• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে বাংলা একাডেমীর তামাশা
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: মোস্তাফা জব্বার
মোট লেখা:১৩৭
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১০ - মার্চ
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
তথ্যসূত্র:
পর্যালোচনা
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে বাংলা একাডেমীর তামাশা

প্রতিবারের মতো এবারো বাংলা একাডেমীতে বইমেলা হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারি সেটি শেষ হয়েছে। এ মেলার সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশকে যুক্ত করে যে একটি ঘটনা ঘটেছে সেটি নিয়েই কিছু বলতে চাই।

বাংলা একাডেমী- আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে এর অবদান অপরিসীম। তবে দীর্ঘদিন যাবত এর কোনো নির্বাচিত পরিচালনা পরিষদ নেই। কবে যে এই পরিষদের নির্বাচন হবে সেটিও আমরা জানি না।



যাহোক এর জন্য একাডেমী তো বসে নেই। যেখানেই হোক, নির্বাচন না হলে আমলারা গ্যাপ পূরণ করেন। একাডেমীতে তা-ই হচ্ছে। তাই তারা আর কিছু করুন বা না করুন প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা চলাকালে ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও তার সাথে সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য বিষয় নিয়ে নিয়মিত আলোচনাসভার আয়োজন করে থাকেন। একাডেমী এবার মেলা শুরুর প্রথম দিনেই আয়োজন করে ডিজিটাল বাংলাদেশবিষয়ক আলোচনাসভা। আলোচনার দিনের দুদিন আগেই একাডেমীর পক্ষ থেকে কেউ একজন আমাকে আমন্ত্রণ জানান, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে অন্যতম আলোচক হবার জন্য। তখন তারা কেউ জানাননি, এই বিষয়ে কয়টি মূল প্রবন্ধ পঠিত হবে বা কারা কারা এই বিষয়ে প্রবন্ধ লিখবেন। শনিবার অবধি কোনো চিঠি না পেলেও রবিবার চিঠির সাথে দু’টি প্রবন্ধ পাঠানো হয়। কাজের চাপ এত বেশি ছিল যে প্রবন্ধ দুটিতে চোখ বুলাতে পারিনি। আমি যখন বাংলা একাডেমীর মঞ্চে পৌঁছাই তখন একটি প্রবন্ধ পঠিত হয়ে গেছে। পঠিত প্রবন্ধটির লেখক রুশো তাহের। তিনি মঞ্চে বসে ছিলেন। অন্য প্রবন্ধটির লেখক আসিফ। ব্যক্তিগত কোনো দুর্ঘটনার জন্য তিনি আসতে পারেননি। তার লেখাটি তখন একটি মেয়ে পাঠ করছে। সেই সুবাদে প্রবন্ধটি শোনা হলো। এরপর একাডেমীর একজন আলোচক ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করলেন। অপরেশ নামের একাডেমীর কর্মকর্তা- সেই আলোচক এতো সাদামাটা আলোচনা করলেন, আমি সেই সময়ে আলোচনা না শুনে রুশোর লেখাটি পড়া যুক্তিযুক্ত মনে করলাম। আমি ঠিক জানি না, অপরেশ কোন বিবেচনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ের আলোচক হলেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সাথে তার কী সম্পর্ক সেটিও আমি জানি না। আমি এর কেন্দ্রে অবস্থান করে অপরেশকে কোথাও ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কোনো কাজ করতে দেখিনি বা শুনিনি। হতে পারে, একাডেমীর নিজস্ব কাউকে আলোচক হিসেবে কিছু অর্থ দেয়ার সুযোগের জন্য এই ব্যবস্থা।

রুশোর প্রবন্ধের শুরু হয়েছে ডিজিটাল জগৎ নিয়ে। তিনি বাইনারি অঙ্ক বুঝিয়ে ডিজিটাল জগতের কথা বললেন। এর পর তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশের সংজ্ঞার কথা বললেন। তার মতে, কমপিউটার, ইন্টারনেট ও ইনফরমেশন টেকনোলজি দিয়ে সব কর্মকান্ড হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। তিনি সব ই-কেই অর্থাৎ ই-গভর্নমেন্ট, ই-হেলথ ইত্যাদিকে ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তি বললেন। তারপর তিনি ডিজিটাল ঢাকা থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশের কথাও বললেন। ঢাকা শহরের ট্র্যাফিক জ্যাম এবং তার সমাধান হয়ে উঠল ডিজিটাল বাংলাদেশের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। এরপর কমপ্যাক্ট ভিলেজশিপ, ডিজিটাল সিটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রস্তাবনা পেশ করা হলো নিবন্ধে। রুশো ফাইবার যোগাযোগ এবং রেডিওকে টেনে আনলেন ডিজিটাল বাংলাদেশ আলোচনায়। প্রবন্ধটির শেষে দেখা গেলো, লেখক রেডিওঅ্যাস্ট্রোনমি ও ডিজিটাল কমিউনিকেশন বিষয়ের গবেষক। আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়ে অনেক আলোচনা বিগত এক বছরে পড়েছি বা শুনেছি। যিনি যেভাবে পেরেছেন ডিজিটাল বাংলাদেশের সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন। এসব প্রবন্ধ পাঠ করতে গিয়ে আমাদের অবস্থা হয়েছে- অন্ধের হাতি দেখার মতো। এতে আমরা কখনো এই হাতির কান দেখেছি, কখনো চোখ দেখেছি বা কখনো পা দেখেছি। আবার কখনো একেবারে উল্টো কিছু দেখেছি। তবে রুশো তাহের যেভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের বর্ণনা উপস্থাপন করেছেন তেমনটা আর কখনো দেখিনি। ডিজিটাল বাংলাদেশকে এমনভাবে উপস্থাপিত করার পর সেটি নিয়ে কী আলোচনা করব সেটিই ভাবতে পারছিলাম না।



অন্যদিকে প্রবন্ধ লেখক আসিফ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিকেন্দ্রীকরণের পথে নামের নিবন্ধে ডিজিটাল প্রযুক্তি-জ্ঞানভিত্তিক সমাজ, শিল্প পুঁজিতন্ত্র ও ডিজিটাল পুঁজিতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করলেন। ই-গভর্নমেন্ট ইত্যাদি নিয়েও লিখলেন।

দুটি প্রবন্ধ পাঠ করে-শুনে আমার মনে হলো-ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে আমি এসব কি শুনছি। রুশোকে দেখে মনে হলো, তিনি বয়সে তরুণ। আমার পাশে বসা অপরেশ জানালেন, আসিফও তরুণ। অপরেশ সম্ভবত জানা সত্ত্বেও আমাকে এটি বললেন না, তারা সরকারি দলের কোন পর্যায়ের বুদ্ধিজীবী। আমি সরকার সমর্থক প্রায় সব প্রধান বুদ্ধিজীবীকেই চিনি, কিন্তু কখনো এদের নাম শুনিনি। ওরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কোন কাজের সাথে জড়িত বলেও স্মরণ করতে পারলাম না। অপরেশের কাছে জানতে চাইলাম-বাংলা একাডেমী ডিজিটাল বাংলাদেশকে এত কম গুরুত্ব দিলো কেনো? অপরেশ যা বললেন তার অর্থ হলো, সেটি শুধু ডিজি জানেন। তিন বছর যাবত আমি ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে লিখি। পুরো একটি বছর ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে যেমন নিজে কথা বলেছি, তেমনি করে অন্যকেও অনেক কথা বলতে দেখেছি। কিন্তু রুশো ও তাহেরকে তো কোথাও কোনো কাজে দেখিনি।

যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা নিয়ে কথা বলেছেন তাদের মাঝে আছেন বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের মুনির হাসান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশন সেলের আনির চৌধুরী, বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের মাহফুজুর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব এন আই খান প্রমুখ। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে কাজ করছে, তার মাঝে রয়েছে বিজ্ঞান এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগযোগ মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি বা কমপিউটার কাউন্সিল। বাংলা একাডেমী এদের কাউকে নিবন্ধ লেখার জন্য কোনো অনুরোধপত্র পাঠিয়েছে বলেও জানা গেল না। আমি পরে এদের কয়েকজনের সাথে কথা বলেছি। তারা এ বিষয়ে একাডেমীর সাথে কোনো যোগাযোগের কথা স্মরণ করতে পারলেন না। আমি ধারণা করি, একাডেমী তেমন কোনো চেষ্টাও করেনি।

এমন এক অবস্থায় আমি যখন সভাপতির আগের সর্বশেষ আলোচক হিসেবে আলোচনা করতে যাই তখন খুব সঙ্গতকারণেই এই প্রশ্নগুলো তুলতে হয়েছে, ডিজিটাল বাংলাদেশের ইতিহাস ও প্রেক্ষিত কী, আওয়ামী লীগ কী হঠাৎ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করেছে, আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোতে কেমন করে এলো এই কর্মসূচী, ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে কী বোঝায়, সরকার এই কর্মসূচী বাস্তবায়নের জন্য কী কী কর্মসূচী হাতে নিয়েছে, আইসিটি পলিসি ২০০৯-এর সাথে ডিজিটাল বাংলাদেশের কী সম্পর্ক রয়েছে ইত্যাদি। আমি স্মরণ করতে বাধ্য হলাম, ডিজিটাল বাংলাদেশ নামের একটি কর্মসূচী আছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ নামে আমার লেখা একটি বই আছে, যার তিনটি সংস্করণ নিংশেষিত হয়েছে এবং সরকারের বর্ষপূর্তিতে এই বিষয়ে আমার একটি লেখাও ছাপা হয়েছে। বিস্মিত হলাম, লেখকদ্বয় আমার লেখা তো নয়ই, অন্য কারও লেখা থেকেও একটি বাক্য বা চরণ উদ্ধৃত করলেন না। কোনো লেখা থেকে কোনো ধারণার কথাও বললেন না। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তারও উল্লেখ করলেন না। ২০০৯-১০ সালের বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ডিজিটাল বাংলাদেশের যে ধারণা দিয়েছিলেন তারও কোনো উল্লেখ করলেন না।

প্রবন্ধ দুটির লেখকেরা যদি প্রবন্ধ লেখার একটি অতিসাধারণ নিয়ম বা সংজ্ঞার কথাও ভাবেন তবে যে বিষয়ে তারা প্রবন্ধ লিখেছেন সেই বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলোকে কোনোভাবেই অবজ্ঞা করতে পারেন না, বা এড়িয়ে যেতে পারেন না। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়টি দেশের সব স্তরের মানুষের কাছেই ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে। বাংলা একাডেমীতে প্রধানত সৃজনশীল তরুণ মানুষেরা গিয়ে থাকেন। দর্শকদের শতকরা প্রায় নববই ভাগ মানুষ নতুন প্রজন্মের। বলা হয়ে থাকে, এই নতুন প্রজন্মের মানুষদের কাছে ডিজিটাল বাংলাদেশ কামনার বিষয়। সেই নতুন প্রজন্মের মানুষদের কাছে শামসুজ্জামান খানের মতো মানুষ শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের এমন অদ্ভুত চিত্র তুলে ধরবেন তা কোনোভাবেই ভাবা যায় না।

প্রবন্ধ দুটি পাঠ করে আমার নিজের কাছেই মনে হয়েছে, দুটি প্রবন্ধের কোনোটিতে কেনো অন্তত এই বিষয়টি আলোচিত হয়নি যে, বিগত এক বছরে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য কী কর্মসূচী হাতে নিয়েছে এবং কোনটা ভালো করেছে বা কোনটা খারাপ করেছে। প্রবন্ধ দুটিতে যদি ডিজিটাল বাংলাদেশ কর্মসূচীর অসঙ্গতি, সমন্বয়হীনতা বা বিভ্রান্তি নিয়ে আলোচনা হতো তবুও আমি খুশি হতাম।

আমি তো মনে করি একাডেমী ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো বিষয়ে এমন একটি কাজ করে বরং সরকারের মূল ভাবনাকে হেয় করেছে।

প্রথমে আমি বুঝতেই পারিনি, একই দিনে যখন অনেক দেরিতে প্রবন্ধ পাঠের ব্যবস্থা করতে হলো তখন এই বিষয়ে দুটি প্রবন্ধ কেনো উপস্থাপিত হলো। একটি প্রবন্ধ পাঠের সময়ও তো সেদিন ছিল না। সেদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয় বিকেল সাড়ে পাঁচটায়। ফলে ছয়টার আগে অনুষ্ঠান শুরু করা সম্ভব হয়নি।

পরে দেখলাম, দু’জন প্রবন্ধ লেখকের জন্য একাডেমীর পক্ষ থেকে জনপ্রতি আড়াই হাজার করে টাকার সম্মানী দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমার ভাবতে খারাপ লাগছে, একাডেমী কর্তৃপক্ষ দু’জন অযোগ্য মানুষকে পাঁচ হাজার টাকা পাইয়ে দেবার জন্যই কি ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো একটি বিষয়কে ছিন্নভিন্ন করেছে। কামনা করি একাডেমীর উদ্দেশ্য এত খারাপ ছিল না। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশের নতুন প্রজন্মের মানুষকে যে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখালেন তাকে নিয়ে এমন তামাশা করাটা কি আদৌ জরুরি ছিল?

আমার এটি বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশবিষয়ক আলোচনাটি ছিল কার্যত সরকারের এ কর্মসূচী নিয়ে যে সাফল্য তার বিপরীত চিত্রটি তুলে ধরা। অথবা পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তামাশা করা। এমনিতেই ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে বিএনপি ও তার দোসররা সুযোগ পেলেই সরকারের ও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা করে। বাংলা একাডেমী তাদের হাতে একটি অস্ত্র তুলে দেবার জন্য এমন আর একটি কাজ না করলেও পারত।

কজ ওয়েব

ফিডব্যাক : mostafajabbar@gmail.com
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
লেখাটির সহায়ক ভিডিও
পাঠকের মন্তব্য
২৬ এপ্রিল ২০১০, ১২:০৪ PM
স্যার, আপনাকে শ্রদ্ধা করি। 'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এর কোন সংজ্ঞা
দেয়া সম্ভব বলে আমি মনে করি না, বরং এর একটি রূপরেখা রচিত হ'তে
পারে। আশা করি আপনি একটি সহজবোধ্য রূপরেখা দেবেন।
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস
অনুরূপ লেখা