মোবাইল ফোন টাচস্ক্রিন কী বয়স্কদের ব্যবহারের সুবিধাজনক প্রযুক্তি?
বাণিজ্যিকভাবে টাচস্ক্রিন প্রযুক্তির ফোন বাজারে আনে বিশ্বখ্যাত স্মার্ট ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। ২০০৭ সালের ২৯ জুন সর্বপ্রথম আইফোনে এই প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়। এসময় টাচস্ক্রিন সারা বিশ্বে মোবাইল ফোনের জগতে এক আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু দেখা যায় এই ধরনের নতুন সব প্রযুক্তি শুধু তরুণরাই ব্যবহার করে যাচ্ছে। তাহলে বয়স্করা এই ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি থেকে চিরদিনই দূরে থেকে যাবেন?
গত ২০ সেপ্টেম্বর লন্ডনে অনুষ্ঠিত হলো ‘সিনিয়র মার্কেট কনফারেন্স ২০১১’। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো আয়োজন করা হলো এই মেলা। এই মেলার প্রধান লক্ষ্য ছিল বয়স্ক লোকদের প্রয়োজনকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা ও আধুনিক প্রযুক্তির সাথে তাদের আরো বেশি সম্পৃক্ত করা। মনে করা হয়, ইংল্যান্ডের ৮০ ভাগ সম্পদের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ৬০-এর অধিক বয়সের লোকেদের হাতে। এই ধনিক শ্রেণীর কথা চিন্তা করার পাশাপাশি সেসব লোকের কাছে প্রযুক্তির আধুনিক সুবিধা পৌঁছে দেয়া যাদের শুধু একটি ফোনও নেই, কিন্তু নষ্ট করার মতো যথেষ্ট টাকা রয়েছে।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে, বয়স্করা যেসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন তা বর্তমান ধারার প্রযুক্তি থেকে অন্তত ৫ বছরের পুরনো। সিনিয়র মার্কেট মোবাইল ২০১১-এর মূল উপপাদ্য ছিল টাচস্ক্রিন প্রযুক্তিকে বয়স্কদের কাছে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা। শুধু তাই নয়, যেসব বয়স্ক লোক কম দৃষ্টিসম্পন্ন, কম শুনতে পান এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে খুব কমই জানেন, যাদের ক্ষেত্রে ডবল ট্যাপ ও সুইপিং পদ্ধতি ব্যবহার করা ততটা সহজ নয়, তাদের জন্য ছিল বিশেষ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা। এতে করে তারা যেন নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহী হন এবং চলমান ধারার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে আগ্রহী হবেন। এছাড়া নতুন প্রযুক্তির ফোন বিশেষ করে টাচস্ক্রিনের মতো পণ্য কিভাবে সহজে ব্যবহার করা যায় সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়।
ইয়ান হোসকিং। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র সহযোগী গবেষক। গত ২০ বছর ধরে প্রযুক্তির সেসব অ্যাপ্লিকেশন নিয়ে গবেষণা করছেন, যা মানুষের জন্য সত্যিকারের প্রয়োজন। ওই প্রদর্শনীতে তিনি বিস্তারিত ভিডিও ও তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। এই ভিডিওতে দেখা যায়, টাচ প্রযুক্তি ব্যবহার না করার ফলে কিছু মানুষ কত কঠিনভাবে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত খুঁজছেন। অন্যদিকে তার সহকর্মী মাইক ব্র্যাডলি প্রদর্শন করেন ঠিক বিপরীত একটি ভিডিওচিত্র। এখানে দেখানো হয়, টাচ প্রযুক্তি ব্যবহার করে খুব কঠিন অপারেশন সহজেই করা সম্ভব।
তবে একথা সত্যি, টাচস্ক্রিন প্রযুক্তির সাহায্যে সহজ-সরল একটি ইন্টারফেস তৈরি করা সহজ কিছু নয়। এর পেছনে রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। সব প্রতিবন্ধকতার সহজ ব্যাখ্যা দিয়ে অ্যান্থনি রিবট উপস্থাপন করেন থ্রিডমফোন প্রযুক্তি। এটি আসলে থ্রি বাটন ইন্টারফেস প্রযুক্তি, যা তিনি তৈরি করেন গুগলের জনপ্রিয় ফোন অ্যান্ড্রয়িডের জন্য। এই প্রযুক্তি টাচস্ক্রিন ফোনকে সহজ-সরল একটি ইন্টারফেস দিতে সক্ষম। যদিও থ্রিডমফোন প্রযুক্তির সমন্বয়ে তৈরি ফোন এখনো বাজারে আসেনি। কিন্তু ‘সিনিয়র মার্কেট কনফারেন্স ২০১১’ চলাকালীন সময় এই ধরনের প্রযুক্তি বিভিন্ন ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টি আকার্ষণ করতে সক্ষম হয়। উল্লেখ্য, অ্যান্থনি রিবট নিজে একজন ডিজাইনার, ডেভেলপার, উদ্যোক্তা। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠান রিবট পরিচালনার পাশাপাশি ইন্টেল, মাইক্রোসফট, টেসকো, অরেঞ্জ ও নোকিয়াতে কাজ করেন।
টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি বিতর্ক
বিষয়টিকে বিতর্ক বলা আসলে ঠিক হবে না। আসলে এটি একটি আলোচনা অনুষ্ঠান। আলোচনা মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন চার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোক। মজার বিষয় হচ্ছে, এর মধ্যে দু’জন ছিলেন মহিলা এবং ফোনের বিভিন্ন ব্যবহারিক বিষয় সম্পর্কে এরা ছিলেন অতন্ত দক্ষ। এর মধ্যে একজন ছিলেন যিনি এইচটিসির ডেজায়ার স্মার্ট ফোন অত্যন্ত পছন্দ করেন। আর বিষয়টি বিতর্কে রূপ নেয় তখনই, যখন তিনি বলেন- ‘আমি আর কোনো বাটন এই ফোনে দেখতে চাই না’। আসলে এই কথাটি বলার বড় কারণ হচ্ছে থ্রিডমফোন প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করায়। ‘সিনিয়র মার্কেট কনফারেন্স ২০১১’-এ একটি বড় আকর্ষণ হলো- এখানে উপস্থিত ছিলেন বড় বড় মোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। সবার লক্ষ্য ছিল সিনিয়র ও সাধারণ ব্যবহারকারীদের মতামত জানা।
‘সিনিয়র মার্কেট কনফারেন্স ২০১১’-এ ইউরোপিয়ান বড় বড় মোবাইল নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এমপেরিয়াম, ডরোর সিনিয়র প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তারা সিনিয়র মার্কেট প্রদর্শনীতে টাচস্ক্রিনকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার রূপরেখা নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হিসেবে দেখছেন।
এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের পক্ষ থেকে মতামত আসে ভোট নেয়ার জন্য। ভোটের বিষয়বস্ত্ত ছিল ‘টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি বয়স্কদের জন্য সুবিধাজনক’। শেষ পর্যন্ত এর পক্ষে ভোট আসে শতকরা ৮৪ ভাগ।
টাচস্ক্রিন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
এমপেরিয়াম টেলিকমের প্রতিষ্ঠাতা আলবার্ট ফেলনার এসেছিলেন ‘সিনিয়র মার্কেট কনফারেন্স ২০১১’-এ। টাচস্ক্রিন প্রযুক্তি নিয়ে তার প্রতিষ্ঠান কিভাবে কাজ করছে এবং এই আলোচনার মাধ্যমে আরো নিশ্চিত হতে চান, তারা সঠিকভাবে কাজ করছেন কি না। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির নীতিনির্ধারণী পদে বেশ কয়েকজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিকে নিয়োগ দিয়েছেন, যারা সবাই কাজ করবেন টাচস্ক্রিন প্রযুক্তির আরো আধুনিকায়ন ঘটাতে। এর মধ্যে রয়েছেন ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন সেন্টারের পরিচালক জন ক্লার্কসন, লিঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ইনোভেশন বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট বেউরি এবং অস্ট্রিয়া টেলিকমের প্রাক্তন প্রধান নির্বাহী বরিস নেমসিক।
সুইডিশ টেলিকম কোম্পানি ডরো ফ্রান্সের একটি কোম্পানিকে কিনে নিয়েছেন। এই কোম্পানিটি অ্যান্ড্রোয়িড ও বে-ফোন অ্যাপ্লিকেশনে বিশেষ পারদর্শী। এই প্রতিষ্ঠানটি দিকনির্দেশনা দিয়েছে যা টাচস্ক্রিন প্রযুক্তির সাথে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা করেছে ডরো।
মোবাইল অপারেটররা যদি ব্যবহারকারীদের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে যথাযথ দামে সঠিক পণ্য দিতে পারে, তবে তারা অনেক বেশি উৎসাহী হবেন। ‘সিনিয়র মার্কেট কনফারেন্স ২০১১’-তে মোবাইল অপারেটর তেলেস্ত্রা কানেটিং সিনিয়র নামে একটি ওয়ার্কশপ পরিচালনা করে। এই প্রোগ্রামের মাধ্যমে বয়স্কদের মোবাইলের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই প্রশিক্ষণে যারা অংশ নেন তাদের অনেকেই জানেন না সিমকার্ড কী এবং বেশিরভাগ লোক খুব সামান্যই মোবাইল অপারেট করতে পারেন। আর এরাই হচ্ছেন কাঙ্ক্ষিত ব্যবহারকারী।
আরএইচসি অ্যাডভানটেজ, বয়স্ক ভোক্তাবিষয়ক বিপণন প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী মার্ক বিয়াসলি বলেন, বয়স্ক ভোক্তাদের বাজার দিন দিন বেড়েই চলেছে। বয়স্ক ভোক্তাদের কাছে পৌঁছানো খুবই কষ্টসাধ্য। এরা এনগেজেট বা মোবাইল চয়েজের মতো জনপ্রিয় ওয়েবসাইটগুলোর নিয়মিত পাঠক নন। সুতরাং তাদের নতুন এসব প্রযুক্তি সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। এই বাজারকে আয়ত্তে আনতে হলে আপনার সহানুভূতিকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের যখন কোনো পণ্য কেনার জন্য অনুরোধ করবেন সেটি করতে হবে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : animesh@letbd.com