ডিজিটাল বাংলাদেশে চলছে ডিজিটাল দুর্নীতি
কৃষি বিপ্লবের পর শিল্প বিপ্লব, শিল্প বিপ্লবের পর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির বিপ্লব। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে সেই সব দেশ সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছে, যারা যুগের চাহিদাকে উপলব্ধি করে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। আর যেসব দেশ যুগের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে সমানতালে চলতে পারেনি, সেসব দেশ অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে গেছে অনেক। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ ধারা আজও অব্যাহত।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার যখন প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়, তখন থেকে দেশে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কিছু উন্মাদনা সৃষ্টি হয়, যা অন্য সরকারের আমলে দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ আমলেই ইন্টারনেটের ব্যাপক বিস্তারের বীজ যেমন রোপিত হয় তেমনি মোবাইল ফোন স্ট্যাটাস সিম্বলের খোলস পাল্টে হয়েছে সর্বসাধারণের জন্য অপরিহার্য এক অনুষঙ্গ। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বেকারত্ব অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পাশাপাশি অর্থনীতির উন্নতির চাবিকাঠি হবে। সে উপলব্ধিতে প্রথম টার্মে আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষণা দিয়েছিল প্রতিবছর দেশে দশ হাজার আইটি গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা হবে। অবশ্য এ লক্ষ্য অর্জিত শুধু হয়নি বললে ভুল হবে বরং বলা যায় লক্ষ্য পূরণের ধারেকাছেও যায়নি। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের গাফিলতি ও অদক্ষতার কারণে। অবশ্য এর সাথে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগও।
আইটি নিয়ে সরকারের কর্মকান্ডে যে উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল তার অনেকটাই ব্যাহত হয় দুর্নীতির ফলে। তখন সরকারের দূরদৃষ্টির অভাবে অনেক বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় আইটিসংশ্লিষ্ট প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো এদেশের মানুষকে প্রতারিত করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়ে গেছে। আর ভেঙে চুরমার করে দিয়ে গেছে এদেশের সাধারণ মানুষের আইটি নিয়ে আশা-আকাঙ্ক্ষা, যা অর্থ হারানোর চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর। এর প্রভাবে পরবর্তী পর্যায়ে দেখা গেছে আইটি বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশনে ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপক অনীহা। আর তার ফল আমরা হারে হারে টের পাচ্ছি এখন।
শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার যখন আবার দ্বিতীয়বারের মতো দেশ পরিচালনার সুযোগ পায় তার মূলে ছিল তাদের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রচারণা। বলা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতিই আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনে সুযোগ করে দেয় অনেকাংশে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বর্তমান সরকার বেশ কাজ করছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেয়। তবে প্রত্যাশিত গতিতে নয়, যে গতিতে কাজ করলে সরকারের লক্ষ্য পূরণ হতো এবং বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশের কাতারে নিজেদের নাম লেখাতে পারত।
ইতোমধ্যে সরকারের উন্নয়নমূলক অনেক কর্মকান্ডই সমালোচিত হয়েছে, হয়েছে বিতর্কিত- যা নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক হইচই পড়ে গেছে। এসব ক্ষেত্রের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো যোগাযোগ, কাস্টমস, জ্বালানি, বিদ্যুৎ খাত। এসব খাতে দুর্নীতি হলে চোখে দেখা যায়, বুঝা যায়। এর ফলে দেশের সাধারণ মানুষ তাৎক্ষিণতভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার প্রতিকারের লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপও গৃহীত হয়।
কিন্তু দুর্নীতি যদি হয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে, তাহলে কি আমরা বুঝতে পারি? জানতে কি পারে দেশের সাধারণ মানুষ? ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে উন্নয়নমূলক অনেক কর্মকান্ড হাতে নেয়া হয়েছে এবং যেগুলোর বাস্তবায়নে কাজ চলছে। এসব ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে, যা সড়ক, নৌ বা অন্যান্য খাতে দুর্নীতির মতো দৃশ্যমান নয় এবং সহজে বুঝাও যায় না। তাই এসব খাতের দুর্নীতিকে ডিজিটাল দুর্নীতি বলে অনেকে আখ্যায়িত করেছেন। যেভাবে দুর্নীতিগুলো হয়েছে বা হচ্ছে তাতে ডিজিটাল দুর্নীতি বললে ভুল হবে না।
বাংলাদেশে যেসব ডিজিটাল দুর্নীতি হচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম একটি খাত হলো ব্যাংক খাত। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অটোমেশনের কাজ চলছে। দুঃখজনক হলো এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কাজ পাচ্ছে না দুর্নীতির কারণে। এসব ক্ষেত্রে ভারতীয় কোম্পানিগুলো এদেশের মুষ্টিমেয় কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার পকেটে মোটা অঙ্কের টাকা গছিয়ে দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমরা কেউ দেখতে বা বুঝতেও পারছি না। এসব দুর্নীতির মাত্রা এত ব্যাপক তা কল্পনা করা যায় না। যেমন কোনো একটি ব্যাংক বিশেষ কোনো কাজ ৫ কোটি টাকা দিয়ে করিয়ে নেয় ভারতীয় কোম্পানির কাছ থেকে। অথচ সেই কাজের জন্য বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান প্রায় অর্ধেক খরচে করে দেয়ার জন্য অফার করে। কিন্তু তারা কাজটি পায়নি। শোনা যায় বেশ বড় অংকের ঘুষ লেন-দেন হয় এখানে। আবার সেই একই ধরনের কাজ আরেকটি ব্যাংক করিয়ে নিচ্ছে ২০ কোটি টাকা দিয়ে। আর এটি সম্ভব হচ্ছে বিশাল অঙ্কের টাকা ডিজিটাল হরিলুটের কারণে। আর মজার ব্যাপার হলো প্রত্যেক ক্ষেত্রেই কাজগুলো পায় ভারতীয় কোম্পানিগুলো। সে কোম্পানির থাকুক আর না থাকুক। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশী কোম্পানিগুলো কাজ পায় না। শুধু তাই নয়, অনেক কম খরচে কাজগুলো করার অফারও করছে বাংলাদেশেী কোম্পানীগুলো। যারা এসব কাজ ভারতীয়দের হাতে তুলে দিচ্ছে তারা মূলত নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য করছে। তারা দেশের শত্রু তো বটে, বলা যায় নব্য রাজাকার বা ভারতীয় দালাল।
সরকার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাইলে প্রথমে দরকার সব ধরনের দুর্নীতি বন্ধ করা। বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্পের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইলে সফটওয়্যারসংশ্লিষ্ট কাজগুলো অবশ্যই বাংলাদেশী কোম্পানিগুলোকে দিয়েই করাতে হবে। কোনো অবস্থাতেই বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দেয়া যাবে না। কেননা, বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্প এখন যথেষ্ট পরিপক্ব হয়েছে। অর্থাৎ আগের সে অবস্থা এখন আর নেই বাংলাদেশী সফটওয়্যার শিল্পের। যেসব কাজ বাংলাদেশের পক্ষে কোনোভাবে করা সম্ভব নয়, শুধু সেসব কাজ বিদেশী কোম্পানিগুলোকে দিয়ে করানো যেতে পারে এবং সেখানেও যেনো বাংলাদেশের কোম্পানির অংশ নিতে পারে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কার্যক্রম কিছুটা হলেও অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
অবন্তী
কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
....................................................................................................................................................................................................................................
ইন্টারনেটের ব্যবহার সর্বব্যাপী হোক
আমরা সবাই জানি, বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে চাই উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, যা হতে হবে আধুনিক ও দ্রুততম। আর এজন্য চাই ইন্টারনেট। কেননা ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব, যা অন্য কোনো মাধ্যমে সম্ভব নয়।
বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করে তা অনেকাংশে ব্যাহত হয়েছে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা তথা ইন্টারনেটের সুবিধা দেশব্যাপী ও সুলভ মূল্যে না হওয়ায়।
বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে এখনো ইন্টারনেট পৌঁছেনি। যদিওবা পৌঁছেছে কিছু কিছু অঞ্চলে তাও আবার সবার নাগালের মধ্যে নেই। উচ্চমূল্যের কারণে ইন্টারনেট আমাদের দেশে ব্যয়বহুল হওয়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম একটি হলো অধিক শুল্কহার। বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর শুল্ক কর ১৫ শতাংশ। দেশের আইসিটিসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর সম্পূর্ণ শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আসছে।
সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর শুল্ক প্রত্যাহারের উদ্যোগ নিয়েছে, যা শিগগির কার্যকর করা হবে। আমরা চাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অতি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর শুল্ক প্রত্যাহার করবে। সেই সাথে প্রত্যাশা করি সাধারণ ব্যবহারকারীরা যাতে আরো কম খরচে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে তার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেবে খুব শিগগিরই। আর ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।
শহিদুল্লাহ