লেখা সম্পর্কিত
								
								
								
									লেখার ধরণ:
									
										ডিজিটাল বাংলাদেশ									
									
								 
																
								
								
							 
						 
						
						
										ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন ও বাস্তবতা 						
						
							
বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মঞ্চ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা উচ্চারিত হওয়ার পর থেকে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিষয়টি বোঝার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। তরুণ প্রজন্ম- যাদের চোখে আগামী দিনের নানা রঙের স্বপ্ন রয়েছে- দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছে। তাদের স্বপ্নের পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে।
আমরা যারা বিজ্ঞানের বিদ্যায় বিদ্বান হওয়ার সুযোগ পাইনি - হয়তো যোগ্যতা ছিল না বলেই, কর্মসূত্রে কমপিউটারপ্রযুক্তির জগতে বিচরণ করার সুযোগ পেয়েছি, তারা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণাটির লক্ষণাদি সম্পর্কে বছর কয়েক আগে থেকেই কিছু কিছু অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের প্রণেতা মোস্তাফা জববার ১৯৯৭ সালের শুরু থেকে মাসিক কমপিউটার জগৎ-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ডিজিটাল বাংলাদেশের অবয়ব সম্পর্কে নিয়মিত লিখে আসছিলেন। মোসত্মাফা জববারের লেখা ডিজিটাল বাংলাদেশ কেমন হবে সে সম্পর্কিত একটি কর্মসূচিও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। অনেক বিষয়ে আমি দারুণভাবে উল্লসিত হয়েছি এই ভেবে যে, একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা এবং মুক্ত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য এরকম সমাজ ব্যবস্থা খুবই দরকার।
সম্প্রতি ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এবং বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারটি শিক্ষিত সমাজের মধ্যে দারুণভাবে ইতিবাচক সাড়া জাগিয়েছে। এর মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে তরুণ সমাজের পাল্লা অনেক ভারি হবে- এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপ-শিরোনামে (১০.৫) দেশের প্রতিভাবান তরুণ এবং আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সর্বতভাবে সহায়তা দিয়ে সফটওয়্যার শিল্প ও আইটি সার্ভিসের বিকাশ সাধনের কথা বলা হয়েছে এবং আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে- এতে রফতানি বাড়বে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এই ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তরুণ সমাজ বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছে বলে আমার ধারণা। কারণ, নতুন গড়ে ওঠা ব্যাপকভিত্তিক সফটওয়্যার শিল্পের প্রাণশক্তি হবে তরুণ সমাজ।
৩ জানুয়ারি ২০০৯ দৈনিক যুগামত্মর পত্রিকার ক্যাম্পাস পাতায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু ছাত্রছাত্রীর মতামত নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে নাদিয়া সুলতানা পিংকি বলেছে, ‘আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রসত্মাব দিয়েছে আমি এটার প্রত্যাশী। শুধু আমি নই, আমাদের বন্ধুদের বেশিরভাগই এই একটিমাত্র কারণে মহাজোটকে ভোট দিয়েছে।’ শাকিল হাসান বলেছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি তরুণদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে।’ আরিফুর রহমান লিমন, বলেছে, ‘তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির যে চমক শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন, এর কারণে আমি আশাবাদী যে বাংলাদেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা নেই। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতায় এ বিষয়ে বিসত্মারিত কিছু বলা হয়নি। জনসভার বক্তৃতায় সেটা সম্ভবও নয়। কাজেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান তরুণ সমাজকে এতটা প্রভাবিত করেছে এবং কিভাবে- সে বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, আমাদের বর্তমান তরুণ সমাজ, বিশেষ করে স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা সচেতন জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো কিভাবে চলছে, কিভাবে আরও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- এসব খবর তারা রাখে। তারা জানে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গতিশীল এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্য বাসত্মবায়ন করতে হলে সমাজ পরিচালনার সবকিছু ডিজিটালপ্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য পৃথিবীর প্রতিটি প্রামেত্মর প্রতিটি ক্ষেত্রের প্রতি মুহূর্তের ঘটমান তথ্য সর্বক্ষণিকভাবে সহজলভ্য হতেই হবে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অর্জিত জ্ঞানই হবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল উপাদান। ডিজিটাল পদ্ধতিনির্ভর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার সেই সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে। এবারের নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণকারীর বেশিরভাগই মমত্মব্য করেছেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করা, সন্ত্রাস দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, বেকার সমস্যার সমাধান করা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদির সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ১ কোটি ১০ লাখ নতুন ভোটারদের মধ্যে বিশেষ করে তরুণদের দারুণভাবে প্রভাবান্বিত করেছে এবং এসব বিষয়ে তারা আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা স্থাপন করেছে।
বিগত দুই বছর ধরে মোসত্মাফা জববার বিভিন্ন পত্রিকায় অবিরাম ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে লিখে আসছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা, লক্ষ্য এবং বাসত্মবায়নের পথ সম্পর্কে নানারকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার কর্মসূচির ডিজিটাল ব্যবস্থা অংশে বলা হয়েছে, ‘সরকারের প্রচলিত কাজ করার পদ্ধতি বদল করে ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। ডিজিটাল সরকার বলতে সরকারের সব তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ, সরাসরি ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন রিয়েলটাইম যোগাযোগ এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারের সব কাজ করাকে বোঝায়। এজন্য সরকারের থাকবে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ ও নেশনওয়াইড নেটওয়ার্ক। সরকারের সব তথ্য থাকবে কেন্দ্রীয়/বিকেন্দ্রিকৃত ডাটাবেজে। কেন্দ্রীয়/স্থানীয় ডাটাবেজটির সব তথ্য সত্মরভিত্তিক বিন্যসত্ম হবে। যার যেসব তথ্য নিয়ে কাজ, সে সেসব তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ বা ব্যবহার করতে পারবে।
সরকারের সব অফিস, বিভাগ, মন্ত্রণালয়, স্বায়ত্তশাসিত-আধা স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সংসদ, জেলা সংসদ, উপজেলা সংসদ ও গ্রাম সংসদ এবং প্রশাসনের সব সত্মর এই নেটওয়ার্কে সরাসরি অনলাইনভাবে যুক্ত থাকবে। এমনকি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবের প্রয়োজনীয় অংশ এই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ (যেমন আয়কর-দুর্নীতি দমন কমিশন) সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে নাগরিকদের প্রাইভেসি বহাল রাখতে হবে।’ দুই পর্যায়ে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন অংশে বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে দুটি পর্যায়ে সরকারের বর্তমান কাজ করার পদ্ধতির পরিবর্তন হবে। প্রথম পর্যায়ে ডিজিটাল পদ্ধতির পাশাপাশি কাগজের ব্যাকআপ থাকবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করার পর কাগজের ব্যাকআপ ফাইল তৈরি করে রাখা হবে। দ্বিতীয় সত্মরে কাগজের ব্যাকআপ বিলুপ্ত হবে। এই পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য বিদ্যমান সরকারি কর্মচারীদের সরকার নিজ খরচে প্রশিক্ষণ দেবে। যারা প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী হবে না বা প্রশিক্ষণ নেয়ার পরও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না, তারা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অবসরে যাবে এবং তদস্থলে নতুন কর্মীবাহিনী কাজে যোগ দেবে। সরকারের নতুন রিক্রুটমেন্ট হবে ডিজিটাল সরকার চালনায় সক্ষম ব্যক্তিদের মধ্য থেকে। সরকারের সব অগোপনীয় তথ্য সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনগণ সরকারের যেকোনো সত্মর পর্যমত্ম যোগাযোগ বা আবেদন করতে এবং আবেদনের ফল পাবে।’ প্রতিটি নাগরিকের জন্য বাসস্থান, ফসলি জমি রক্ষা ও ভূমির অপব্যবহার রোধ অংশের শেষ বাক্যে বলা হয়েছে, ‘ভূমি ব্যবস্থা জিআইএস প্রযুক্তিনির্ভর ডাটাবেজভিত্তিক হবে। জমির রেজিস্ট্রি ও নকশা থেকে শুরু করে দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমির ডিজিটাল নকশা থাকবে। জমির বেচাকেনা, উত্তরাধিকার, বণ্টন, দান ইত্যাদি এবং সব ধরনের হসত্মামত্মরের রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণভাবে কমপিউটারে করা হবে। জমি সংক্রামত্মও সব তথ্য কমপিউটারে সংরক্ষণ করা হবে এবং জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে।’ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা অংশের শেষ পাঁচটি বাক্য এরকম- ‘‘গ্রামের মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পৌঁছানোর জন্য টেলিমেডিসিন পদ্ধতির সহায়তা নিতে হবে। রাষ্ট্রের পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা ডিজিটাল করা হবে। এটি সরকারের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের অংশ হিসেবে কাজ করলেও দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা একটি নেটওয়ার্কের আওতায় থাকবে। স্বাস্থ্যখাতের বিপুল তথ্যাবলী, প্রাথমিক চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য সচেতনতা ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষের হাতের নাগালের মাঝে দিতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ডাটাবেজ আকারে সংরক্ষিত থাকবে।’ অপরাধ, আইন ও বিচার অংশের শেষ চারটি বাক্য এরকম- ‘প্রয়োজনমতো বায়োমেট্রিক্স, জিন পরীক্ষা, অপরাধীর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, অপরাধীর ডাটাবেজ তৈরি করা ছাড়াও বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা হবে। আইনসমূহ অনলাইনে পাবার পাশাপাশি, ডিএলআর অনলাইনে পাওয়ার উপযোগী হবে। বিচারপ্রার্থী অনলাইনে বিচার প্রার্থনা করার পাশাপাশি তার মামলা কোথায় কী অবস্থায় আছে তা অনলাইনে জানতে পারবে। আইনজীবী অনলাইনে তার বক্তব্য পেশ করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের সহায়তায় বাদী-বিবাদীর বক্তব্য বা সাক্ষ্য নেয়া করা যাবে।’’ অন্য ধারাগুলোতেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ডিজিটালপ্রযুক্তির কথা রয়েছে, যার অনেক কিছুই আমাদের কাছে পরিচিত। মোসত্মাফা জববারের এই ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচিকে প্রাথমিকভাবে ই-গভর্নেন্স ধরনের কিছু মনে হতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মসূচির পরিধি, ব্যাপ্তি অনেক বেশি বিসত্মৃত এবং সুদূরপ্রসারী। সামনের দিকে অনেক দূরে তাকিয়ে এ কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। একে এক অর্থে বৈপ্লবিক কর্মসূচি বলা যেতে পারে। কর্মসূচিতে বলা হয়েছে ২০২১ সালের মাঝে দেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ কর্মসূচি বাসত্মবায়নের জন্য বলা হয়েছে, ‘.... তরুণ সমাজকে নিয়ে এই কর্মসূচি বাসত্মবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর টেলিভিশনে নির্বাচনী বক্তৃতায় এবং জনসভায়ও ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ যদি অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল হিসেবে তার এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে, তাতেও বলবো এটি একটি সময়োপযোগী ভাবনা। উৎস যেই হোক বা যাই-ই হোক বাসত্মবায়নের উদ্যোগ যেন গুরুত্ব হারিয়ে না ফেলে।
বাংলাদেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মঞ্চ থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কথা উচ্চারিত হওয়ার পর থেকে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বিষয়টি বোঝার জন্য কৌতূহলী হয়ে উঠেছেন। তরুণ প্রজন্ম- যাদের চোখে আগামী দিনের নানা রঙের স্বপ্ন রয়েছে- দারুণভাবে আলোড়িত হয়েছে। তাদের স্বপ্নের পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে।
আমরা যারা বিজ্ঞানের বিদ্যায় বিদ্বান হওয়ার সুযোগ পাইনি - হয়তো যোগ্যতা ছিল না বলেই, কর্মসূত্রে কমপিউটারপ্রযুক্তির জগতে বিচরণ করার সুযোগ পেয়েছি, তারা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণাটির লক্ষণাদি সম্পর্কে বছর কয়েক আগে থেকেই কিছু কিছু অবহিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের প্রণেতা মোসত্মাফা জববার ১৯৯৭ সালের শুরু থেকে মাসিক কমপিউটার জগৎ-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ডিজিটাল বাংলাদেশের অবয়ব সম্পর্কে নিয়মিত লিখে আসছিলেন। মোসত্মাফা জববারের লেখা ডিজিটাল বাংলাদেশ কেমন হবে সে সম্পর্কিত একটি কর্মসূচিও পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। অনেক বিষয়ে আমি দারুণভাবে উল্লসিত হয়েছি এই ভেবে যে, একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা এবং মুক্ত নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য এরকম সমাজ ব্যবস্থা খুবই দরকার।
সম্প্রতি ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এবং বিভিন্ন নির্বাচনী জনসভায় আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার মুখে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকারটি শিক্ষিত সমাজের মধ্যে দারুণভাবে ইতিবাচক সাড়া জাগিয়েছে। এর মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে তরুণ সমাজের পাল্লা অনেক ভারি হবে- এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপ-শিরোনামে (১০.৫) দেশের প্রতিভাবান তরুণ এবং আগ্রহী উদ্যোক্তাদের সর্বতভাবে সহায়তা দিয়ে সফটওয়্যার শিল্প ও আইটি সার্ভিসের বিকাশ সাধনের কথা বলা হয়েছে এবং আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে- এতে রফতানি বাড়বে এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এই ব্যাপক কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা তরুণ সমাজ বিশ্বাসযোগ্য মনে করেছে বলে আমার ধারণা। কারণ, নতুন গড়ে ওঠা ব্যাপকভিত্তিক সফটওয়্যার শিল্পের প্রাণশক্তি হবে তরুণ সমাজ।
৩ জানুয়ারি ২০০৯ দৈনিক যুগামত্মর পত্রিকার ক্যাম্পাস পাতায় বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া কিছু ছাত্রছাত্রীর মতামত নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে নাদিয়া সুলতানা পিংকি বলেছে, ‘আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে তারা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে প্রসত্মাব দিয়েছে আমি এটার প্রত্যাশী। শুধু আমি নই, আমাদের বন্ধুদের বেশিরভাগই এই একটিমাত্র কারণে মহাজোটকে ভোট দিয়েছে।’ শাকিল হাসান বলেছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি তরুণদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে।’ আরিফুর রহমান লিমন, বলেছে, ‘তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতির যে চমক শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন, এর কারণে আমি আশাবাদী যে বাংলাদেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা নেই। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার বক্তৃতায় এ বিষয়ে বিসত্মারিত কিছু বলা হয়নি। জনসভার বক্তৃতায় সেটা সম্ভবও নয়। কাজেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্লোগান তরুণ সমাজকে এতটা প্রভাবিত করেছে এবং কিভাবে- সে বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, আমাদের বর্তমান তরুণ সমাজ, বিশেষ করে স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীরা সচেতন জনগোষ্ঠীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো কিভাবে চলছে, কিভাবে আরও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে- এসব খবর তারা রাখে। তারা জানে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গতিশীল এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার লক্ষ্য বাসত্মবায়ন করতে হলে সমাজ পরিচালনার সবকিছু ডিজিটালপ্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। আর জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার জন্য পৃথিবীর প্রতিটি প্রামেত্মর প্রতিটি ক্ষেত্রের প্রতি মুহূর্তের ঘটমান তথ্য সর্বক্ষণিকভাবে সহজলভ্য হতেই হবে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অর্জিত জ্ঞানই হবে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের মূল উপাদান। ডিজিটাল পদ্ধতিনির্ভর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিই জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার সেই সুযোগ নিশ্চিত করতে পারে। এবারের নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণকারীর বেশিরভাগই মমত্মব্য করেছেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে প্রত্যাখ্যান করা, সন্ত্রাস দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, বেকার সমস্যার সমাধান করা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদির সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ১ কোটি ১০ লাখ নতুন ভোটারদের মধ্যে বিশেষ করে তরুণদের দারুণভাবে প্রভাবান্বিত করেছে এবং এসব বিষয়ে তারা আওয়ামী লীগের ওপর আস্থা স্থাপন করেছে।
বিগত দুই বছর ধরে মোসত্মাফা জববার বিভিন্ন পত্রিকায় অবিরাম ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে লিখে আসছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা, লক্ষ্য এবং বাসত্মবায়নের পথ সম্পর্কে নানারকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তার কর্মসূচির ডিজিটাল ব্যবস্থা অংশে বলা হয়েছে, ‘সরকারের প্রচলিত কাজ করার পদ্ধতি বদল করে ডিজিটাল সরকার ব্যবস্থা স্থাপন করতে হবে। ডিজিটাল সরকার বলতে সরকারের সব তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ, সরাসরি ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইন রিয়েলটাইম যোগাযোগ এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে সরকারের সব কাজ করাকে বোঝায়। এজন্য সরকারের থাকবে একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ ও নেশনওয়াইড নেটওয়ার্ক। সরকারের সব তথ্য থাকবে কেন্দ্রীয়/বিকেন্দ্রিকৃত ডাটাবেজে। কেন্দ্রীয়/স্থানীয় ডাটাবেজটির সব তথ্য সত্মরভিত্তিক বিন্যসত্ম হবে। যার যেসব তথ্য নিয়ে কাজ, সে সেসব তথ্য সংগ্রহ, প্রক্রিয়াকরণ বা ব্যবহার করতে পারবে।
সরকারের সব অফিস, বিভাগ, মন্ত্রণালয়, স্বায়ত্তশাসিত-আধা স্বায়ত্তশাসিত বা বিধিবদ্ধ সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান, জাতীয় সংসদ, জেলা সংসদ, উপজেলা সংসদ ও গ্রাম সংসদ এবং প্রশাসনের সব সত্মর এই নেটওয়ার্কে সরাসরি অনলাইনভাবে যুক্ত থাকবে। এমনকি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবের প্রয়োজনীয় অংশ এই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ (যেমন আয়কর-দুর্নীতি দমন কমিশন) সুনির্দিষ্ট প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাংকের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে নাগরিকদের প্রাইভেসি বহাল রাখতে হবে।’ দুই পর্যায়ে ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন অংশে বলা হয়েছে, ‘এখন থেকে দুটি পর্যায়ে সরকারের বর্তমান কাজ করার পদ্ধতির পরিবর্তন হবে। প্রথম পর্যায়ে ডিজিটাল পদ্ধতির পাশাপাশি কাগজের ব্যাকআপ থাকবে। ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাজ করার পর কাগজের ব্যাকআপ ফাইল তৈরি করে রাখা হবে। দ্বিতীয় সত্মরে কাগজের ব্যাকআপ বিলুপ্ত হবে। এই পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য বিদ্যমান সরকারি কর্মচারীদের সরকার নিজ খরচে প্রশিক্ষণ দেবে। যারা প্রশিক্ষণ নিতে আগ্রহী হবে না বা প্রশিক্ষণ নেয়ার পরও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না, তারা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অবসরে যাবে এবং তদস্থলে নতুন কর্মীবাহিনী কাজে যোগ দেবে। সরকারের নতুন রিক্রুটমেন্ট হবে ডিজিটাল সরকার চালনায় সক্ষম ব্যক্তিদের মধ্য থেকে। সরকারের সব অগোপনীয় তথ্য সব মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে জনগণ সরকারের যেকোনো সত্মর পর্যমত্ম যোগাযোগ বা আবেদন করতে এবং আবেদনের ফল পাবে।’ প্রতিটি নাগরিকের জন্য বাসস্থান, ফসলি জমি রক্ষা ও ভূমির অপব্যবহার রোধ অংশের শেষ বাক্যে বলা হয়েছে, ‘ভূমি ব্যবস্থা জিআইএস প্রযুক্তিনির্ভর ডাটাবেজভিত্তিক হবে। জমির রেজিস্ট্রি ও নকশা থেকে শুরু করে দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমির ডিজিটাল নকশা থাকবে। জমির বেচাকেনা, উত্তরাধিকার, বণ্টন, দান ইত্যাদি এবং সব ধরনের হসত্মামত্মরের রেজিস্ট্রেশন সম্পূর্ণভাবে কমপিউটারে করা হবে। জমি সংক্রামত্মও সব তথ্য কমপিউটারে সংরক্ষণ করা হবে এবং জনগণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে।’ স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা অংশের শেষ পাঁচটি বাক্য এরকম- ‘‘গ্রামের মানুষের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা পৌঁছানোর জন্য টেলিমেডিসিন পদ্ধতির সহায়তা নিতে হবে। রাষ্ট্রের পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থা ডিজিটাল করা হবে। এটি সরকারের কেন্দ্রীয় ডাটাবেজের অংশ হিসেবে কাজ করলেও দেশের সব স্বাস্থ্যসেবা একটি নেটওয়ার্কের আওতায় থাকবে। স্বাস্থ্যখাতের বিপুল তথ্যাবলী, প্রাথমিক চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য সচেতনতা ডিজিটাল পদ্ধতিতে মানুষের হাতের নাগালের মাঝে দিতে হবে। প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ডাটাবেজ আকারে সংরক্ষিত থাকবে।’ অপরাধ, আইন ও বিচার অংশের শেষ চারটি বাক্য এরকম- ‘প্রয়োজনমতো বায়োমেট্রিক্স, জিন পরীক্ষা, অপরাধীর অবস্থান নির্ণয়ের জন্য গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, অপরাধীর ডাটাবেজ তৈরি করা ছাড়াও বিচার ব্যবস্থাকে ডিজিটাল করা হবে। আইনসমূহ অনলাইনে পাবার পাশাপাশি, ডিএলআর অনলাইনে পাওয়ার উপযোগী হবে। বিচারপ্রার্থী অনলাইনে বিচার প্রার্থনা করার পাশাপাশি তার মামলা কোথায় কী অবস্থায় আছে তা অনলাইনে জানতে পারবে। আইনজীবী অনলাইনে তার বক্তব্য পেশ করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে ভিডিও কনফারেন্সের সহায়তায় বাদী-বিবাদীর বক্তব্য বা সাক্ষ্য নেয়া করা যাবে।’’ অন্য ধারাগুলোতেও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ডিজিটালপ্রযুক্তির কথা রয়েছে, যার অনেক কিছুই আমাদের কাছে পরিচিত। মোসত্মাফা জববারের এই ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচিকে প্রাথমিকভাবে ই-গভর্নেন্স ধরনের কিছু মনে হতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মসূচির পরিধি, ব্যাপ্তি অনেক বেশি বিসত্মৃত এবং সুদূরপ্রসারী। সামনের দিকে অনেক দূরে তাকিয়ে এ কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। একে এক অর্থে বৈপ্লবিক কর্মসূচি বলা যেতে পারে। কর্মসূচিতে বলা হয়েছে ২০২১ সালের মাঝে দেশে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছে, ‘.... তরুণ সমাজকে নিয়ে এই কর্মসূচি বাসত্মবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর টেলিভিশনে নির্বাচনী বক্তৃতায় এবং জনসভায়ও ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের কথা বলা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ যদি অন্য কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের সম্মিলিত প্রয়াসের ফসল হিসেবে তার এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে, তাতেও বলবো এটি একটি সময়োপযোগী ভাবনা। উৎস যেই হোক বা যাই-ই হোক বাস্তবায়নের উদ্যোগ যেন গুরুত্ব হারিয়ে না ফেলে।