• ভাষা:
  • English
  • বাংলা
হোম > টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তি
লেখক পরিচিতি
লেখকের নাম: ড. আতিউর রহমান
মোট লেখা:১
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০০৯ - এপ্রিল
তথ্যসূত্র:
কমপিউটার জগৎ
লেখার ধরণ:
আইটি
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ৩
ভাষা:
বাংলা
স্বত্ত্ব:
কমপিউটার জগৎ
টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তি





ড. আতিউর রহমান
চেয়ারম্যান, উন্নয়ন সমন্বয়

বাংলাদেশ এখন এক কঠিন বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতির দৈন্যদশার প্রভাব এদেশে এখনও তেমন অনুভূত না হলেও নিকট ভবিষ্যতে এটা জাতির সামনে যে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপস্থিত হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর এমনি এক সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে একটি নতুন সরকার, যারা ইতোমধ্যেই দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য বেশকিছু পরিকল্পনার কথা বলেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’।

আমি মনে করি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ একটি সময়ের দাবি, যার গুরুত্বের কথা উপলব্ধি করে সরকার তার অত্যাবশ্যকীয় কার্যক্রমের মধ্যে একে যুক্ত করেছে। আর এ উদ্যোগের মধ্যে প্রযুক্তি এবং অর্থনীতির এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। আমরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবো, আধুনিক এ সময়ের অর্থনীতির চাকা প্রযুক্তি ছাড়া নিশ্চল।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যারা আজকে শক্তিশালী অর্থনীতির দাবিদার, তারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রযুক্তির সফল ব্যবহারের মাধ্যমে এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, বিশ্বায়নের এই যুগে আমাদের চোখের সামনে সবকিছু ঘটলেও জাতি হিসেবে আমরা এখন প্রযুক্তি প্রয়োগের দিক থেকে বেশ পিছিয়েই আছি।

তাই এখন সময় এসেছে স্বপ্ন এবং সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে একটি বাস্তব উদ্যোগ নেয়ার, যা জাতির সামনে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সরকারকে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের দেশজুড়ে যে বিভিন্ন কার্যক্রম আছে সেগুলোকে আধুনিক কমপিউটার নেটওয়ার্ক তথা অনলাইন সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসলে সরকারি সেবাসমূহ সহজেই নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে। অন্যদিকে সরকার যেহেতু তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যের সবচেয়ে বড় ভোক্তা তাই সরকারের ডিজিটালাইজেশনের ফলে দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবসায় আরও সম্প্রসারিত হবে এবং আরও অনেকে বিনিয়োগ করতে এগিয়ে আসবে।

সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে বহুল আলোচিত ই-গভর্মেন্টকে বাস্তবে রূপ দেয়া। আমরা এখন দেখতে পারছি সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব ওয়েবসাইট আছে। তবে এটাকে পরিপূর্ণ ই-গভর্মেন্ট বলা যাবে না। কারণ, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এখনও সব নাগরিককে সেবা দেয়া যাচ্ছে না। সম্পূর্ণ ই-গভর্মেন্ট প্রক্রিয়াকে সরকার এবং নাগরিক এই দুই প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা যেতে পারে।

সরকারকে ই-গভর্মেন্ট রূপে নাগরিকদের কাছে পৌঁছে যাবার জন্য প্রথমে সব মন্ত্রণালয়ে তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আর এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে।

সরকারি বিভিন্ন তথ্য যা নাগরিকদের কাছে প্রকাশ করা যায় তার ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াকে আরও বেগবান করতে হবে। সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগ এবং চুক্তি, যা সরাসরি নাগরিকদের স্বার্থের সাথে যুক্ত, তা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে। বিভিন্ন সময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে যখন নাগরিকদের মতামত প্রয়োজন হয়, তখন সরকার ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ভোটের ব্যবস্থা করতে পারে। এছাড়া আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে সরকারি বিভিন্ন তথ্যের ডাটাবেজ তৈরি করা যেতে পারে, যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে শুধু সরকারি কর্মকর্তারা ব্যবহার করতে পারবেন।

এর ফলে ফাইল সংক্রান্ত জটিলতার অবসান ঘটবে এবং একটি মন্ত্রণালয় চাইলে সহজেই অন্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য শেয়ার করতে পারবে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী যাতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চলমান কার্যক্রম এবং অগ্রগতি সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন সেজন্য একটি ভার্চুয়াল মনিটরিং সিস্টেম তৈরি করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে একই সাথে পারদর্শী ও উৎসাহী। সে কারণেই আমাদের মনে আশা জাগে, ই-গভর্নেন্স প্রক্রিয়াকে তিনি দ্রুতই এগিয়ে নিতে পারবেন।

নাগরিকদের প্রেক্ষাপটে ই-গভর্মেন্ট বলতে সরকারি বিভিন্ন সেবার ডিজিটাল সংস্করণকে বোঝানো হয়। বর্তমানে এর পরিধি ব্যাপক না হলেও নাগরিকদের জন্য ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সরকারি সেবাসমূহ যেমন- বিল পরিশোধ, টেন্ডার, ট্যাক্স শনাক্তকরণ নম্বর, জন্ম নিবন্ধকরণ এবং নাগরিকত্বের সনদপত্র ইত্যাদি কি করে নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে সরকারকে নজর দিতে হবে। ই-গভর্মেন্ট বাস্তবায়িত হলে সরকারের অনেক অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমে যাবে। সাশ্রয় করা সেই অর্থ অন্য খাতে কাজে লাগানো যেতে পারবে।

সরকার ইতোমধ্যে মেশিন-রিডেবল বা ই-পাসপোর্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে নাগরিকদের পাসপোর্ট পেতে বিড়ম্বনা পোহাতে না হয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছতে অসুবিধার অবসান ঘটে। ভূমি মন্ত্রণালয় ভূমি জরিপের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় তথ্য ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে যেকোনো নাগরিক তার জমির মালিকানা সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাবে বলে আশা করা যায়। অবশ্য, এটি বিরাট এক কর্মযজ্ঞ। এজন্য সময় ও অর্থ দুই-ই বেশ লাগবে।

তবে আমরা এখনও দেশে ‘অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম’ চালু করতে পারিনি, যা একটি গভীর পরিতাপের বিষয়। আর এর ফলে আমাদের দেশে এখনও ই-কমার্স জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারেনি। দেশের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ইলেকট্রনিক ট্রানজেকশনের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন, যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং সরকারকে এ ব্যাপারে বিকল্প পথ খুঁজে বের করতে হবে। এরই মধ্যে মোবাইল ফোনকে ব্যবহার করে বেশ কিছু ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেন হতে শুরু করেছে। এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরো দ্রুত তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অর্থ লেনদেনের শক্ত ভিত্তি তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে বিদেশী বিনিয়োগের এক বিশাল ভূমিকা আছে। দেশে আইটি শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির উত্তম প্রয়োগের মাধ্যমে একটি প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে দেশীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি বিদেশী প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সরাসরি তাদের ব্যবসায় শুরু করতে পারে। প্রয়োজন হলে ট্যাক্স হলিডের কথা চিন্তা করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের একমাত্র সাবমেরিন ক্যাবলের অবশিষ্ট ব্যান্ডউইডথ যাতে করে সব নাগরিক ব্যবহার করতে পারে সেজন্য সরকারকে ব্যান্ডউইডথের দাম আরও কমাতে হবে এবং টেলিকমিউনিকেশন সার্ভিসের ওপর ১৫ ভাগ শুল্ক কমানোর ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা গোটা জাতির তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের সব স্কুল-কলেজে যাতে কমপিউটার এবং ইন্টারনেট সংযোগ নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। আজকাল পাঠ্যপুস্তক সঠিক সময়ে প্রকাশে জটিলতার সৃষ্টি হয়। আর তাই পাঠ্যপুস্তক বোর্ড সব পাঠ্যপুস্তকে ই-বুক হিসেবে ওয়েবসাইটে দিতে পারে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা তা ডাউনলোড করে ব্যবহার করতে পারে। এছাড়া বর্তমানে দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মোবাইল ফোন ব্যবহার করছে এবং এই মোবাইল প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করে বিভিন্ন এডুকেশনাল কনটেন্ট তৈরি করা যেতে পারে, যাতে করে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।

‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ উদ্যোগের মাধ্যমে প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য আমাদের শহরকেন্দ্রিক চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। পল্লী অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার এবং প্রয়োগ নিশ্চিত না করলে ২০২১ সালের উন্নত বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন কখনও পূরণ হবে না। পল্লী অঞ্চলে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের ব্যবসায় সম্প্রসারণের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি কিভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, তা খুঁজে বের করতে হবে। প্রয়োজনে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবসায় সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়ায় অনুপ্রাণিত করতে হবে। এক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ব্যবস্থা গড়ে তোলা খুবই জরুরি।

আমাদের মনে রাখতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তির আবেদনকে শুধু প্রযুক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না বরং একে একটি আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। আর এজন্য সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে এবং নতুন প্রযুক্তির সুবিধাকে সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পল্লী অঞ্চলে তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং তাই সরকারের উচিত এই কাজগুলোর সাথে নিজেকে যুক্ত করে দেশব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা। উন্নয়ন আনে মনের পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন তথ্যপ্রযুক্তির কারণে অনেকটাই ঘটতে শুরু করেছে। এখন সময় এসেছে দিনবদলের সেই আকাঙ্ক্ষাকে আরও কত বিস্তৃত করা যায়, আরও কত দ্রুত করা যায় তাই নিয়ে ভাবার।

কজ ওয়েব
পত্রিকায় লেখাটির পাতাগুলো
লেখাটি পিডিএফ ফর্মেটে ডাউনলোড করুন
চলতি সংখ্যার হাইলাইটস