লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
লেখার ধরণ:
ডিজিটাল বাংলাদেশ
ডিজিটাল নেতৃত্ব : তিনটি উদাহরণ
আপনারা যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে চিন্তা করেন এবং যারা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট, তাদের উভয়ের কাছেই সম্ভবত একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ই-নেতৃত্ব। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বলুন, স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ বা একেবারেই তৃণমূল পর্যায়ে যারা কাজ করছেন; যাদের মাধ্যমে ই-সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে শুরু করেছে- সব স্তরেই এই ই-নেতৃত্ব অনিবার্য। স্তরে স্তরে এই নেতৃত্ব যদি গড়ে না ওঠে, তবে ডিজিটাল উদ্যোগের সুসমন্বয় ঘটবে না। সুসমন্বয় না ঘটলে যত উদ্যোগই নেয়া হোক না কেনো, মূল লক্ষ্য অর্থাৎ জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর কাজ হবে না। এর ফলে সত্যিকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ আর হবে না- যা কাঙ্ক্ষিত নয়। এ কথা সত্য ই-নেতৃত্বের কথা বলা যত সহজ, তা সৃষ্টি করা সত্যিকার অর্থেই ততটাই কঠিন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব।
কিন্তু এ অসম্ভবকেও সম্ভব করা যায়। তেমনিই উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে একাধিক। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রাম এই নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ/ই-গভর্নেন্স/ই-সার্ভিসবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করে। এই প্রশিক্ষণ কর্মশালার আওতায় রয়েছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগ পর্যায়ের সচিব ও ই-গভ: ফোকাল পয়েন্ট, স্থানীয় প্রশাসনের বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা তথ্য কর্মকর্তা, স্থানীয় সরকার বিভাগের জেলা পর্যায়ে কর্মরত উপ-পরিচালক, উপজেলা চেয়ারম্যানরা। এসব প্রশিক্ষণের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন স্তরে। একাধিক এলাকায় একাধিক পর্যায়ে অভাবনীয় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এসব দৃষ্টান্ত পুরোপুরি তথ্যায়িত করা সম্ভব হয়নি। এমনই চলমান দু’টি উদাহরণ এ লেখায় উপস্থাপন করা হয়েছে। আজকের নিবন্ধে উপস্থাপন করছি আপনাদের জন্য। জামালপুরের এডিসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘সেবা মানুষের কাছে যাবে, মানুষ সেবার কাছে যাবে না’।
তিনি জানান, এই প্রশিক্ষণ এডিসিদের দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর ঘটাতে ব্যাপক সহায়তা করে। তার মতে, জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে হলে সবার আগে আমলাদের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে এটা এখন করে দেখাবার সময় যে সেবা মানুষের কাছে যাবে, মানুষ সেবার কাছে যাবে না। তিনি বিশ্বাস করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ ‘রূপকল্প ২০২১’-এর আওতায় সেবা তৈরি এবং সেবা দেয়ার প্রক্রিয়ায় আইসিটির ব্যাপক ব্যবহার ঘটানোর মাধ্যমে এই অবস্থার পরিবর্তন করা সম্ভব।
প্রশিক্ষণের এই অনুপ্রেরণা থেকেই ই-গভ: জেলা ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে জাহাঙ্গীর আলম জামালপুরে একাধিক ডিজিটাল উদ্যোগ নেন। স্থানীয় জনগণ এর সুফলও পেতে শুরু করেছেন। সেখানে হতদরিদ্র মানুষ এখন বিনামূল্যে ও সহজে লিগ্যাল এইড সেবা পান ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপিত ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র থেকে। এই সেবা পেতে দরিদ্র মানুষের আর ঘোরাঘুরি করতে হয় না। জামালপুরের মানুষ এখন জেলা প্রশাসনের রেকর্ড রুম থেকে নির্দিষ্ট দিনে নকল সংগ্রহ করেন। সেখানে নকল পেতে কাউকে আর দালালের খপ্পরে পড়তে হয় না। নকলের দরখাস্ত সংগ্রহ এবং নকল সরবরাহ করা হয় ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে। দেওয়ানী আদালত সহজেই এ নকল গ্রহণ করছে, কারণ এটি মূল খতিয়ানের অবিকল। এতে বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত এবং যথাসময়ে কোর্টে নকল দাখিল করতে পারছেন। পর্চা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম কমপিউটারাইজড হবার সুবাদে জনগণকে সেখানে বিআরএস পর্চার নকলও স্ক্যানিং করে সরবরাহ করা হচ্ছে। সেবাগ্রহীতারা বলছেন, অবিশ্বাস্য! ডিসি অফিস থেকে এমন সেবা পাওয়া যাবে কখনও ভাবিনি। ইসলামপুর উপজেলার দরিয়াবাজ গ্রামের মো: আ: করিম এবং মেলান্দহ উপজেলার আমবাড়ীয়া গ্রামের সুরুজ্জামান নকল সংগ্রহ করে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ফ্রন্ট ডেস্কে নকলের দরখাস্ত গ্রহণ এবং নকল সরবরাহ করার পদ্ধতি চালু হওয়ায় আমাদের অনেক সুবিধা হয়েছে। এখন দরখাস্ত জমা দেবার দিন কাগজে সরবরাহের তারিখ লিখে দেয়, আর সেই তারিখ অনুযায়ী আমরা নকল সংগ্রহ করি। এজন্য কোনো দালাল ধরতে হয় না। জাহাঙ্গীর আলম জানান, নতুন পদ্ধতিতে সময় ও সরকারি সম্পদও বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। আগে একদিনে হাতে লিখে নকল করা হতো ৬০/৭০টি মাত্র। এখন স্ক্যানিং করে নকল তৈরি করা হয় ২৫০/২৭০টি।
দারিদ্র্য বিমোচনেও তিনি আইসিটিকে কাজে লাগাচ্ছেন। নদী অঞ্চলে খাঁচায় মাছ চাষ করা বেশ লাভজনক। এ চিন্তা থেকে তিনি স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা ঢাকা আহছানিয়া মিশনের সহায়তা নিয়ে জামালপুর জেলার নদী ভাঙ্গনের ফলে নিঃস্ব মানুষদের জন্য ৫টি উপজেলায় খাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম শুরু করান। পুরো কার্যক্রমের ভিডিও চিত্র তৈরি করে তা ইউআইএসসির মাধ্যমে স্থানীয় মানুষকে জানাবার ব্যবস্থা করেছেন।
মো. বোরহান উদ্দীন, যিনি একজন ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্রের উদ্যোক্তা, ইউনিয়ন পরিষদের নাম ঢাকাদক্ষিণ, উপজেলা গোলাপগঞ্জ, জেলা সিলেট।
‘আমি উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ নিই ২০১০-এর জানুয়ারিতে ঢাকায়। মার্চে ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র (ইউআইএসসি) স্থাপন করি সিলেটের গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নে। স্থানীয় জনগণকে আমি ইউআইএসসি থেকে দু’ধরনের সেবা দিই। তাদের দৈনন্দিন জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় জীবিকাভিত্তিক তথ্য ও বিভিন্ন সরকারি সেবা এবং আইসিটি ব্যবহারের মাধ্যমে বাণিজ্যিক সেবা। আয় আসে প্রধানত বাণিজ্যিক সেবা- কমপিউটার-ইন্টারনেট প্রশিক্ষণ থেকে। বর্তমানে শুধু প্রশিক্ষণ থেকেই মাসে নিট আয় করছি গড়ে ২০ হাজার টাকা। প্রশিক্ষণের চাহিদা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ায় ইউআইএসসির একটি কক্ষ থেকে মানুষকে সেবা দেয়া কঠিন হয়ে ওঠে। এ অবস্থায় ইউপি চেয়ারম্যান এবং ইউএনও মিলে শুধু প্রশিক্ষণের জন্য পরিষদের আরও একটি কক্ষ বরাদ্দ করেন। এই রুমে সারাদিন বিভিন্ন ব্যাচে প্রশিক্ষণ চলে। ইউআইএসসিতে এখন ১২টি ডেস্কটপ কমপিউটার ও ১টি ল্যাপটপ রয়েছে। এর মধ্যে ২টি ডেস্কটপ ও ১টি ল্যাপটপ ব্যস্ত থাকে তথ্য ও সেবা দেবার কাজে, আর প্রশিক্ষণ রুমে ১০টি ডেস্কটপ রাখা হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ সরবরাহ করে ৫টি কমপিউটার, ল্যাপটপটি আসে এনআইএলজি থেকে এবং অবশিষ্টগুলো আমি নিজে কিনি।
আমি গর্ববোধ করি, আমার এসব অগ্রগতি দেখে যখন মুরুববীরা আমাকে গুরুত্ব দিয়ে কথা বলেন, স্ব-কর্মসংস্থানের ব্যাপারে আমাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন, তাদের সন্তানদের আমার কাছে পরামর্শ নিতে পাঠান এবং শিক্ষকরা উৎসাহমূলক কথা বলেন। আমার জন্য আরো সম্মানজনক বিষয় হলো- উদ্যোক্তা হবার কারণে উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও, এডিসি, ডিসি সবার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।
উপসংহার
এই এডিসি এবং উদ্যোক্তা দু’জনই এখন অন্যদের অনুপ্রেরণা। এখন একাধিক এডিসি, ডিসি, ইউএনও ব্লগে লেখেন, আমলাতন্ত্রের বাক্স থেকে বের হবার চেষ্টা করছেন, জনমুখী উদ্যোগ নিয়েছেন, এসবই ঘটছে এডিসি জামালপুরের অনুপ্রেরণায়। অনেক উদ্যোক্তা যারা আদৌ ইউআইএসসি শুরু করবেন কি-না তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলেন, পেশা হিসেবে উদ্যোক্তা হবেন কি-না, বিনিয়োগ করবেন কি-না, এসব সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না তারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন বোরহান উদ্দীনের মাধ্যমে।
কজ ওয়েব
ফিডব্যাক : manikswapna@yhaoo.com