্যোগে ফিজিবিলিটি স্টাডিও করা হয়। স্থানীয় সরকার বিভাগ এনআইএলজির মাধ্যমে ২০০৯-এ সিইসির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ৩০টি ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র (সিইসির পরিবর্তিত নাম) স্থাপন করে। একই বছর তা ১০০টিতে পৌঁছায়। ইউআইএসসির জন্য উদ্যোক্তা মডেল বেছে নেয়া হয়। এ মডেল অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ের দু’জন তরুণ উদ্যোক্তা, একজন নারী, একজন পুরুষ যারা কমপক্ষে এইচএসসি পাস, কমপিউটার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা আছে, ইউআইএসসির জন্য ন্যূনতম পঞ্চাশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করার সামর্থ্য আছে, তাদেরই উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। মডেলের শর্ত অনুযায়ী আংশিক উপকরণ ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও সরবরাহ করা হয়। এই উদ্যোক্তার সাথে ইউনিয়ন পরিষদের চুক্তি হয় (কমপক্ষে ২ বছরের জন্য) ইউআইএসসি থেকে আসা সব আয় এই উদ্যোক্তা গ্রহণ করবে। উদ্যোক্তা বাছাই করা হয় সমন্বিতভাবে- উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নেতৃত্বে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের সম্পৃক্ততায়। উদ্যোক্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং ইউআইএসসির জন্য তথ্যভান্ডারের সাপোর্ট আসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম থেকে।

২০১০ : লক্ষ্যমাত্রা ৪৪৯৮ ইউনিয়ন পরিষদ

স্থানীয় সরকার বিভাগ লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে আগামী ডিসেম্বর ২০১০-এর মধ্যে সব ইউনিয়নে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবা কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শেষ করবে। ইতোমধ্যে ১০০০ ইউআইএসসি স্থাপনের লক্ষ্যে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ শুরু করেছে। আগস্ট মাসের মধ্যে ১০০০ ইউআইএসসি স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হবে। আগস্ট-ডিসেম্বর মাসের মধ্যে অবশিষ্ট ইউনিয়নসমূহের উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। ইউএনওরা ইতোমধ্যে উদ্যোক্তাদের নাম পাঠাতে শুরু করেছেন।

প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ :
উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের জেলা পর্যায়ে স্থাপিত কমপিউটার ল্যাবে তাদের অ্যাসিসট্যান্ট প্রোগ্রামারদের নেতৃত্বে। এই প্রোগ্রামারদের জন্য প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণ দেয় এটুআই প্রোগ্রাম। এ পর্যন্ত ১৬০ জন প্রশিক্ষক তৈরি করা হয়।

জেলা ফোকাল পয়েন্ট :
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হলেন জেলা ফোকাল পয়েন্ট। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তাদের জেলা ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়। তাদের দায়িত্বের মধ্যে অন্যতম বিষয়গুলো হলো জেলা পর্যায়ে যেসব ডিজিটাল উদ্যোগ বাস্তবায়ন হবে তার সমন্বয় করা। ইউআইএসসি হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কিত কাজের মধ্যে বর্তমানে অন্যতম প্রধান একটি। এই প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব জেলা ফোকাল পয়েন্টের। ইউএনওর দায়িত্ব হলো সঠিক উদ্যোক্তা বাছাই করে দেয়া।

ইউআইএসসি ব্লগ :
এটুআই এই ব্লগটি জুন ২০১০ মাসে তৈরি করে। শুরুতে এই ব্লগটি প্রশিক্ষকদের ফলোআপ করার কাজে ব্যবহার হলেও খুব শিগগিরই তা পরিণত হয় অনলাইনে সমস্যা ও সমাধানের এক শক্তিশালী হাতিয়ারে। এই ব্লগে এখন সদস্যসংখ্যা পাঁচ শতাধিক। এই ব্লগের লেখকরা হলেন বিসিসির প্রশিক্ষক, ইউআইএসসি উদ্যোক্তা, জেলা ফোকাল পয়েন্ট, উপজেলা ফোকাল পয়েন্ট, জেলা প্রশাসক, এনআইএলজি কর্তৃপক্ষ, বিসিসি কর্তৃপক্ষ। লেখকের সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। একাধিক ফলাফল সৃষ্টি হচ্ছে এই ব্লগের মাধ্যমে। যেমন অনলাইনে উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ ফলোআপ করা যাচ্ছে, প্রশিক্ষণ সম্পর্কিত সমস্যা ও এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করা যাচ্ছে, প্রশিক্ষণের মান বাড়ানো সম্পর্কিত পরামর্শ পাওয়া যাচ্ছে, প্রশিক্ষকরা স্বীকৃতি পাচ্ছে, উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হচ্ছে, ফোকাল পয়েন্ট তাদের নেয়া কার্যক্রম/খবর (যেমন- ডিজিটাল বাংলাদেশবিষয়ক কর্মশালা) সবাইকে জানাবার সুযোগ পাচ্ছে। ব্লগের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের কিছু সফলতার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

মবিলাইজেশন :
ইউআইএসসি টেকসই করার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শক্তিশালী একটি মবিলাইজেশন প্রসেস দাঁড় করানো। এখানেও অন্যদের সম্পৃক্ততা লাগবে। কেননা, স্থানীয় সরকার বিভাগের সরাসরি মবিলাইজেশন করার অভিজ্ঞতা নেই। মবিলাইজেশন কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হবে বার্ড, আরডিএ, বিআরডিবি ও বাংলাদেশ টেলিসেন্টারের মতো প্রতিষ্ঠান। আলোচনা চলছে এসব প্রতিষ্ঠান কিভাবে মবিলাইজেশন কার্যক্রম চালাবে, এর অর্থ কোথা থেকে আসবে। সম্ভাব্য একটা পথরেখা হলো বার্ড, আরডিএ, বিআরডিবি, বাংলাদেশ টেলিসেন্টারের একদল কর্মকর্তাকে মবিলাইজেশন বিষয়ে টিওটি দেয়া হবে, এরপর এরা তাদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ইউআইএসসির উদ্যোক্তাদের মবিলাইজেশন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করবে।

চ্যালেঞ্জ নিয়েই কিছু দৃষ্টান্ত :
এনআইএলজি এক জরিপ থেকে দেখিয়েছে, ২০০৯ সালে যে ১০০টি ইউআইএসসি শুরু হয়েছে এর মধ্যে ৫০ ভাগের বেশি ইউআইএসসি সফলভাবে টেকসই হয়েছে। এসব ইউআইএসসির অনেকের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার বেশি। সিলেটের গোলাপগঞ্জ ইউআইএসসিতে এলাকার প্রশিক্ষণ চাহিদা মেটাতে উদ্যোক্তা-ইউপি চেয়ারম্যান মিলে ১৮টি কমপিউটার কিনেছে। সেখানে প্রশিক্ষণ থেকে এমনও হয়েছে মাসে ২০ হাজার টাকাও এসেছে। এর চেয়ে কম আয়, কিন্তু একই ধরনের একাধিক ইউআইএসসি রয়েছে এই ১০০টির মধ্যে। নেত্রকোনার উদ্যোক্তা মারজুকা ইয়াসমিন জানায়, তার মাসিক আয় গড়ে ৩ হাজার টাকা। মারজুকার মতে, মবিলাইজেশন ঠিকমতো হলে ইউআইএসসির আয় বাড়ানো কোনো ব্যাপারই নয়। সব ইউআইএসসিতে মবিলাইজেশন প্রক্রিয়া ঠিকভাবে দাঁড় করাতে পারাই একটি চ্যালেঞ্জ। তবে এর চেয়েও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো শুধু প্রশিক্ষণ থেকে আয় আসা। গোলাপগঞ্জে দেখা যায়, সেখানে প্রশিক্ষণই প্রধান এবং একমাত্র কাজ হয়ে উঠেছে। এমন ধারা প্রধান হয়ে উঠলে এবং এটা বিস্তৃত হতে থাকলে ইউআইএসসির যে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ‘নলেজ হাব’ হয়ে ওঠার কথা, সে সম্ভাবনা হারিয়ে যেতে পারে। তবে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। স্থানীয় সরকার বিভাগ নেতৃত্ব দিচ্ছে বটে, কিন্তু সমন্বয়ের জন্য যে গতি যেমন পরিকল্পনা দরকার তা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এনআইএলজি মাঠ পর্যায়ে দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছে বটে, কিন্তু এনআইএলজি কি আদৌ তৈরি এ কাজের জন্য। সেই দক্ষতা আর লোকবল কি আছে? পাশাপাশি ইউআইএসসির টেকসই হবার ক্ষেত্রে আর একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো পর্যাপ্ত সার্ভিস না থাকা। জাতীয় পর্যায়ে সেই পরিমাণ ই-সার্ভিস এখনো তৈরিই হয়নি, তৃণমূল জনগোষ্ঠীর জন্য যত ধরনের সেবা চাহিদা আছে তার ওপর।

তথ্য অধিদফতরের সম্পৃক্ততা :
মবিলাইজেশনের কাজে একটি নতুন মাত্রা হলো, এ প্রক্রিয়ায় তথ্য অধিদফতরের সম্পৃক্ত হবার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। খোলামেলাভাবে বলা যায়, বর্তমানে এই দফতরটির মাঠ পর্যায়ে বিশেষ কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। পরিকল্পনা হচ্ছে, জেলায় জেলায় জেলা তথ্য কর্মকর্তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রচারণা চালাবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রচারণা চালাবার জন্য যা কিছু কনটেন্ট তৈরি হবে, তা থাকবে এ দফতরের প্রতিটি জেলা অফিসে। সেখানে তৈরি হবে এই প্রচার চালাবার জন্য একদল দক্ষ কর্মীবাহিনী। জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেবার যে কর্মযজ্ঞ সরকার হাতে নিয়েছে এর সত্যিকারের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জেলা তথ্য কর্মকর্তারা এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। খুব শিগগিরই কিভাবে তারা এই প্রচারের কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারবে, সে ব্যাপারে দক্ষতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হবে। এ প্রশিক্ষণ আয়োজন হবে তথ্য মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে।

নতুন ব্যবস্থাপনা :
শুরুর দিকে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের মাঠ পর্যায়ের আমলারা ইউআইএসসির ব্যাপারে খুব একটা সময় দিত না। এনআইএলজি থেকে অনেক তাগাদা যেত, কিন্তু তা তেমন কাজ করতো না। এতে ইউআইএসসির জন্য যে উদ্যোক্তা বাছাই করা হতো তা খুব একটা ভালো হতো না। এখন আর সেই দিন নেই। পাল্টে গেছে বাস্তবতা। গত দেড় বছরে জেলা প্রশাসকদের, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদের, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে। এসব প্রশিক্ষণে ডিজিটাল বাংলাদেশ কী, কেনো ও কিভাবে বাস্তবায়ন হবে তা যেমন বলা হয়েছে, তেমনি এর সফল বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের এসব সরকারি কর্মকর্তার কী দায়িত্ব, তাও স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করা হয়েছে। দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। এখানে নতুন ব্যবস্থাপনা যা দাঁড়িয়েছে তা হলো, এখন এই সরকারি কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টির ওপর মালিকানা তৈরি করতে পেরেছে। নিজেরা ইনসেনটিভ খুঁজে পাচ্ছে। তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। এসব কর্মকর্তা ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কিত সব উদ্যোগকে অনলাইনে ডকুমেন্ট করার চেষ্টা করছে। যেমন ইতোমধ্যে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকরা জেলা ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে অনলাইনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে মাসিক প্রতিবেদন পাঠাবার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানদেরও ডিজিটাল বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা রাজনৈতিকভাবে কোনো বাধা তৈরি না করেন। বহু জেলায় উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের মধ্যে সত্যিকারের সমন্বয় ঘটেছে। সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করেছে ইতোমধ্যে একাধিক জেলায়। জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায় তো উপজেলা চেয়ারম্যান ডিজিটাল বাংলাদেশের গতি যাতে না কমে এবং ২০১০ সালের মধ্যেই যাতে করে তার উপজেলা ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসে সেজন্য ৩০টি মডেম সরবরাহ করেছেন এবং একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। জেলা ফোকাল পয়েন্ট এ পরিকল্পনা তৈরির কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, প্রায় সব এডিসি এটুআই থেকে যে ইউআইএসসি ব্লগ তৈরি করেছে তাতে নিয়মিত লিখছেন।

প্রশিক্ষণ থেকেও আয় করা সম্ভব- কমপিউটার প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ। কমপিউটার প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সতর্কতার বিষয় হলো এর চাহিদা ব্যাপক থাকলেও তা করা উচিত সীমিত পরিসরে, ধাপে ধাপে। প্রচলিত কোর্স পরিচালনা করে কিছু দিন আয় বাড়ানো সম্ভব। তবে এ আয়কে স্থায়ী করতে হলে বয়স ও পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স তৈরি করতে হবে এবং এর ব্যয় হতে হবে অবশ্যই সুলভমূল্যে। প্রশিক্ষণ থেকে এ আয়কে স্থায়ী করে তুলতে আর একটি উদ্যোগ নিতে হবে তা হলো এ প্রশিক্ষণের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করা।

ইউআইএসসির জন্য উদ্যোক্তা মডেল বেছে নেয়া হয়। এ মডেল অনুযায়ী ইউনিয়ন পর্যায়ের দু’জন তরুণ উদ্যোক্তা, একজন নারী, একজন পুরুষ যারা কমপক্ষে এইচএসসি পাস, কমপিউটার সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা আছে, ইউআইএসসির জন্য ন্যূনতম পঞ্চাশ হাজার টাকা বিনিয়োগ করার সামর্থ্য আছে, তাদেরই উদ্যোক্তা হিসেবে নির্বাচন করা হয়। মডেলের শর্ত অনুযায়ী আংশিক উপকরণ ইউনিয়ন পরিষদ থেকেও সরবরাহ করা হয়।

শেষ কথা

এভাবেই অর্জিত প্রতিটি অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে যে মুহূর্তেই একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে এগিয়ে চলছে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়ন।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : manikswapna@yahoo.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
পাঠকের মন্তব্য
৩০ সেপ্টেম্বর ২০১০, ৯:০৯ AM
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস