কোরিয়ার বিজ্ঞানীরা স্মার্টফোনকে আরো স্মার্ট করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা চিকিৎসা বিজ্ঞানে কাজে লাগাতে চান এই প্রযুক্তিকে। দিতে চান চিকিৎসাবিদ্যা, যাতে করে ব্যবহারকারীরা ঘরে বসেই ওই স্মার্টফোনের মাধ্যমে নিজের যাবতীয় চিকিৎসাসেবা পেতে পারেন। ইতোমধ্যেই স্মার্টফোনে কথা বলা, ম্যাসেজ পাঠানো, ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ, ইন্টারনেট ব্রাউজিংসহ নানা কাজ করা যাচ্ছে।
কোরিয়া অ্যাডভান্সড ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি তথা কেএআইএসটির একদল বিজ্ঞানী জানিয়েছেন, মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা অবশ্যই বিরক্তিকর। এই বিরক্তিকর অপেক্ষার অবসান ঘটানোরই চেষ্টা চলছে। গবেষণা সফল হলে একদিন স্মার্টফোনই করতে পারবে মেডিক্যাল পরীক্ষা, এমনকি জানাতে পারবে ক্যান্সারের মতো রোগ আছে কি না। বায়োমলিকুলার পদার্থ শনাক্তের জন্য টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব, মেডিক্যাল পরীক্ষায় যেগুলো করা হয়।
ডয়েচে ভ্যালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফলিত রসায়ন বিষয়ক জার্মান জার্নাল, আনগেভান্টে শেমিতে প্রকাশ হয়েছে কোরীয় বিজ্ঞানীদের এই গবেষণা। এ বিষয়ে গবেষক হিয়ুন-জিউ পার্ক জানান, টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাতের স্পর্শে ডিজিটাল স্বাক্ষর শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। একই ধারণায় সুনির্দিষ্ট প্রোটিন এবং ডিএনএ শনাক্ত করা যেতে পারে। প পার্কের সাথে এই গবেষণায় রয়েছেন বিয়ং-ইয়ন ওন।
স্মার্টফোন, পিডিএ এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের টাচস্ক্রিন সাধারণত ব্যবহারকারীর শরীরের ইলেকট্রনিক চার্জ শনাক্ত করতে পারে। প্রোটিন এবং ডিএনএ মলিকুলাসের মতো বায়োকেমিক্যালগুলো বিশেষ ধরনের ইলেকট্রনিক চার্জ বহন করে। কেএআইএসটি জানিয়েছে, গবেষকদের পরীক্ষায় দেখা গেছে টাচস্ক্রিন সেটির ওপরে রাখা ডিএনএ মলিকুলাসের অবস্থান শনাক্ত করতে পারে। এটি একটি প্রাথমিক সাফল্য, যা একদিন মেডিক্যাল পরীক্ষার মতো কাজে স্মার্টফোন ব্যবহারের সম্ভাব্যতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। পার্ক জানিয়েছেন, আমরা নিশ্চিত হয়েছি টাচস্ক্রিন প্রায় ১০০ ভাগ নিখুঁতভাবে ডিএনএ মলিকুলাস শনাক্ত করতে পারে।
গবেষকরা বর্তমানে একটি বিশেষ ধরনের ফিল্ম তৈরির চেষ্টা করছেন, যাতে রিঅ্যাক্টিভ ম্যাটেরিয়াল থাকবে, যা বিশেষ ধরনের বায়োকেমিক্যাল শনাক্তে সক্ষম হবে। গবেষকদের আশা, এই প্রক্রিয়ায় টাচস্ক্রিন বিভিন্ন ধরনের বায়োমলিকুলার বিষয় শনাক্তের ক্ষেত্রে সফলতা দেখাবে। বলাবাহুল্য, টাচস্ক্রিন বায়োমলিকুলার ম্যাটেরিয়াল শনাক্তে সক্ষম হলে, তা হবে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। তবে সামগ্রিক গবেষণার পথে এটি প্রথম ধাপ।
এটা খুবই স্বাভাবিক, টাচস্ক্রিনের ওপর রক্ত কিংবা মলমূত্র রেখে সেগুলো পরীক্ষা করতে কেউ রাজি হবে না। পরীক্ষার জন্য এ ধরনের নমুনা একটি বিশেষ কাপড়ে ধারণ করে, সেটি টাচস্ক্রিনের ওপর রাখা যেতে পারে। পার্ক মনে করেন, স্মার্টফোনে একটি নতুন হার্ডওয়্যার যোগ করা যেতে পারে, যা পরীক্ষার ‘এনট্রেন্স পয়েন্ট’ হিসেবে কাজ করবে। তিনি বলেন, মানুষের আঙুলের ছোঁয়া যেভাবে টাচস্ক্রিন শনাক্ত করে, একইভাবে পরীক্ষার নমুনা শনাক্ত করবে।
স্মার্টফোনকে এভাবে রোগ নির্ণয় যন্ত্র হিসেবে কবে নাগাদ ব্যবহার করা যেতে পারে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ ঘোষণা করেননি গবেষকরা। তাই এটিকে আপাতত একটি সম্ভাবনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
এদিকে শিগগিরই আসতে যাচ্ছে ‘স্মার্ট অ্যাপ্লায়েন্সেস’। এর মধ্যে রয়েছে বুদ্ধিমান রেফ্রিজারেটর, ওভেন, রোবটিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ইত্যাদি। স্মার্টফোন দিয়ে ওই সব বুদ্ধিমান গ্যাজেটগুলোকে কাজের নির্দেশ দিলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারা তা করে দেবে। তাই নিজে ঘরে না থেকেও রান্না তৈরি হয়ে যাবে আপনার কমান্ডে। এতদিন এ ধরনের ভাবনাকে শুধু কল্পকাহিনী বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু সেদিন আর নেই। এবার বাস্তব রূপ দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে সম্প্রতি শেষ হওয়া কনজিউমার ইলেকট্রনিক শো-তে এ ধরনের গ্যাজেট প্রদর্শন করা হয়েছে।
স্মার্ট অ্যাপ্লায়েন্স তথা বুদ্ধিমান তৈজসপত্র উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে আছে দক্ষিণ কোরিয়ার এলজি কোম্পানি। তারা মেলায় এমন একটা রেফ্রিজারেটর নিয়ে এসেছিল, যাতে একটা টাচস্ক্রিন রয়েছে। ফ্রিজের ভেতরে কী, কোন জায়গায় রয়েছে, সেটা লেখা রয়েছে ওই স্ক্রিনে। এ ছাড়া ফ্রিজে থাকা দুধের মেয়াদ কতদিন আছে সেটাও স্ক্রিনে দেখা যাবে। এই ফ্রিজকে বাইরে থেকে স্মার্টফোনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন- আপনি বাজার করার সময় ফোনের মাধ্যমে জেনে নিতে পারবেন ফ্রিজে কী কী আছে, আর কী কী কিনতে হবে। আপনি যদি ফ্রিজকে জানিয়ে দেন আপনি কী রান্না করতে চান, তাহলে ফ্রিজ সেটা জানিয়ে দেবে ওভেনকে। আর ওভেন সে অনুযায়ী কাজ শুরু করে দেবে। অর্থাৎ ওই সব গ্যাজেট কমান্ডের ভিত্তিতে কাজ করবে। তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করবে এবং কমান্ড বাস্তবায়ন করবে। এসব সেবা নিশ্চিত করতে গ্যাজেটগুলোর মধ্যে ওয়াই-ফাই কানেক্টিভিটি থাকতে হবে। এলজির গবেষকেরা সে চেষ্টাই করে যাচ্ছেন। একই সাথে ঘরের কাজে সহায়ক এসব যন্ত্রপাতিকে জ্বালানিসাশ্রয়ী করতেও গবেষণা করছেন তারা।
দক্ষিণ কোরিয়ার আরেক কোম্পানি স্যামসাংও বুদ্ধিমান ফ্রিজ নিয়ে কাজ করছে। তাদের উদ্ভাবিত ফ্রিজকে শুধু বলবেন, এটা-ওটা প্রয়োজন। ব্যাস, ফ্রিজই সেটা বাজার করে আনবে। ব্যাপারটা এরকম- ফ্রিজে যে টাচস্ক্রিনটা রয়েছে সেটা ব্যবহার করে ফ্রিজকে জানিয়ে দিতে হবে এক কেজি আপেল আর এক হালি ডিম দরকার। সাথে সাথে ফ্রিজ সেটা এসএমএস করে জানিয়ে দেবে দোকানিকে। দোকানি তখন সেগুলো বাসায় পৌঁছে দেবেন। অবশ্য এজন্য কতগুলো নির্দিষ্ট দোকানের সাথে ফ্রিজের সংযোগ থাকতে হবে। দেশটিতে সংক্ষিপ্ত পরিসরে এই ব্যবস্থা ইতোমধ্যেই চালু হয়ে গেছে।
স্মার্টফোন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় এমন একটি ভ্যাকুয়াম ক্লিনারও তৈরি করেছে এলজি। তিনটি ক্যামেরা সজ্জিত ওই রোবটিক ক্লিনারের মাধ্যমে দেখা যাবে ঘরের কোথায় ময়লা জমে আছে। পরে কমান্ড করলে ক্লিনার তা পরিষ্কার করতে শুরু করবে।
এলজি যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জন টেলর বলেছেন, ‘কানেক্টেড হোম’ ধারণার একটা অংশ হলো এই সব স্মার্ট অ্যাপ্লায়েন্স। বাইরে থেকে ঘরের জিনিসপত্র ব্যবহার করতে পারাই এর লক্ষ্য। খুব শিগগিরই এগুলো সাধারণ ব্যবহারকারীদের কেনার সামর্থ্যের মধ্যে চলে আসবে।
অ্যাসোসিয়েশন অব হোম অ্যাপ্লায়েন্স ম্যানুফ্যাকচারার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ম্যাসনার বলেছেন, গত বছরের মেলায় একটা বড় প্রশ্ন ছিল, কবে নাগাদ স্মার্ট অ্যাপ্লায়েন্সগুলো বাজারে আসবে। গত এক বছরে এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যখন সাধারণ মানুষও এসব বুদ্ধিমান যন্ত্রগুলোর মালিক হতে পারবেন।
ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের মেলা ‘কনজিউমার ইলেকট্রনিক্স শো’ তথা সিইএস শেষ হয়েছে গত মাসে। প্রতিবছর জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত হয় এই মেলা। এবারও বিশ্বের বড় বড় কোম্পানি তাদের পণ্য নিয়ে এসেছিল মেলায়। মেলার ‘সেরা গ্যাজেট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে একটি টেলিভিশনের নাম। দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি এলজির তৈরি এই টিভির নাম ‘ইএম৯৮০০’। ৫৫ ইঞ্চির টিভিটি মাত্র ৪ মিলিমিটার পুরু। এ ছাড়া এতে ব্যবহার করা হয়েছে ‘অর্গানিক লাইট এমিটিং ডায়োড’ বা ওএলইডি প্রযুক্তি। ফলে ছবি হবে নিখুঁত। এ বছরের তৃতীয় ভাগে টিভিটি বাজারে আসতে পারে।
নোকিয়া এনেছিল ‘লুমিয়া ৯০০’ নামের একটি টাচস্ক্রিন ফোন। এতে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ ফোন ৭ সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। মেলায় এটি ‘সেরা সেলফোন’-এর পুরস্কার পেয়েছে। মার্কিন চিপ তৈরির প্রতিষ্ঠান ইন্টেল চীনা কমপিউটার প্রস্ত্ততকারক লেনোভোর সাথে মিলে মেলায় আনে ‘কে ৮০০’ নামের একটি স্মার্টফোন। বছরের দ্বিতীয় ভাগে এটি আসছে। চীনা কোম্পানি হুয়াওয়ে আনে ‘এসেন্ড পিওয়ানএস’ নামের একটি স্মার্টফোন। এটি বিশ্বের সবচেয়ে পাতলা স্মার্টফোন, যার পুরুত্ব ৬.৬৮ মিলিমিটার। মেলায় ‘সেরা কমপিউটার’ বিবেচিত হয়েছে এইচপির ‘এনভি ১৪’। চলতি মাস থেকেই পাওয়া যাবে এটি। তাইওয়ানের কোম্পানি আসুস আনে সাত ইঞ্চি স্ক্রিনের ট্যাবলেট। এলজির নতুন রেফ্রিজারেটরে ‘ব্লাস্ট চিলার’ নামে একটি বিশেষ অংশ রয়েছে, যেটি অল্প সময়ে বিয়ার বা এই জাতীয় পানীয় শীতল করতে সক্ষম।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : sumonislam7@gmail.com