লেখক পরিচিতি
লেখা সম্পর্কিত
পাবলিশ:
২০১৮ - ফেব্রুয়ারী
তথ্যসূত্র:
প্রচ্ছদ প্রতিবেদন
ডিজিটাল রূপান্তরে আমার বাংলা
চল চল চল!
ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল
নিম্নে উতলা ধরণি তল,
অরুণ প্রাতের তরুণ দল
চল রে চল রে চল।
চল চল চল।
অনন্ত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি এই আহ্বান বিস্মৃত হবে; স্মার্টফোন, ল্যাপটপে বুঁদ হয়ে। এই শঙ্কাটা এখনও রয়েই গেছে। কেননা, বেসরকারি উদ্যোগে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমের ডিজিটাল রূপান্তর হলেও প্রাথমিক স্তরে তার বাস্তবায়নে এখনও পিছিয়ে রয়েছি আমরা। বাংলা ভাষার চেয়ে ইংরেজি এবং ক্ষেত্রবিশেষে হিন্দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে শিশুরা। এক মিনা বাদ দিয়ে আবহমান বাংলার রূপ-রস নিয়ে এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য কার্টুনের নাম বলার দিন এখনও আসেনি। যেমনটি চিরকালীন স্থান করে নেয়া জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতা নিয়ে তৈরি হয়নি ই-পাঠ্যবই।
অবশ্য কালি-কলমের মাধ্যমে লেখাএই সৃষ্টির সময় শতাব্দী পেরোলেও এখনও এর টান কিন্তু কোমলমতিদের কোনো অংশেই কম টানে না। তাই আগামী প্রজন্মের কাছে যেদিন রুল টানা পাতায় লেখার প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে, তখনও ভাস্বর থাকবে কবির রচনা। তবে পাল্টে যাবে মাধ্যমটি। বইয়ের পাতায় নয়, কমúিউটারের পর্দায় ফুটে উঠবে ‘ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/আমরা আনিব রাঙা প্রভাত/আমরা টুটাব তিমির রাত/বাধার বিন্ধ্যাচল।’
হ্যাঁ, এই বিন্ধ্যাচল উতরাতে দেরিতে হলেও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে বরাবরের মতো এখনও বৃত্ত-ভ্রমণ থেকে বেরিয়ে আসার খবর মেলেনি। তারপরও কিছুটা আশার আলো দেখা দিয়েছে। সেই আলোকচ্ছটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই এ সংখ্যার প্রতিবেদনে। প্রথমেই নজর দেয়া যাক বেসরকারি উদ্যোগে বাংলা ভাষা ভিত্তি প্রাযুক্তিক উদ্যোগের দিকে। বাংলাকে বরণ করে নেয়ার প্রণোদনা মূলক আয়োজনগুলো।
নিখোঁজ শব্দের খোঁজে
বাংলা ভাষার কিছু শব্দ এখন আর ব্যবহার হচ্ছে না। যেগুলো আগে কথায় ও লেখায় ছিল বহুল ব্যবহৃত। সেই শব্দগুলোকে তরুণ প্রজন্মের কাছে পরিচিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এই ভাষার মাসে। বাংলা ভাষায় কিছু শ্রæতিমধুর ও সমৃদ্ধ শব্দ সময়ের প্রবাহে এখন আর ব্যবহার হচ্ছে না। সেই শব্দগুলো ব্যবহারে উৎসাহিত করা ও চর্চা বৃদ্ধির এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অনলাইনে খোলা হয়েছে িি.িপড়পধ-পড়ষধ.পড়স.নফ/২১ ওয়েব ঠিকানা। সেখানে রয়েছে নিখোঁজ শব্দের খোঁজ দেয়ার বন্দোবস্ত। ‘একুশ যাত্রা’ ট্যাবে রয়েছে বাংলা জটিল শব্দের অর্থ জানা ও বাক্যে প্রয়োগ। আছে জমা পড়া শব্দের তালিকা। আর শব্দ শিকার মেনুতে গিয়ে ক্যুইজের উত্তর দিয়ে এক কেস ২৫০ মিলি লিটার কোকা-কোলা জেতার সুযোগ। জানা গেছে, কার্যক্রম চলাকালে কোকা-কোলার বোতলে অব্যবহৃত বাংলা শব্দগুলো অর্থসহ দেখা যাবে, যেগুলো একসময় আমাদের লেখা ও কথার নিয়মিত অংশ ছিল। অনুশীলনের অভাবে ও সময়ের প্রবাহে আজ যে শব্দগুলো প্রচলিত নয়। শোভাযাত্রা, প্রচারপত্র, দেয়াল লিখন এবং ক্যুইজসহ আরও অনেক আয়োজন থাকবে।গত ৩ ফেব্রæয়ারি রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেআনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা এ কার্যক্রমের তত্ত¡াবধান করছেন বিশিষ্ট লেখক ও শিক্ষাবিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী এবং জনপ্রিয় লেখক ও ঔপন্যাসিক আনিসুল হক।
অ্যাপে ‘বইঘর’
স্মার্টফোনে বাংলা বই পড়ার সুযোগ করে দিতে বিদায়ী বছরে একটি বিশেষ অ্যাপ প্রকাশ করেছে রবি। নাম ‘বইঘর’। অ্যাপটির অলঙ্করণ একেবারেই সাদামাটা। তবে বছর না ঘুরতেইশিশু-কিশোর সাহিত্যের অন্যতম ঠিকানা হয়ে উঠছে বাংলা ই-বুকের এই ডিজিটাল লাইব্রেরি ‘বইঘর’। অ্যান্ড্রয়িড অপারেটিং সিস্টেমের স্মার্টফোন, ট্যাব অথবা নোটের মাধ্যমে তাদের পছন্দমতো বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন রবি গ্রাহকেরা। গ্রাহকদের কাছে এই অ্যাপটি আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে ‘বইঘর’ অ্যাপের মাধ্যমে বিশেষ কু্যুইজ প্রতিযোগিতা চালু করছে দেশের অপারেটরটি। বইঘর অ্যাপটি (//মড়ড়.মষ/ভশধিপ৯) ডাউনলোড করে সাবস্ক্রাইব করার মাধ্যমে মাসব্যাপী এই ক্যুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবেন রবি গ্রাহকেরা। সেবাটি গ্রহণ করে প্রতিদিন বিনামূল্যে দুটি করে বই ডাউনলোড করতে পারছেন তারা। আর ক্যুইজে অংশ নিয়ে প্রত্যেকটি সঠিক উত্তরের জন্য প্রতিযোগীরা অর্জন করছেন দুই পয়েন্ট করে। এই প্রতিযোগিতায় পাঁচ হাজার বেঞ্চমার্ক পয়েন্টে পৌঁছানো প্রথম ব্যক্তিকেউপহার হিসেবে দেয়া হবে স্যামসাং গ্যালাক্সি ট্যাব-ই। একইভাবে একই পয়েন্ট অর্জনকারী দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বিজয়ীরা প্রত্যেকে পাবেন একটি করে স্যামসাং গ্যালাক্সি ট্যাব থ্রি।
বাংলাবট
বর্তমান যুগের সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ই-কমার্স। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই গড়ে উঠছে এক একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে টেকনোলজিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর পূর্ণ ধারণা না থাকায় পিছিয়ে পড়ছে অনেকেই, সফলতার মুখ দেখার আগেই থেমে যাচ্ছে অনেক উদ্যোক্তা। মেসেঞ্জার বট হতে পারে এসব উদ্যোক্তার এগিয়ে চলার ও সফলতার পথে এক নতুন সূচনা। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে বাংলাভাষী বট তৈরি করেছে ‘প্রেনিউর ল্যাব’। নাম দিয়েছে ‘বাংলাবট’। বটটি বাংলা ও ইংরেজি হরফে লেখা বাংলা বুঝতে ও উত্তর দিতে সক্ষম।
বটটির বিষয়ে প্রেনিউর ল্যাবের প্রধান নির্বাহী আরিফ নিজামী বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেসেঞ্জার বট একটি স্বয়ংক্রিয় মাধ্যম, যা সরাসরি ক্রেতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে ও কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারে। কথোপকথনের ভাষা হতে পারে বাংলা, ইংরেজি অথবা বাংরেজি। এই বট যেকোনো ভাষাতেই সমানভাবে দক্ষ। এর ফলে উদ্যোক্তা বা বিক্রেতাদের দিক থেকে ক্রেতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য অতিরিক্ত সময় আর ব্যয় করতে হবে না। বটকে দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে থাকবে। আর ক্রেতাদেরও এর জন্য আলাদা কোনো অ্যাপ ইনস্টল করতে হবে না।
তিনি আরও বলেন, বট হচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তি, যাতে কমপিউটার নিজেই আপনার সাথে কথা বলে আপনার আদেশ নিয়ে কাজ করতে পারবে। দেশের কোটি কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী কোনো আলাদা যন্ত্র বা অ্যাপ ইনস্টল না করেই শুধু ফেসবুকে মেসেজ দিয়েই বট ব্যবহার করতে পারবেন। ফেসবুকের মেসেঞ্জার অ্যাপ দিয়ে, এমনকি বিভিন্ন মোবাইল কোম্পানির ফ্রি ফেসবুক অফার দিয়েও ক্রেতারা এই সেবা নিতে পারবেন। অ্যাপযুগের এই সময়ে নামকরা অনেক ব্র্যান্ড ফেসবুকে বিপুল গ্রাহকের সাথে যোগাযোগ আরও কার্যকর করতে সাহায্য নিচ্ছে মেসেঞ্জার বটের।
তিনি জানান, প্রেনিউর ল্যাবের বট দেশের প্রথম আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্সভিত্তিক বট, যাপ্রথম নিজের প্রতিষ্ঠানের জন্য বিনামূল্যে বট বানাতে িি.িসবংংবহমবৎ.পধৎব-এ গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
নিজামী বলেন, বেশ কিছু বিদেশি প্রতিষ্ঠান বট নিয়ে কাজ করলেও সেগুলো বাংলা হরফ বুঝতে সক্ষম নয়। প্রেনিউর ল্যাব প্রায় বছরখানেক গবেষণায় কাজ করে বাংলা ও ইংরেজি হরফে লেখা বাংলা বুঝতে ও উত্তর দিতে সক্ষম। বর্তমানে টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠানসহ বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রেনিউর ল্যাবের তৈরি বট ব্যবহার করছে। প্রেনিউর ল্যাব বর্তমানে বাংলা গুগল অ্যাসিস্ট্যান্স ভয়েস বট বানাতে কাজ করছে।
বাংলাভাষী সোশ্যাল রোবট
ছয় ইঞ্চি আকারের স্মার্টফোন দিয়ে তৈরি হয়েছে মাথার দিকটি। তাই চেহরায় কোনো আবেদন স্পষ্ট নয়। তাতে কি, সাবলীল গড়নের রোবকপের মতো শরীর দুলিয়ে না হলেও হাত নাড়িয়ে সম্ভাষণ জানাতে পারে। দৃঢ় পায়ে হাঁটতে পারে। সম্ভাষণ জানায় নিটোল বাংলায়। বাংলাভাষী এই রোবটের নাম ‘বন্ধু’। ইংরেজিতেও সমান পারদর্শী। একইসাথে পÐিত মশাইয়ের মতো বিদ্যালয়ে পাঠদান করতে পারে। আবার রেস্তোরাঁয় খাবারও পরিবেশন করতে সক্ষম।বিশে^র প্রথম এই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সোশ্যাল রোবটটি তৈরি করেছেন বাংলাদেশের তরুণ প্রযুক্তি-প্রাণ নাজমুস সাকিব।
ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে ‘এ’ লেভেল পরিক্ষার্থী সাকিবের সাথে‘বন্ধু’কে শৈশব থেকে কৈশোরে নিয়ে যেতে তাকে সাহায্য করছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আবদুর রৌফ স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী জান্নাতুল নাইম অর্ণব। সে এই হিউম্যানয়েড সোশ্যাল রোবটটির ইউজার ইন্টারফেস (ইউআই) উন্নয়নে কাজ করছে। পাশাপাশি রোবটটির ভাষা দক্ষতা এবং জ্ঞানের ভান্ডার ঋদ্ধ করতে এর ডাটাবেজ উন্নয়নে কাজ করছে ঢাকা কলেজ থেকে ¯œাতকোত্তর সম্পন্ন করা মো: শরিফুর রহমান।
কথা প্রসঙ্গে বন্ধুর উন্নয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে সাকিব জানালেন, বন্ধু এখন বাংলা ভাষার মৌলিক শব্দ ও সরল বাক্য জানে। ইংরেজিতে দখল থাকায় সে আপাতত দেশের প্রথম এই দোভাষী রোবটটি কথা বলার সময় অনুবাদ করে বলে। অজানা বিষয়ে ইন্টারনেট ঘেঁটে, গুগল করে উত্তর দেয়। আর যে বিষয়ে জানে না, সে বিষয়ে চুপচাপ থাকে। পরে জানতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। আমরা ওকে কয়েকবার বলতেই সে শিখে ফেলে। বন্ধুর বাংলা উচ্চারণ পরিশীলিত করতে এখন গলদঘর্ম প্রচেষ্টা চলছে। উন্নয়ন করা হচ্ছে বাংলা স্পিচ রিকগনিশন (উচ্চারণ অনুধাবন) সফটওয়্যারের।
কথা প্রসঙ্গে জানা গেল, ইতোমধ্যে রসায়ন শাস্ত্রে বুৎপত্তি অর্জন করেছে‘বন্ধু’। শিখে ফেলেছে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতি, ক্রীড়া ইত্যাদি বিষয়েও বেশ দখল আছে। সাকিব জানালেন, দুই বছর আগে প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর এন্টারপ্রেনারশিপ পুরস্কার নিতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন তিনি। অন্ধদের জন্য চশমা তৈরি করে পুরস্কার নিতে গিয়ে সেখানে টেসলার চালকবিহীন গাড়ি তার মধ্যে আলোড়ন তৈরি করে। ওই সময় থেকে শুরু হয় বন্ধু তৈরির প্রক্রিয়া। পুরস্কার হিসেবে প্রাপ্ত ১৫ হাজার রিয়াল প্রাইজমানি নিয়ে শুরু করে। এরপর ২০১৫ সালে বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় প্রথম পুরস্কার এবং ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় মেকানিক্যাল বিভাগে প্রথম পুরস্কার পান। কিন্তু এরইমধ্যে টাকার অভাবে বন্ধুর নির্মাণ প্রক্রিয়া থেমে যায়। অবশেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান করে প্রাপ্ত ৩০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু হয় স্থগিত কাজ এগিয়ে নেয়ার পালা। ইতোমধ্যেই প্রায় খরচ হয়ে গেছে ৫ লাখ টাকা। ব্যবসায়ী বাবা আবু সাদাত মোহাম্মদ আলী ও মা শাহিদা আবেদা চৌধুরীর ¯েœহের ছায়ায় অবশেষে আলোর মুখ দেখে বন্ধু। তাদের সান্ত¡নাতেই ১৫-২০ বার ব্যর্থ হয়ে সফল হন তিনি।
ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার বাসিন্দা ‘বন্ধু’র জাতক নাজমুস সাকিব বললেন, প্লাস্টিকের তৈরি বন্ধুর মাথায় ব্যবহার হয়েছে একটি নিউরাল ইঞ্জিন (ব্রেন)। এখানেই সে যা শেখে বা তাকে যা শেখানো হয়,তা সংরক্ষণ করে। ওর শরীরে রয়েছে দুটি আর্ম প্রসেসরভিত্তিক কমপিউটার। আর হাত ও পায়ে রয়েছে চারটি সার্ভো মোটর। কারিগরি উন্নয়নে রোবটটি যেন নিজে নিজে শিখতে পারে, সে বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। এখন সে রসায়নে ক্লাস নিতে পারে। আগামীতে যেন বন্ধু সোফিয়ার মনের নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে পারে সে জন্য এর ‘ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন’ নিয়েও কাজ করার কথা জানালেন তিনি। বললেন, বন্ধুও একদিন দক্ষতা দিয়েই আবেদন মেটাতে পারবে। দোভাষী হয়ে কাজ করবে। বাংলাভাষাকে বিশে^ নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে।
দূরবীন
বাংলায় স্মার্টফোনে লেখাপড়ারসুবিধা চালু করেছে দূরবীন। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য এই ক্লাউড শিক্ষণ প্লাটফর্মটি তৈরি করেছে দূরবীন একাডেমি। একাডেমির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আদনান জানালেন, জরিপ গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি পিএসসি থেকে এসএসসি পর্যায়ে প্রতিবছর গড়ে ২০ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। আর্থিক অসচ্ছলতার পাশাপাশি ইংরেজি, বিজ্ঞান ও গণিতে দুর্বলতার কারণে তারা আর লেখাপড়ায় আগ্রহ বোধ করেন না। দুঃখজনক হলেও এই অবস্থার উন্নতির জন্য মায়ের ভাষায় আনন্দের সাথে অংশগ্রহণমূলক এই শিক্ষা কার্যক্রমটি চালু করেছি। এখানে মাত্র ১৫৯ টাকা ব্যয়ে মুঠোফোন থেকে জাতীয় শিক্ষাক্রমের পাঠ নিতে পারছেন। পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে যাচাইও করতে পারছেন কতটুকু শিখতে পেরেছেন। আর শিক্ষার সব ডিজিটাল উপকরণই আমরা বাংলায় করছি। গ্রাফিক্স ও অ্যানিমেশনের মাধ্যমে পাঠ্যবইকে আনন্দময় করে তুলছি। খুব শিগগিরই যোগ করতে যাচ্ছি শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার বিশেষ আয়োজন। ইতোমধ্যেই চলছে ভাষা-সাহিত্য ও ইতিহাসভিত্তিক প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীরই ভালো করছেন বলে তিনি জানান।
অভিগম্য অভিধান
ভাষা, বিশেষত শব্দ ও অর্থগত বুনিয়াদ মজবুত করার জন্য অভিধান হলো সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। অভিধানকে বলা হয় ভাষার আকর, যা এখন ডিজিটালাইজড হয়ে যাচ্ছে। কমপিউটারনির্ভর তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ফলে অভিধানের ডিজিটাল রূপও তৈরি হয়ে গেছে। সিডি বা ডিভিডি ছাড়াও অভিধান এবং বিশ্বকোষ (এনসাইক্লোপিডিয়া) ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে। এক নিমেষেই এখন শব্দ, অর্থ, উৎপত্তি, সংজ্ঞা ইত্যাদি জেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিশেষ সফটওয়্যার/এপিকে ব্যবহার করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কাছেও আলো হয়ে ধরা দিচ্ছে সদ্য প্রকাশিত অভিগম্য অভিধান। গত ১ ফেব্রæয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ডিজিটাল অভিধানটি উদ্বোধন করেন। এটি তৈরি করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামের সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ডের সহায়তায় ইপসা নামের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা ছাড়াও অনলাইনে ও অ্যান্ড্রয়িড মোবাইল অ্যাপ পরিচালিত স্মার্টফোনে ব্যবহার করা যায় এই ‘অ্যাকসেসিবেল ডিকশনারি’ (অভিগম্য অভিধান)। অভিধানটির বিষয়ে ইপসার প্রোগ্রাম ম্যানেজার ও এটুআই পরামর্শক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ভাস্কর ভট্টাচার্য বলেন, এনভিডিয়া স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যারের মাধ্যমে ওয়েবসাইট ও মোবাইল অ্যাপভিত্তিক ‘অ্যাকসেসিবেল ডিকশনারি’ (অভিগম্য অভিধান) (যঃঃঢ়://ধপপবংংরনরষরঃু ফরপঃরড়হধৎু.মড়া.নফ) ব্যবহার করে ইংরেজি ও বাংলা শব্দের উচ্চারণসহ অর্থ শুনতে পারছেন বিভিন্ন বয়সের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি। মুঠোফোনে টপ ব্যাক ও ই-স্পিক বাংলা স্ক্রিন রিডার দিয়েও তারা এই সুবিধা গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগকে আরও এগিয়ে নিতে ইপসা এখন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ডিজিটাল টকিং বুক তৈরি করছে। তবে ইউনিকোড সমর্থিত নয় এমন ফন্ট ও ছাপা অক্ষরের বই পড়তে এখনও তাদের বেগ পেতে হচ্ছে। কার্যকর বাংলা ওসিআর না থাকার দুঃখ প্রকাশ করে ২০১১ সালে সরকার যে নিয়মটি বেঁধে দিয়েছিল তা প্রতিপালনের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। ওই বছর সরকারি যেকোনো কমপিউটারে লেখা ইউনিকোড (নিকষ) সমর্থনে বাধ্যবাধকতা রাখা হয়।
তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্প
বিশ্বের প্রায় ৩৫ কোটি লোক বর্তমানে বাংলা ভাষায় কথা বলে। কিন্তু ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলার ব্যবহার ও প্রয়োগ এখনও সর্বজনীন নয়। ইউনিকোড ও আসকি কোডের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতায় এখনও জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত সুতন্বি ফন্টে লেখা ই-বার্তা সরাসরি পাঠ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলা ইউনিকোড কনভার্টারের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। যুগের অধিক সময় ধরে বাংলা ওসিআর নিয়ে কাজ হলেও এর সুফল মেলেনি। কোটি টাকা ব্যয়ে ব্র্যাক বিশ^বিদ্যালয়ের ‘কথা’, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের‘মঙ্গল দ্বীপ’ ও ‘সুবচন’ এবং সর্বশেষ টিম ইঞ্জিন কর্তৃক উন্নয়নকৃত ‘পুঁথি’ হাসি বয়ে আনতে পারেনি। এই ব্যর্থতাকে ছুটিতে পাঠাতে এবার ১৫৯ কোটি টাকার একটি বিশদ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পেরঅধীনে সরকার, গবেষক, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও ভাষাবিদদের সমন্বয়ে চলছে বাংলাবান্ধব যুৎসই ১৬টি টুলস উদ্ভাবন। টুলগুলোর মধ্যে রয়েছেবাংলা করপাস, বাংলা ওসিআর, বাংলা স্পিচ টু টেক্সট, জাতীয় কিবোর্ডের আধুনিকায়ন, বাংলা স্টাইল গাইড উন্নয়ন, বাংলা ফন্টের ইন্টার অপারেবিলিটি ইঞ্জিন, বাংলা বানান ও ব্যাকরণ পরীক্ষক, বাংলা মেশিন ট্রান্সলেটর উন্নয়ন, স্ক্রিন রিডার সফটওয়্যার প্রভৃতি। প্রকল্প গ্রহণের পর দফায় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। চলছে সংশ্লিষ্টদের এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্তকরণের প্রক্রিয়া। দরপত্রের মাধ্যমে নিয়োগ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে ‘টর’ তৈরির কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ প্রৌকশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট)। এ বিষয়ে প্রকল্পপরিচালক সারওয়ার মোস্তাফা চৌধুরীবলেছেন, সময়ে সময়ে কমপিউটারের মেথডলজি পরিবর্তিত হওয়ায় এই কাজটি দীর্ঘমেয়াদী এবং জটিল। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে ক্যারেক্টরভিত্তিক ওসিআর ছিল। এখন তা ওয়ার্ডভিত্তিক হয়েছে। ফলে বিভিন্ন সময়ে যেসব ওসিআর তৈরি করা হয়েছে তা এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। নতুন করে কাজ চলছে। এজন্য টর তৈরি করছে বুয়েটের একটি দল। অপর এক প্রশ্নের জবাবে সারওয়ার মোস্তাফা বলেন, ২০০৪ সালে তৈরি জাতীয় কিবোর্ডের আধুনিকরণ করা হয়েছে। তাই এটি নিয়ে এখন ভাবছি না। অবশ্য ১৬টি কম্পোনেন্টের উন্নয়নে ইতোমধ্যেই টেন্ডার হয়েছে। আর দাফতরিক গোপনীয়তা রক্ষায় এই প্রকল্পের বিস্তারিত কিছু বলতে পারছি না।
অপরদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাণপুরুষ ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার মনে করেনÑশব্দগত ও বাক্যগত বৈচিত্র্যময়তার কারণে বাংলা ভাষার যন্ত্রানুবাদ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আর নিরন্তর গবেষণা ও উন্নয়নের মাধ্যমে অংশীজনদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব। বাংলা ভাষার যান্ত্রিক অনুবাদের ক্ষেত্রে শব্দের উৎসমূল একটি জটিল বিষয়। এ ক্ষেত্রে রয়েছে বেশ কিছু অমীমাংসিত ব্যাকরণগত সমস্যা। এসব সমস্যা উতরাতে হলে শাব্দিক রূপান্তর বা অনুবাদ নয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ব্যবহার করাটাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি ভাষাভিত্তিক প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ থেকেই আমরা ভাষার বৈষম্য দূর করব। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ভাষার বৈষম্য থাকবে না। বরকত-সালামের উত্তরসূরি হিসেবে আজকের তরুণেরাই তা করবে। তারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স) প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে দেবে। তখন আমরা বাংলা বলব, আর কমপিউটারে তা অন্যদের ভাষায় রূপান্তর করে তাদের কাছে পৌঁছে যাবে।