লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম:
হিটলার এ. হালিম
মোট লেখা:১৪
লেখা সম্পর্কিত
ইই ফান্ডের ঋণ অনুমোদনে আরও সতর্ক হওয়া দরকার
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে সফটওয়্যার ব্যবসায়ের সাথে জড়িতরা ইইএফ তথা ইকুইটি অ্যান্ড এন্টারপ্রিনারশিপ ফান্ড থেকে ঋণ নিলে আর ফেরত দেন না। সরকারের ইইএফ তহবিল থেকে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ীদের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার তালিকাটি বেশ লম্বা। এই ঋণের বিপরীতে কোনো ইকুইটি (সম্পদ বন্ধক) না থাকায় ঋণ আদায় সম্ভব হচ্ছে না। ঋণদাতা কর্তৃপক্ষ বারবার তাগাদা দিলেও কোনো কাজ হয় না। জানা গেছে, এই টাকা আদায়ে মামলা হতে পারে। তবে ঋণ নেয়া ১১ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে তিনটি প্রতিষ্ঠান। ঋণ নিয়ে ফেরত না দেয়ার তালিকায় সফটওয়্যার নির্মাতা ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) এক সাবেক সভাপতিও আছেন। তবে ঋণ নিয়ে সম্পূর্ণ টাকা ফেরত দিয়েছে এমন সংখ্যাও খুব কম, মাত্র তিনটি প্রতিষ্ঠান।
সফটওয়্যার ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল ব্যাংক ঋণের। কিন্তু সফটওয়্যার ভার্চুয়াল পণ্য হওয়ায় কোনো ব্যাংক সফটওয়্যার খাতে ঋণ দিত না। ১৯৯৬ সালে সরকার এই ব্যবসায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ইইএফ নামে একটি তহবিল গঠন করে তথ্যপ্রযুক্তি ও কৃষি খাতের ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণদানের জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংককে দায়িত্ব দেয়া হয় এই ঋণের টাকা বিতরণের। শুরুতে ঋণ নেয়ার শর্ত সহজ থাকায় খুব বেশি কিছু যাচাই বাছাই না করে ঋণ অনুমোদন দেয়া হয়। ২০০১ সালের পরে এ খাতে অসংখ্য প্রকল্পে টাকা দেয়া হয়েছে। গুরুতর সব অনিয়মও ওই সময়ে সংঘটিত হয়। সে সময়ে ঋণগ্রহীতাদের বেশিরভাগই খেলাপি।
জানা যায়, ইইএফ থেকে প্রকল্পের জন্য ঋণ নিলে তা ৮ বছরের মধ্যে বাই ব্যাক (ফেরত) করতে হয়। ওই সময়ের মধ্যে তা পরিশোধ করতে না পারলে পরে সেটা ঋণে পরিণত হয় এবং তা সুদে-আসলে পরিশোধ করতে হয়। এ বিষয়ে ইইএফ সিলেকশন কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ কমপিউটার সমিতির (বিসিএস) সাবেক সভাপতি মোস্তাফা জববার বলেন, ‘বেশিরভাগ অনিয়ম হয় ২০০৬ পর্যন্ত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার (২০০৭ ও ২০০৮) এসে এই ফান্ড বন্ধ করে দেয়। আমরা পরে এটি আবার চালু করি এবং কিছু নতুন ফার্ম টাকা পায়। আমি যতদিন ছিলাম কোনো কনসালটিং ফার্ম এতে যুক্ত থাকতে পারেনি। আবেদনকারীকে ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে। এখনও অনিয়মের খবর পেলে তা প্রতিরোধ করার চেষ্টা করব।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৫১ প্রতিষ্ঠান ইইএফ থেকে ঋণ নিয়েছে। এর আগে নেয়া ঋণের সঠিক কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি এই ৫১ প্রকল্পের মূল্য ছিল ১৯৮ কোটি টাকা। আর অনুমোদন সীমা ছিল ৮৩ কোটি টাকা। আইসিবি (ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ) মোট অর্থ ছাড় করেছে ৫৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা।
ইইএফ গঠনের শুরুর দিকে ঋণ নিয়ে এখন পর্যন্ত পরিশোধ করেনি টেকনোহ্যাভেন, স্টেরয়েড, ডেভনেট, স্পিল ম্যাক্রোসফট, মিলেনিয়াম, ফরনিক্স সফট, এক্সপার্ট কমপিউটার, ইন্টিগ্রেটেড সলিউশন্স, ইলেকট্রোকাফট, দি ডিকোড লিমিটেড, ইনফোরেভ, র্যালিসোর্স, মাল্টি মাইক্রোটেক নামের প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঋণদানকারী সংস্থা আইসিবির কর্মকর্তারা সংশ্লিষ্ট ঠিকানায় গিয়ে খুঁজে পায়নি এমন ১১ প্রতিষ্ঠান হলো ক্রিস্টাল ইনফরমেশন, মারফি মাক্কান কনসালট্যান্ট, ড্রিম সফট, নো ভিশন, ইন্টারসেক্ট সফটওয়্যার, রিসোর্স টেকনোলজি, জুপিটার আইটি, ইলেকট্রনিক ডিজিটাল সিস্টেম ইনফরমেশন টেকনোলজি, ম্যাট্রিক্স, আলফা সফট, আরাফাত ইনফরমেশন টেকনোলজি। আর প্রযুক্তি ব্যবসায় না করে নিষ্ক্রিয় আছে এমন তিনটি প্রতিষ্ঠান হলো গাঙ্কি লিমিটেড, ফাইভ-এম ইনফোটেক, আইজেন সফটওয়্যার। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অনেকে ইইএফ থেকে ঋণ নিয়ে অন্য ব্যবসায়ে টাকা খাটিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। অনেকে ঋণ নিয়ে দেশে ব্যবসায় গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। ঋণ নেয়ার সময় প্রতিষ্ঠানগুলো যে ঠিকানা আবেদনপত্রে দিয়েছিল পরে কর্মকর্তারা সে ঠিকানায় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর খুঁজে পায়নি।
তবে ব্যতিক্রমও আছে। ঋণ নিয়ে সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করেছে এমন তিনটি প্রতিষ্ঠান ইনফোরেভ লিমিটেড, ডাটাএজ ও ইনফরমেশন টেকনোলজি কনসালট্যান্ট লিমিটেড। এ ছাড়া মায়েস্ত্রো প্রাইভেট লিমিটেড ও এক্স-নেট লিমিটেড মোট টাকার কিছু অংশ পরিশোধ করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইইএফ তহবিলে প্রথমবার ১৫০ কোটি এবং দ্বিতীয়বার ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। শুরুতে এর সাথে বাংলাদেশ ব্যাংক জড়িত থাকলেও ২০০৯ সাল থেকে আছে আইসিবি। ওই তহবিলে এখনো পর্যাপ্ত টাকা থাকলেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবসায়ীদের সৃষ্ট জটিলতার কারণে ঋণ নেয়া এখন অনেক কঠিন হয়ে গেছে। সিলেকশন কমিটির কারিগরি অনুমোদনের পরে মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশেই ঋণ মঞ্জুর হয়ে থাকে। বরাবরই ঋণ অনুমোদন ও মঞ্জুর প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত বেসিস। এ প্রসঙ্গে বেসিসের সভাপতি ফাহিম মাশরুর বললেন, ‘আমার জানা মতে ইই ফান্ডে এ পর্যন্ত ৫০০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। বেসিসের কোনো সদস্য যদি ইই ফান্ডের ডিফল্টার হয় তাহলে প্রচলিত আইনে আইসিবি ব্যবস্থা নেবে।’ আগের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার দায়ভার বাংলাদেশ ব্যাংকেই নিতে হবে দাবি করে তিনি বলেন, ‘একটি প্রতিষ্ঠান তো আর এক দিনে ব্যর্থ বা হাওয়া হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক তো অনেক দিন সময় পেয়েছে। তাহলে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেনো বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের নজরদারিতে আনেনি।’ তিনি জানান, বেসিস বর্তমানে কোনো প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয়ার আগে সবকিছু ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে তবেই অনুমোদন দিয়ে থাকে।
ইইএফ থেকে (২০১০-১১ অর্থবছরে) টেক হান্টস টেকনোলজিস লিমিটেড ২০১০ সালের ১২ আগস্ট প্রথম কিস্তিতে নিয়েছে ৫৫ লাখ এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে নিয়েছে ৬০ লাখ (মোট ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা), ভারটেক্স সফটওয়্যার লিমিটেড ওই বছরেরই ৬ সেপ্টেম্বর প্রথম কিস্তিতে নিয়েছে ৬৫ লাখ এবং ২০১১ সালের ৭ জুন দ্বিতীয় কিস্তিতে ৪০ লাখ (মোট ১ কোটি ৫ লাখ), অপটিমাম সলিউশন্স লিমিটেড ৫৫ লাখ, কপোট্রনিক ইনফোসিস্টেমস লিমিটেড ৭০ লাখ, দি ডাটাবিজ সফটওয়্যার লিমিটেড ৯৫ লাখ, বিজনেস অটোমেশন লিমিটেড ৮০ লাখ, এথিকস অ্যাডভান্স টেকনোলজিস লিমিটেড ৮৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা ইই ফান্ড থেকে ঋণ নিয়েছে।
২০১১-১২ অর্থবছরে ইউওয়াই সিস্টেমস লিমিডেট ৫৫ লাখ, ইউএস সফটওয়্যার লিমিটেড ৫০ লাখ, অপটিমাম সলিউশন্স লিমিটেড দ্বিতীয় কিস্তির ৩৬ লাখ, ডেল্টাটেক লিমিটেড ৫৫ লাখ এবং কমপিউটার গ্রাফিকস অ্যান্ড ডিজাইন লিমিটেড ৪৪ লাখ টাকা ইইএফ থেকে ঋণ নিয়েছে।
জানা যায়, চলতি অর্থবছরে (২০১২-১৩) এরই মধ্যে ৮-১০টি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইইএফ থেকে ঋণ নিয়েছে।
কজ
ফিডব্যাক : hitlarhalim@yahoo.com