একটা সময় মোবাইল ফোন বা সেলফোন ছিল আভিজাত্যের প্রতীক। সমাজের উঁচু শ্রেণীর লোকজনই শুধু এটি ব্যবহার করতো। ক্রমে এ যন্ত্রটি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনে পরিণত হয়। তবে এখন এটি নিত্যপ্রয়োজনকেও হার মানিয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে যে শিল্পটির নীরবে বিপ্লব হয়েছে তার নাম মোবাইল ফোন। বাংলাদেশে এ খাতে কারো আগ্রহের যেমন কমতি নেই, তেমনি মোবাইল ফোনের চাহিদারও শেষ নেই। মোবাইল ফোনকে আগে অনেকেই তথ্যপ্রযুক্তির সাথে মেলাতে চাইতো না। সেই ধারণার এখন পরিবর্তন হয়েছে। মোবাইল ফোন এখন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ।
মোবাইল ফোন নামটি খুব জনপ্রিয় হলেও এর প্রকৃত নাম হচ্ছে সেলফোন। সেলফোন তৈরি করা হয়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের জন্য। একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, ল্যান্ডফোনের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এ সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্যই উৎপত্তি হয়েছে সেলফোন বা মোবাইল ফোনের। প্রথমদিকে সেলফোন ব্যবহার করা হতো শুধু কথা বলার জন্য। ধীরে ধীরে এর বহুবিধ ব্যবহার বাড়তে থাকে। ভোক্তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করার পাশাপাশি এখন অনেক সুবিধা চান। এতে যুক্ত হয়েছে ফ্যাশনের ব্যাপার-স্যাপার। এখন একই সাথে সবাই মোবাইল ফোনে কথা বলার পাশাপাশি ইন্টারনেট সার্ফিং, রেডিও শোনা, গান শোনা, ভিডিও দেখা সবই সম্ভব হয়েছে প্রযুক্তি কল্যাণে। ভোক্তাগণ মোবাইল ফোন কেনার সময় এসব বিষয় খোঁজ করেন এবং সে অনুযায়ী মোবাইল ফোন কেনেন। এ ধরনের বিনোদনমূলক নানা সুবিধা প্রতিনিয়ত মোবাইল ফোনে যুক্ত হচ্ছে এবং ভোক্তাশ্রেণীও তাদের চাহিদা অনুযায়ী মোবাইল ফোন কিনতে পারছেন। ধীরে ধীরে মোবাইল ফোন আমাদের দৈনন্দিন কমপিউটিংয়েও অংশ নিচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়ত যাবতীয় কমপিউটিং মোবাইল ফোনের মাধ্যমেই সম্ভব হবে। এখানেই শেষ নয়। এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কিংও করা যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ব্লু-টুথ এবং ইনফ্রায়েড প্রযুক্তি। এর সাথে অচিরেই ওয়াইম্যাক্স এবং অন্যান্য সুবিধার প্রচলন পুরোপুরিভাবে চালু হবে। আমাদের দেশে এখন এমন অনেক মানুষ পাওয়া যাবে যারা নিয়মিত কিছুদিন পরপর মোবাইল ফোন পরিবর্তন করে থাকেন। অনেকে আবার প্রয়োজনের খাতিরেই একসাথে একাধিক মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকেন। মানুষের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে মোবাইল ফোন নির্মাতারাও আনছেন তাদের পণ্যের ফিচার এবং স্পেশালিটিতে পরিবর্তন। এমন একটি ফিচার হচ্ছে মোবাইলে টিভি দেখা। মোবাইল ফোনে সরাসরি টিভি দেখার ফিচার নিয়ে এই লেখা সাজানো হয়েছে।
মোবাইল ফোনে অনেকভাবে টিভি দেখা যায়। তার মধ্যে আইপি টিভি, স্ট্রিমিং টিভি ইত্যাদি অনেক আগে থেকেই আছে। কিন্তু অ্যান্টেনা ব্যবহার করে সরাসরি টেরেস্ট্রিয়াল সংযোগে টিভি দেখার সুবিধা দিচ্ছে এখন অনেক মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। তবে এগুলোর বেশিরভাগই চীনের তৈরি করা মোবাইল ফোনসেট। অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল, ক্যাবল টিভি দেখার সুবিধাসংবলিত ফোনসেট অচিরেই বাজারে আসবে। কিন্তু সেটি সরাসরি মোবাইলে টেলিভিশন দেখার প্রযুক্তি নয়। এর জন্য বাসায় একটি স্প্রিংবক্স নামের ডিভাইস থাকতে হবে। যার মাধ্যমে ক্যাবল টিভি থেকে সিগন্যাল সংগ্রহ করে মোবাইল ফোনে ওয়্যারলেস সংযোগের মাধ্যমে প্রেরণ করা হবে। তারপর মোবাইল ফোন থেকে তা দেখা যাবে। এবারে এসেছে সরাসরি মোবাইল ফোনে টিভি দেখার সুযোগ।
মোবাইল ফোনে এ সুবিধা পাবার জন্য এমন মোবাইল ফোনসেট কিনতে হবে যাতে টেরেস্ট্রিয়াল টিভি দেখার ব্যবস্থা আছে। এ প্রযুক্তিতে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে টিভি দেখা যায় সরাসরি। টেলিভিশনের পুরো সিগন্যালিং ব্যবস্থা এখানে মোবাইলে সংযুক্ত করা হয়েছে। শুধু আউটপুট হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে মোবাইল ফোনের ডিসপ্লে স্ক্রিন। সে সাথে সিগন্যালিং ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য ইন্টারনাল অ্যান্টেনা যুক্ত করা হয়েছে। আশির দশকে সনি কর্পোরেশন ছোট আকারে যে পকেট টিভি বের করেছিল এখনকার টিভি মোবাইল ফোন অনেকটা সে রকমেরই। শুধু প্রযুক্তির কল্যাণে এতে যুক্ত হয়েছে মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য সুবিধা। বেশিরভাগ টিভি মোবাইল ফোনে এখন এফএম রেডিও শোনার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এসব রেডিও শোনার জন্য কোনো অ্যান্টেনা বা হেডফোনের প্রয়োজন নেই। মোবাইল ফোনসেটের ইন্টারনাল হেডফোনই যথেষ্ট।
মজার ব্যাপার হচ্ছে চীনের এসব মোবাইল ফোনসেটের বেশিরভাগই ডুয়াল সিম সাপোর্ট করে। অর্থাৎ একসাথে দুটি সংযোগ ব্যবহার করা যাবে। ডুয়াল সিম ফোনের কনসেপ্ট হচ্ছে-একটি মোবাইল ফোন ব্যবহার করে দুটি লাইন সচল রাখা। দুইটি লাইন সচল রাখার বিভিন্ন অর্থ হতে পারে। একটি হচ্ছে একসাথে যেকোনো একটি লাইন সচল থাকবে। অন্যটি হচ্ছে একসাথে দুইটি লাইনই সচল থাকবে। এই দুই ধরনের ফোনেরই আবার অনেক ধরন আছে। যেমন-একটি লাইন সচল ব্যবস্থার ক্ষেত্রে দুইটি সিমে নাকি একটি সিমে লাইন পরিবর্তন থাকবে, লাইন কিভাবে পরিবর্তিত হবে, তা ফোন সচল অবস্থায় নাকি বন্ধ অবস্থায় ইত্যাদি। আবার দুইটি লাইন সচল ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অনেক ধরন আছে। যেমন-একটি ব্যস্ত থাকলে অন্যটি সচল থাকবে নাকি বন্ধ থাকবে ইত্যাদি। তবে টিভি যুক্ত এসব ফোনে একই সাথে দুটি সিমই চালু রাখা যায়।
ইদানীং অনেকেই এসব টিভি ফোনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। এসব টিভি ফোনে টেরেস্ট্রিয়াল সংযোগের কল্যাণে অন এয়ার সিগন্যালে টিভি দেখা যায়। তবে আমাদের দেশে কিন্তু এধরনের ফোনে শুধুই বিটিভি দেখা যাবে। অন্য কোনো চ্যানেল দেখা যাবে না। তবে অতিসম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিভিশনের যে আরেকটি টেরেস্ট্রিয়াল চ্যানেল খোলা হতে যাচ্ছে সেটি উপভোগ করা সম্ভব হবে এসব ফোনসেটে।
এ ফোনসেট কাজ করে সেটে সংযুক্ত টেলিভিশন সিগন্যালিং সিস্টেমকে ডিজিটাল আউটপুটে পরিবর্তন করার মাধ্যমে। অর্থাৎ এ ফোনসেটে অবস্থিত টেলিভিশন রিসিভার ফোনসেটের ইন্টারনাল অ্যান্টেনা ব্যবহার করে তা সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে। তারপর সেই বিশ্লেষিত সিগন্যাল অ্যাম্পলিফাই করে ডিজিটাল সিগন্যালে কনভার্ট করে। সেই কনভার্টেড সিগন্যাল সরাসরি স্ক্রিনে প্রদর্শিত হয়। ব্যাপারটি অনেকটা ডিজিটাল এলসিডি টেলিভিশনের মতো, কিন্তু ছোট আকারের এবং মোবিলিটি সুবিধাসংবলিত।
প্রযুক্তি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে তা কেউ বলতে পারি না। তবে একথা বলা যায় নিঃসন্দেহে, মোবাইল ফোনে সরাসরি টিভি দেখা প্রযুক্তির আরেক অভিনব উদ্ভাবন। মোবাইলে টিভি অনেক দিন আগেই সম্ভব ছিল। কিন্তু কোনোটিই সরাসরি টিভি না। এখন বাজারে যেটি পাওয়া যাচ্ছে সেটি হচ্ছে সরাসরি মোবাইল ফোনে টিভি ফিচারসহ ফোনসেট। বর্তমানে স্প্রিন্ট, ম্যাক্সিমাস, টেকনো, সেক্ট প্রভৃতি এ ধরনের ফোনসেট তৈরি করে। তবে যে সেটই পছন্দ করুন না কেন, কেনার আগে ওয়ারেন্টির বিষয়গুলো নিশ্চিত হয়ে নিন। বিশেষ করে চীনের তৈরি ফোনসেটগুলোর ক্ষেত্রে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : javedcse1982@yahoo.com